পঞ্চ ‘ম’ এর বিষয়ে এদেশে কিঞ্চিত অনীহা ও আতঙ্ক রয়েছে। গত ২-৩ সপ্তাহের ভাষণকে, প্রথমে মাছ মাংসের গন্ধে মাতিয়ে তোলার পরে মোদিজি মঙ্গলসূত্র ও মুসলমানকে একসূত্রে গেথে এই নির্বাচনে নব কলেবরে পঞ্চ ‘ম’কে উপস্থাপিত করছেন, যাতে ওনার চিরাচরিত মেরুকরণের উদ্দেশ্য সফল হয়।
যদিও সে মাছ বাসি হয়ে গিয়েছে তবুও বলি। এপ্রিল মাসের ১২ তারিখে জম্মুর উধমপুরে মোদিজি বললেন, দেখেছ তেজস্বী যাদব নবরাত্রিতে মাছের ছবি দিয়ে বলছে কী দারুণ মাছ! একদম মুগল মানসিকতা। এর আগে ওর বাবা রাহুল গান্ধিকে মাংস রান্না শেখাচ্ছে সেই ছবিও দিয়েছিল। নিরামিশাষী ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের (পড়ুন উত্তর ভারতীয় উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের) কেমন হেলা অচ্ছেদ্দা করছে এই সব মুগল প্রেমীরা। এরকম ভাষণ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এসে উনি দেবেন না। কারণ এটা ওনারা জানেন যে নবরাত্রিতে আমিষ ভক্ষণে এরাজ্যে তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। পাণ্ডব বর্জিত বঙ্গে সেকথা জোর গলায় বললে আমিষ বর্জনের বদলে বিজেপি বর্জনে এরাজ্যের ভোটাররা দ্বিধা করবেন না। অবশ্য তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারলে ওই বিজেপিই জোর করে আমিষ বর্জনে রাজি করাতে দ্বিধা করবে না। তখন বলা হবে ‘এক দেশ এক খাদ্যাভ্যাস’। তবে নির্বাচনের সময়ে ভোটে জেতার জন্য, ‘এক দেশ বিবিধ ভাষণ’।
নির্বাচন এগোতেই মোদিজি সুর পাল্টালেন। বলতে শুরু করলেন কংগ্রেস দেশের সব মানুষের ঘরে এক্স-রে মেশিন দিয়ে সোনা-দানা সম্পত্তির তল্লাসি করে সেই সোনা বাজেয়াপ্ত করে অনুপ্রবেশকারী, অতিরিক্ত সন্তান জন্মদাতাদের মধ্যে বন্টন করে দেবে। এমনকি মঙ্গলসূত্রও দিয়ে দেবে মুসলমানদের। মাংস, মাছ, মুগল আগেই এসে পড়েছিল মোদিজির অসত্য ভাষণে, এবার রাজস্থানের বাঁশওয়ারায় কোনো রাখঢাক না করে মঙ্গলসূত্র ও মুসলমানকে প্রসঙ্গ বহির্ভুত ভাবে নিয়ে এসে মিথ্যাচারের ১৬ কলা পূর্ণ করলেন। তা করার জন্য রাহুল গান্ধীর সাম্প্রতিক ভাষণের সঙ্গে ১৮ বছর আগের মনমোহন সিংএর বক্তৃতাকে জুড়লেন, যেখানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন সমাজের দুর্বল বর্গের, এসসি, এসটি, ওবিসির পাশাপাশি দেশের সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলমানদের দেশের সম্পদের উপরে প্রথম হক। বিজেপির অসততা ও চালাকির প্রথা অনুযায়ীই অন্য অংশ বাদ দিয়ে শেষ অংশ মুসলমানদের হকের কথা মিথ্যাবাদী প্রধানমন্ত্রী বললেন। উনি ভেবেও দেখলেন না, মনমোহন সিং যদি তেমনটাই ভাবতেন তাহলে ২০০৬ সালের পরে যে ৮ বছর উনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনইতো গয়না ও মঙ্গলসূত্র মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করে দিতে পারতেন। এর পরেই বিজেপির প্রচারযন্ত্র শুরু করে দিল, কংগ্রেস সম্পত্তির উপরে উত্তরাধিকার কর আরোপ করতে চাইছে। এর সঙ্গে এও বলা হতে থাকল, দেশের সমস্ত নাগরিকের মৃত্যুর পর তাদের সম্পত্তির উপরে ৫৫ শতাংশ হারে উত্তরাধিকার কর বসাবে কংগ্রেস। ৫৫ শতাংশের সূত্র হল স্যাম পিত্রোদার সাক্ষাৎকার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসে দেওয়া। যেখানে তিনি বলেছেন যে উত্তরাধিকার করের কথা ভাবা যেতে পারে, আমেরিকায় ওই হার ৫৫ শতাংশ। যেহেতু পিত্রোদা ৫৫ শতাংশ বলেছেন তাই মোদি, শিবরাজ চৌহান সমেত বিজেপির অসত্যবাদীরা ওই ৫৫ শতাংশ হারের কথা বলতে শুরু করেছেন। যদিও আমেরিকায় তা ৪০ শতাংশ। এবং তা নেওয়া হয় মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির পরিমাণ ১১২ কোটি টাকার উপরে হলে, অর্থাৎ অতি অতি অতি ধনীদের কাছ থেকে। এই যে অলীক বিষয় নিয়ে মিথ্যে বলে শোরগোল তোলা তার কারণ কী? কংগ্রেস নিজেদের ইস্তেহারে যে সমস্ত ইতিবাচক কর্মসূচির কথা বলেছে সেগুলি যাতে চর্চায় না যেতে পারে তার জন্যই মনে হয় এসব কথা বলা।
