বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ তাঁর ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষ্টি কিন্তু সুইচ টিপলেই হয় না’ নিবন্ধে লিখছেন,“কেবল আইন কানুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে বসে গেলেই শিক্ষার প্রকৃত পরিবেশের সৃষ্টি হয় না। কফি হাউসের তর্কযুদ্ধও দরকার, আবার ক্রিকেট মাঠের উত্তেজনাও প্রয়োজন।…..বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষ্টি সুইচ টিপলেই হয় না। শিক্ষার সঙ্গে কৃষ্টি না থাকলে বিদ্যালয়ের আলোর জোগান কে দেবে? জ্ঞানের জ্যোতিই বা কোথা থেকে আসবে?খ্যাতির চূড়া থেকে নীচের অন্ধকারে পড়ে যাওয়া খুবই সহজ ব্যাপার-সেই পাতাল থেকে প্রতিষ্ঠানকে উপরে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। উৎকৃষ্ট করাই অনেক শক্ত। কিন্তু নিকৃষ্টকে উৎকৃষ্ট করা আরও কঠিন।” ন্যাকের খাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকৃষ্টতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠার কথাই নয়। বিশেষত তার মানের কাছে কোনো আপোষ ধোপে টেকে না। এ হেন বিশ্ববিদ্যালয় যখন অশান্ত হয়ে ওঠে একটি সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এবং তাতে রাষ্ট্র তার ক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষেত্র হিসাবে নিজের আধিপত্যকামী মনোভাবকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রক্তে ভেজায় প্রতিষ্ঠানের মাটিকে তখনই একরাশ প্রশ্নের জন্ম হয়। অধিকার কেউ কাউকে এমনি এমনি দেয় না তার জন্য লড়াই আন্দোলন যে অন্যতম হাতিয়ার আবার তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গে হলে তো কথাই নেই; তাতে আন্দোলনের ঝাঁঝ যে বাড়ে তা ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু যে মেধার চাষ হয় তা নয়; সেখানে নানা সময়ে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা (রাগিং, আত্মহত্যা ইত্যাদি)ও ঘটেছে যার ফলে তার উজ্জ্বলতা অনেকাংশে ম্লান হয়েছে সন্দেহ নেই,তবু তার যে প্রাতিষ্ঠানিকতার গর্ব ও শ্লাঘা যা দেশ বিদেশে বিস্তৃত তার ব্যত্যয় ঘটেনি।আর সেই অস্মিতা নিয়েই যাদবপুর আজ বিশ্বমানের তকমা পেয়েছে। একটি মুক্ত ভাবনা বিকাশের সর্বোচ্চ স্তর হলো বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে যেমন মুহুর্মুহু প্রশ্ন উঠবে তেমনি থাকবে চিন্তার বিকাশের পরিসর।তর্ক থাকবে, থাকবে তার সমাধান। মতের একীকরণ থাকবে দলের নামে, কিন্তু উচ্চশিক্ষার বিকাশে সব ছাত্রগোষ্ঠী একসুরে কথা বলবে। দাবি দাওয়া নিয়ে থাকবে সম্মিলিত উচ্চারণ আবার তাকে পরিচালনা করার মতো থাকবেন আচার্য কূল। বিচ্ছিন্নতাকে এক করে সমাধানের পরিসর বজায় থাকবে ক্যাম্পাসে।আমরা তো ভুলে যেতে পারিনা আমাদের শ্রদ্ধার শিক্ষক ডিরোজিওর কথা। ১৮২৬ সালের ১লা মে তারিখে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন হিন্দু কলেজের বিদ্যালয় শিক্ষা বিভাগে।তাঁর ছাত্ররা তখন মাত্র ১২ বা ১৬বছরের। তাঁরই বয়সের কাছাকাছি।ছাত্রদের মধ্যে কিভাবে যুক্তিবোধ, কর্তব্যবোধ ও মূল্যবোধের বীজ বপন করতে হয় ও তার মধ্যে কিভাবে তাদের ভুলত্রুটি সংশোধন করে এগিয়ে যেতে হয় তার শিক্ষায় শিক্ষিত করতেন তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্রদের।