বাড়ি ঘরে আমরা যেমন কোথাও পলকা তিন ইঞ্চির ফলস দেওয়াল গেঁথে রাখি। যেটা ভবিষ্যতে ভেঙে ফেলে একটা দরজা বসানো যাবে, পৃথক নির্গমন পথ বানানো যাবে। কেউ কারো মুখ দর্শন করবে না। দরকারে ভাড়া দেওয়া যাবে। সেই রকম প্রতিটি ভাগ বাঁটোয়ারা, সীমানা নির্ধারণ, এসব কর্মকাণ্ডে, ভবিষ্যতে ভারসাম্য ভেঙে ফেলার একটা সুযোগ রেখে দেওয়া হয়। প্রয়োজনমতো যাতে বোঝাপড়া ও ভারসাম্য নষ্ট করা যায়। এগুলো হলো ভবিষ্যতের গোলযোগ এর উৎস মুখ। সলতে টা পাকিয়ে রাখা। প্রয়োজন পড়লে অগ্নিসংযোগ করা।
তা না হলে ভাবুন না ভার্সাই চুক্তিতে আঞ্চলিক পুনর্বন্টনের সময় প্রায় ২৫ লক্ষ জার্মান অধ্যুষিত সুদেতান অঞ্চলকে চেকোস্লাভাকিয়ার সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। পরাজিত জার্মানি এই আঞ্চলিক বন্টন মানতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু একদিকে চেকোস্লোভাকিয়ার অধীনে সুদেতানে বসবাসকারী জার্মানদের মনে আত্মপরিচয়ের সংকট, অন্যদিকে জার্মানিতে, জার্মান জনগণের মধ্যে সুদেতান কে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই গিয়েছিল। মনে রাখবেন পরবর্তীকালে সঠিক সময়ে হিটলার জার্মানি থেকে অর্থ অস্ত্র ইত্যাদি সুদেতানে সরবরাহ করে, তাদের চেক বিরোধী কার্যকলাপে মদত দেয়। চেক সরকার এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংখ্যালঘু সুদেতান জার্মান পার্টি (এসডিপি) র ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও দমন পীড়ন শুরু করলো। তখন জার্মানিতে সুদেতানের পক্ষে একটা জনমত সংগঠিত হয়। হিটলার জার্মান জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও উত্তেজিত করার ক্ষেত্রে সুদেতান সমস্যাকে কাজে লাগালেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে এবং জার্মানির ফ্যাসিস্ট জাতীয়তাবাদ এর শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুদেতান সমস্যা অনেকাংশে সাহায্য করেছিল।
ভাবা যায় ১৮৭৮ সালের বার্লিন কংগ্রেসে পূর্ব ইউরোপে বলকান অঞ্চলে জাতি সমস্যাকে ঢেলে সাজানো হয়। জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রকে মর্যাদা দেওয়া হয়। আঞ্চলিক বন্টনের ক্ষেত্রে একটি পৃথক শ্লাভ রাষ্ট্র, সার্বিয়া তৈরি করা হলো। অথচ শ্লাভ অধ্যুষিত দুটি অঞ্চল বসনিয়া ও হার্জিগোরিনা কে সার্বিয়ার সাথে নয়, জুড়ে দেওয়া হল অস্ট্রিয়ার সাথে। অর্থাৎ শ্লাভ জাতীয়তাবাদকে অতৃপ্ত রেখে দেওয়া হলো। সার্বিয়ার সঙ্গে অস্ট্রিয়ার এক অসমাধানযোগ্য সমস্যার জন্ম দেওয়া হলো। বসনিয়া, হার্জিগোরিনার শ্লাভরা সার্বিয়ার সাথে সংযুক্তি দাবি করলো। নানান জাতীয়তাবাদী গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠলো। এসব করা হয়েছিল সেই বার্লিন কংগ্রেসে বসে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে। এটাও ছিল একটা সলতে পাকানো। ১৯১৪ সালে এই বসনিয়াতেই গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির হাতে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ নিহত হলেন। ১৯১৪ সাল, গ্রীষ্মের সময়। ২৮ জুন অস্ট্রিয়ার রাজা জোসেফের ছোট ভাইয়ের ছেলে, উত্তরাধিকার সূত্রে আর্চডিউক ফ্রানজ ফার্দিনান্দ, সেরেজাভো (Sarajavo) তে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ওই সময়ে গ্যাভ্রিলো প্রিন্সেপ নামে এক ১৯ বছর বয়সী বসনিয়ার যুবক তাকে গুলি করে হত্যা করে। সে ছিল অখণ্ড শ্লাভ জাতীয়তাবাদের সমর্থক ও গুপ্ত সমিতি ব্ল্যাক হান্ড্রেড এর সদস্য। সেটাই ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত। অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে আক্রমণ করে। সার্বিয়ার পেছনে সাহায্যে এগিয়ে আসে রাশিয়া। জার্মানিও অস্ট্রিয়ার পেছনে দাঁড়ায়। ফ্রান্স এগিয়ে আসে রাশিয়ার পেছনে। সম্মুখ সমরে দুটি শিবির। যেটা সেরেজাভো সংকট নামে খ্যাত। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি প্রতিটি রাজনৈতিক চুক্তি বা মীমাংসার মধ্যে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সমস্যার বীজ সুপ্ত রাখা হয়।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তো স্পষ্টই বলতেন to me, every armistice is nothing but a brief space for future aggression. রকে বসা ছেলেদের ভাষায় নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাস নির্মাতা মূত্রত্যাগের ব্যবস্থা রেখেই অন্তর্বাস তৈরি করে। তা না হলে মানুষের জামাপ্যান্ট নোংরা হত। অর্থাৎ বলা যায় রাষ্ট্রনীতি কূটনীতিতে স্থায়ী শান্তি বলে কোন শব্দই হয় না। না হলে ভাবুন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত লাল সেনা জার্মানির পূর্বাংশ দখল করল। অন্যদিকে ব্রিটেন ফ্রান্স আমেরিকার মিত্র জোট সেনা জার্মানির পশ্চিমাংশ দখল করলো। জার্মানি দুটি স্ফীয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্সে বিভক্ত হলো, পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানি। এ পর্যন্ত আপনি মানতে পারেন। পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েত আধিপত্য, আর পশ্চিম জার্মানিতে ব্রিটেন ফ্রান্স আমেরিকার আধিপত্য। এবার দেখুন সমস্যার সলতে পাকানো হলো কিভাবে। অবিভক্ত যুক্ত জার্মানির রাজধানী ছিল বার্লিন। সেটা পড়েছে পূর্ব জার্মানিতে। ব্রিটেন ফ্রান্স আমেরিকা দাবি করল, বার্লিনের ওপরেও তাদের সমান অধিকার চাই। বার্লিন অবস্থান করছে পূর্ব জার্মানির মধ্যে এবং পশ্চিম জার্মানির সীমান্ত থেকে স্থলপথে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে। এত দূরে তাদের পক্ষে বার্লিন নিয়ন্ত্রণ অসুবিধা জনক। তো তাতে কি? তারা তো সুবিধা চায়না। পূর্ব জার্মানির ওপর দিয়ে, পশ্চিম জার্মানি সদম্ভে যাতায়াত করবে বার্লিনে, সেফ করিডোর দিয়ে। এটাই ছিল ভাগ বাঁটোয়ারার লক্ষ্য। সুবিধা না, অসুবিধা তৈরি করাই উদ্দেশ্য। প্রতিদিন তোমার উঠোন দিয়ে সদর্পে যাতায়াত করবো। দেখি কে আটকায়। সলতেটা পাকিয়ে রাখা। ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে, এটাই জন্ম দিয়েছিল বার্লিন সংকটের।
তাহলে এবার ভাবুন। আমাদের ভারতবর্ষে একটা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও মশকরা চালু আছে। ভারতের ম্যাপের সঙ্গে বাংলাদেশের ম্যাপ ফ্রি। বাংলাদেশকে তিন দিক দিয়ে ভারত ঘিরে আছে। আর চতুর্থ দিকটা তার সীমানা বঙ্গোপসাগর। ফলে ভারতের মানচিত্র আঁকতে গেলে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা হয়ে যায়। যারা ১৯৪৭ এ দেশভাগ করল, তাদের কাছে এটা জানাই ছিল যে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, বিচ্ছিন্ন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখা অসম্ভব। তথাপি সকলেই এই বিভাজন মেনে নিয়ে চুক্তিতে সই করেছিলেন। জিন্না সাহেবের কি মাথা খারাপ ছিল? তিনি জানতেন, যে লাহোর থেকে ঢাকায় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভব না। বিলক্ষণ জানতেন। আর জানতেন বলেই তো যুক্ত বাংলাকে নিয়ে একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে তিনি সম্মত ছিলেন। যখন তিনি দেখলেন স্বাধীন ভারত পৃথক যুক্তবঙ্গের প্রস্তাবে রাজি নয়, বাংলার পশ্চিম অংশ ভারত ভুক্ত করতে চায়। তখন তিনিও এক প্রকার জিদ দেখিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গঠনের দাবি করেন। যুক্তবঙ্গ রাষ্ট্রে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হবে, মুসলমানরা হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ এটাই ছিল হিন্দু মহাসভার প্রধান আপত্তি। দেরি করলে পস্তাতে হবে এই আশঙ্কায় জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্টরা এই বিভাগের দাবি মেনে নেয়।
এভাবেই পাকিয়ে রাখা আছে বাংলাদেশের সলতেটি। একবার নয়, এই বাংলাদেশ বারবার ভারতের কেন্দ্রীয় শাসক কে ডিভিডেন্ড এনে দিয়েছে। ১৯৭১ সালে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনী হাল যথেষ্ট বেসামাল ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেই নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর লক্ষ্মীপেঁচা হয়েছিল। আজও যখন কেন্দ্রের শাসক দল উড়িষ্যা জয় করেও সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভে ব্যর্থ হয়ে ২৪০ এ এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। তার লক্ষ্য পশ্চিমবাংলার ৪২ টি আসন। আর এই আসন জুটিয়ে দিতে পারে সেই লক্ষ্মীপেঁচা বাংলাদেশ। এবার আসুন একটু মুখ পাল্টাই :
“ঠেলাঠেলি করিয়া বাহির হইতেই দেখি, পিসেমশাই তাঁর দুই ছেলেকে বগলে চাপিয়া ধরিয়া তাহাদের অপেক্ষাও তেজে চেঁচাইয়া বাড়ী ফাটাইয়া ফেলিতেছেন। এ যেন তিন বাপ-ব্যাটার কে কতখানি হাঁ করিতে পারে, তারই লড়াই চলিতেছে।
এই সুযোগে একটা চোর নাকি ছুটিয়া পলাইতেছিল, দেউড়ীর সিপাহীরা তাহাকে ধরিয়া ফেলিয়াছে। পিসেমশাই প্রচণ্ড চীৎকারে হুকুম দিতেছেন—আউর মারো—শালাকো মার ডালো—ইত্যাদি।
মুহূর্ত্তকাল মধ্যে আলোয়, চাকর-বাকরে ও পাশের লোকজনে উঠান পরিপূর্ণ হইয়া গেল। দরওয়ানরা চোরকে মারিতে মারিতে আধমরা করিয়া টানিয়া আলোর সম্মুখে ধাক্কা দিয়া ফেলিয়া দিল। তখন চোরের মুখ দেখিয়া বাড়ী-সুদ্ধ লোকের মুখ শুকাইয়া গেল! আরে, এ যে ভট্চায্যিমশাই!” মানে রামকমল ভটচায।
শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রথম খন্ডের একটি খন্ড চিত্র ছিনাথ বহুরূপী। সেই বহুরূপীর আবির্ভাবের পূর্ব মুহূর্তের পটভূমি থেকে একটু উল্লেখ করলাম। কারণ এখানে একটা সুন্দর দৃশ্যকল্প হাজির হয়েছে।
প্রথম) পিসেমশাই দুই ছেলেকে বগলের চেপে ধরে আছেন। মানে আগলে রেখেছেন। আর দূর থেকে চেঁচাচ্ছেন, আউর মারো, শালাকো মার ডালো ইত্যাদি। উত্তেজনার আগুনে রুটি সেঁকা বলতে যেমন বোঝায়। নিরাপদ দূরত্বে থেকে পরিস্থিতিকে উত্তেজিত করে তোলা, পিসেমশাই সেটাই করছেন। রকের ছেলেরা বলে থাকে, "মার শালাকে, আরো মার। দাদা পালিয়ে আয়।" তারাই উত্তেজনা ছড়ায়, যারা উত্তেজনার আগুন থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকে। ঠান্ডা ঘরে বসে আইটি সেল ফেক অডিও ভিডিও তৈরি করে, উত্তেজনা গুজব ছড়ায়। কিন্তু আগুনটা লাগলে তার সামান্য আঁচ আইটি সেলে পৌঁছায় না।
দ্বিতীয়) একবার উত্তেজনা ছড়াতে পারলে চিনলো না, জানলো না, অন্ধকারে ধরে পিটিয়ে দিল। কাকে পেটাচ্ছি, কেন পাঠাচ্ছি, কিছুই জানিনা। শুধু জানে কেউ বলেছে, আউর মারো, শালাকো মার ভালো, তাই পেটাচ্ছে। এটাও উত্তেজনা ও গুজবজনিত পিটানির একটা অন্যতম শর্ত।
