কোভিড ১৯ আবির্ভাবের পর প্রায় দেড় বছর অতিক্রান্ত। ২০১৯ এর ডিসেম্বর মাসে উহানে করোনার প্রথম কেস আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে এই মারিকে নিয়ন্ত্রণ করার মোক্ষম উপায় যা সব দেশই কমবেশি অনুসরণ করেছে তা হল লকডাউন। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর থেকে টিকাকরণও আরেকটি উপায় হিসাবে সামনে এসেছে যদিও এটা কতটা কার্যকারী সেটা নিশ্চিত নয়, আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রথম বিশ্বের বাইরে খুব অল্প সংখ্যক মানুষকেই আজ অবধি টিকা প্রদান করা হয়েছে। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প বা ব্রাজিলের জায়ের বোলসেনারো এবং ইয়োরোপের কিছু খুচখাচ বিক্ষোভ সমাবেশ এর ব্যতিক্রম। উপরোক্ত দুই প্রেসিডেন্ট খোলাখুলি লকডাউন অমান্য করতে বলেছেন, দ্বিতীয় জন তো সামরিক বাহিনীকে পর্যন্ত এর বিরোধিতা করার জন্য প্ররোচিত করেছেন। কিন্তু দুটি দেশেই বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নররা তাঁদের প্রেসিডেন্টের আহ্বানকে নাকচ করেছেন এবং নিজেদের এক্তিয়ারে পূর্ণাঙ্গ তালাবন্দি করেছে্ন। তাই প্রায় প্রত্যেক দেশেই বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছে লকডাউনই সেই বিশল্যকরণী যা মারিকে রোধ করতে পারে। শুরু থেকেই প্রায় প্রতিটি দেশ জনজীবন স্তব্ধ করে দিয়ে মারিকে আটকানোর চেষ্টা করেছে।
কিন্তু কী লাভ হয়েছে এই লকডাউনে? আমেরিকা, ব্রাজিল, ভারতের মোট মৃত্যু ৪ লাখ, সারা বিশ্বে মোট ৪০ লাখ। এটা সরকারি পরিসংখ্যান। শুধুমাত্র আমাদের দেশেই মৃত্যুর সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বেশি। যোগেন্দ্র যাদব একটা মোটামুটি হিসাবে বলেছেন উত্তরপ্রদেশে প্রতি হাজারে তিন জন মারা গেছেন, যদি এটা দু জনও ধরা হয় তাহলেও ২৩ কোটি মানুষের রাজ্যে মোট মৃত্যুর সংখ্যা হিসাব করতে গেলে মাথা গুলিয়ে যাবে। বিহারে ২০১৯ এর জানুয়ারি থেকে মে মাসের তুলনায় এই বছরের একই সময়ে ৮২৫০০ বেশি মৃত্যু হয়েছে, কী ভাবে, কোন অসুখে তাঁরা মারা গেলেন সেটার কোনও হিসাব নেই। তালাবন্দি নাহলে যে এর থেকে কম লোক মারা যেতো এর কী প্রমাণ আছে? লকডাউনের পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয় যে এটা সংক্রমণের গতি শ্লথ করে, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো সাজিয়ে নেবার সুযোগ পাওয়া যায়। গতি শ্লথ হল ঠিক আছে কিন্তু যখন আনলক হল দেখা গেলো বাবাজীবন আবার নতুন এবং আরও প্রাণনাশক রূপে আবির্ভুত হয়েছেন----ভারতীয় স্ট্রেইন (B.1617), ডেল্ট্রা স্ট্রেন, তার আবার কোনটা ‘ভ্যারিয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট’, কোনটা ‘ভ্যারিয়েন্ট অফ কন্সার্ন’ ইত্যাদি সব বাহারি তত্ত্বকথা। যে টিকা বাজারে এসেছে তা এই নতুন রূপের জীবাণুকে ঠেকাতে পারবে কি না সেটারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর সাজানোর যা ছিড়ি সেটা তো দেখাই গেল। ঢেঁড়া পিটিয়ে সারা বিশ্বকে বলা হয়ে গেলো যে আমরাই পৃথিবীকে করোনার হাত থেকে রক্ষা করলাম, তার তিন মাস বাদেই অক্সিজেনের জন্য ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দৌড়াতে হল।