অচিরেই তাঁর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত পরিচালকমন্ডলী ১৮৩১ সালে তাঁকে বরখাস্ত করলেন কলেজ থেকে। ‘ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট’এর স্রষ্টা এই মানুষটি (তাঁর সৃষ্ট ছাত্রদের মধ্যে রাধানাথ শিকদার,রামতনু লাহিড়ী, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখের নাম করা যায়) তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কিভাবে আপোষহীন লড়াই করা যায় তার প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। আজ সেই ডিরোজিওরা অন্তর্হিত।দল, পক্ষ বা আরও কিছু ভেস্টেড ইন্টারেস্ট নিয়ে তাঁরা সব দেখেও না জানার ভান করে বসে থাকেন। ঘটনার ঘনঘটা মুখর ক্যাম্পাসে দায় ঠেলেন একে অপরের বিরুদ্ধে। তবু সত্যিটা সত্যিই থাকে।
কিন্তু একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় কেন কোয়ান্টা পরিমান ‘না’ নিয়ে চলবে আর তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেই ছাত্রছাত্রীদের একটি বিশেষ তকমায় ভূষিত করে নিন্দে মন্দ করতে হবে তার কোনো সদুত্তর রাষ্ট্রের কাছে নেই। কথা উঠেছে রাজনীতি বিবর্জিত ছাত্র আন্দোলনের। কিন্তু কী রাজ্য কী কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষার যাবতীয় নীতি যখন রাজনীতি ঠিক করে তখন পড়ুয়াদের কাছে রাজনীতি ছাড়া আর কোনো দ্বিতীয় অপশন থাকে না। তারাই ঠিক করে নেয় কোন রাজনীতি তারা গ্রহণ করবে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক না এর উত্তর চাওয়া আর গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে এনে নির্বাচিত সংসদ গঠন করার যে দাবী ছাত্র ছাত্রীদের তাতে শুধু প্রশ্ন তোলাই নয়, প্রতিষ্ঠানের পঠন পাঠনের সঙ্গে সংযুক্ত যাবতীয় বিষয়গুলির উন্নতি সাধনের বিষয়টি যে যুক্ত তা সরকারকে বোঝাবে কে! নইলে ভালো মন্দ, রক্তপাত, হিংসা যাবতীয় অসংসদীয় বিষয়গুলিকে হাতিয়ার করেও তো লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত, কো-অপারেটিভ এমনকি ডাক্তারদের নির্বাচন গুলিও এ রাজ্যে সংগঠিত হয়। যত আপত্তি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে।আসলে উত্তরটাও সরকারের জানা যে, গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিলে ওরা যত জানবে তত কম মানবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে ওরা প্রশ্ন তুলবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্তমূলে যে ভুলগুলি আছে এবং রাজ্য চালানোয় যে খামতি আছে তাকে এরা চ্যালেঞ্জ করে বসবে; তখনই রাষ্ট্র তার দাঁত নখ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ছাত্র ছাত্রীদের ওপরে। সাম্প্রতিক যাদবপুর যা আমাদের দেখাল। অনেকে আবার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশুদ্ধতা নিয়ে বেশি ভাবিত। তাঁদের কথায় ‘ছাত্রানাং অধ্যায়নাং তপ:”-অধ্যয়নই তাদের একমাত্র তপস্যা। এটা তপোবন কেন্দ্রিক ভাবনা সন্দেহ নেই। তাহলে গাছতলায় বসে যে লেখাপড়া আর চারদেয়ালের গন্ডিতে আবদ্ধ যে শিক্ষার ধরতাই তাতে তো ভিন্নতা থাকবেই। সেখানে পরিচালকদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে পরিকাঠামো বাড়াও, ভালো ল্যাব দাও, ফ্যাকাল্টি দাও, প্লেসমেন্টের সুযোগ থাকলে তা বাড়াও, গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াও ইত্যাদির কথা। আর নির্বাচন করে নির্বাচিত সংসদ গঠনের কথা তো আগে। নইলে পড়ুয়াদের সমস্যা তোলার প্লাটফর্ম কোথায় পাবে তারা। মজার বিষয় হলো তাহলে ভোটাধিকারের বয়স একুশ থেকে কমিয়ে আঠারো করা হল কেন! সে কী রাষ্ট্র সুকান্তের ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতা পড়ে ঠিক করেছে! আঠারোর পদধ্বনি এমনই যে বয়সে সে সরকার বা কোনো বিধিবদ্ধ সংস্থা গঠনে তার ভূমিকা পালন করতে পারে।