কিছুদিন আগে বিজেপির এক জনৈক নেতা জানিয়েছেন আগামী দিনে দেশের মানুষ নরেন্দ্র মোদীকে রামচন্দ্র হিসেবে পুজো করবে! হ্যাঁ, পূজ্য ব্যক্তিই বটে। শেক্সপিয়রের এক নাটকে আছে, যে হাতে রক্ত লেগে আছে সেই হাতে আরবের প্রখ্যাত সুগন্ধী আতর লাগিয়েও রক্তের গন্ধ ধুয়ে মুছে ফেলা যায় না। অথচ আমাদের দেশের মোদী-অমিতরা তাঁদের রক্তমাখা হাত অবলীলায় ধুয়ে মুছে একেবারে দেশের ভাগ্যবিধাতা হয়ে বসেছেন!
এঁরা অনবরত অনৃতভাষণে দক্ষতা দেখাচ্ছেন, মিথ্যেকে ক্রমাগত বিজেপির ফ্যাসিস্ত প্রচারযন্ত্রে সত্য বলে চাউর করার প্রয়াস পেয়ে চলেছন! মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। আর এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে নির্বাচনী ফয়দা তোলাই তাদের চিন্তা এবং অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মোদী-অমিতরা জানেন যে পশ্চিমবঙ্গে তাদের পায়ের তলায় মাটি পাওয়া খুব শক্ত। তবু এই বাংলা দখল তাঁদের এখন প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাঁদের এই লক্ষ্য পূরণে একবার তাঁরা রবীন্দ্র ভজনা করতে গিয়ে সত্য, অর্ধসত্য এবং মিথ্যের খিচুড়ি পাকাচ্ছেন, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে তাঁকে আবার শ্রদ্ধা জানাবার নাটক করছেন, শ্যামাপ্রসাদকে পুজো করছেন বিজেপির বাঙালি আইকন হিসেবে আবার তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সুভাষচন্দ্রকেও সাভারকরের স্নেহধন্য বলে প্রচার করে গণমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে চলেছেন। ফ্যাসিস্তদের কাজই হচ্ছে একটা মিথ্যেকে বারবার সত্য বলে প্রচার করার মধ্যে দিয়ে তাকে সঠিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া। এক্ষেত্রে তারা সেই ফ্যাসিস্ত প্রক্রিয়ারই সক্রিয় অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছে।
বিজেপি এখন বাংলার নির্বাচনে বাঙালির মন পেতে সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে আজগুবি প্রচার করে চলেছে। এমনভাবে তারা প্রচার করে চলেছেন যাতে মনে হবে সুভাষচন্দ্র বসু প্রাক-‘স্বাধীন’ ভারতে হিন্দুমহাসভা-রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক দলের অনুগত সৈনিক ছিলেন! গত ২৩ জানুআরি আমাদের প্রধানমন্ত্রী তথা সঙ্ঘপরিবারের ফ্যাসিস্ত প্রচারক সুভাষচন্দ্রের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর দিনে কলকাতায় দাঁড়িয়ে এই দিনটিকে ‘পরাক্রম দিবস’ হিসেবে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন! এখন থেকে সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনটিকে ‘পরাক্রম দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণার মধ্যে দিয়ে একদিকে তিনি যেমন রাজনৈতিক চমক দিতে চেয়েছেন, তেমনই অন্যদিকে সুভাষচন্দ্র যে মোদিতান্ত্রিকদের একান্ত স্বজন, তার বার্তা দিয়ে সুভাষভক্ত বাঙালির মন জয় করার অপপ্রয়াসী স্বাক্ষর রেখেছেন। সুভাষচন্দ্রের অনুগামীদের হাতে হিন্দু-সাম্প্রদায়িক শ্যামাপ্রসাদের নিগৃহীত হওয়ার তথ্য এখন তারা বেমালুম চেপে যাচ্ছেন।
