‘বন্দেভারত’ এক্সপ্রেস ট্রেন চালু হওয়া ইস্তক, বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। প্রথমে শোনা গেল, ট্রেনের সঙ্গে গোরু ধাক্কা খেয়ে, ট্রেনের ক্ষতি হলো। তারপরে বাংলায় যেদিন এই ট্রেনের উদ্ধোধন হলো, সেদিন সরকারী অনুষ্ঠানে আর এক বিতর্ক। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে হঠাৎ, কে বা কারা ‘জয় শ্রী রাম’ শ্লোগান তুললেন। তার প্রতিবাদে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলেন, যে তিনি ঐ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে একই মঞ্চ ভাগ করে নিতে অপারগ। তাই তিনি পাশের মঞ্চ থেকেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী শারিরীকভাবে উপস্থিত ছিলেন না, কিন্তু এই গোটা বিষয়টি তাঁর নজর এড়িয়ে গেছে, তা কোনও মানুষই কি বিশ্বাস করবেন?
তারপরে এই ট্রেন নিয়ে নতুন বিতর্ক চালু হলো। ঐ ট্রেনে কারা যেন পাথর ছুঁড়ে জানলার কাঁচ ভেঙে দিয়েছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলা শুরু করলেন, এই পাথর ছোঁড়া কি তাঁদের ট্রেন সরকারীভাবে উদ্ধোধনের দিনে ‘জয় শ্রী রাম’ শ্লোগানের বদলা? বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার দায়ী করলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য বলা শুরু করলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুই পারেন না, তাই তাঁর ক্যাডারেরা বন্দে ভারত ট্রেনে পাথর ছুঁড়েছেন। আইটি সেল থেকে মিম ছড়িয়ে দেওয়া হলো, তাতে স্পষ্ট ইঙ্গিত, মুসলমান মানুষজন ঐ পাথর ছুঁড়েছে। যেহেতু মালদাতে মুসলমান মানুষজন বেশী বাস করেন, তাই তাঁদের রাগের বহিঃপ্রকাশ এই পাথরছোঁড়া। ঘুরিয়ে বলতে চাইলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোট ব্যাঙ্ক যেহেতু মূলত মুসলমানেরা, তাই তিনি তাঁদের লেলিয়ে দিয়েছেন এই পাথর ছোঁড়াতে। বিষয়টি সেখানেও থেমে থাকেনি, ঐ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন ঢোকার আগেও। শুভেন্দু অধিকারী থেকে শুরু করে বিজেপির অনেকেই এই ঘটনার জন্য জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা বা এনআইএকে দিয়ে তদন্তের দাবী তুলেছেন। শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা। যে বা যাঁরা এই তদন্ত দাবী করছেন, তাঁরা কিন্তু খুব সন্তর্পনে একটা তথ্য চেপে গিয়েছেন, বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ট্রেনে কিন্তু এই ঘটনার আগেও পাথর ছোঁড়া হয়েছে, একবার মোদীর রাজ্য গুজরাটে আর একবার ছত্তিশগড়ে। সেখানে তো এই বিষয় নিয়ে হিন্দু- মুসলমান বিতর্ক উঠে আসেনি, তাহলে বাংলায় এই ঘটনার পিছনে কি অন্য কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আছে? কেউ বা কারা কি সচেতনভাবে এই কাজটি করিয়েছেন বা করাচ্ছেন?
এবার ফিরে যাওয়া যাক, ২০২১ সালের একটি ঘটনায়। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন উপলক্ষে সরকারী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ঐ একই রকমভাবে ‘জয় শ্রী রাম’ শ্লোগান দেওয়া হয়েছিল। সেদিন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনার নিন্দে করেননি। যদি সেদিন ঐ ঘটনার নিন্দে করা হতো, তাহলে কিন্তু ‘বন্দে ভারত’ অনুষ্ঠানে ঐ আওয়াজ তোলা হতো না। এবার আসা যাক, কেন এই শ্লোগান নিয়ে আপত্তি জানানো জরুরী? গত আট বছরে যেভাবে ঐ শ্লোগানকে সামনে রেখে সংখ্যালঘু মানুষকে পিটিয়ে মারা থেকে শুরু করে অত্যাচার করা হয়েছে, সেখানে এই শ্লোগানকে কি কোনও যুক্তিবোধ সম্পন্ন মানুষ একটি নির্বিষ শ্লোগান হিসেবে ভাবতে পারে? এই বাংলাতেও এই শ্লোগান দিয়ে একজন মাদ্রাসা শিক্ষককে ট্রেন থেকে মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে, এরপরেও যদি কেউ এই শ্লোগান শুনে ভয় পান, তাহলে কি তা অন্যায়? কোনও মানুষ যদি এই শ্লোগানকে ভয় পান বা এই শ্লোগান দেওয়া বা তার সমর্থন করতে আপত্তি জানান, তাঁকে কি তাহলে দোষী বলা যায়? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যদি তাঁর আপত্তি জানিয়ে থাকেন, নিশ্চিত উচিৎ কাজই করেছেন, কিন্তু আরো একটা কথা থেকেই যায়, এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন আগেই কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেছিলেন, তখন কি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, যে এই প্রধানমন্ত্রী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময়েই গুজরাট গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল? তিনি কি ভুলে গিয়েছিলেন এই প্রধানমন্ত্রী নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত মানুষদের নিয়ে কী বলেছিলেন?