৪ এপ্রিল কংগ্রেস তাদের ইস্তাহার বা ন্যায়পত্র প্রকাশ করেছে। তাতে বেশ কয়েকটি অতি প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা আছে। পঞ্চ ন্যায়ের উপর ভিত্তি করে কংগ্রেসের ন্যায়পত্র দাঁড়িয়ে আছে বলে কংগ্রেসের বক্তব্য: যুব ন্যায়, নারী ন্যায়, কৃষক ন্যায়, শ্রমিক ন্যায় এবং অংশীদারী ন্যায়। সে যাই হোক না কেন, ২৫ বছরের নীচে প্রতিটি স্নাতক এবং ডিপ্লোমা প্রাপকদের এক বছরের শিক্ষানবিশির বন্দোবস্ত করা ও ওই সময়ে বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা দেওয়া; মহালক্ষ্মী প্রকল্পে দরিদ্র পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা সদস্যের ব্যাঙ্ক খাতায় বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা দেওয়া, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য ৫০% সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করা, কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তার আইন প্রণয়ন, দেশে ন্যূনতম মজুরি দৈনিক ৪০০ টাকা করা, সরকারী দফতরে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ বন্ধ করা, ৩০ লক্ষ শূন্য সরকারী পদে নিয়োগ করা এগুলির কথা ওই ন্যায়পত্র বা ইস্তেহারে বলা আছে। প্রথমেই বলা আছে যে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে দেশ জুড়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক জনগণনার মাধ্যমে জাতি, উপজাতি ও তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে সম্যক অবহিত হবে ও তার উপর ভিত্তি করে সমাজের দুর্বল শ্রেণীর উন্নতির কর্মসূচি বানাবে। এসসি, এসটি, ওবিসিদের জন্য ৫০ শতাংশ সংরক্ষণের সীমা তুলে দেওয়া হবে। সমাজের সমস্ত বর্গের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণীর জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করা হবে।
উপরোক্ত কর্মসূচির কথা যদি দেশের মানুষের কাছে পৌঁছায় তাহলে মোদিজির জুমলা টিকবে না। তাই ঢাক ঢোল বাজিয়ে যা ইস্তেহারে নেই তাকে কংগ্রেসের কথা বলে উপস্থাপনা চলছে। বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, দারিদ্র, নারী নির্যাতন, কৃষকের আয় বৃদ্ধি, সামাজিক বৈষম্য এসব নিয়ে বিজেপির বলার কিছুই নেই। ১০ বছর দেশ শাসনের পর এসব ক্ষেত্রে যে তেমন ইতিবাচক কিছু ঘটেনি তা মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতাতেই বুঝছেন। যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মোদিজির লড়াই তা যে বাগাড়ম্বর তাও বৈশাখের মধ্যাহ্নের আলোর মত পরিষ্কার হয় উঠেছে ডজন ডজন দুর্নীতিগ্রস্থ বিরোধী নেতাদের বিজেপিতে অন্তর্ভুক্তিতে। বোঝাই যাচ্ছে যে, ইডি, সিবিআই, আয়কর দফতরের তৎপরতা কেবল আপোষহীন বিরোধী নেতাদের ধরপাকড়ের ক্ষেত্রেই। এমতাবস্থায় কংগ্রেসের আপাত জনমুখী ইস্তেহারে ঘোষিত জনকল্যাণকামী কর্মসূচি যদি পৌঁছে যায় নির্বাচক মন্ডলীর কাছে তাহলে তা বিজেপির বিরুদ্ধে পাশুপত অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। তাই সেসবকে আটকানো যাক নাটক করে, মিথ্যা কথা বলে। মোদিজির সে ব্যাপারে দক্ষতা প্রশ্নাতীত। সঙ্গে তোষামুদে প্রচার মাধ্যম তো আছেই।