কী লাভ হল তাহলে লকডাউনে? অদূর ভবিষ্যতে এর ফলে মারি নির্মূল হবে এরকম কেউ আশা দিতে পারছে না, অথচ মানুষের রুটিরুজি চৌপাট। অফিসকাছারি, ব্যবসাবাণিজ্য, স্কুলকলেজ, বাজারহাট, দোকানপাট সব বন্ধ, জনজীবন চালু রাখার যে মূল উপায় যানবাহন সেটাও স্তব্ধ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা বলছে কম মজুরির লোকেরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত—২৩.৬%, মধ্যম বর্গীয় মানুষ ৪.৫%। বেকারি বাড়ছে, দারিদ্র বাড়ছে, ক্ষুধা বাড়ছে। ২০২০র এপ্রিলে-মে মাসে বেকারি আমাদের দেশে ছিল সর্বাধিক-২৩%। দারিদ্র তো আমাদের দেশে একটি চিরায়ত ব্যাধি। তালাবন্দির আগেই অন্তত ৫০% অসংগঠিত মজুর ৩৭৫ টাকা দৈনিক মজুরির কমে কাজ করতেন। আশি শতাংশ অসংগঠিত শ্রমিক ২০২০র তালাবন্দিতে কাজ হারিয়েছিল, এঁদের বেশির ভাগই দৈনিক মজুর, হকার, ছোটো ব্যবসায়ী, নির্মাণ শ্রমিক ইত্যাদি। আনলক পর্ব শুরু হওয়ার পর অনেকে কাজে ফিরে যান এবং এপ্রিল, ২০২১য়ে বেকারি ৮%য়ে নেমে আসে। এর মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যে আংশিক বা পূর্ণাংগ লকডাউন শুরু হয়ে যায়। প্রধান শহরগুলি যেমন মুম্বাই, দিল্লি ও কলকাতায় যথাক্রমে ছয়, পাঁচ ও তিন সপ্তাহ সব কিছু স্তব্ধ হয়ে যায়, যার ফলে বেকারি পুনরায় বেড়ে এখন ১৩.৬%। বলা হচ্ছে জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ২.৫৩ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৮৫ লক্ষ চাকুরিজীবী। এঁদের অনেকেই আর পুরানো কাজ ফিরে পান না; চুক্তি, ক্যাসুয়াল, গিগ শ্রমিকে পরিণত হন। যাঁরা দৈনিক মজুরি করেন তাঁদের বেশির ভাগ, সবাই নয় কিন্তু, আবার কোনও না কোন কাজ পেয়ে যান। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই তাঁদের আয় কমে যায়। ধরা যাক রেস্তোরাঁর হিসাবরক্ষক ২০০০০ টাকা বেতন পেতো, আনলক হবার পর তাঁকে দেওয়া হল ১৬০০০, এখন আবার যখন রেস্তোঁরা বন্ধ তখন সে বাড়িতে বসে পাচ্ছে মোটে ১০০০০। ক্যানিং থেকে যে গৃহসেবিকা কলকাতায় এসে দৈনিক ৩০০-৩৫০ টাকা আয় করতেন, ট্রেন বন্ধ থাকার দরুণ তাঁর এখন অটোতে বারুইপুর হয়ে গড়িয়া আসতে খরচ হয়ে যায় ৬০ টাকা, আসা যাওয়া ১২০ টাকা! কী থাকলো তাহলে? তিন চারজন মিলে এখন শহরে ঘর ভাড়া করে থাকছেন, কিন্তু তাতেও তো অতিরিক্ত খরচ। বাস, ট্রেন বন্ধ হলে মানুষের কী দুর্ভোগ এতে কি বোঝা গেল? CMIE তথ্য বলছে লকডাউনের ফলে ৫৫% মানুষের উপার্জন কমে গেছে, ৪২%র একই রয়ে গেছে। দারিদ্র আর বেকারত্বর এই বিষাদঘন প্রান্তরে কতিপয় মানুষের সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মুকেশ আম্বানির ধনদৌলত ২৪% বেড়েছে, গৌতম আদানির দ্বিগুণ হয়েছে। এটা কী কম কথা যে অর্থনৈতিক এই বিভীষিকার মধেই আরও ৪০ জন নতুন অর্বুদপতি হয়েছে, মোট বিলিনিয়ারের সংখ্যা এখন ১৭৭, আমেরিকা আর চিনকে টপকে গেলো বলে!
