বাবা কমিউনিস্ট মুর্মু।মেয়ে তীব্রতা মুর্মু।যাদের তিনকূলেও মাধ্যমিকের গন্ডী ডিঙোতে পারেনি কেউ। অথচ গতকাল এই আদিবাসী ভাগচাষীর ঘরেই এক অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে তার মেয়ে।অঘটনই তো।বাংলায় লেটার নিয়ে মাধ্যমিক পাশ করে ফেলেছে তীব্রতা।অথচ কাস্টসার্টিফিকেটই নেই তার।তিনকূলে কারও ছিলনা এসব কাগজ।তাই আজ অবধি সরকারি কোন সুযোগসুবিধেও পায়নি এ পরিবার।আর তীব্রতার বাবাও জানেননা এসব সুবিধে পাবার কথা। মা তো পৃথিবীতেই নেই। সেকারণেই সকাল সকাল বাবার সাথে তীব্রতা ছুটছে কাস্ট সার্টিফিকেটের স্পেশাল ক্যাম্পে।স্টাইপেন পাবে বলে।না ব্লকঅফিস যেতে হবে না।সরকারি নির্দেশে অফিসই নাকি আজ ছুটে এসেছে তীব্রতার গ্রামের দোরগোড়ায়।সকল আদিবাসীদের কাস্টসার্টিফিকেট দ্রুত দিতে নির্দেশ জারির ফল।তাই এ আদিবাসী পাড়ায় খোলাআকাশের তলেই আজ বসেছে টেবিলেচেয়ারের জমজমাট অফিস।কেননা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে,তফশিলি জাতিউপজাতি বা অনগ্রসর শ্রেণীর মাঝে,এই উপজাতি শ্রেণীরই নাকি শংসাপত্র গ্রহণে সবচেয়ে বেশি অনীহা।তাদের অধিকাংশদের যোগ্যতা থাকলেও একমাত্র উপযুক্ত নথির অভাবে তারা নাকি প্রমাণ করতে পারেননা ,তারা আদিবাসী।আসলে নুন আনতে পানতা ফুরনো সংসারে ফাইলে সযত্নে ছেলেমেয়ের জন্মশংসাপত্র,নিজের সচিত্রপরিচয়পত্র, রেশন কার্ড আগলে রাখাই তো এক বিলাসিতা। তাই খোঁজ নিয়ে জানা যায়,বন্যায়,আগুনে, বৃষ্টিতে তাদের অনেকের ঘরেই এসব নথি মিসিং।তাই ওদের ভোট নেই।সরকারি সুবিধেও নেই।আসলে সমাজের মূলস্রোতের থেকে এতগুলো বছর পেরিয়েও তারা বিচ্ছিন্ন।আক্ষরিক অর্থেই সংযোগহীন। এক আধিকারিক বলেছিলেন,পৃথিবীর আদি বাসিন্দাদের কাছে তো ক্যাম্পে বাসিন্দা শংসাপত্র চাইতেই লজ্জা লাগে।যারা পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে আছেন,তাদেরকেই স্বীকৃতি দিতে এতো টালবাহানা।এটা চাই।ওটা চাই।তাই সরকারি নিয়ম তাদের জন্য অনেক শিথিল করেও তফশিলি উপজাতিভুক্ত মানুষদের শংসাপত্র প্রাপ্তির সংখ্যাহার বাড়ানো যাচ্ছেনা। কারণ তারা মনেপ্রাণে এখনো বিশ্বাস করেন,পড়ালেখাই যখন বংশে নেই,তখন অহেতুক গাড়িভাড়া দিয়ে ,কাগজপত্র ব্লক অফিসে জমা দিয়ে সামান্য একটা কাগজের জন্য ছুটে কী লাভ?আর এই কাগজ থাকলে চাকরিতে সুবিধে হতে পারে,শুনেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছিলেন কমিউনিস্ট মুর্মু।বললেন,আমাদের ঘরে চাকরি?আসলে এই বিশ্বাসটাই তো চুরমার হয়ে গেছে তাদের।অভাব,অশিক্ষা,দারিদ্র্য ক্রমশ তাদের দাবি জানানোর স্পর্ধা কেড়ে নিয়েছে।নিজেদের অধিকার যে কারো সহানুভূতি নয়,অনুভব করতেই পারেনি তা।