বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও ধারণা বদলে যাচ্ছে আমাদের ভূবনে। সমস্যাটা কেবল ভারতের নয়, বরং গোটা দুনিয়ার। উনিশ শতক থেকে চলে আসা বিশিষ্ট ভাবুক হামবল্টের আদলে নির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারনা ছিল মূলত মুক্ত জ্ঞানচর্চা ও সাংস্কৃতিক বোধ নির্মাণের ওপরে নির্ভরশীল। সেই ধারণায় রদবদল ঘটিয়ে উচ্চশিক্ষাকে মূলত লাভ ক্ষতির অঙ্কে মেপে নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান বা বর্তমান সমাজের সুবিধার উদ্দেশ্যে ঢেলে সাজানোই এই নয়া শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য। এখানে সমাজবদল নামক বিপজ্জনক প্রক্রিয়ার কোন ঠাঁই নেই। এই ব্যবস্থায় শিক্ষা ব্যক্তির ও মূলস্রোত-সমাজের লাভের জন্য নিবেদিত। ঠিক যেভাবে একটি কর্পোরেট কোম্পানিগুলি তাদের মূলধন ও আর্থিক লাভ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিজেদের তথাকথিত গবেষণাকে চালিত করে, এখানেও উচ্চশিক্ষা আগে থেকে ঠিক করে রাখা রাষ্ট্রীয় ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে নিয়ে যায় আমাদের। অর্থাৎ জ্ঞান এখানে মুক্ত নয়, জ্ঞানের পিছনে থাকে কোনো এক নৈর্ব্যক্তিক লাভ অথবা সুবিধার যুক্তি। শিক্ষার ব্যাপক প্রযুক্তিকরণ, এবং উচ্চশিক্ষায় অন্তর্জালের মাধ্যমকে প্রধান করে ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করা, উচ্চশিক্ষায় বদল আনার এই বৃহত্তর প্রকল্পেরই অংশ বলে মনে হয়। এর উদ্দেশ্য মানুষকে কর্পোরেট রোবটে পরিণত করা যার মূল কাজ কতগুলো নৈর্ব্যক্তিক ভিডিও অডিও দেখা ও শোনার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট ধারণা মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া ও সেই অনুসারে তাকে পরিচালিত করা।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সাহায্যপ্রদানকারী কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা ইউজিসির নয়া শিক্ষানীতি সর্বাধিক চল্লিশ শতাংশ অবধি কোর্সকে অনলাইনে করার ছাড়পত্র দিয়েছে। ইউজিসি যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সাহায্যপ্রদানকারী একটি সংস্থামাত্র এ কথা মনে করিয়ে দিতে হল কারণ ইদানীং এই সংস্থাটি বেসরকারি সংস্থার মালিকের মতো সারা দেশের সিলেবাস ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করার চেষ্টা করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এরকম নির্ধারণ আসলে লেখাপড়ার নৈর্ব্যক্তিক নিয়ন্ত্রণপ্রকল্পেরই অংশ যা পড়ুয়া, শিক্ষক ও জ্ঞানচর্চার সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে তৈরি করে বিচ্ছিন্নতা। ঠিক এভাবেই লেখাপড়ার সম্পূর্ণ অনলাইন ব্যবস্থা আসলে শিক্ষক, ছাত্র, ক্লাসরুম এবং যে সমাজকে ঘিরে তার জ্ঞানচর্চা সেই প্রেক্ষিতটির মধ্যে একটা বিরাট বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে। এটা মনে রাখা দরকার যে এই নৈর্ব্যক্তিক কেজো রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিচ্ছিন্নতা