দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে তবে....
"অমৃত কুম্ভের সন্ধানে" উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে সমরেশ বসু (কালকূট) লিখেছিলেন, "অনেক আশা নিয়ে যারা গিয়েছিল,আর কোন আশা নিয়ে কোনদিন ফিরে আসবে না তাদের জন্য"। কুম্ভ মেলায় পদপিষ্ট হয়ে মানুষের মৃত্যুর মিছিলের সারি দেখে সমরেশ বসুর লেখা লাইনগুলো আবার মনে এল। তবে কুম্ভমেলার ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৫৪ সালে। স্বাধীনতার পর সেটিই ছিল ভারতের প্রথম কুম্ভ। ১৯৫৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, মৌনী অমাবস্যায় এলাহাবাদের (বর্তমানে প্রয়াগরাজ) কুম্ভমেলায় অমৃত স্নানের জন্য ভিড় জমিয়েছিলেন অসংখ্য পুণ্যার্থী। সেই ভিড়ের কারণে পদপিষ্ট হয়ে এবং নদীতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছিলেন কমপক্ষে ৮০০ জন। এরপর ১৯৮৬ সালে হরিদ্বারের কুম্ভমেলাতেও ঘটেছিল পদপিষ্টের ঘটনা। সেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল অন্তত ২০০ জনের। উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর সিং সহ বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং সাংসদরা হরিদ্বারে পৌঁছানোর পরই চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। কারণ নিরাপত্তার জন্য নদীর তীরে সাধারণ মানুষের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। যার জেরে জনতা অস্থির হয়ে পড়ে। ভিড় নিয়ন্ত্রণে না আসায় ঘটে যায় দুর্ঘটনা। সেই ভিআইপি কালচারের ট্র্যাডিশন যে আজও চলেছে কোনও সন্দেহ নেই। আমরা ইতিহাস থেকে কোনও শিক্ষাই নিতে পারি নি। ২০০৩ সালেও মহারাষ্ট্রের নাসিক- এ কুম্ভমেলা চলাকালীন গোদাবরী নদীতে অমৃত স্নানের জন্য হাজার হাজার পুণ্যার্থী জড়ো হন। ভিড়ের কারণে পদপিষ্টের ঘটনায় সেবার মহিলা সহ কমপক্ষে ৩৯ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন ১০০ জনেরও বেশি।সেই ঘটনার পর ২০১৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কুম্ভমেলা চলাকালীন এলাহাবাদ রেলস্টেশনে একটি ফুট ব্রিজ ভেঙে পড়ে। আতঙ্কের জেরে হুড়োহুড়ি শুরু হওয়ায় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ৪২ জনের। আহত হয়েছিল ৪৫ জন। এ বছর ১৩ জানুয়ারি থেকে প্রয়াগরাজে শুরু হয়েছে মহাকুম্ভমেলা। দেশ-বিদেশের বহু মানুষ ভিড় জমিয়েছেন মহাকুম্ভে। মৌনী অমাবস্যা উপলক্ষ্যে গভীর রাতে গঙ্গা, যমুনা, এবং সরস্বতী- তিন নদীর সঙ্গমস্থল বা ত্রিবেণী সঙ্গমে অমৃত স্নান করতে জড়ো হয়েছিলেন পুণ্যার্থীরা। সেই সময়ই ঘটে যায় মর্মান্তিক পদপিষ্টের ঘটনা। ভিড়ের চাপে ব্যারিকেড ভেঙে পড়ায় পদপিষ্ট হয়ে সরকারি মতে তিরিশ জনের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে এই মৃত্যু অন্যবারের ঘটে যাওয়া মৃত্যুর সঙ্গে আলাদা। কারণ এই প্রথম ঘটনার অনতিবিলম্বে সামাজিক মাধ্যম ছেয়ে যায় বিভিন্ন পোস্টে যেখানে দাবী করা হয় যে একটা "সামান্য দুর্ঘটনা" নিয়ে দেশের গর্ব এই কুম্ভমেলাকে পৃথিবীর কাছে ছোট করার এক অপচেষ্টা চলছে। অর্থাৎ কিছু সাধারণ মানুষের মৃত্যু, হিন্দু গৌরবের সামনে তুচ্ছ। এই ভাবনা প্রথম জানলাম আমরা,যদিও অন্যরকম তো হওয়ার ছিল না।