ক্যাম্পাসে কেউ রক্তাক্ত হলে তার পাশে এসে দাঁড়াতে শেখে। যাদবপুরে যেমন ইংরাজি প্রথম বর্ষের আহত-রক্তাক্ত ছাত্র ইন্দ্রাজিত(রায়) -র হিস্ট্রি জিওগ্রাফি নিয়ে প্রশ্ন তুলে তার পাশে বৃহত্তর প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ কেন দাঁড়াবে সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে বিশুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে তখন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন না – “কে কোনখানে ঘুমোন সেটা একেবারেই গৌণ/দেখব তিনি কোথায় জেগে কোথায় নন মৌন।” পরিসর একটি সমাধান কিন্তু একমাত্র সমাধান নয়। আর তার জন্যই সংসদ গঠনের নির্বাচন জরুরী। কিন্তু দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি যে আমাদের ক্যাম্পাসগুলির সংসদ দীর্ঘ অবসরে চলে গেছে বহুদিন। যার কারণ হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন মতের পক্ষের ছাত্র ছাত্রীদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা, পরিকাঠামো উন্নয়ন কিংবা হস্টেল সমস্যা অথবা রাগিং নামক এই বীভৎসার নিকেষ কিভাবে করা যায় তার ডায়ালগ ওপেন করার বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন ভাবে কোনো কোনো ছাত্র সংগঠন কর্তাদের কানে তুললেও তার সমাধান বিরল। যাদবপুরের ছাত্র মৃত্যুর ঘটনার পরে পরেই আমরা দেখেছিলাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দলীয় ছাত্রদের সভায় বক্তৃতা করার সময় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বলেন,“পুজোর পর আপনাদের ছাত্রসংসদ নির্বাচন হবে। শান্তিপূর্ণভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে হবে। আমরা যেমন শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন করি আপনারাও তেমনভাবে করবেন। ”ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী এ কথা বলেছেন কিনা জানা নেই, তবে বিগত ১৪ বছরে যে দুবার ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়েছে তাতে অশান্তি অব্যাহত ছিল। যাদবপুরের ঘটনার পর আমরা ‘ছাত্রানাং অধ্যয়ণং তপঃ’ এই আপ্তবাক্যের উপর ছাত্রছাত্রীদের বিশ্বাসী করে তোলার পক্ষে নানান নিদান দিচ্ছি।কিন্তু জওহরলাল নেহেরুর কথায় মান্যতা দেওয়ার এতটুকু সাহস যদি আমাদের থাকে তবে ফিরে দাঁড়াতেই হয়। তিনি বলেছিলেন, “Students must always leave dangerously”। এ কথার প্রেক্ষিত বিচার করলেও সেই বাস্তবতায় আমাদের ফিরে যেতেই হয় তা হল মৌলিক প্রশ্ন তোলার বয়সে রাষ্ট্র কাঠামোর দুর্বলতাগুলিকে চিহ্নিত করা যেমন তাদের দায়িত্ব তেমনই রাষ্ট্র পরিচালকের শিক্ষার অভিমুখের বিপদের দিকগুলিকে চিহ্নিত করতে সেমিনার, মিটিং মিছিল ইত্যাদির ব্যবস্থা করে ছাত্র সমাজকে সচেতন করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ছাত্ররা কেন সংসদ নির্বাচন চাইবে বা তারা কেন ছাত্র রাজনীতি করবে এ ধরণের প্রশ্ন যখন ওঠে তখনই জ্ঞানভিত্তিক সমাজে আজকের দিকে জ্ঞান অন্বেষণ যেমন মুঠোফোনের একটি ক্লিকে পৃথিবীর কোথায় কী আন্দোলন কেন হচ্ছে তা জানিয়ে দিচ্ছে তেমনই একটি সিস্টেমের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে যে সব আন্দোলন গুলি হচ্ছে তাতে ছাত্রসমাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। পরিণত ছাত্রজীবনে স্থিতাবস্থার পক্ষে যাঁরা মত পোষণ করেন তাঁদের জেনে রাখা দরকার, যে ষাট সত্তরের ছাত্র আন্দোলনের যে অভিমুখ ছিল তারই পথ ধরে সমাজ বদলের