তাই যারা সংরক্ষণব্যবস্থা তুলে দেবার পক্ষে চিঠি লেখেন কিংবা সরকারের দপ্তরে,বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শ্রেণীর মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে উপজাতি উন্নয়নের সিদ্বান্তের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন ,তারা ভুল করেননা। একটা অন্যায় করেন।কেননা যে শ্রেণীর অধিকাংশ মানুষ আজও জানেননা,একটা তফশিলি উপজাতি শংসাপত্র মানে কী,এর কার্যকারিতাই বা কতটা,বা তাদের পারিবারিক সুখের জন্য এ সরকারি কাগজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ,সেই শ্রেণীর মানুষকেই সংরক্ষনের কক্ষচ্যূত করার দাবি উঠলে তাদের সমাজটাই হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে।হারিয়ে যাবে তাদের ভাষা,সংস্কৃতি।হারিয়ে যাবে পৃথিবী জন্মের মূল ইতিহাস।তাই সংরক্ষণ মানে যারা ভাবেন কোন মুন্ডা বা চন্ডাল মেয়ে সর্বনিম্ন নম্বর পেয়েও স্লেট পাশ করার অনধিকার সুযোগ নিয়েছেন বা অফিসের পদোন্নতিতে সোরেনবাবু কেন এতো অল্পদিনেই এগিয়ে গেলেন ফিফটিপয়েন্ট রোষ্টারের যাদুবলে,তারা ভুল ভাবেন।
আসলে একটা পিছিয়েপড়া জাতিকে যদি রাষ্ট্র সুবিধে না দেয়,কে দেবে? এটুকুও তুলে দিলে বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, প্লেনে ,কলেজে, অফিসে, স্কুলে ,খেলারমাঠে, নাটকের মঞ্চে যে সেই অপমানের তালিকা আরো দীর্ঘতর হবে।দিকে দিকে অসম্মানের সমাধি তৈরি হবে আদিবাসী ঘরে,আদিবাসী পাড়ায় পাড়ায়। তাই সমাজের পিছিয়েপড়া মানুষদের জন্য এক ছিটেও যদি ভাল কিছু করার সুযোগ থাকে,তাকে পূর্ণতা দেওয়াই তো যথার্থ মানবতা।
না স্টিফান হোরোর মত সংস্কৃত উচ্চারণ করে হয়তো কোনদিন চমকে দিতে পারবে না তীব্রতা।কিন্তু খড়ের চালের নিচে সেদিন ওর পড়ার বইয়ের পাশেই নির্লিপ্ত পথেরপাঁচালী বইটি দেখে চমকে ওঠেন মাস এডুকেশন অফিসার।তীব্রতা বলেছিল,আধপেটা দিনগুলোয় অপুই নাকি ওর পেট ভরিয়ে দেয়।দুর্গার সাহসই চরম অভাবেও নাকি ওর মাধ্যমিক পাশের স্বপ্নকে মরতে দেয়নি।তাই কোন বই কখন যে কার জীবনের গীতা হয়ে যায়,তার হদিশ দিতে পারে একমাত্র সময়।তবে কমিউনিস্ট মুর্মু আজও বুঝতে পারেনি,তার মেয়েকে নিয়ে সেদিন কেন সারা আদিবাসী পাড়া আনন্দে মাদল নৃত্য করেছিল।তাই এটা ছিল সেদিনকার জন্য একটা বড় খবর। তাই এখনও তীব্রতার মত দেখতে কোন মহকুমাশাসক নতুন কাজে যোগ দিতে এলে অফিসে ঝড় ওঠে।পারবে তো?ইংরেজী জানে?মহকুমাটা শেষ।এরকম আশঙ্কায় কাঁপতে থাকে অফিস দালান।যেন এক নতুন জন্তু এসেছে সদ্য দপ্তরে।তাই দরজার ফাঁকে উৎসাহী চোখ ভিড় করে।যেমন সহকর্মীর ট্রাইবাল মেয়ে নেট পাশ করলেও একটা সন্দেহ ঘুরে বেড়ায় সকলের মনে।যেন এটা হবারই ছিল।তাই প্রশংসার বর্ণমালাটাও সেদিন ফ্লয়েডের মত দম আটকে ফেলেছিল অন্যসব কর্মীদের মনে।