তৃতীয়) কেউ উত্তেজনা ছড়ালো কেউ উত্তেজিত হলো কিন্তু মার খেলো নিরীহ রামকমল বাবু। "শালা আমায় কিলায়কে কিলায়কে কাঁঠাল পাকায় দিয়া।" যেকোনো গুজব ও উত্তেজনা কর পরিস্থিতিতে এটাই হয় নিরীহ সাদামাটা উলুখাগড়ার দল আক্রান্ত হয়।
বাংলাদেশে বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে রাস্তার উপরে নাকি ভারতের জাতীয় পতাকা আঁকা হয়েছে। সকলকে ওই পতাকা মাড়িয়ে যেতে হবে। এতো জাতির অপমান। জাতির অপমানের প্রতিবাদও করতে হবে। কিন্তু সবার আগে তো জানতে হবে যে এই যে ভিডিও দেখা যাচ্ছে এটা সত্য কিনা। প্রতিবাদ করতে হলে ভারত সরকার বাংলাদেশের সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানাবে। যথাযথ পদ্ধতিতে। তা নয়, সেই ভিডিও যাচাই না করে, ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলায় চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেওয়া হল।
বলাই বাহুল্য দেশের অপমান এটা নিয়ে ক্ষুব্ধ হওয়া ও ক্ষোভ প্রদর্শন করাটা প্রধান লক্ষ্য ছিল না। প্রধান লক্ষ্য হলো ওই ভিডিও দেখিয়ে এদেশের হিন্দুদের মধ্যে, বিশেষ ভাবে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে বাংলাদেশী মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটা আক্রোশ জাগিয়ে তোলা। এবার আপনি উভয়পক্ষে বাঙালি ও বাংলাদেশি শব্দ দুটি বাদ দিন তাহলে দাঁড়ালো ওই ভিডিও দেখিয়ে হিন্দুদের মধ্যে একটা আক্রোশ জাগিয়ে তোলা মুসলমানদের বিরুদ্ধে। যেটা ইউপি মধ্যপ্রদেশ হরিয়ানা রাজস্থানে গুজরাটে অতি সহজে হয়, সেটা বাংলায় সহজ হচ্ছিল না। বাংলাদেশের ঘটনা সেই কাজে একটি সাপোর্ট হিসেবে ব্যবহৃত হলো। জানা যাচ্ছে বাংলাদেশে কিছু সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে যেমনটা বিভিন্ন দেশেই হয়ে থাকে। কিন্তু সেটাকে এত বাড়িয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে যে, এদেশের পশ্চিমবাংলার হিন্দুদের মধ্যে একটা গেল গেল আতংক ভাব তৈরি করা। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে আমার বিচরণ অতি সামান্য। কিন্তু যারা বিচরণ করেন তাদের কাছে শুনছি, এই সমস্ত সম্প্রচারিত অডিও ও ভিডিও গুলির আশি শতাংশই ফেক মিথ্যা। ২০১৩ সালের ভিডিও। তাতে কি, সাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে একটা timeless essence বর্তমান। সবই কাজে লাগে।
আর পিসেমশাইও মানে আমাদের শুভেন্দু অধিকারী বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছে গুটিকতক হিন্দু অনুগামী নিয়ে হম্বিতম্বি, বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানো, এই ঢুকে পড়বো, বাংলাদেশ দখল করে নেব, এমন হুমকি। কিন্তু ঢোকার কোন প্রচেষ্টা দেখতে পেলাম না। সীমান্তে বিএসএফ সেনাবাহিনীর জওয়ান সবই তো কেন্দ্রের বিজেপির নিয়ন্ত্রণে। শুভেন্দু অধিকারী নিজেও কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপির নেতা। তাহলে লম্ফঝম্প না করে সোজাসুজি ঢুকে গেলেই পারতেন। কিন্তু তিনি তো ঢুকে পড়ার জন্য যাননি। গিয়েছেন দূরে বসে উত্তেজনা তৈরি করে সেই আগুনের হালকা উত্তাপে গা শেকার জন্য। এখানে যত লম্ফঝম্প করা যাবে, ততই বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে অশান্ত ও উত্তেজিত করা যাবে এবং সেখানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা কমবে।