কংগ্রেসে থাকাকালীন শ্যামাপ্রসাদ সেখানে হিন্দুদের স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলতেন। তাঁর অভিযোগ ছিল: কংগ্রেস যতখানি অহিন্দুদের স্বার্থপূরণে যত্নশীল ততখানি হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষায় ভাবিত নয়! আর মূলত এই প্রশ্নেই তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে সাভারকরের অনুগামী হয়ে হিন্দুমহাসভার নেতা হয়ে ওঠেন। আর এরই প্রেক্ষিতে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন :
একটা সময় ছিল যখন কংগ্রেসের নামী নেতারা হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক দলগুলির সদস্য হতে পারতেন। কিন্তু এখন সময় পালটেছে। এখন এইসব সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি আগের চাইতে আরো বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে। আর এর ফলে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তার সংবিধানে নতুন সংযোজনী এনে জানিয়ে দিয়েছে যে হিন্দুমহাসভা এবং মুসলিম লিগের মতো কোনও সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সক্রিয় কর্মিরা আর কংগ্রেসের ইলেকটিভ কমিটির সদস্য হতে পারবে না।
এই হিন্দুমহাসভা এবং শ্যামাপ্রসাদের সাম্প্রদায়িক কাজকর্মে সুভাষচন্দ্র এতটাই বিরক্ত ছিলেন যে তিনি তাঁর অনুগামিদের নিয়ে শ্যামাপ্রসাদকে সমুচিত ‘শিক্ষা’ দেবার কথা ভেবেছিলেন। সুভাষের নেতৃত্বে তাঁর অনুগানিরা তো হিন্দুমহাসভার মিটিং ভেস্তে দিয়ে উদ্যোক্তাদের শারীরিক নিগ্রহ পর্যন্ত করেছিল। আর এর প্রতিক্রিয়ায় শ্যামাপ্রসাদ প্রতিবাদী সভার আয়োজন করতে চাইলে সুভাষপন্থিরা তাঁকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলেন বলে জানা যায়।—অথচ মোদিরা এসব তথ্য এখন বেমালুম হজম করে নিছক বাংলায় নির্বাচনে বাঙালির মন পাওয়ার লক্ষ্যেই বাঙালির এই প্রিয় নেতা সুভাষ বন্দনা করতে গিয়ে তাঁকে বিজেপির ঘরের লোক বানিয়ে ফেলার অপচেষ্টা শুরু করেছে!
নেতাজির ব্রিটিশবিরোধী ভুমিকাকে মোদীরা এখন খুবই প্রশংসা করে থাকেন। অথচ তাঁরা নিজেরা কখনও আমাদের দেশে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন নি। বরং তাঁরা এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে বিদেশি ব্রিটিশস্বার্থ সেবাকেই তাঁদের ধর্ম বলে ঘোষণা করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র যখন তাঁর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির মাধ্যমে ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের মোকাবিলার চেষ্টা করছিলেন, তখন সাভারকার ভারতের এই বিদেশি ব্রিটিশ সরকারকে সক্রিয়ভাবে সাহায্যের লক্ষ্যে লক্ষ লক্ষ ভারতীয়কে ব্রিটিশরাজশক্তির সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার প্রকাশ আহ্বান রেখেছিলেন। শুধু তাই নয় ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকারও, সাভারকারের অনুসরণে, ভারতীয় যুবকদের ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আহ্বান রেখেছিল!