দুর্ঘটনার আশঙ্কা ছিলই
দুর্ঘটনার আশঙ্কা ছিল গোড়া থেকেই। কিন্তু গত কয়েক মাসে বারে বারেই তা উড়িয়ে দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এবং তাঁর সরকারের মন্ত্রী আধিকারিকেরা। পদপিষ্টের সম্ভাবনা এড়িয়ে কোটি কোটি পুণ্যার্থীর নিশ্ছিদ্র সুরক্ষার আয়োজনের দাবি করেছেন তাঁরা। যাকে অভিহিত করেছেন এক নতুন শব্দবন্ধে—‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস ক্রাউড ম্যানেজমেন্ট’। কিন্তু প্রয়াগরাজে মৌনী অমাবস্যার শাহি স্নানের গোড়াতেই সামনে চলে এল ভিড় সামলানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যর্থতার ছবি। যার তুলনা টানতে অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে সেই পুরনো প্রবাদ— বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, মঙ্গলবার রাত আড়াইটে নাগাদ একসঙ্গে প্রচুর মানুষ সঙ্গমের তীরে এসে পৌঁছেছিলেন। অনেকেই মাথায় ভারী মালপত্র নিয়ে এসেছিলেন স্নান করতে। নদীর তীরে লোহার বেশ কিছু ডাস্টবিন রাখা ছিল, যা ভিড়ের মধ্যে অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। তাতেই ধাক্কা খেয়ে বহু পুণ্যার্থী মাটিতে পড়ে যান। মাথায় থাকা মালপত্রও ছিটকে পড়ে। মালপত্র এবং মাটিতে পড়ে যাওয়া পুণ্যার্থীদের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আরও অনেকে পড়ে যান। তাঁদের মাড়িয়েই এগোতে থাকেন অন্যেরা। ভিড়ের চাপে ভেঙে পড়ে অনেকগুলি ব্যারিকেড। চেষ্টা করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় আধাসেনা। তাহলে এতদিন ধরে কিসের প্রস্তুতি নেওয়া হল? এমন প্রস্তুতি যা কিনা আসল সময়ে কাজে আসে না?
"ওয়ার্ল্ড ক্লাস ক্রাউড ম্যানেজমেন্ট" ঠিক কী বস্তু
কথা ছিল ড্রোন থাকবে,থাকবে হেলিকপ্টারে আকাশপথে ভিড়ের দিকে নজর রাখার ব্যবস্থা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নাকি সাহায্য নেওয়া হবে ভিড় নিয়ন্ত্রণে। এ সবই ওই ওয়ার্ল্ড ক্লাস ক্রাউড ম্যানেজমেন্টের অংশ।দেদার খরচ হয়েছে এসবে, প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে সবই ফাঁকা। ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে ত্রিবেণী সঙ্গম থেকে এক কিলোমিটার দূরে বাঁশের ব্যারিকেড তৈরি করেছিল প্রশাসন।বাঁশের ব্যারিকেড তৈরিতেই কি হাজার কোটি? জানা নেই। বিশৃঙ্খলা এড়াতে এলাকা ভাগ করে করে পুলিশি গার্ড রেল দিয়ে ঘেরা হয়েছিল। সাধারণ বুদ্ধি বলে ওই ভিড়ে ভারী গার্ড রেলের ব্যবহার করা মানে দুর্ঘটনা ডেকে আনা। হয়েছেও তাই, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বাড়তে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের দাবি, রাত ১২টা পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু তার পর থেকে ভিড়ের ছবিটা ক্রমে বদলাতে শুরু করে এবং রাত ২ টোয় পরিস্থিতি পুরো বদলে যায়। পুণ্যার্থীরা দলে দলে এগোতে শুরু করেন সঙ্গমের দিকে।