আমি এখন নির্দেশনার কাজে হাত দিয়েছি। বুদ্ধিমান, পড়াশোনা করা, আকর্ষণীয় বাঙালি যুবক হিসাবে সৌমিত্রবাবুর চেহারাটা মনের মধ্যে এমনভাবে বসে গেছে, যে কোন ছবি করার কথা ভাবতে গেলেই ওরকম চরিত্রে ওঁর চেহারাটাই প্রথমে মনে আসে। আমি নিশ্চিত, বয়সের এত ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও আমার প্রজন্মের অনেক নির্দেশকেরই তাই হয়। আসলে আমরা বাঙালিরা, বিশেষ করে যারা মননশীল ছবি দেখে বড় হয়েছি, তাদের কাছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একজন আদর্শ চিন্তাশীল বাঙালি যুবক। তাই গল্প যা-ই হোক, তেমন একটা চরিত্র থাকলে প্রথমেই মনে হয়, ওঁকে দিয়ে যদি করানো যেত। এই ভাবনাটা মাথায় আসার পর আগে খেয়াল হত, না, ওঁর তো বয়স হয়েছে, ওঁকে দিয়ে তো করানো যাবে না। আর এখন, দুর্ভাগ্যবশত, নিজেকে বোঝাতে হবে, উনি তো নেই।
আমার সৌভাগ্য, ওরকম একজন মানুষের সঙ্গে কাজ ছাড়াও অনেকটা সময় কাটাতে পেরেছি। সিনেমা বাদ দিয়ে সবচেয়ে বেশি যা নিয়ে উনি কথা বলতে ভালবাসতেন, সেটা হল জীবন। আসলে সিনেমার সাথে সংযুক্ত অন্য শিল্পমাধ্যমগুলোর সবকটার সঙ্গেই তাঁর অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক ছিল। উনি সিনেমাকে অন্য শিল্পমাধ্যমগুলোর থেকে আলাদা করে দেখতেন না। ওঁর অ্যাপ্রোচটা ছিল ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি। শিল্প শেষ অব্দি জীবন থেকেই আসে। উনি যে যে শিল্পমাধ্যমে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন --- ছবি আঁকাই হোক বা কবিতাই হোক কিম্বা নাটক হোক, সেগুলোর মধ্যে উনি জীবনকে কিভাবে দেখছেন, এবং শিল্প ওঁকে কোন জীবনবোধ দিচ্ছে --- তা উনি খুব সুন্দর করে বলতে পারতেন। সেই নিয়েই বেশিরভাগ সময়ে আমাদের কথা হত।
উনি যখন নাটক নিয়ে কথা বলতেন, তা আমার জন্য একটা শিক্ষণীয় আলোচনা হয়ে উঠত। আমি তো নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসিনি, আমার নাটকের সঙ্গে যোগাযোগ মানে হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে নাটক দেখা। আর সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে নাটক আমায় পড়তেও হয়েছে। নাটক না করলেও, বাংলা নাটক বা ভারতীয় নাটকের একটা বেসিক ধারণা আমার আছে। মূলত সেই নিয়েই কথা হত আমাদের। আমি নিজে যে নাটকের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত নই, তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হত না। বরং আমি ওঁর কাছ থেকে জানতে চাইতাম, কিভাবে কাছ থেকে দেখেছেন শিশির ভাদুড়িকে। অজিতেশবাবুর মূল্যায়ন উনি কিভাবে করেন, কুমার রায়ের সম্পর্কে কী মতামত। বর্তমানে যাঁরা নাটক করেন, তাঁদের কাজ নিয়েই বা ওঁর কী মতামত --- এইসব শুনতে চাইতাম।
আড্ডার বেশকিছুটা জুড়ে থাকত রাজনীতি। ওঁর খুব নির্দিষ্ট কিছু চিন্তাভাবনা ছিল, কিন্তু উনি কখনোই কট্টরভাবে কোন পক্ষ নিতেন না, অর্থাৎ মোটেই পার্টিজান ছিলেন না। ওঁর জীবনবোধের মধ্যেই খুব স্বচ্ছ রাজনীতিবোধ ছিল, ফলে ওঁর রাজনৈতিক অবস্থান ছিল খুব স্পষ্ট। সেই অবস্থান থেকে নিরপেক্ষভাবে উনি কিছু জিনিস দেখতে পারতেন। তবে মৌলিক রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে কিন্তু কখনো সরে আসেননি।
সৌমিত্রবাবু মারা যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বা অমিত শাহের শোকবার্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে বলছেন এটা স্রেফ পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে। আমার অবশ্য তা মনে হয় না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জাতীয় সম্পদ। আমার ধারণা অন্তত এইটুকু বোধ ওঁদের আছে, যে এরকম একজন মানুষের প্রয়াণে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে শোকজ্ঞাপন করতেই হয়। কারণ উনি চলে যাওয়ার ক্ষতি যতটা একজন বিজেপি সমর্থকের, ততটাই একজন বাম সমর্থকের, আবার ততটাই একজন তৃণমূল সমর্থকের। কাজেই আমি এর মধ্যে রাজনীতি দেখছি না। তবে নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিকভাবে সৌমিত্রবাবু আর এঁরা একেবারে দুই মেরুর মানুষ। কিন্তু তাঁর মত একজন মানুষের প্রয়াণে সমস্ত রাজনৈতিক মতের মানুষই শোক জ্ঞাপন করবেন --- এটাই স্বাভাবিক, এটাই প্রত্যাশিত।
চলে যাওয়ার ঠিক আগে আমি ওঁকে নিয়ে একটা ছবি করছিলাম। সেই ছবির শুটিং শেষ হয়েছিল, ফলে কাজ শেষ করে ছবিটা দেখানোর ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করতে পারব। কিন্তু একটা বড় ক্ষতি হল, ওঁর ঐ অননুকরণীয় কণ্ঠস্বর ডাব করানো গেল না। আমরা চেষ্টা করছি শুটিং এর অডিও ট্র্যাকটাকে যদি কোনভাবে ব্যবহার করা যায়। তাতে কিছুটা সময় যাবে। তবে সেসব সত্ত্বেও আশা করছি কয়েক মাসের মধ্যেই ছবিটা মুক্তি পাওয়ার মত জায়গায় পৌঁছে যাবে।
অনুলিখন: প্রতীক