বাড়ির মধ্যেই রয়েছে একটা ছোট্ট পুকুর। হেলানো নিমগাছের কালো ছায়া পড়েছে জলে। পাড়ার মণ্ডপে শুরু হয়েছে প্রতিমা বরণের প্রস্তুতি। অঘোরে ঘুমোচ্ছে সৃজনী। গাঢ় ঘুমটা এক ঝটকায় ভেঙে গেল মঞ্জু মাসির ডাকে। "তিতি উঠে পড়ো। চা এনেছি।" চোখ রগরাতে রগরাতে উঠলো তিতি, চোখেমুখে এখনও ঘুমের রেশ লেগে আছে। চোখ গেল সেন্টার টেবিলে রাখা কমলা রঙের চায়ের কাপে। "অনেকটা সময় ঘুমিয়ে ছিলাম বলো মঞ্জুমাসি?"
"ঘুমের আর দোষ আছে? এত ঝক্কি আর টেনশনে কদিন ছিলে যে ঘুম তো পাবেই। দু বছর পুজোতে তো কলকাতায় ছিলে না এবারে থেকেও না থাকার মতো অবস্থা।"
"মা ভালো হয়ে যাবে তো মাসি?"
"আরে আজেবাজে কথা একদম ভাববে না তো, বৌদি একেবারেই সুস্থ হয়ে যাবে, হুইলচেয়ারও ছেড়ে দিয়ে আগের মতো গটগট করে হাঁটবে।"
কাকা, কাকিমারা, মঞ্জুমাসি সবাই বললেও সত্যিটা জানে তিতি। মা কখনও আর আগের জীবনে ফিরতে পারবে না। ডাক্তারবাবুদের সবারই একমত,
"সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে তোমার মায়ের স্পাইন আর পায়ে সাংঘাতিক চোট লেগেছে। এই বয়সে প্রাণে বাঁচলেও হাঁটাচলা করা আগের জীবনে ফেরা প্রায় অসম্ভব। ফিজিওথেরাপি চলুক। সময়ের হাতে ছাড়তেই হবে।"
"অত ভেবো না, আজ বিজয়া, মুখ ভার করে থেকো না। আমি একটু পরে এসে নিমকি দিয়ে যাচ্ছি।" " তুমি নিমকি ভাজছো?"
" হুম, ভাবলাম বিজয়ার দিন একটু করি।"
"একটা কথা। মা উঠেছে গো? "
"না বোধহয়, ডাকেনি তো। চলি গো, মেলা কাজ আছে।"
চায়ের ট্রে ধুতে মঞ্জুমাসি চলে গেল। চুলে ক্লিপ লাগিয়ে বারান্দায় গেল তিতি। পশ্চিমের আকাশে সূর্য ডোবার মুখে। নিমগাছে পাখিরা বাসায় ফিরছে। একটা নীলচে পাখি ঠুকরে ঠুকরে নিমফল খাচ্ছে। বাবার হাতে পোঁতা ছাতিম গাছটা থোকা থোকা ফুলে নুইয়ে পড়েছে, মনে হচ্ছে কেউ যেন গাছের তলায় সাদা শতরঞ্জি বিছিয়ে রেখেছে। বাবা থাকতে পুজোতে খুব আনন্দ হত, সব আত্মীয়দের ডেকে বিজয়ার দিন আসর বসাতো বাবা। বাবা চলে গেছে, সব বন্ধ হয়ে গেছে। মা পাড়ার পুজো, বিভিন্ন অনুষ্ঠান এলেই হুজুগে মেতে উঠতো। একটা দুর্ঘটনা সবকিছুকেই বদলে দিল। কাকার একটা কল পেয়েই প্রোজেক্টের সব কাজ ফেলে কলকাতায় ছুটে আসতে হয়েছে তিতিকে। কদিন ধরে হসপিটালেই থাকতে হয়েছে, এর মাঝেই পুজো এলেও হুস করে দশমীও এসে গেছে। কয়েকজন মহিলা বরণের লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। ছোটবেলায় মায়ের আঁচল ধরে তিতি দাঁড়িয়ে থাকতো মণ্ডপে। অতীত বড্ড পিছু ডাকছে।
"তিতি, এদিকে এসো।"
একটা ফুলকাটা প্লেটে নিমকি আর নাড়ু নিয়ে আবার হাজির মঞ্জুমাসি।