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুমহাসভার ভাগলপুর অধিবেশনে সাভারকার বলেছিলেন :
এই যুদ্ধ এখন আমাদের সামনে একদিকে যেমন বিপদের সংকেত দিচ্ছে, তেমন আবার আমাদের সামনে এই পরিস্থিতি ব্যবহার করার সুযোগও এনে দিয়েছে। আমাদের এখন উচিত আমাদের আন্দোলনকে শক্তিশালী এবং জঙ্গি করে তোলার লক্ষ্যে প্রতিটি গ্রাম এবং শহরে আমাদের সক্রিয় কর্মিদের সংগঠিত করে ব্রিটিশ সরকারের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া।
স্পষ্টতই এখানে বিপদ মানে ব্রিটিশ শাসনের বিপদ। আর সুযোগ মানে ব্রিটিশ সরকারের এই বিপদের দিনে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে দেশদ্রোহিতার কাজে সামিল হওয়া। আর সাভারকারের নেতৃত্বে শ্যামাপ্রসাদরা সেটাই করেছিলেন। আর তাদের উত্তরসুরি বিজেপি নিজেদের দেশপ্রেমী হিসেব জাহির করে বিরোধীদের দেশদ্রোহী হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমলের ঔনিবেশিক আইন প্রয়োগ করে আজও ব্রিটিশদের কাছে সেবাব্রতীর নজির রেখে চলেছে।
মনে রাখা দরকার যে এই সময় ভারতের পূর্বাঞ্চল দিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি নিয়ে দেশমুক্তির লক্ষ্যে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন। আসলে এই সময় বিদেশি ব্রিটিশ সরকার এবং বাহিনীকে হিন্দু সৈনিকদের দিয়ে সাহায্য করায় সাভারকারদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সুভাষচন্দ্রের এই ভূমিকার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সক্রিয় উদ্যোগে সামিল হওয়া। একদিকে সুভাষচন্দ্র যেমন তাঁর পরাধীন দেশের মুক্তির লক্ষ্যে (দেশের গণশক্তির ওপর আস্থা জ্ঞাপনের বিপ্রতীপে) জাপান সরকারের সাহায্য নিয়ে গঠিত সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বিদেশি ব্রিটিশশাসনের অবসানের আকাঙ্ক্ষী ছিলেন, তেমনই অন্যদিকে সাভারকারের নেতৃত্বে হিন্দুমহাসভা তার সর্বশক্তি দিয়ে হিন্দুসৈনিকদের ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ানোর মাধ্যমে প্রকাশ্যে সুভাষচন্দ্র তথা দেশবাসীর দেশমুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকরা করেছিল। দেশমুক্তির লক্ষ্যে সুভাষচন্দ্রের গৃহীত পথ প্রশ্নাতীত না-হলেও তাঁর দেশপ্রেম ছিল প্রশ্নাতীত। অন্যদিকে হিন্দুমহাসভার সাভারকার এবং তাঁর অনুগামিদের (শ্যামাপ্রসাদ সহ) না ছিল আত্মসম্মান বোধ, না ছিল দেশপ্রেম। পরাধীন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকাশ্য বিরোধিতা করে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতার নিদর্শন রেখে তাঁরা প্রকৃতপক্ষে দেশদ্রোহিতার কাজই করেছিলেন।
অথচ সেই সাভারকার-শ্যামাপ্রসাদদের উত্তরসুরি হিসেবে মোদি সহ আজকের বিজেপি নেতৃবৃন্দ পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন নির্বাচনে বাঙালির মন জয়ের লক্ষ্যে চরম মিথ্যে কথাকে ক্রমাগত সত্যে পরিণত করার অপপ্রয়াস পেয়ে চলেছেন। তাদের এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করা আজ জরুরি কাজ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে বিজেপির কর্মী বিক্ষোভ, স্মৃতি ইরানি এবং অমিত শাহের সভায় ভিড় না-হওয়ার মতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে গতকাল তারা কফি হাউসে গিয়ে হুজ্জুতির নমুনা রেখেছে, বিজেপি বিরোধী পোস্টার ছিঁড়ে দিয়ে খবরের শিরোনাম হওয়ার চেষ্টা করেছে। একইসঙ্গে গতকালই দমদম মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলে বিজেপি বিরোধী পোস্টার লেখার যথার্থ কাজকে পণ্ড করতে জিআরপি-কে দিয়ে পোস্টারলিখিয়েদের গ্রেপ্তার করেছে এবং হেনস্থা করেছে। বাংলায় এভাবেই শুরু হতে চলেছে বিজেপির ফ্যাসিস্ত আক্রমণ। এর বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময় এসেছে।