নতুন নয়। ভারতের আনাচে কানাচে বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে তার উদাহরণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে। বরং বলা চলে যে এই ডিজিটাল লেখাপড়া আসলে মুক্ত জ্ঞানচর্চাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক। এতে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানববিদ্যাচর্চা ও সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলি যেখানে তর্ক, বিতর্ক, ছেদ, যতি, ক্রোধ, আবেগের স্ফুরণ ও অপরের প্রতি সহমর্মিতা ক্লাসরুমে শিক্ষার অংশ। এই ক্লাসরুমেই আমাদের ভিন্ন লিঙ্গ ব যৌনতার মানুষদের প্রতি, অন্ত্যজ জাতির সহপাঠীদের প্রতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে ছড়ানো অঞ্চলে জনসমাজের প্রতি সহমর্মীতা ও ভিন্নতর বোধ তৈরি হয় পাঠ নিতে নিতে। লেখাপড়া যে কতগুলো শুষ্ক তথ্যের সমাহার নয় বা জ্ঞানচর্চা যে কিছু বই পড়ে সংকলিত তথ্যকে সুন্দর মোড়কে ক্লাসরুমে অথবা ছাপার অক্ষরে পরিবেশনা নয় সেই কথা বিস্মৃত হতে হয় এই কর্পোরেট ও অধুনা অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার মডেলে। শিক্ষাকে যে মানুষের বহতা জীবনের টানাপড়েন ও ন্যায় ও নৈতিকতার সাথে যুক্ত নানা তর্কের মধ্যে দিয়ে যাপন করতে হয় সেই বোধকে কেড়ে নেওয়ার কল এই ব্যবস্থা। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনা অতিমারির প্রভাবে এই ডিজিটাল লেখাপড়া অনেক বেশি স্বাভাবিক করে দেওয়া হয়েছে উচ্চশিক্ষায় (সমস্ত স্তরের শিক্ষায় সেটা ঘটেছে, যদিও এখানে আমরা উচ্চশিক্ষাক্ষেত্র নিয়েই আমাদের আলোচনাকে সীমিত রাখছি)। লকডাউনের সামাজিক প্রভাব কি তা বিস্তর আলোচনার দাবি রাখে, কিন্তু আপাতত আমরা ভাবার চেষ্টা করি এই লকডাউন আমাদের কতটা নৈর্ব্যক্তিক অনুভূতিহীন ও নিষ্ঠুর করে তুলেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে তার প্রভাব ঠিক কী?
প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। সেই সংকটের শুরুর মরশুমে ডিজিটাল উদ্দীপনায় কেউ কেউ মেতেছিলেন রাশি রাশি অনলাইন ওয়েবিনার আয়োজনে। সেই উৎসাহে সম্ভবত কোনো ঘাটতি ছিল না। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে যে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হল ছাত্র সমাজের সেটি চাপা পরে যেতে থাকে এই ডিজিটাল উদ্দীপনায়। বিশ্বায়নের আপাত মুক্তির অলীক দাবির সাথে সাযুজ্য রেখেই এই তথ্য বিস্ফোরণ। ইনফরমেশনের স্রোতে ভাসে ইন্টারনেট। সরাসরি যোগাযোগহীন, প্রযুক্তিতে দুর্বল, অন্তর্জালের অপর্যাপ্ত কানেকশনে, স্মার্টফোনহীন ধুঁকতে থাকা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পরা, অপেক্ষাকৃত প্রান্তিক অঞ্চলের ছাত্ররা ততদিনে বিভ্রান্ত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে শারীরিক উপস্থিতিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় অভ্যস্ত ও পটু তাকে রাতারাতি রোগে আক্রান্ত হওয়ার যুক্তিতে প্রতিস্থাপন করা হল প্রযুক্তিনির্ভর পড়াশোনায়। এ যে নিতান্তই এক বৈষম্যমূলক সামাজিক ও সংগঠিত অপরাধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সেই বোধ অন্তর্জালিক জ্ঞান বিতরণের বাড়বাড়ন্তে বিস্মৃত হওয়া শুরু হল। বিরাট সংখ্যক ছাত্রসমাজ স্বভাবতই অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকলো। আর যারা পেল এই ডিজিটাল লেখাপড়ার তথাকথিত সুফল তারা হয়ে উঠতে থাকলো ডিজিটাল নিষ্ঠুর।