শুধু তাই নয় ,চরম প্রগতিশীল মানুষও খালকোবাবুর ছেলের প্রথমবারে এস এসসির ইংরেজী শিক্ষকের চাকরি পাওয়ায় প্রাণখুলে হাসতে ভুলে গেছিলেন।এমনকি খুশির মিষ্টিও জোর করে গিলেছিলেন সকলে।একটা বাতিল রেজেলিউশন মেনে নেবার মত।তাইতো ট্রাইবাল মানুষকে শব্দছক মেলাতে দেখলে বাকিরা অবাক হন।সেই জাতির প্রতিনিধি কেউ সেরাফল করলেও প্রশ্ন করা হয়, সে কী জেনারেলদের মধ্যেও প্রথম?পঁচিশে বৈশাখ সকালে ওদের কেউ অন্যরকম উচ্চারণে রবিগান গাইলে আমাদের হাসি পায়।ভেনাস উইলিয়ামস র্যাম্পে হাঁটলে নিজেদের দুর্বল লাগে।অলচিকি ভাষা স্বীকৃতি চাইলে উচ্চবর্ণের প্রাসাদ ভঙ্গুর হতে থাকে।ট্রাইবাল চিকিৎসক হলেই তার মেডিক্যালের র্যাঙ্ক জানতে ছটফট করি।সাঁওতাল শিক্ষিকা স্কুলে জয়েন করবার দিনেই তার পরিবারের সবাই চাকরি করে জেনে সংরক্ষণবিরোধী বিলের জন্য পথ অবরোধ করতে ইচ্ছে করে।
আসলে শিক্ষাকে সত্যিই আমরা বাহন করতে পারিনি।বহন করেই চলেছি।কলসে জল ভরেছি সেই নার্সারি থেকে।তারপর কলস বড় হল।জল বাড়ল স্নাতকে।কিন্তু সেই জল পাণের যোগ্য হল কিনা,উপলব্ধি হল কই? বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে রচনা লেখা হল পাতার পর পাতা,মিছিল হল কয়েক কোটি কিলোমিটার পথ,সন্ধ্যায় বসল সাজো সাজো প্যানেল ডিবেট।বঞ্চিত কালো মানুষকে স্টুডিওয় এনে চলল নিরন্তর ময়নাতদন্ত।তবুও সেদিন ফরসা সাঁওতাল দেখতে মুদির দোকানে ছুটে গেছিলেন কজন ভদ্রলোক।সাঁওতালের দুধসাদা গাত্রবর্ণে সেটাও সেদিন ছিল শহরের এক বড়খবর।বিরল সেই মানবীকে দেখতে ভিড় হয়ে গিয়েছিল আনলকের প্রথম সকাল। স্কুলশিক্ষিকা অপমানে ঐ দোকানে আর কোনদিন আসেননি।যেমন দারুণ নাচ করেও সেবার চিত্রাঙ্গদায় বাদ পড়েছিল টুসি হেমব্রম।দিদিমণি বলেছিলেন,আসছে বার চন্ডালিকায় নাচিস।টুসি কিচ্ছু না বুঝে একটি বছরের কোয়ারিন্টিনে চলে গেছিল।তাই টুসির মত মেয়েরা ফরসা হবার ক্রিম কিনতে বলেছিল মাকে, বাড়ি ফিরে।মা বলেছিলেন,পৃথিবীর কোন ক্রিম তোকে আর ফরসা করতে পারবে না রে।
তাই এটাই এখনকার সামাজিক ব্যবস্থার আপাতত আস্ত রূপরেখা।একটা অনগ্রসর সমাজের ভবিতব্যের নির্মম রাশিফল।যেখানে ঋণাত্মক শক্তির কাছে আজীবন ধনাত্মকশক্তির ইনিংস ডিফিট চলছেই।মহাভারত লেখা থেকে থিয়োরি অফ রিলেটিভিটিও যে সংজ্ঞার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি।হয়তো এটাই এক ট্রাইবাল ট্রাজেডি।এক হতভাগ্য মহাকাব্যের বঙ্গানুবাদ।দোবরুপাণ্ণা ,ভানুমতী,টাঁড়বাড়োর পোড়া কপালের শেষ চিহ্ন।তবু ভোট হবে,মিছিল হবে,লক্ষ লক্ষ গবেষণাপত্র বছর বছর স্বীকৃতি পাবে দেশে বিদেশে।কিন্তু উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদও যে এক সক্রিয় ভাইরাসের মত প্রতিনিয়ত নিজেকে বদলে নিচ্ছে অন্যরূপে অন্যভাবে সমাজে,সে খবর কেউ রাখেন না।