মানুষ সভ্য হয়েছে। আমরা পাশবিক আর মানবিক শব্দ দুটোকে আলাদা করেছি। কিন্তু পাশবিক হিংসা ও প্রতিহিংসার আস্ফালন এতটুকু কমেনি। নারীঘাতী শিশুঘাতি কুৎসিত বীভৎসা প'রে ধিক্কারের বদলে চলছে প্রতিহিংসার বড়াই প্রদর্শন। আর মজার ব্যাপার হলো, যুদ্ধক্ষেত্র অগ্নুৎপাত রক্তপাত থেকে যে যত দূরে, তার কন্ঠে প্রতিহিংসার আস্ফালন ততই বেশি। স্টুডিওর ঠান্ডা ঘরে অ্যাঙ্কার ও বুদ্ধিমানদের দাপাদাপি, মারো মারো ওঠে হাঁকি। এ যেন রোমানদের বধ্যভূমিতে গ্লাডিয়েটরের লড়াই অথবা ওয়ার্ল্ড রেসলিং এর সেই মঞ্চ। আমরা তার পিশাচ, নির্বোধ, রক্তলোলুপ, দর্শক।
মধ্যযুগের যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল কিছুটা নৈতিকতা সম্মত। আমরা শুনেছি সন্ধ্যার পর যুদ্ধ বন্ধ থাকত। একটি নির্দিষ্ট রণাঙ্গনে যুদ্ধ হতো, দুই পক্ষের সামরিক সশস্ত্র বাহিনী সেখানে অংশ নিতো। অর্থাৎ কোন নিরস্ত্র, অসামরিক মানুষের মৃত্যুর সুযোগ থাকত না। পানিপথের যুদ্ধ, খানুয়ার যুদ্ধ, কালিঞ্জরের যুদ্ধ, সেডানের যুদ্ধ, ট্রাফালগারের যুদ্ধ, এরকম কত না রণাঙ্গনের নাম ইতিহাসের পাতায়। ওই সমস্ত যুদ্ধে অসামরিক মানুষের পরোক্ষ আগ্রহ থাকতে পারে, তাদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অহম পুষ্ট হতে পারে। ফলে তাদের আগ্রহ থাকতে পারে। কারণ সরাসরি তাদের কোন ক্ষতি নেই।
মনে আছে, প্রাশিয়ার সম্রাটের কাছে ফরাসি দূত একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। প্রাশিয়ার সম্রাট সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। দূত দেশে ফিরে যায়। এরপর সম্রাট এই ঘটনাটি টেলিগ্রাম করে (এমস্ টেলিগ্রাম) প্রাশিয়ার চ্যান্সেলর বিসমার্ক কে জানালেন। বিসমার্ক টেলিগ্রামটির একটু বিকৃতি ঘটিয়ে সংবাদ মাধ্যমে পরিবেশন করেন যে -- প্রাশিয়ার সম্রাট ফরাসি দূতকে "চরম অপমান করে" তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। একদিকে ফ্রান্সের সম্রাট লুই বোনাপার্ট যখন দেশের জনগণকে বোঝাচ্ছেন প্রাশিয়া ফ্রান্সের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে মাত্র। আর তখন সংবাদ মাধ্যম প্রচার করেছে, প্রাশিয়া ফরাসি দূতকে "চরম অপমান করে" প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। ফরাসি জনগণের ধারণা, লুই বোনাপার্ট জাতীয় অপমানকে গোপন করে, অপমান হজম করছেন। এই "চরম অপমান"কে ঘিরে সারা দেশ লুই বোনাপার্টকে প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য করলো। বিসমার্ক ঠিক এটাই চাইছিলেন, ফ্রান্স আগে আক্রমণ করুক। পরিণতি সেডানের যুদ্ধ, ১৮৭০-৭১ সাল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে যুদ্ধের চরিত্র অনেক পাল্টে গেছে। আগে পরাজিতের কাছ থেকে বিজয়ী শক্তি ক্ষতিপূরণ আদায় করতো। এটা অর্থে হতে পারে অথবা কোন অঞ্চল ভূখণ্ড অঙ্গীভূত করার মাধ্যমে। কারণ যুদ্ধের ফলে অনেক আর্থিক ও সামরিক ক্ষতি হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই ক্ষতিপূরণের ধারণাটা পাল্টে যায়। কারণ যুদ্ধ হয়েছিল আকাশ পথে। বোমাবর্ষণ হয়েছে আকাশ থেকে। শুধু সামরিক ক্ষতি নয়, বহু অসামরিক নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই war indemnity র পরিবর্তে reparation আদায় করা হয়। এখন যুদ্ধ আর নির্দিষ্ট রণাঙ্গনে আবদ্ধ থাকলো না। অসামরিক নাগরিক জনপদেও তা প্রসারিত হল।