এক সময়ে ক্লাসরুমে কোনো এক বা একাধিক ছাত্র অর্থনৈতিক কারণে অনুপস্থিত থাকলে কেবল শিক্ষক নয়, সহপাঠীরাও উদ্বেলিত হত। আর এখন আমরা ধরেই নিলাম যারা নিজেদের ক্লাসের সময়ে কানেকশনের কারণে অথবা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে যুক্ত করতে অক্ষম তারা আসলে হতভাগ্য। তারা রইলো আমাদের ডিজিটাল স্পেসে দৃষ্টিগোচরতার বাইরে। আমরা তাদের দেখতে পেলাম না, স্পর্শ করতে পারলাম না। আমরা জানলাম না কারা কোন সামাজিক অবস্থা থেকে উঠে আসছে, কাদের রান্না, স্নান, কাজ, লেখাপড়া, টিভি দেখা সব একটা ঘরেই হয়। শিক্ষকদের সাথেও ছাত্রদের তৈরি হল এই বিচ্ছিন্নতা। লকডাউনে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে মানুষ থালাবাসন বাজিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে যখন করোনা রোগটিকে বিদায়ের প্রার্থনা করছে তখন হয়তো শেষ ঘটিবাটি বিক্রি হয়ে গেছে কারো, নিভে গেছে অন্তিম মোমবাতি। আমাদের মতো শিক্ষকদের স্ক্রিনজুড়ে তখন কেবল নীরব কতগুলো নাম। হিসেব রাখা দুষ্কর, মনে রাখা দুরহ সেই ছাত্রদের নাম আর নম্বর। তারা কতগুলো আকৃতি মাত্র। লকডাউনে ঘটে চলা সামাজিক বৈষম্যের বৃদ্ধি, দীর্ঘদিন ট্রেন না চলায় গ্রাম মফস্বল থেকে শহরে আসা খেটে খাওয়া মানুষের অসম্ভব লড়াই যেন স্বাভাবিক হয়ে গেল অপেক্ষাকৃত সুবিধাভোগী, প্রযুক্তিদক্ষ, অর্থবান ছাত্র ও শিক্ষক সমাজের কাছে। রাশি রাশি ওয়েবিনার ও পরীক্ষায় ঢালাও নম্বরই যেন উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য। বিশ শতকের নয়ের দশকের শেষ থেকে যে বেসরকারি কারিগরি শিক্ষার প্রচলন হয় যেখানে কেবল পাশ করে চাকরি পেয়ে দক্ষ কর্পোরেট শ্রমিক তৈরি করাই ছিল উদ্দেশ্য এবং যে শিক্ষা ছিল বিজ্ঞান, কারিগরির সাথে সামাজিক জ্ঞানের বিচ্ছিন্নতার ওপর নির্ভরশীল তা এক নয়া অবতারে আক্রান্ত করলো যেন আমাদের সর্বস্তরের উচ্চশিক্ষাকে। হিউম্যানিটিজ চর্চাও সেখানে ওয়েবিনার আবদ্ধ, পরীক্ষা নির্ভর ও কেরিয়ারের নিমিত্ত।
দেড় বছর কেটে গেল, করোনার প্রথম, দ্বিতীয় ঢেউ পেরিয়ে এখন সম্মুখে তৃতীয় ঢেউয়ের আতঙ্ক। জনজীবন আজ অনেকটাই স্বাভাবিক। মানুষ ভয়ের সাথে লড়াই করে কাজে ও ফুর্তিতে সমানভাবে ফিরে আসছে। সিনেমা হল, বিপণি, অফিস, আদালত সবই খোলা। তবু কোথাও যেন আমরা মেনে নিয়েছি এই ডিজিটাল নিষ্ঠুরতা, এই অনলাইন বিচ্ছিন্নতা। তাই তো এখনো স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। সংযোগহীন ডিজিটাল শিক্ষার প্রসারকে যদি এই নিষ্ঠুর সামাজিক বৈষম্য টিকিয়ে রাখার জন্য দায়ী করি – তাহলে কি খুব ভুল হবে?