"রেখে গেলাম, খেয়ে নাও।"
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে দু থোকা ছাতিম সাদা রঙের ফ্লাওয়ার ভ্যাসে রেখে দিল মঞ্জুমাসি। ডিস হাতে জানলার পাশের ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো তিতি। ক্রমশ অন্ধকারের গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে দশমীর বিকেল। সবাই মিলে ঠাকুর তুলেছে লরিতে। বেশ কয়েক ঘণ্টা ফোনটা চেক করা হয়নি। ফোনটা হাতে তুলতেই তিতির চোখে পড়লো বেশ কয়েকটা মিসড কল আর টেক্সট। সবকটাই করেছে প্রমিত। এখন ওই দেশে মাঝ দুপুর। তবে আজ উইকএন্ড, অফিস ছুটি। কল দিল তিতি, ফোন বেজে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জ্বলে উঠলো ফোনের আলো।
"হ্যালো সৃজনী, শুভ বিজয়া। যাইহোক ফোনটা ধরলে!"
"সরি প্রমিত। কিছু মনে করো না। তোমাকেও শুভ বিজয়ার শুভকামনা জানাই। আসার পর থেকে আমি খুবই টেনশন আর দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম। ফোন করতে পারিনি। সবসময় ধরতেও পারিনি। তোমাকে মেল মারফৎ সবটাই বলেছি। মায়ের অবস্থা ভালো নয়। সিভিয়ার চোট, ভবিষ্যতে হাঁটার সম্ভবনা প্রায় নেই। এতটাই আতঙ্কের মধ্যে মা ছিল যে কথা বলার শক্তিটুকুও ছিল না। যাইহোক এখন কথা বলছে।"
"একটা কথা আছে সৃজনী, জানি না এখন বলা ঠিক হবে কিনা।"
"বলো। এখন একটু ফ্রি আছি।"
"তাহলে বলেই ফেলি! অফিসের সূত্রে জানলাম যে তুমি এখন ফিরতে পারবে না, বলে দিয়েছো।"
লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৃজনী জবাব দিল,"
মায়ের এই অবস্থায় আমি কোথাও যেতে পারবো না। আমি বসকে বলেছি। পরের সপ্তাহে আমি ছোটকাকা মাকে নিয়ে চেন্নাই যাবো, চেষ্টা করে দেখি।"
সৃজনী আর প্রমিত দুজনের আলাপ হয়েছিল হায়দ্রাবাদের একটা অফিসে, প্রমিত প্রমোশন পেয়ে ইউকে চলে যায়। সৃজনী প্রোজেক্টের কাজে পরে ওখানে যায়।
"চুপ করে গেলে প্রমিত?"
"দেখো সৃজনী তোমার পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই বলছি কাকিমাকে কাকু নিয়ে যান না! তুমি চলে এসো। আমাদের সম্পর্কের কথাটাও তো উভয়কেই ভাবতে হবে। বাড়িতে আমি বিয়ের কথাও বলে দিয়েছি।"
"দাঁড়াও দাঁড়াও প্রমিত, সম্পর্ক কখনও ভৌগলিক বেড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এই সময়ে আমি মায়ের পাশে থাকবো না? বাবা নেই, আমি জানি চাকরি গেলে সেটা পাওয়া যাবে, মা গেলে মা …" গলাটা কান্নায় বুজে গেল সৃজনীর।
"এটাই তোমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যে তুমি আসবে না?"