এখানেই দেখা দিল যুদ্ধের বিপদ যুদ্ধ আর সামরিক ক্ষয়ক্ষতি ও পেশাদার দের মধ্যে আবদ্ধ রইল না তা সাধারণ নিরীহ মানুষ বৃদ্ধ নারী শিশু হাসপাতাল স্কুল সকলকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশেষভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধ পৃথিবীর দেশে দেশে সাধারণ অসামরিক মানুষের মধ্যে যুদ্ধ বিরোধী মনোভাব তৈরি করতে লাগলো খোদ মার্কিন মুলুকে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নামল ভিয়েতনাম থেকে হাত ওঠাও দাবিতে। মিডিয়ার সামনে সেই আমেরিকান মায়ের করুন আর্তি ও প্রতিবাদ আমরা ভুলতে পারিনা -- I lost my son in Vietnam, that useless war. I don't want to lose another in Gulf War. It's much painful to me to think that even today a war is necessary to solve problems. যুদ্ধের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে একটা জনমত গড়ে উঠতে লাগলো এই অবস্থায় যুদ্ধের সমর্থনে দার্শনিক ভিত্তিটাও পরিবর্তিত হতে বাধ্য। কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদ, ভ্রান্ত দেশপ্রেম, শুধুমাত্র এগুলো যুদ্ধের সমর্থনে সেভাবে সক্রিয় থাকছে না। বরং যুদ্ধের বীভৎসতা মানুষকে অনেক বেশি মানবিক চিন্তায় আচ্ছন্ন করেছে।
নতুন দার্শনিক ভিত্তির সমর্থনে একটা নতুন আখ্যান রচনা করা হলো। বোধ করি গালফ ওয়ারেই প্রথম এটা চালু হয়। যুদ্ধের সরাসরি সম্প্রচার এবং সেই সম্প্রচারের সম্পূর্ণ বরাত দেওয়া হল একমাত্র সিএনএনকে। তারা যুদ্ধকে দূরদর্শনের পর্দায় ধারাবাহিক সম্প্রচারের মাধ্যমে পিক্টোরিয়াল করে তুললো। যেন গালফ ওয়ার একটি হলিউডি সিনেমা বই অন্য কিছু নয়। যুদ্ধের সরাসরি সম্প্রচার একটা বিনোদনের বিষয়ে পরিণত হলো। তার পাশাপাশি আরেকটি ভাষ্য জ্যামিতিক নকশার মধ্য দিয়ে, ডেমোর মাধ্যমে প্রচারিত হলো। কিভাবে উপগ্রহের মাধ্যমে শত্রুর অবস্থানকে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং ক্ষেপনাস্ত্র কে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্র সেই নির্দেশ মাফিক নিখুঁত নিশানায় একটি হোটেলের নির্দিষ্ট একটি ঘরে আঘাত হানতে সক্ষম। আধুনিক যুদ্ধ করছে কম্পিউটার, উপগ্রহ। একটাও নিরীহ অসামরিক মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এই প্রচারটা মানুষের মনে ধরা খুবই স্বাভাবিক। বিশেষভাবে সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি যখন হচ্ছে না তখন যুদ্ধ অনেক বেশি মানবিক। আর বিশেষভাবে কম্পিউটার, উপগ্রহ, রোবটিক টেকনোলজি, এগুলির প্রতি মানুষের আস্থা প্রায় ঈশ্বর ভক্তির সদৃশ্য। কম্পিউটার প্রযুক্তি মানেই তা অভ্রান্ত এগুলোকে প্রশ্ন করা যায় না। একেই বোধ করি প্রযুক্তির কুসংস্কার বলা হয়ে থাকে। ফলত দেশে দেশে যুদ্ধ বিরোধী যে মানবিক মুখ সোচ্চার হয়েছিল, ১৯৭০-৮০ দশকে ১৯৯০ এর দশকে এসে সেটা অনেকাংশে পাল্টে গেল।