পুলিশ চেষ্টা করেছিল, পুণ্যার্থীরা আসুক, স্নান সেরে আবার ফিরে যাক। কিন্তু স্নানের পরেও বহু পুণ্যার্থী সঙ্গমস্থলের আশপাশেই ছিলেন। মানুষ তো আর যন্ত্র নয় যে স্নান সেরেই তক্ষুনি জল ছেড়ে উঠে পড়বে। তার দুদিন আগেই জলে নেমে যোগী, অমিত শাহ কিংবা অনিল আম্বানির জলকেলি তাঁরা নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন। ফলে অত মানুষ একসঙ্গে জল ছেড়ে উঠে পড়বেন, এমন ধারণার ভিত্তিতে কি করে পুলিশ প্রশাসন এত বড় ভিড় নিয়ন্ত্রণের নীল নকশা তৈরি করল, সেটাই আশ্চর্যের। শোনা যাচ্ছে অনেকে আবার প্লাস্টিক পেতে মাটিতে শুয়েও পড়েছিলেন। সঙ্কটের মুহূর্তে যা মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনে।এছাড়া ছিল লোহার ডাস্টবিন, যা চোখে পড়েনি মানুষের, বহু মানুষ হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। এত ভিড়ে লোহার ডাস্টবিন রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত ? প্রশাসনিক ফাঁকফোকরের বার্তা ছিল গত ১৯ জানুয়ারি, যখন কুম্ভমেলায় আগুন ছড়িয়েছিল, তখন থেকেই। ১৯ নম্বর সেক্টরে গীতা প্রেসের তাঁবু জ্বলে উঠেছিল দাউদাউ করে। সেখান থেকে আশপাশের কিছু তাঁবুতেও আগুন ছড়ায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়ছিল ৫০টিরও বেশি তাঁবু। তাঁবুগুলির ভিতর থেকে পর পর সিলিন্ডার ফাটার শব্দও পাওয়া গিয়েছিল। মহাকুম্ভ উপলক্ষে প্রয়াগরাজে তখনও কয়েক কোটি পুণ্যার্থীর ভিড় ছিল বলে উত্তরপ্রদেশ সরকারের দাবি। বিস্তীর্ণ মেলাপ্রাঙ্গণকে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে নজরদারি চালানো হচ্ছে বলে পুলিশ-প্রশাসন জানিয়েছিল। জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করে রাখা হয়েছিল বলে দাবি। পুলিশের পাশাপাশি সর্বক্ষণ মোতায়েন ছিলেন দমকলকর্মীরা। অগ্নিকাণ্ডের পর পদপিষ্টের ঘটনা— কুম্ভমেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।অথচ কথা ছিল যে অদাহ্য উপাদানের তাঁবু নাকি মেলা জুড়ে থাকবে,সে সব তবে শুধুই কথার কথা। এই লেখা যখন লিখছি খবর পাওয়া গেল যে ২২ নম্বর সেক্টরে আগুন লেগে বেশ কিছু তাঁবু পুড়ে গেছে।অর্থাৎ দুর্ঘটনা এখন কুম্ভে ঘটমান বর্তমান।
সমন্বয়ের অভাব ও ভিআইপি কালচার
কুম্ভ দুর্ঘটনায় প্রকট প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। খবরে প্রকাশ প্রয়াগরাজ ডিভিশনাল কমিশনারের দফতরের এক কর্তা নাকি মঙ্গলবার গভীর রাত থেকেই মাইক নিয়ে দ্রুত পুণ্যস্নান করার আবেদন জানাচ্ছিলেন ভক্তদের কাছে। সরকারি হিসাব বলছে, সে সময় কুম্ভমেলা প্রাঙ্গণে হাজির ছিলেন আট কোটিরও বেশি ভক্ত। প্রশাসনের আবেদনে সাড়া দিয়ে তাঁদের বড় অংশ একসঙ্গে গঙ্গা, যমুনা এবং অন্তঃসলিলা সরস্বতী নদীর সঙ্গমের দিকে এগিয়ে যান। আর তাতেই ঘটে বিপত্তি।