পরম্পরা অব্যাহত থাকলেও আজকের রাজনীতি পরিচর্যার অভাবে খানিকটা হলেও দিকভ্রান্ত সন্দেহ নেই। যারই ফল হিসেবে হিংসা ও রক্তপাত একটি প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। তার জন্য সংসদ নির্বাচন অপেক্ষা করে থাকতে পারেনা। মুখ্যমন্ত্রীর কথার বাস্তবায়নের অপেক্ষায় ছাত্রসমাজ। কিন্তু তাঁর অন্যান্য ঘোষণা গুলি যত তাড়াতাড়ি আলোর মুখ দেখে এ ক্ষেত্রে কতটা দ্রুত তার বাস্তবায়ন ঘটবে তা আগামী দিন বলবে। এক কালের ছাত্রআন্দোলনের দামাল ঐতিহাসিক অসীম চট্টোপাধ্যায় তাঁর একটি নিবন্ধে লিখছেন, “লিংডো কমিশনের আচার সংহিতায় আমি ছাত্র আন্দোলনের যুক্তি দেখিনা। মতাদর্শই হলো ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতির জিয়নকাঠি। যখনই মতাদর্শ নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে, ছাত্রসমাজ উদ্বেল হয়েছে। স্বাধীনতার স্বপ্ন, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, কৃষিবিপ্লবের স্বপ্ন, দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষার স্বপ্ন তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। ”ছাত্রসমাজই পারে ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে। আমাদের বিস্মৃত হওয়ার কথা নয় ভিয়েতনামের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম ছাত্র সমাবেশ হয়েছিল আমেরিকার ওয়াশিংটনে। বন্দুকবাজদের হাতে আঠারো জন কিশোরের মৃত্যুর বিরুদ্ধে আট লক্ষ ছাত্রের সমাবেশ ঘটেছিল সেদিন।স্লোগান ছিল, ‘আমাদের জীবনের জন্য সমাবেশ।’ ক্যাম্পাসে ‘থ্রেট কালচার’, ভায়োলেন্স, ইত্যাদি বিষয় থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ক্যাম্পাসে নির্বাচিত সংসদ ফিরিয়ে দিয়ে ডেমোক্রেসি ফিরিয়ে আনা। তখন আর মন্ত্রীর জেড ক্যাটাগরি নিরাপত্তার প্রয়োজন হবে না। কোট আনকোট ‘রান ওভার’ হবে না ইন্দ্রানুজের। অভিনবদের পায়ে চোট লাগবে না, সতের জন পড়ুয়ার বিরুদ্ধে ঠিকানাহীন এফ আই আর হবে না, সুচরিতা, শাঁওলিদের ওপর ওসি স্বাতী বারিকের নির্দেশে অত্যাচার হবে না।আদিবাসী গবেষিকা ছাত্রী সুশ্রীতা সোরেনের হাতে গরম মোম ফেলে তার পায়ের ওপর মহিলা পুলিশ দাঁড়িয়ে পুলিশ ব্যারাকে ব্রিটিশ আমলের অত্যাচার হবে না। অন্তর্বর্তী উপাচার্যকে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না। রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী প্রায়শই বলেন, তিনি আন্দোলনের ফসল, আন্দোলন লগ্নে তাঁর জন্ম। অথচ,তাঁর সহকর্মীরা যখন এক মিনিটে ক্যাম্পাস দখল, তিরিশ সেকেন্ডে দখল কিংবা তৃণ মূলের দু-তিন হাজার লোক ঢোকানোর হুমকি দেন তখন এক অন্তঃসারশূন্য নীরবতায় তিনি মৌনব্রত পালন করেন। অন্যদিকে বিজেপি নেতার ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’তো আছেই! আমরা কি বিস্মৃত হয়েছি আর জি কর -র হামলা ভাঙচুর থেকে!
জরুরী অবস্থার সময় সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ একটি চিঠি লেখেন তাঁর প্রিয় পুত্রকে। তিনি লেখেন,“….কখনোই নিজেকে এলোমেলো ভাবনার হাতে সঁপে দিও না।ওতে লাভ হয় না।যে ভাবনা মনে প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং উত্তর পাওয়ার জন্য অস্থির করে তোলে, সেই চিন্তাই কাজের চিন্তা। এই ধরনের চিন্তাকেই মনে জায়গা দেবে।”যাদবপুরে তাই ঘটেছে। পড়ুয়ারা রাষ্ট্রের কাছে অনেক অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল! আর তার সমাধান হচ্ছে না বলেই তাদের আন্দোলন। হাইকোর্ট যখন প্রশ্ন তোলে, একপক্ষের বয়ানের ভিত্তিতে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অন্য পক্ষের বয়ান কোথায়!....