বিভিন্ন ভাষণে কিংবা দূরদর্শন সাক্ষাৎকারে মোদিজি ও তার স্যাঙাতরা উত্তরাধিকার কর এবং দেশের সম্পদ পুনর্বন্টনকে অপরাধ হিসেবে তুলে ধরছেন। যদিও কংগ্রেসী ইস্তেহারের কোথাও সম্পদ পুনর্বন্টন বা উত্তরাধিকার করের কথা বলা হয়নি তবুও সেটা করাই কংগ্রেসের উদ্দেশ্য বলে মিথ্যাচার চলছে। হিন্দু মুসলমান এসব শব্দের উল্লেখ না থাকাতেও প্রথমোক্তদের থেকে সম্পদ হাসিল করে তা শেষোক্তকে দেওয়া হবে বলে মিথ্যাচার তো করাই হচ্ছে। এমন ভাবে বলা হচ্ছে যেন, ধনীদের উপরে কর বসিয়ে নির্ধনের কাছে বন্টন করা পাপ।
ভারতের অতি অতি অতি অতি ধনী ২১ জন পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের কাছে প্রায় ৮০ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ আছে যা দেশের ৭০ কোটি নিম্ন সম্পদশালী মানুষের কাছে থাকা মোট সম্পদের থেকে বেশি। অতি অতি অতি ধনী ৯২২৩ জন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের কাছে থাকা গড় সম্পদের পরিমাণ ২২৬১ কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে নীচের ৪৬ কোটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের গড় সম্পদ তার ১ লক্ষ ভাগের ১ ভাগের থেকেও কম। অতি ধনী পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের সংখ্যা ৯২ লক্ষ ২৩ হাজার যাদের গড় সম্পদ ৫ কোটি টাকার বেশি। যাদেরর তুলনায় নীচের ৪৬ কোটি ১১ লক্ষ ৭২ হাজার পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের গড় সম্পদের অনুপাত ১ হাজার ভাগের ৩ ভাগ। ধনী ১০ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের গড় সম্পদ ৪৬ কোটি পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের গড় সম্পদের ৬৫ গুণ। এই কুৎসিত আর্থিক বৈষম্যকে মোদিজি ভগবানের ইচ্ছা বলে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে চান। আর্থিক বৈষম্যকে দূর করার কোনো কর্মসূচি মোদির গ্যারান্টিতে নেই। মোদির গ্যারান্টি তাহলে এই বীভৎস বৈষম্যকে বজায় রাখা। যেহেতু কংগ্রেসের ন্যায়পত্রে পরোক্ষভাবে হলেও, যুবকদের নিশ্চিত আয় বা মহালক্ষ্মী প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারপিছু ১ লক্ষ টাকা দেওয়ার মাধ্যমে, সম্পদের কোনো এক মাত্রায় পুনর্বন্টনের দিক দেখানো হয়েছে, তাই মোদিজির দেওয়া অবাধ লুন্ঠনের গ্যারান্টিপ্রাপ্ত অতি অতি অতি ধনীরা শঙ্কিত হয়েছে। মোদিজি তাদের লুন্ঠন চালিয়ে যাওয়ার গ্যারান্টি দিতে ব্যাট ধরেছেন।
যদি সম্পদের পুনর্বন্টন মহাপাপ হয়ে থাকে তাহলে দেশের করব্যবস্থাই তুলে দেওয়া উচিত। অর্থনীতির ছাত্ররা সবাই জানেন যে, যেকোনো করই দেশের আয় তথা সম্পদকে পুনর্বন্টিত করে থাকে। উঁচু আয়ের নাগরিকদের উপরে ক্রমান্বয়ে উঁচু হারে প্রত্যক্ষ করারোপ ধনীদের থেকে সম্পদ নিয়ে গরিবদের কাছে পুনর্বন্টনের একটি মাধ্যম। অপরদিকে পণ্য ও সেবার উপরে কর, যাকে পরোক্ষ কর বলে, গরিবদের বিরুদ্ধে যায়। তা তদর্থে বিপরীতমুখী পুনর্বন্টন করে থাকে। ফলে মোদিজি ও তার স্যাঙাতরা যদি সম্পদের পুনর্বন্টনকে মহাপাপ বলে গণ্য করে থাকেন তাহলে তাঁরা কি করারোপের বিরুদ্ধে বলবেন?
উত্তরাধিকার কর বা সম্পদের পুনর্বন্টন আলোচনায় চলে আসলে দেশের আর্থিক বৈষম্যও এসে পড়ে। যদি সম্পদের পুনর্বন্টন নিয়ে দেশের জনগণের কাছে রায় চাওয়া হয়, যেখানে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে নীচের ৫০ শতাংশের মধ্যে বন্টনের বন্দোবস্ত করা হবে, মাঝের ৪০ শতাংশকে করের বা বন্টনের আওতায় না এনে, তাহলে কী রায় পাওয়া যেতে পারে তা অনুমানের অপেক্ষা রাখে না। মোদিজি ও তার স্যাঙাতরা কি সেই জনমত নিতে রাজি আছেন?