দ্রুত স্নান সারার নির্দেশ দেওয়ার কারণ কি উপস্থিত বিভিন্ন ভিআইপিদের বেশ খানিকটা ফাঁকায় স্নান করার সুবিধে করে দেওয়ার প্রয়াস? মোট উনিশটি ঘাটের মধ্যে মাত্র ছয়টি ঘাট চালু ছিল সাধারণের জন্য, যা ওই বিপুল সংখ্যক ভক্তের জন্য নেহাতই অপ্রতুল বললেও খুব কম বলা হবে। বাকি ঘাট গুলিতে কারা স্নান করছিলেন,এটা জানার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করার কোনও কারণ আছে কি? সবাই দেখছেন যে যোগী প্রশাসনের ছোট, বড়, মেজ থেকে বিজেপির সর্বভারতীয় স্তরের নেতা নেত্রীরা দলে দলে ভিড় জমিয়েছেন শাহি স্নানে। স্নান করার অধিকার তাঁদের নিশ্চয়ই আছে, তবে সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে নয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, মঙ্গলবার রাত আড়াইটে নাগাদ একসঙ্গে প্রচুর মানুষ সঙ্গমের তীরে এসে পৌঁছেছিলেন।মালপত্র এবং মাটিতে পড়ে যাওয়া পুণ্যার্থীদের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আরও অনেকে পড়ে যান। তাঁদের মাড়িয়েই এগোতে থাকেন অন্যেরা। সে সময় ভিড়ের চাপে ভেঙে পড়ে অনেক ব্যারিকেড। ফলে কোনও অবস্থাতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। মঙ্গলবার রাত ১টা থেকে ৩টের মধ্যে পুরো ঘটনাটি ঘটে। প্রশাসনিক সমন্বয়ের যে চূড়ান্ত গাফিলতি যাকে প্রায় অমার্জনীয় বলা চলে সেটা হল এই যে পুণ্যার্থীরা যেখানে পদপিষ্ট হন তারই লাগোয়া এলাকায় আখাড়া মার্গে রয়েছে সাধুদের তাঁবুর জন্য চার হাজার হেক্টর জমি। এটি প্রয়াগ সঙ্গমে যাওয়ার পথেই পড়ে। গভীর রাতে আখাড়ার সাধুদেরই একাংশ তখন স্নান করছিলেন।প্রশাসনিক স্তরে কারুর কি মনে হল না, ভিড়কে ঠেলে দিতে ওই তাঁবুর দিকে। তাহলে হয়ত অনেক প্রাণ বেঁচে যেত। প্রশ্ন উঠছে কেউ কি আদৌ ছিলেন ওই ভিড়ের দ্বায়িত্বে নাকি সবই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল কতিপয় পুলিশ ও ভলেন্টিয়ারের উপর। মঙ্গলবার সন্ধে ৭টা ৩৫ মিনিট থেকে বুধবার সন্ধে ৬টা ৫ মিনিট পর্যন্ত ছিল মৌনী অমাবস্যায় শাহি স্নান সময়। নিয়ম মেনে আখাড়ার সাধুরাই প্রথমে গিয়েছিলেন সঙ্গমস্নানে।সাধারণ পুণ্যার্থীদের জন্য সঙ্গমে নামার মূল রাস্তা বন্ধ থাকায় বিপুল জমায়েতের প্রচণ্ড চাপে দমবন্ধ হয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকেন অনেকে। একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে, টেনে ধরে, গায়ের উপর দিয়ে এগোতে চেষ্টা করেন। অনেকে ব্যারিকেড টপকে যেতে থাকেন। প্রবল ধাক্কাধাক্কির মধ্যেই পিছন থেকে আরও চাপ বাড়তে থাকে এবং পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়।
যোগীর ব্র্যান্ড কুম্ভ
এ বারের মহাকুম্ভের যাবতীয় কৃতিত্ব গোড়া থেকেই একক ভাবে নিতে চেয়েছেন উত্তর প্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। লক্ষ্য, সফল ভাবে কুম্ভের আয়োজন করে হিন্দু সমাজের প্রধান মুখ হয়ে ওঠা, যাতে ২০২৯ সালে দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার দৌড়ে শীর্ষ সারিতে থাকতে পারেন তিনি।সেই কারণে গোড়া থেকেই কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে কুম্ভের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেননি যোগী। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে শেষে মাঠে নামতে হয় খোদ অমিত শাহকে। কুম্ভ আয়োজনে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাফল্যের তত্ত্ব নস্যাৎ করতে চেয়েছেন পরের লোকসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার দৌড়ে যোগীর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী অমিত শাহ। গুজরাটের আমেদাবাদে হিন্দু আধ্যাত্মিক ও সেবা মেলার উদ্বোধনে গিয়ে কুম্ভমেলা প্রসঙ্গে শাহ বলেন যে, বাধাহীন ভাবে হাজার বছর ধরে কুম্ভমেলা হয়ে চলেছে। মহাকুম্ভের আয়োজন কখনওই সরকারের উপরে নির্ভরশীল নয়। এখানে অসংখ্য ধর্মীয় সংস্থাও অংশ নিয়ে থাকে। শত-সহস্র মানুষ এই মেলায় যুগ যুগ ধরে আসছেন। মোগল, ব্রিটিশ আমলে কিংবা কংগ্রেসের সময়েও ওই মেলা বন্ধ হয়নি। রাজনীতিকদের মতে শাহ বোঝাতে চেয়েছেন, কুম্ভমেলার সফল আয়োজনের নেপথ্যে রয়েছে সমন্বয়। এই সাফল্য ব্যক্তি বা সরকারের নয়। মেলায় যত আগুন লাগছে, মানুষের পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটছে তত মনে মনে খুশি হচ্ছেন যোগীর বিপক্ষ শিবির। সবই হিন্দুত্বের(পড়ুন ক্ষমতা লাভের)জন্য! আদতে হিন্দুত্ব মানে কতিপয়ের শাসন,সেখানে শুধুই হিন্দু হৃদয় সম্রাট, বাকিরা পথের ধারের মৃতদেহ। শাহি স্নানের দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে দিল।ভুললে চলবে না, কুম্ভের দুর্ঘটনার প্রথম সরকারি শীলমোহর পরে প্রধানমন্ত্রীর টুইটে, তার আগে সরকারি ভাবে দুর্ঘটনার ব্যাপারে কেউ কিচ্ছু জানাননি। না যোগী প্রশাসন, না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
কুম্ভমেলা ও বহমান রাজনীতি
কুম্ভমেলা প্রতি ১২ বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র ও গুরুত্বপুর্ন উৎসব। চার জায়গায় অমৃত মন্থনের শেষে অমৃতের ফোঁটা পড়েছিল, এই পৌরাণিক কাহিনী উদযাপন করে হরিদ্বার, এলাহাবাদ (প্রয়াগরাজ), উজ্জয়িনী এবং নাসিক, এই চার জায়গায় হয় এই উৎসব ও মেলা। উনিশ শতকের শেষভাগে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই জাতীয়তাবাদের জন্য একটি মঞ্চ হিসেবে বিকশিত হতে থাকে কুম্ভ মেলা। ধর্মীয় অ-হস্তক্ষেপের ব্রিটিশ নীতি ভারতীয় নেতাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় সমাবেশগুলি ব্যবহার করার সুবিধে পাইয়ে দেয়।উনিশ-এর দশকে বাল গঙ্গাধর তিলক এবং গোপাল কৃষ্ণ গোখলের মতো জাতীয়তাবাদী নেতারা স্বদেশী এবং অন্যান্য জাতীয়তাবাদী কারণের প্রচারের জন্য কুম্ভমেলাকে ব্যবহার করেছিলেন। কংগ্রেসের কট্টর জাতীয়তাবাদী নেতাদের ভূমিকাও এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। উনিশশো তিরিশের দশকে, কংগ্রেস পার্টি সক্রিয়ভাবে কুম্ভ মেলাকে রাজনৈতিক সংঘবদ্ধতার জন্য ব্যবহার করেছিল। সাধু এবং তপস্বীরা জাতীয়তাবাদী বার্তা ছড়িয়ে দিতে ধর্মীয় কর্তৃত্বকে কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে মিশ্রিত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৩৬ সালের অর্ধ কুম্ভের সময় ভারত মাতার মূর্তি নিয়ে রাজনৈতিক মিছিলের মতো ঘটনার সাক্ষী ছিল কুম্ভ মেলা প্রাঙ্গণ।