এটা রাজ্যের ব্যর্থতা, কেনএই গোয়েন্দা ব্যর্থতা, এটা নিয়ে আরও সতর্ক না হলে গোটা রাজ্যে তার প্রভাব পড়বে। আমরা লক্ষ্য করলাম প্রভাব পড়েছে। বিরোধী পরিসরে আঘাত এসেছে।এবং অবশ্যই ইন্দ্রানুজের মেলকে এফআইআর-র মর্যাদা দিতে হবে বলে হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়।একদিকে শিক্ষামন্ত্রীকে গ্রেপ্তার ও তাঁর পদত্যাগের দাবী অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রীর ইন্দ্রানুজের বাবা-মা’র কাছে দুঃখপ্রকাশ এই দুই সমান ও বিপরীত ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মাঝে আরও এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আমাদের পরিবার ও সামাজিক প্রক্রিয়ার অভ্যন্তরে। পরিবার গুলো যেমন অনেক আগেই ভেঙেছে এখন আরও ভাঙছে মত ও মতান্তরে, কোথাও কোথাও মনান্তরে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছে বড়ো একলা হয়ে পড়ছে।এ এক নিদারুণ বিচ্ছিন্নতা যা পরিবার গুলিকে গ্রাস করছে। একা একা আত্মহনন আগেও আমরা দেখেছি এখন এক একটা গোটা পরিবার আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। সবাই সবার কাছে অচেনা।কেউ কারো মনের নাগাল পায় না।ঠিক তার পাশটিতে যে বসে আছে সে তার সন্তান স্ত্রী কন্যা স্বামী যেই হোক না কেন প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছে কী যেন আড়াল করে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ঠিক যেমন যাদবপুরের ইন্দ্রানুজের অধ্যাপক বাবা যখন বলেন, ‘ছাত্র ছাত্রীরা একদিকে আহত হয়েছে আর তাদের বিরুদ্ধেই মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হল। এই অভিযোগ গুলি তুলে না নিলে বোঝা যাবে ওঁর কষ্টটা কষ্ট নয়। ওটা শুধু মুখের কথা।…যেভাবে সেদিন ঘটনাটা ঘটানো হয়েছে তাতে কি তারা চেয়েছিল ছাত্ররা মরে যাক? হয়তো তারা তাই চেয়েছিল।’ অন্য দিকে ইন্দ্রানুজের অধ্যাপিকা মা বলছেন,…‘এটা অ্যাকসিডেন্ট। ইচ্ছাকৃত নয় এবং এটা কেউই চায়নি। ওই সময় উনি(মন্ত্রী)যদি জানতেন এটা হবে উনি কিছুতেই গাড়ি চালাতে দিতেন না। এটা আমি বিশ্বাস করি।’ বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। কিন্তু অমর্ত্য সেনই তো তাঁর ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ গ্রন্থে বলেছেন, ভারতীয়রা সব কিছুকে যুক্তি বোধ ও বিচারের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করে। এককথায় সবকিছুকে বাজিয়ে নেয়। কিন্তু ইন্দ্রানুজের বাবা ও মা’র বয়ানে যে ভারসাম্যের অভাব তা কি আমাদের আস্বস্ত করছে! এ প্রশ্নের সমাধান তো ইন্দ্রানুজ নিজেই করে দিয়েছে মিডিয়ায়।আহত অভিনব (বসু)-র বাবা তো স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ‘অভিনব বাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আমি তৃণমূল করি, ফলে আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ এক নয়। এই কারণেই আমাদের সম্পর্ক নেই।’ গণতন্ত্রে এটাই যেমন স্বাভাবিক তেমন অস্বাভাবিকও খানিক। সম্পর্ক অপেক্ষা মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার মাঝের দ্বন্দ্বটি পরিস্কার।যেখানে ইন্দ্রানুজ ও অভিনব তাদের নিজ নিজ অভিভাবকের কথাকে শ্রদ্ধা রেখেই নিজেদের মননে মতাদর্শের চ্যাপ্টার ওপেন করেছে। কঠিন হলেও বাস্তব যে, মতাদর্শই ক্যাম্পাস রাজনীতির চাবিকাঠি। আগামীর দেশনায়কেরা তো সেভাবেই বৃহত্তর রাজনীতির আঙিনায় এসেছেন।