পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

শেষ বিচারে মানুষ বাঁচবে তো ?

  • 13 December, 2019
  • 0 Comment(s)
  • 2302 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
আসামে ক্যাব বিরোধী আন্দোলন হচ্ছে সেটা কিন্তু বিজেপি বিরোধী হলেও তাতে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ তাঁরা চাইছে আরও কঠিন ভাবে এনআরসি আনা হোক, যাতে আরও বেশী মানুষকে বাদ দেওয়া যায়, আরও বেশী মানুষকে রাষ্ট্রহীন করা যায়, আর রাস্ট্রহীন হলে সেই মানুষটিকে কম পয়সায় বা সেই অর্থে বিনা পয়সায় ক্রীতদাস বানানোর প্রক্রিয়ার নাম এই ক্যাব- এনআরসি।  

অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা
জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা!
জয়হে, জয়হে, জয়হে, জয় জয় জয়, জয়হে

এই হচ্ছে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের একটি অংশ। যা কখনই বলে না যে মুসলমানেরা এদেশের নাগরিক নয়। অনেকেই বলতে পারেন যে নতুন বিলে তো বলা হয়েছে যে যারা এদেশে এসেছেন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে তাঁদের জন্য এই আইন প্রযোজ্য হবে। তাহলে আমরা কি চাইনা যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা এদেশ থেকে চলে যাক? অবশ্যই চাই। কিন্তু কিভাবে সম্ভব সেটা? আসলে এখানেই আসল খেলা। এই ক্যাব এবং এনআরসিকে দেখতে হবে একই মুদ্রার এপিঠ এবং ওপিঠ হিসেবে। ধরা যাক একজন ঝাড়খণ্ডের গরীব হিন্দু এনআরসির তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তাহলে কি তাঁকে ক্যাবের মাধ্যমে বাংলাদেশের থেকে আসা শরণার্থী হিসেবে গণ্য করা হবে? তাঁকে কি তখন বলা হবে তিনি যদি নিজেই নিজেকে প্রত্যয়িত করেন যে তিনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে তাহলেই কি তিনি এদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন?

তাহলে কি দাঁড়ালো একজন হিন্দু গরীব মানুষকে মিথ্যেবাদী হতে হবে আর নয়ত সে ক্যাব এবং এনআরসির তালিকা থেকে বাদ পড়বেন। ধরা যাক কোনও মানুষের বাবা মারা গেছেন ১৯৯৫ সালে, বেঁচে থাকলে হয়তো জিজ্ঞেস করা যেত কি ভাবে কোন অত্যাচার সহ্য করে এসেছিলেন। কিংবা তাঁর বাবা মানে, প্রপিতামহ কিভাবে এসেছিলেন। আর যদি এসেও থাকেন সেটা কিভাবে এখন প্রমাণ করা সম্ভব?

আচ্ছা এরপর ধরা যাক আগামীকাল থেকে প্রতিবেশী যে দেশগুলোর কথা বলা হচ্ছে সেখান থেকে যদি হিন্দু এবং মুসলমান বাদে অন্যদের বিতারন শুরু হয়ে যায়, তাহলে ভারত কি করবে?

এনআরসির তালিকা থেকে বাদ হলে কি হবে ? আসামের প্রাক্তন পুলিশ অফিসার হিরণ্য কুমার ভট্টাচার্য, কিছুদিন আগেও বিজেপি-র উচ্চ কোটির নেতা ছিলেন। সম্প্রতি তিনি বলতে শুরু করেছেন যে এন.আর.সি তালিকাছুট অবৈধ অভিবাসী হিসাবে পাওয়া লোকদের নিয়ে একটি লেবার ফোর্স" তৈরি করাই একমাত্র বাস্তব উপায়। তিনি বলেন, এই লেবার ফোর্স" এর অংশ হওয়া এন.আর.সি তালিকাচ্যূত লোকেরা একটি নির্ধারিত স্থানে বাস করবে এবং তাদের নিয়মিত নাগরিকদের থেকে আলাদা করে পরিচয়পত্র সরবরাহ করা হবে। যেহেতু এখন স্পষ্ট যে বাংলাদেশ এখানে আসা লোকদের ফিরিয়ে নেবে না। এন.আর.সি চূড়ান্ত তালিকায় লক্ষ লক্ষ লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে যাবে, তাই তাদেরকে লেবার ফোর্স হিসাবে সংগঠিত করাই যায়। আজকে যে আসামে ক্যাব বিরোধী আন্দোলন হচ্ছে সেটা কিন্তু বিজেপি বিরোধী হলেও তাতে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ তাঁরা চাইছে আরও কঠিন ভাবে এনআরসি আনা হোক, যাতে আরও বেশী মানুষকে বাদ দেওয়া যায়, আরও বেশী মানুষকে রাষ্ট্রহীন করা যায়, আর রাস্ট্রহীন হলে সেই মানুষটিকে কম পয়সায় বা সেই অর্থে বিনা পয়সায় ক্রীতদাস বানানোর প্রক্রিয়ার নাম এই ক্যাব- এনআরসি।

তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন যে আসাম দেশের অন্যান্য অংশে "শ্রম রপ্তানিকারক" হতে পারে। তিনি বলেছিলেন যে এই জাতীয় লোকদের "মৌলিক মানবতা" অনুসারে কোন আইনগত অধিকার থাকবে না। বিজেপি থিংক-ট্যাংক এই প্রস্তাব লুফে নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে গোপনে পরিকল্পনা হয়েছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে এন.আর.সি প্রক্রিয়ায়। ক্যাব মুসলিম ব্যতিরেকে অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠিগুলিকে নাগরিকত্ব দেবে। আর এন.আর.সি মুসলিম সহ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অভিবাসীদের নাগরিকত্ব হরণ করবে। বিভাজন সম্পূর্ণ হবে। আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া চিহ্নিত দলিত আর মুসলিমরা লেবার ফোর্সের অন্তর্ভূক্ত হবে। তাদের কোনও নাগরিক অধিকার থাকবে না, কারণ তারা তো রাষ্ট্রহীন। গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে ডিটেনশান সেন্টার তৈরী হতে চলেছে। আনডিসক্লোজড অভিবাসীরা আগামী দিনে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে

এনআরসি এবং ক্যাবকে দেখতে হবে এক করে। এটা নিয়ে যদি পার্লামেন্ট কিছু না করতে পারে তাহলে কি সুপ্রিম কোর্টের উপর ভরসা করা যায়? যে সুপ্রিম কোর্ট সংখ্যাগুরুর বিশ্বাসকে মর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়ে একটা মুসলমান স্থাপত্যকে ভেঙে রামমন্দির গড়ার রায় দেয়, যে সুপ্রিম কোর্ট কাশ্মীর ৪ মাস যোগাযোগ বিহীন অবস্থায় থাকে তাও তাঁদের টনক নড়ে না, তাহলে কি করনীয় থাকে? তখন কি মনে হয় না যে রাস্তায় নেমে মুসলমান হোক বা অন্য কারুর জন্য যে কেউ বাদ যাবেন তাঁর জন্য পাশে দাঁড়ানোটাই কর্তব্য?

শেষ বিচারে তো গরীব নিরন্ন মানুষেরাই বাদ পড়বেন। তাই নয় কি? আজকে সকালে সরকারী দামের পিঁয়াজের দোকানে দেখলাম অনেকে বলছেন ২০১৬সাল থেকে শুধু লাইন দিয়েই চলেছে মানুষজনপ্রথমে নিজের টাকা তোলার জন্য নিজে যে কালো টাকার মালিক নয়, তার জন্য লাইন দিতে হয়েছে ব্যাঙ্কেতারপর নিজে সন্ত্রাসবাদী নয় তা প্রমাণ করার জন্য মোবাইল এবং ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধার সংযোগের লাইনতারপর আধারের সঙ্গে রেশন কার্ডের যোগ করে সেই কার্ডকে ডিজিটাল করা এবংএকদেশএকরেশনকার্ড করার লাইন, কারণ সেটা নাকি আবার পরিচয়পত্র হয়ে উঠবে
যারা মনে করছেন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবিতে তাঁদের কোনও অসুবিধা হবে না, তাঁদের জন্য প্রশ্ন কিভাবে এটা প্রমাণ করা সম্ভব? কারণ একজন সেই অর্থে অনুপ্রবেশকারী চিহিত করার উপায় কি? যদি কেউ অবৈধভাবে এসেই থাকেন, তিনি তো সবার আগে তাঁর ‘বৈধ’ কাগজ বানিয়ে নিয়েছেন। তাহলে তো ঘুরিয়ে এটাই দাঁড়ালো যে যার কাছে বৈধ কাগজ নেই, সেই অবৈধ। রাস্ট্র যদি তাঁর নিজের নাগরিকদেরই সন্দেহ করে সেই রাস্ট্র উন্নতিতে সেই মানুষটি কাজে লাগবে কি করে? এটা তো সেই ‘নোটবন্দী’ র যুক্তি, কালো টাকা ফেরানোর জন্য সবাইকে নিজের ঘরের টাকা ব্যঙ্কে জমা দিয়ে প্রমাণ করতে বলা যে সে কালো টাকার মালিক নয়? আসামের ক্ষেত্রে ১৬০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, ৬ বছর লেগেছে, এখনও প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি, পুরো ভারতের ক্ষেত্রে কত টাকা ব্যয় হবে, কত বছর লাগবে? তারপরেও কি বলা যাবে যে দেশ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মুক্ত হল? এতসব বলার পরেও হয়তো মানুষ বলবেন, দেখা যাক না কি হয়, কিন্তু মরে বেঁচে থাকার মতো অবস্থায় চলে যাওয়ার পরেও যদি চুপ করে থাকছে মানুষ, ভাবছে আমি তো বেঁচে যাব। সত্যি বাঁচবেন তো?

0 Comments

Post Comment