কুম্ভ মেলা ক্রমে আঞ্চলিক ধর্মীয় সমাবেশ থেকে একটি প্রধান জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল। এই রূপান্তর জাতীয়তাবাদী নেতাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল এবং স্থানীয় সাধুসন্তরা এটিকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং ভারতীয় রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের দাবির মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তবে বিশ শতকে এসে শুরু হল কাল্পনিক ধর্মীয় ট্যাবুকে ইতিহাস বলে মানুষের কাছে তুলে ধরে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার দ্বারা চালিত হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। মৌলবাদী শক্তি বিশ শতকের শুরু থেকেই গোটা হিন্দি বলয় জুড়ে জোরদারভাবে কাজ শুরু করেছিল। এক্ষেত্রে ‘কুম্ভমেলা’-কে ধর্ম চর্চা থেকে ধর্মান্ধতার আঁতুড়ঘরে পরিণত করবার প্রবণতা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির গোটা বিশ শতক ধরেই দেখিয়ে এসেছে। সেই প্রবণতাই পরবর্তী সময়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের হিন্দুত্বের রাজনীতির বিকাশ এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ক্ষেত্রটিকে আরও অনেক দ্রুত প্রসারিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ধর্মপালন, ধর্মাচরণকে ধর্মান্ধতায় পর্যবসিত করবার রাজনৈতিক খেলা হিন্দি বলয় জুড়ে বিগত প্রায় দুই দশক ধরে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির জোরদারভাবে করে চলেছে। এভাবেই তাঁদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি-কে তাঁরা কেন্দ্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে।আমাদের মনে রাখা দরকার, আজ গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে সম্বল করে পর পর তিনবার কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করে আছে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির। পশ্চিমবঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন থেকে এই রাজ্যেও নানা ধরনের বিভাজনের রাজনীতির পরিবেশ রচনা করে যাচ্ছে,যার মূল চালিকা শক্তি কিন্তু আরএসএস। এটা একটা দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পরিকল্পনা।যেটাকে বর্তমানে সামাজিক কার্যক্রমের আবরণ দিয়ে, অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে সামাজিক প্রযুক্তির সঙ্গে মিশিয়ে হিন্দি বলয়ের ধাঁচেই এই রাজ্যে আরএসএস এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যার জেরে সামাজিক গণমাধ্যম থেকে সামাজিক জীবন, সর্বত্রই ধর্মচর্চাকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক অভিসন্ধি নিয়ে তারা ধর্মান্ধতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে এবং ধর্মের রাজনৈতিক প্রয়োগ অত্যন্ত সফলভাবে ঘটাতে শুরু করেছে। সুতরাং সাধু সাবধান।