সোশাল মিডিয়ায় মমতা নিন্দা করে কিছুটা নজর-কাড়া সুজাতা মণ্ডল খান তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। সুজাতা মণ্ডল খান বর্তমান বিজেপি যুব মোর্চার সভাপতি সৌমিত্র খানের স্ত্রী। শুভেন্দু অধিকারী যেদিন বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন, সেদিন আরও অনেকের সঙ্গে বিজেপিত যোগ দিয়েছিলেন সিপিএমের বিধায়ক তাপসী মণ্ডল।
এ দুটি নাম একসঙ্গে উল্লেখ করার কারণ, দল ছাড়া ও নয়া দলে যোগের সময় এঁদের পারিবারিক, বা আরও নির্দিষ্ট করে বলে স্বামীর পরিচিতি সামনে চলে এসেছে। তার একটা আর্থ-সামাজিক কারণ রয়েছে। ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, তা প্রগতিশীল হলেও, স্বামীর পরিচায়ক চিহ্ন মহিলার পক্ষে বহন করে চলাই রীতি। সে চিহ্ন শাঁখা-সিঁদুর প্রভৃতির মত বিবাহের বিভিন্ন আলঙ্কারিক পরিচায়ক হতে পারে, হতে পারে পদবী। যা-ই হোক না কেন, সে রীতিই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও।
সুজাতার বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পাচ্ছে কারণ তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেবার অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর স্বামী, সৌমিত্র প্রকাশ্যে ডিভোর্স চেয়েছেন, এবং সুজাতাকে অনুরোধ জানিয়েছেন, তিনি যেন আর খান পদবী ব্যবহার না করেন।
সংবাদমাধ্যম সৌমিত্রের আবেগবিহ্বল সাংবাদিক সম্মেলন সহজে ছাড়বে না, তাতে করুণরস ও হাস্যরসের মিশেল ঘটিয়ে কিছু সময় বা কিছুদিন বিষয়টি নিংড়ানোর চেষ্টা করবে। এরকম ঘটনা কিছুদিন আগেও দেখা গিয়েছে, যখন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ত্রিকোণ সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশ্যে খেউড় হতে দেখা গিয়েছিল।
যেদিন বেলা একটায় সুজাতা তৃণমূলে যোগদান করেন, তার এক ঘন্টা পরে নিজের ডাকা সাংবাদিক সম্মেলেনে দৃশ্যতই বিহ্বল ছিলেন সৌমিত্র খান। সে বিহ্বলতার মধ্যে থেকে তিনি যা বলেছেন, তার মধ্যে রয়েছে ডিভোর্সের নোটিস পাঠাবার কথা, রয়েছে নিজের বেতনের অর্ধেক প্রতি মাসে সুজাতাকে দিয়ে দেবার কথা। সৌমিত্র বলেছেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হতে পারে, কিন্তু পরিবার ও সম্পর্ক রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকা উচিত।
স্পষ্ট যে, সৌমিত্র চান স্বামী ও স্ত্রী ভিন্ন রাজনীতির অংশীদার যেন না হন, তাঁর কাম্য পরিস্থিতিতে তেমন হলে স্বামী ও স্ত্রীর ভিন্ন হয়ে যাওয়া উচিত। এ বিষয়টি খুব উড়িয়ে দেবার মত কিনা তা ভাবা দরকার। সৌমিত্র অতীব পিতৃতান্ত্রিক অবস্থান থেকে এ কথা বলেছেন, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। তিনি সম্ভবত কল্পনা করতে পারেন না, বাড়ির পুরুষের যে রাজনীতি, স্ত্রী-র রাজনীতি তার চেয়ে ভিন্ন হতে পারে। সৌমিত্র যে ধরনের রাজনীতির সঙ্গ করেন, তাতে এমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু সৌমিত্রের কথাটিকে অন্য ভাবে ভাবার অবকাশ রয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যে সহভাগিতা, যে অংশিদারিত্ব, তা কত দূর ভিন্নতা ধারণ করতে পারে, সৌমিত্রের আক্ষেপ থেকে তেমন একটা চিন্তার পরিসর তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। স্ত্রী-কে স্বামীর অনুগামী হতে হবে, সৌমিত্রের কথা যদি এ প্রসঙ্গকেই জোর দিয়ে থাকে, তাহলে সৌমিত্রের সে কথাকেই একবার পাল্টে দেখা যেতে পারে। অনুগমন নয়, সহগমন, এমন জায়গা থেকে যদি দাম্পত্যকে দেখা হয়, তাহলে দুজনের চিন্তা ও নৈতিকতা যখন পরস্পরের বিরোধী শুধু নয়, একেবারে মুখোমুখি যুদ্ধরত, তখন তেমন দাম্পত্য কিসের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? অভ্যাস? সামাজিকতা? পরিচয়?
এই প্রশ্নগুলির সমাধান একভাবে করে দিয়েছেন হলদিয়ার তাপসী মণ্ডল। বিজেপির সৌমিত্র যেমনটি চান, সিপিএম থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া তাপসী ঠিক তেমনটি করেছেন। তাপসীর স্বামী অর্জুন মণ্ডল আগেই বিজেপিতে গিয়েছিলেন। সিপিএম ছাড়ার পর ও বিজেপিতে যোগ দেবার আগে তাপসী বলেছিলেন, 'আমি ও আমার স্বামী আলাদা আলাদা দলে কাজ করলে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে। তার থেকে একসঙ্গে মানুষের জন্য কাজ করব।'
সরলভাবে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যাবে এ ধরনের পিতৃতান্ত্রিক ও পশ্চাৎমুখী ভাবনাগুলি বিজেপি-তে প্রশ্রয় পায়। তেমনটাই স্বাভাবিকও বটে, কারণ বিজেপি প্রকাশ্যে দক্ষিণপন্থার চর্চা করে। তাদের কোনও লুকোছাপা নেই। কিন্তু তাপসী, সিপিএমের তাপসী, সিপিএম বিধায়ক তাপসীর মুখে এ কথা কিছুটা হলেও ধাক্কা দেবার মত। বাস্তব ঘটনা হল, এগুলি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না, স্বাভাবিক, সহজ, দুর্গাপুজোয় বামপন্থীদের স্টল দেবার মত। সে সময়ে যুক্তি থাকে, এ হল উৎসব। আর বিবাহোত্তর নারীজীবনে স্বামীর অনুগমনের যুক্তি সম্ভবত সামাজিক পরিস্থিতি, শাঁখা-সিঁদুরের যুক্তি যেমন লোকাচার।
এমন পরিস্থিতিতে একজন মণ্ডলকন্যা বিবাহসূত্রে যে অতি সহজে খান হয়ে যাবেন, ভারতের এক অঙ্গরাজ্যের গ্রামীণ ও পশ্চাৎপদ অংশে, তেমনটাই স্বাভাবিক দেখাতে থাকে, থাকবেও সম্ভবত, আরও বহুকাল ধরে।
কিন্তু কোনও এক সূরজ লাল দাস ও অশ্রুকণা মিত্রের কন্যা দিল্লির মিরিন্ডা হাউজে শিক্ষালাভ করে, লন্ডনে গিয়ে চার বছর ধরে এয়ার ইন্ডিয়ার মত সংস্থায় চাকরি করে, বিবাহের পর যদি স্বামীর কারাত পদবী নিঃসংকোচ ধারণ ও সেই রাজনীতি বহন করতে পারেন, তাহলে সেই কারাতদের থেকে এই মণ্ডলরা আর কতটুকুই বা পিছিয়ে?