দৃঢ় গলায় সৃজনী বললো, "না গো এখন ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমার পরিবারের প্রতি একটা দায়িত্ব আছে। সেটাই পালন করতে চাই।"
"পরিবার!" শব্দটা উচ্চারণ করেই তাচ্ছিল্যের ক্রূর হাসি হাসলো প্রমিত।
"যতটুকু তোমার মুখে শুনেছিলাম ওটা তোমার নিজের পরিবার নয়। কাকিমাও তোমার নিজের মা নন।"
মুহূর্তে হতবাক আর স্তব্ধ হয়ে গেল সৃজনী।
"হ্যালো, হ্যালো সৃজনী লাইনে আছ? হ্যালো, হ্যালো।" ক্ষীণ স্বরে সৃজনী বললো,
"বলো।"
"ভাবছিলাম লাইন বোধহয় কেটে গেল। যাইহোক শুনে রাখো আমার ভারতে ফেরার ইচ্ছে আর নেই। তোমার সিদ্ধান্ত একান্তই তোমার। তবু বলবো ভেবে দেখো।"
রাগে দুঃখে ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। মুখের ডগায় কিছু তিক্ত শব্দ এলেও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো সৃজনী। আস্তে আস্তে জবাব দিল
"ভেবে দেখার কিছু নেই। তবে আমি এই দুঃসময়ে মায়ের পাশে থাকতে চাই, এই কথাই বলেছি। মা মা-ই হয়…"
কথা শেষ হতে না হতেই প্রায় ধমকের সুরে প্রমিত বললো "আমার বাড়ির প্রথম থেকেই আপত্তি ছিল। সবার অমতেই এগিয়েছি। বাবা মা বলেছিল এসব অজাত কুজাত অনাথ আশ্রমের লোকজনের সঙ্গে শেষ অব্দি জড়ালে!" রাগ আর বাধা মানলো না। কিছুটা উত্তেজিত হয়ে সৃজনী বললো " সেই কথাই শুনতে পারতে। আমি জোর করিনি কিছুতেই। আমার জীবনের কথা লুকিয়েও যাইনি। তুমি আমাকে কখনও ভালোবাসোনি, মনে এত ঘৃণা জমে থাকলে ভালোবাসা যায় নাকি? সবটাই অভিনয় আর মোহ। মানুষ মানুষকে ভালোবাসে মন দেখে, জাত ধর্ম দেখে নয়।" ফোনটা রাগে যন্ত্রণায় দপ দপ করতে করতে কেটে দিল সৃজনী। প্রমিতকে মনের মানুষ ভেবেছিল, ভেবেই গলগল করে সব বলেছে। বুঝতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। মনের দরজা পেরিয়ে অন্দরে ঢুকতে পারেনি প্রমিত। সম্পর্কে রয়ে গেছে ফাঁক, মনে হচ্ছে এক লহমায় অনেক কিছুই হারিয়ে গেল। ছাতিম ফুলের গন্ধ যেন বুকফাটা যন্ত্রণার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আবার বারান্দায় গেল সৃজনী, মণ্ডপ ফাঁকা, একটা ছোট্ট দীপ জ্বলছে। বাড়িটার খিলান, কড়ি বর্গার দিকে তাকায় সৃজনী। এই বাড়িটাকে কখনও "অপরের বাড়ি" বলে মনে হয়নি। ছোটবেলায় আর পাঁচটা বাচ্চার মতো মাকে যখন সৃজনী জিজ্ঞেস করত, "মা আমি কোথা থেকে এসেছি?" মা গলা জড়িয়ে বলতো, "ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।" তখন মানেটা বোঝেনি তিতি, এখন বোঝে। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় সৃজনী একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কলকাতার দুজন তাবড় তাবড় ডাক্তারবাবু দিশা পাচ্ছিলেন না। দিনরাত এক করে মায়ের সেবায় সুস্থ হয়। তখন তো একবারও মনে হয়নি যে এই মা সৃজনীর নিজের নয়! সৃজনীকে যখন জন্ম পরিচয়ের কথা বলা হয়েছিল তখন সৃজনীর মধ্যে একটা অদ্ভুত ফিলিং তৈরি হয়েছিল। মা বলেছিল, "শুনে রাখ তিতি অতীতের কথাগুলো তোকে বললাম শুধুমাত্র তোকে জানানোর জন্য। অন্য কেউ বললে তোর অভিমান হতে পারতো। আমার মেয়েকে তো চিনি, অভিমান হলেই তীব্র মনঃকষ্ট পায়।মুখখানা মেঘের মতো কালো করে বসে থাকে। "সেদিন মা বাবার কথা শুনে মনে হয়েছিল সত্যিটা জানানো দরকার তাই জানানো হয়েছে। বাবা বলতো " মিথ্যে, ইনিয়ে বিনিয়ে বললে আখেরে ক্ষতি হয় , তেতো হলেও সত্যি শুনে নেওয়া অনেক সুখের। " এই সাতাশ বছরের জীবনে নিজেকে এতটা আশাহত কখনও মনে হয়নি। এলেমেলো ভাবনার সমাহার ঘুরঘুর করছে মাথার মধ্যে।
"আমি কারুর গর্ভের ভেতর দশমাস ছিলাম, যাঁরা আমাকে পৃথিবীতে এনেছিলেন আমার চরম অসহায় মুহূর্তে তাঁরা নোংরার মধ্যে ( যতটুকু জানা গেছে) রেখে যান। একবার আমার পরিণতির কথা ভাবেননি। মরেও যেতে পারতাম যদি না আশ্রমের ফাদারের হাতে পড়তাম। তারপর এই মা বুকে টেনে নেন। গর্ভের আশ্রয়ের চেয়ে এত বছরের মায়াময় ছায়ার গুরুত্ব কম নয়, কোথায় যেন পড়েছিলাম- শুন হে মানুষ ভাই সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই- জীবন সেটা বুঝিয়ে দিল। রক্তের চেয়ে মনুষ্যত্বের দাম ঢের বেশি।"
তিতি!" ডাক শুনে চমকে উঠলো তিতি। অপার বিস্ময়ে পিছন ফিরে তিতি দেখলো হুইলচেয়ার নিয়ে মা হাজির, চোখেমুখে দুশ্চিন্তার কালো রেখা। "তুমি আবার ঠেলে ঠেলে এলে কেন? মঞ্জুমাসিকে বলতে পারতে।"
"তুই কষ্ট পাচ্ছিস জেনে আমি না এসে পারি। আমি সব শুনেছি। যতদিন দেহে প্রাণ আছে, চেতনবোধ জাগ্রত আছে, হাঁটতে চলতে না পারলেও হামাগুড়ি দিয়েও তোর কাছে আসবো। পেটে না ধরলেও তোকে মনে ধরেছি তিতি! রক্ত শেষ কথা বলে না। যে গেছে তাকে যেতে দেয়, প্রমিত যদি সত্যিই মানুষের মতো মানুষ হত, মনুষ্যত্ববোধের এতটুকু অংশ যদি বহন করত তোর হাতটা আজ শক্ত করে ধরে থাকতো। কোন অধিকারে প্রমিত তোর জন্মের প্রসঙ্গ তোলে?" কান্নার স্রোতে ভাসতে ভাসতে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দিল তিতি।
মণ্ডপে বোধহয় ঠাকুর বিসর্জন দিয়ে সবাই ফিরে এসেছে, বিষাদের আবহেই রচিত হচ্ছে আগামীর আহ্বানের সুর।
ছাতিমের সমধুর গন্ধের মধ্যেই কানে অনুরণিত হচ্ছে মায়ের গলায় বলা রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি," ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।"
উৎসব সংখ্যা: নবান্ন।