পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে

  • 01 May, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1538 view(s)
  • লিখেছেন : ধীমান বসাক
শুধু লকডাউন নয়, করোনাও এসে অনেকগুলো জিনিস আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে। আমাদের দেশে এবং রাজ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবস্থা আর কত সহজে একটা আতঙ্কের চাষ করা যায়, সেসব তো বটেই, সে নিয়ে ক্রমাগত বলে যাচ্ছি। কিন্তু এসব বাদেও কতকগুলো জিনিস চোখে পড়ছে। রোগটা শহুরে বা আর্বান। যে জায়গাগুলোতে গতবছরে এবং এবছরেও রোগের বিস্তার ঘটেছে, তীব্রতা, সবই শহরকে ঘিরে। যে রাজ্যে যত বেশি নগরায়ণ ঘটেছে, সেখানে তার প্রকোপ, মোট আক্রান্তের সংখ্যা আক্রান্তের হার এবং মৃত্যুহার সবদিক থেকেই, বেশি।

আবারও একদফা আধা নাকি মিনি লকডাউন। সমাজের একটা অংশ এরকন কিছু বোধহয় চাইছিলেন, ছোট অংশ, হয়তো নিরাপদ বেতন বা প্রচুর সঞ্চিত অর্থ রয়েছে। দিন আনি দিন খাই মানুষের সাথে এদের মানসিক ব্যবধান অনেক, আর তাকে পুঁজি করেই, একের পর এক জনবিরোধী এবং অবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ।


শুধু লকডাউন নয়, করোনাও এসে অনেকগুলো জিনিস আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে। আমাদের দেশে এবং রাজ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবস্থা আর কত সহজে একটা আতঙ্কের চাষ করা যায়, সেসব তো বটেই, সে নিয়ে ক্রমাগত বলে যাচ্ছি। কিন্তু এসব বাদেও কতকগুলো জিনিস চোখে পড়ছে।

রোগটা শহুরে বা আর্বান। যে জায়গাগুলোতে গতবছরে এবং এবছরেও রোগের বিস্তার ঘটেছে, তীব্রতা, সবই শহরকে ঘিরে। যে রাজ্যে যত বেশি নগরায়ণ ঘটেছে, সেখানে তার প্রকোপ, মোট আক্রান্তের সংখ্যা আক্রান্তের হার এবং মৃত্যুহার সবদিক থেকেই, বেশি।

আমাদের দেশে নগরায়ণ মানে একদিকে যেমন বিশ্বের এবং দেশের অন্য প্রান্তের সাথে তার সংযোগ, তেমনি জনবসতির চূড়ান্ত ঘনত্ব, প্রতিটি বড় নগরে বস্তির বিস্তার, যেখানে মাথা ঘেঁষাঘেঁষি করে রাত কাটায় অসংগঠিত শ্রমজীবীরা, যার একটা বড় অংশ বাইরে থেকে কাজ করতে আসা মানুষ, যাদেরকে শৌখিন ভাষায় আজকাল পরিযায়ী শ্রমিক বলা হয়, আর তার পাশেই হাই রাইজ। এতদিন শোনা এবং দেখা গেছে, নাগরিক জীবনের সুযোগসুবিধে নাকি শহরেই বেশি, স্কুল কলেজ হাসপাতাল ডাক্তার শিল্প কাজের সুযোগ, আরও কত কী। সেই হাসপাতাল আর ডাক্তারও যে একটা সংকটে পড়লে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তৈরী হয়, তা করোনা বুঝিয়ে দিল, বুঝিয়ে দিল সেসব কত কম, কত অনুন্নত, কত বিচ্ছিন্ন।