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যদি এত নিখুঁত নিশানায় শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ পরিচালিত হয়, তাহলে বাগদাদের পথে এত লক্ষ লক্ষ মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার দৃশ্যগুলো কোথা থেকে এলো? রেড ক্রসের হাসপাতাল, শিশুদের স্কুল, ত্রাণ শিবির, খাদ্যের গুদাম, এমনকি হোটেলে দেশ - বিদেশের সাংবাদিকদের অবস্থান লক্ষ্য করে মিসাইল ছোঁড়া হয়েছে। শাসক খোঁড়া যুক্তি হাজির করে বলেছে, সাংবাদিক ফটোগ্রাফারদের এসএলআর ক্যামেরাগুলো চিনতে কম্পিউটার ভুল করেছে। তারা ওগুলিকে অস্ত্র ভেবেছে। আর ড্রোন বড়জোর কিছু ছবি পাঠাতে পারে অথবা লুকিয়ে থাকা জীবটিকে চিহ্নিত করে আঘাত হানতে পারে। কিন্তু সেই লুকিয়ে থাকা জীবটি শত্রু নাকি মিত্র সেনা, নাকি মেষ পালক, তা বুঝতে পারে না। তা যদি বুঝতই, তাহলে পাঠানকোটে ড্রোন টেকনোলজির পাহারা পাকিস্তানি জঙ্গিদের চিনতে ব্যর্থ হল কিভাবে? কারণ তারা পাঞ্জাবের পুলিশের ঊর্দ্দি পরে, পুলিশের গাড়িতে চেপে এসেছিল। অর্থাৎ আক্রমণে যে নিখুঁত নিশানা precision এর কথা বলা হচ্ছে সেটা অনেকাংশেই গাল গল্প। যুদ্ধকে মানবিক রূপ দেওয়া বা গ্লোরিফাই করার অপচেষ্টা।
জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেমের আফিম, জঙ্গি নিধন, এ সবই যুদ্ধের সমর্থনে জনমতকে প্রভাবিত করবেই, না হয় করলো। অন্যদিকে প্রচার মাধ্যম জানাতে থাকলো নিখুঁত নিশানায় আমরা নটি জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিলাম। জানাবেনই। প্রতিপক্ষ "ওরা" আমাদের অসামরিক নারী শিশু বৃদ্ধের উপর আক্রমণ চালিয়েছে (precisionless)। আমাদের যুদ্ধ মানবিক, আর ওদের যুদ্ধ অমানবিক, সভ্যতা বিরোধী। একবার আমাদের সিয়াচেন সীমান্তের জওয়ানদের কথা ভাবুন। মাইনাস ১৫ ডিগ্রিতে বিনিদ্র রজনী যাপন করছে। একবার ভাবুন এই জওয়ানরা শত শত মাইল দূরে স্ত্রী পুত্র পরিবারকে ফেলে রেখে এসেছে, দেশ সেবায় রত। এমন একটা ভাব যেন, সিয়াচেন সীমান্তের ওপারে পাক জওয়ানটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নিদ্রা দিচ্ছে সপরিবারে। এভাবে একদিকে আমরা ওরা র আখ্যান, সেই সাথে আমার যুদ্ধ মানবিক, আর ওদের যুদ্ধ অমানবিক, সভ্যতা বিরোধী। এটাই যুদ্ধের দর্শন, যুদ্ধের পেছনে তাত্ত্বিক বৈধতা দানের প্রয়াস। ।
একবার সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে গেলেই ছবিটা যাবে পাল্টে। ঠিক একই বয়ান এবং আখ্যান। শুধু শোনা যাবে ভিন্ন স্বরে, ভিন্ন সুরে, ভিন্ন কন্ঠে। কে যেন বলেছিলেন (বহু কথাই জর্জ বার্নাড শ' এর নামে চালিয়ে দেওয়া হয়), যে কোন যুদ্ধে সবার আগে মারা পরে "সত্য"। আর অস্ট্রেলিয়ার যুদ্ধ সাংবাদিক জন পিলগার বলেছিলেন -- আর যার কথাই বিশ্বাস করুন, যুদ্ধের সময়ে কোন সরকারের কথা বিশ্বাস করবেন না। কারণ সমস্ত সরকার চালায়, ভেড়ার চামড়া গায়ে জড়ানো কিছু নেকড়ের দল।