যেই সময়ে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল, সেই সময়েও চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়া হয়েছিল এই মালদা অঞ্চল এবং আশেপাশের অঞ্চল থেকে। কিছু ছবি এসেছিল, দাড়িওয়ালা, লুঙ্গি ও ফেজ টুপি পরিহিত যুবক এই কাজটি করছেন। সেই ঘটনাকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, যাঁরা এই আন্দোলন করছেন, তাঁরা যে পোষাক পরে এই কাজটি করছেন, তা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কারা আসলে এই নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে। তাঁর স্পষ্ট আঙুল ছিল, মুসলমানদের দিকে। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, মুসলমান মানুষজনই মূলত দাড়ি রাখেন, ফেজটুপি ও লুঙ্গি পরেন এবং তাঁরাই এই কান্ড ঘটিয়েছেন। পরে দেখা গিয়েছিল, এই কান্ডে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই বিজেপি কর্মী, লুঙ্গি ও টুপি পরে মুসলমান সেজে এই কান্ড ঘটানোর জন্যই তাঁরা নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আসলে সমাজে মুসলমানদের সম্পর্কে আরো একটা বিরূপ ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। এবার ও যে বা যাঁরা পাথর ছুঁড়েছেন, তাদেরকে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে, তাঁদের সম্পর্কে যদি রটিয়ে দেওয়া যায়, যে তাঁরা সন্ত্রাসবাদী, তাঁরা আতঙ্ক ছড়ান এবং তাঁরা উন্নয়ন বিরোধী, তাহলে রাজনৈতিকভাবে কারা লাভবান হবেন?
এই কথাগুলো কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভুলে গিয়েছিলেন সেদিন, যেদিন তিনি অন্য একটি প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা করেছিলেন? নাকি তিনি সত্যিই মনে করেন, আদবানির চেয়ে মোদী খারাপ, মোদীর চেয়ে অমিত শাহ খারাপ? মুখ্যমন্ত্রী যেদিন বলেছিলেন, তিনি বিজেপির বিরোধী, কিন্তু আরএসএস বা সঙ্ঘ পরিবারের নয়, সেদিন কি তিনি আরএসএসের গত ১০০ বছরের কর্মকান্ডের কথা ভুলে গিয়েছিলেন? বিজেপি এবং আরএসএসের কোনও মূলগত তফাৎ নেই, এই নরেন্দ্র মোদী আদবানির সুযোগ্য শিষ্য, যে আদবানির নেতৃত্বেই দেশব্যাপী রথযাত্রা হয়েছিল এবং তার মধ্যে দিয়েই আজকের ঘৃণার রাজনীতির সূত্রপাত। বাবরি মসজিদ যেদিন ধ্বংস করা হয়েছিল, সেদিন যে করসেবকেরা সরাসরি এই কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা কিন্তু এই ‘জয় শ্রী রাম’ শ্লোগানই দিয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে না থাকলেও সংখ্যালঘু মানুষদের স্মৃতিতে কিন্তু গুজরাট গণহত্যা এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংস যথেষ্ট দগদগে স্মৃতি হয়েই আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো নবান্নে একান্তে অমিত শাহ্র সঙ্গে বৈঠক চলাকালীন আরো একটি কথা ভুলে গিয়েছিলেন, তাই ওনাকে মনে করিয়ে দেওয়া জরুরী, যে এই অমিত শাহ, গুজরাটের নির্বাচনের আগে গুজরাট দাঙ্গার স্মৃতি উস্কে দিয়ে বলেছিলেন, কিভাবে সংখ্যালঘু মানুষকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল।
আজকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করেও বলা যায়, তিনি যে বিজেপি এবং আরএসএসকে পৃথক করতে চাইছেন, তাতে কি খুব লাভ হবে? বিজেপি তো আরএসএসেরই রাজনৈতিক দল। তাই যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, বিজেপিকে আটকানোর, আরএসএসকে মতাদর্শগতভাবে হারানো জরুরী, তা কি তিনি বুঝতে পারছেন না ? যে আরএসএসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকর এবং সাভারকার কিন্তু সম্পুর্ণ মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন, সুতরাং তাঁদের মতাদর্শে দীক্ষিত আজকের নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহ কিংবা আদবানি বা রাজনাথ সিংহের কোনও পার্থক্য আছে? তিনি যতই বলুন।
ঘটনাচক্রে হয়তো ২০১৯ সাল থেকে বামেদের ভোট কমা এবং রাম অর্থাৎ বিজেপির ভোট বৃদ্ধির হার দেখিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখাতে চাইছেন এই বাংলায় রাম-বামের অলিখিত জোট চলছে। ঘটনাচক্রে হয়তো বামেরা বিজেপির তুলনায়, তৃণমূলকে বেশী করে রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করে, কিন্তু তা হলেও কি বিজেপি আরএসএসের এই পৃথকীকরণ করার রাজনীতি দিয়ে সবটা সামলানো যাবে? বিজেপি খারাপ আরএসএস ভালো, মোদীর তুলনায় আদবানি ভালো এই সব বললে হয়তো সাময়িকভাবে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে, কিন্তু মতাদর্শগত ভাবে কি এই ‘জয় শ্রী রাম’ সংস্কৃতিকে হারানো যাবে?