আর এক সর্বব্যাপী আতঙ্ক, হাহাকারের পরিবেশ। সুবিধাভোগী মধ্যশ্রেণী যে কী পরিমাণ বিচ্ছিন্ন একে অপরের থেকে, একটা সংকটে পাশে তার শ্রেণীর কাউকে যে সে পায় না, এই করোনা তাও দেখিয়ে দিচ্ছে। নগরায়ণের বৈশিষ্ট্যই এই বিচ্ছিন্নতা। হয়তো আজ থেকে নয়, বরাবরই। কিন্তু একসময় এই মধ্যশ্রেণী ষাটের দশকে সংকটে পড়ে তার নীচের শ্রেণীগুলোর হাত ধরেছিল। সেই স্ফুলিঙ্গ দাবানলের জন্ম দিয়েছিল। রাষ্ট্র ক্রমশ এই শ্রেণীগুলোর একটা অংশকে অপেক্ষাকৃত নিরাপত্তা দিয়ে শ্রমজীবী জনতার থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছে। এই নিরাপত্তা হয়তো কাম্য, কিন্তু সেখানেই থেমে না থেকে রাষ্ট্র মধ্যশ্রেণীর মধ্যে নিজে বাঁচো, নিজে বাঁচলে বাপের নাম এই নীতির অনুশীলন ঘটালো। তাতে যোগ্য সঙ্গত দিল নব্য উদারবাদী অর্থনীতির কনজিউমারিজম। ভেতর এবং বাইরে থেকে আন্তর্জাতিক 'সমাজতান্ত্রিক' শিবিরের বিলুপ্তি এই মনোভাবকে পরিপুষ্ট করলো।

ফলে ষাটের দশকে বিচ্ছিন্নতার সংকটে পড়ে যে মধ্যশ্রেণীর আগুয়ান বাহিনী কাঁধ মিলিয়েছিল শ্রমিকদের সাথে, ফ্রান্সে একযোগে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারখানার দখল নিতে নেমেছিল, যারা উদ্দীপ্ত হয়েছিল "গ্রামে চলো" স্লোগানে, হাজারে হাজারে ছাত্রযুব নিজের অবস্থান ছেড়ে গ্রামের কৃষক জনতার পাশে দাঁড়ানোকেই নিজের সংকট মোকাবিলার রাস্তা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, তারা বড়জোর এখন কমিউনিটি কিচেন চালান, আর বাকি শ্রেণী নিজেরটুকু নিয়ে আঁকড়ে বসে থাকে, আর সংকটে পড়লে এক বিচ্ছিন্নতার সাগরে হাবুডুবু খায়।

যে দর্শন, যে ভাবনা ষাটের দশকে এই আগুয়ান বাহিনীকে আগুনে ঝাঁপ দিতে সাহস জুগিয়েছিল, সেই দার্শনিক পরিমণ্ডলও আজ শতধাবিভক্ত। প্রশ্নও উঠে এসেছে অনেক। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আর কোন দর্শন একথা বলেনি যে মানুষের মুক্তি সম্ভব এবং বাস্তব। শুধু সম্ভব নয়, বাস্তবও।

সেই দর্শনই বলেছে যে মানুষের মুক্তি শুধু পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণেই হবে তা নয়, তার জন্য পরিস্থিতিকে যে পালটাবে সেই মানুষেরও পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আর এই পরিবর্তন শুধু কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীর কাজ নয়, এটা একটা গোটা শ্রেণীর কাজ। এই পরিবর্তনের নাম বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড। বিপ্লব মানে ভাতের লড়াই নয়, আরও বড়কিছু, কিন্তু ভাতের লড়াইকে বাদ দিয়েও সে কাজ হবে না।

মধ্যশ্রেণীর মুক্তি, অসহায়তা অপমান বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তির জন্য, তাকে শ্রমজীবী জনতার হাত ধরতেই হবে। সুখের হাইরাইজে বাস করে কনসিলড ওয়ারিং-এর ফাঁক গলে ঢুকে পড়া বিচ্ছিন্নতার ভাইরাসকে আটকানো যাবে না।

0 Comments

Post Comment