শুধু তো শুভেন্দু বাবু নয়, তার পারিষদবর্গ কম কিসে! এ বাংলার হোটেল জানিয়ে দিয়েছে - বাংলাদেশীদের ঠাঁই নেই। সংস্কৃতিপ্রেমী সুধীজনেরা বসুবৈধ কুটুম্বকম ভুলে গিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, রেজওয়ানা বন্যার সংগীতানুষ্ঠান বন্ধ। মহানুভ ডাক্তাররা তাদের হিপোক্রেটিক ওথ বিস্মৃত হয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, এদেশে বাংলাদেশীদের চিকিৎসা করা হবে না। খেলোয়াররা এখনো কিছু বলেননি। ইলিশ ভক্তবৃন্দ পদ্মা পাড়ের ইলিশ নিয়েও এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেননি। কলকাতার তিন প্রধান ক্লাব এখনও কিছু বলেনি। ঢাকের সুরে কাঁসর ঘন্টা ভেঁপু র ঐকতান দারুন জমে উঠেছে। এতে করে বাংলাদেশে মৌলবাদ আরো উৎসাহিত হবে, হচ্ছেও। সেখানকার সংখ্যালঘুর এতোটুকু নিরাপত্তা বাড়বে না। তবুও দেশপ্রেমের ও হিন্দুত্ব প্রেমের এক প্রতিযোগিতা চলছে।
একের পর এক নির্বাচনে প্রমাণিত যে পশ্চিমবাংলায় হিন্দু ভোটের এক বিরাট অংশ বিজেপির থেকে মুখ ঘুরিয়ে আছে। সেই অংশের ৪ বা ৫ শতাংশ যদি একটু সদয় হয়, তাহলে ৪২ আসনের বাংলা বিজেপির করায়ত্ত হবে। পশ্চিম ভারতে নতুন করে শক্তি বাড়বে না। বরং ক্ষমতায় টিঁকে থাকার গ্যারান্টি বিহার বাংলা উড়িষ্যা আসাম এতদঞ্চল। বাংলাদেশ সেই সুযোগ এনে হাজির করেছে। বিজেপির সামনে বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দু নির্যাতিত, এই আওয়াজ এ রাজ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের পরিবেশকে ভেঙে ফেলতে সাহায্য করবে। ধর্মীয় কারণে উৎসাদিত হলে তাদের স্বার্থেই তো নতুন নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হবে। অতএব বাংলাদেশে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মতো মানুষদের অর্থ অস্ত্র সাহায্য চলবে, যাতে উত্তেজনা ও আগুন বেড়ে চলে। চুলার আগুনে একটি একটি করে কাঠ যিনি গুঁজে দেন, তিনি কিন্তু চুলার আগুনে হাত লাগান না।
তবুও শাসকের সমস্যা যায় না। রাষ্ট্র, রাজনীতি, প্রশাসনের বাইরে এখনও এক বিশাল জনগোষ্ঠী আছে। সংকীর্ণতা যাদের এখনও গ্রাস করেনি।চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিপরীতে আছেন কাকদ্বীপের বিদ্যানগরের বাসিন্দা, মৎস্যজীবী প্রাণ কৃষ্ণ দাস। গত ১১ ই সেপ্টেম্বর প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে। মৎস্যজীবী প্রাণ কৃষ্ণ ট্রলার নিয়ে ফিরে আসছিলেন। প্রথমে তিনি দুজনকে সমুদ্রে খাবি খেতে দেখে উদ্ধার করেন। এরপর তাদের কাছে শুনতে পান, আরও ১০ জন বাংলাদেশী সমুদ্রে ভেসে আছেন। সেই দুর্যোগের মধ্যেই মৃত্যুকে তুচ্ছ করে তিনি গভীর সমুদ্রে ফিরে যান। ওই দশ জন মৎস্যজীবীকেই উদ্ধার করেন। পাথরপ্রতিমার ঘাটে নিয়ে আসেন। উল্লেখযোগ্য যে এই ১২ জনই কিন্তু বাংলাদেশের মৎস্যজীবী।
বিস্ময়ের আরও বাকি আছে। পাকিস্তানি সামুদ্রিক নিরাপত্তা সংস্থার সহযোগিতায়, আরব সাগরের মাঝ সমুদ্র থেকে ১২ জন ভারতীয় নাবিক কে উদ্ধার করে পি এম এস এ। পাকিস্তানের জাহাজ এমভি কসকো গ্লোরি ও পাকিস্তানের বিমান, এই উদ্ধারকার্যে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। অবশেষে গুজরাটের দ্বারকা থেকে ২৭০ কিলোমিটার দূরে ১২ জন ভারতীয় নাবিক কে তারা উদ্ধার করে। তাদের পোরবন্দরে নিয়ে আসা হয় নিরাপদে।
ভাগ্যিস আমরা সকলেই সুনাগরিক হয়ে উঠিনি। এখনো বহু মানুষ মানবিক আছে। তাই রক্ষে এবং আশা ভরসা।
"দেশ কাল সীমা ছাড়ায়ে যে প্রাণ
স্বপ্নের নীল ডানায় ভাসে
আমি কান পেতে রই তারই আশে।"