লকডাউন সেই অর্থে ব্যাধির প্রতিকার করতে পারছে না উল্টে মানুষ অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে ৯০% মানুষ খাবারের খরচা কমিয়ে দিয়েছে। ২.৩ কোটি মানুষ দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর দারিদ্র সীমার নীচে চলে গেছে। এবারে কোভিডের আক্রমণ অনেক মারণঘাতি হওয়ার কারণে, অক্সিজেন, বেড বিপুলভাবে অপ্রতুল হওয়ার কারণে এবং সর্বোপরি মৃত্যু অনেক বেশি হওয়ার কারণে, বেকারি, কাজ খোয়ানো, ক্ষুধা অত প্রচারে আসছে না। অথচ এবারও মানুষের দুর্দশা অকল্পনীয়। দিনমজুরদের অবস্থা এবার না ঘর কা না ঘাট কা। গতবার সম্পূর্ণ তালাবন্দির কারণে মানুষ পথে নেমে এসেছিলেন, সেই অধ্যায়ের বিয়োগান্ত পরিণতি আমরা জানি। এবার পুরো শহর লকডাউন হলেও কিছু এলাকায় কিছু কাজকর্ম জারি থাকার ফলে অনেকেই কাজের জায়গায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কোনও দিন কাজ পাচ্ছেন, কোনও দিন পাচ্ছেন না। গতবার প্রচুর জনতা কিচেন খুলেছিল, এবার সংখ্যায় কম। রান্নার গ্যাস, পেট্রল, ডিজেলের দাম কম ছিল। আধারের সঙ্গে রেশন কার্ডের লিংক না করতে পারার জন্য অনেকেই রেশন পাচ্ছেন না। গ্রামেগঞ্জে নেট কানেকশন প্রায়ই থাকে না তাই বহু মানুষের বায়োমেট্রিকের কাজ এখনো হয়নি। অনেকের আঙুলের ছাপ মেলে না। এর ফলে তথাকথিত ‘ওয়ান নেশন ওয়ান কার্ড’ প্রকল্প সত্ত্বেও বহু মানুষ রেশনের খাদ্যশস্য পাচ্ছেন না। অনাহারের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাবার জন্য মারির প্রকোপ যতদিন জারি থাকবে ততদিন মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে। যাদের আধারের সাথে রেশন কার্ড সংযুক্তিকরণ হয়নি, কিংবা যাঁদের কার্ড নেই তাঁদেরও দিতে হবে। অন্তত তিন মাস ৫০০০ টাকা প্রত্যেকের ব্যাংকের খাতায় দিতে হবে। এনরেগায় ২০০ দিনের কাজ দিতে হবে। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য শহরে সস্তা ঘরের ব্যবস্থা করতে হবে। কোভিডের তৃতীয় ঢেউ কিছু মিডিয়া এবং স্বার্থান্বেষি মহল আমাদের ঘাড়ের ওপর প্রায় চাপিয়েই দিয়েছে। দুর্ভিক্ষ যদি আটকাতে হয় তাহলে বুকনিবাজি না করে এখনই প্রস্তুতি শুরু করতে হবে।