ভারতের সংবিধান রচনার সময়ে (১৯৪৬-৪৯), কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলি অর্থাৎ গণ-পরিষদ তার আগেকার ১৯৩২ সালের গান্ধী-আম্বেদকর সংগঠিত "পুনা চুক্তি" এবং ভারত শাসন আইন(১৯৩৫) এর গৃহীত সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ শুধু দলিতদের ভোটের জন্য আলাদা নির্বাচকমন্ডলী না রেখে তাদেরকে সাধারন নির্বাচকমন্ডলীর মধ্যে রেখেই সংখ্যার শতাংশ হিসাবে আসন সংরক্ষণের সিদ্ধান্তের নিয়মকে মান্যতা দেয়। কিন্তু উল্টো দিকে এই সংবিধান ১৯১৬ সালের "লক্ষ্ণৌ চুক্তি" তথা ভারত শাসন আইন মোতাবেক গৃহীত সিদ্ধান্ত মুসলমানদের জন্য নিজস্ব পৃথক নির্বাচকমন্ডলীকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দেয়। ফলে ১৯৪৬ সালে শুরু হওয়া সংবিধান রচনার স্থান গণ-পরিষদ (কন্সটিটিউয়েন্ট এসেম্বলি) বয়কট করে মুসলিম লীগের সদস্যরা। একই নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে জিতে এলেও তাদের প্রতিনিধিরা আলাদা গণ-পরিষদ ও তার মাধ্যমে রচিত আলাদা নিজস্ব সংবিধান দাবী করে। অর্থাৎ পাকিস্তান গঠনের একপ্রকার বুনিয়াদ রচনা হয়। নেহেরুর নেতৃত্বে ভারতের সংবিধানের লক্ষ্য-দিশা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ঠিক হয়ে গেলেও এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাহ্যিক রূপে-আকৃতিতে থাকলেও বিষয়টা মুসলিম লীগের কাছে দাঁড়িয়েছিল চিরায়ত গল্পের সারসকে অতি উপদেয় পায়েস চ্যাপ্টা থালায় পরিবেশন করে আপ্যায়ন করার মতোই । লীগ এটা আন্দাজ করেছিল আগেই। ক্যাবিনেট মিশন এর প্রস্তাবে নেহেরুর সাথে সই করে ঐক্যবদ্ধ ফেডারেল সরকারে থাকতে রাজি হলেও ঐ দিনই নেহেরুর সন্ধ্যার সময়ে সাংবাদিক সম্মেলনের ঘোষিত বাঁকা কথার বিভ্রান্তিতে সন্দেহ পোষণ করে নিজেদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে, "ডাইরেক্ট একশান ডে" ঘোষণা করে দেয় মুসলিম লীগ। দেশভাগের পরিস্থিতি তৈরী করতে তারা দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু করে দেয়, কলকাতা, নোয়াখালী, বিহার,এক কথায় দেশ জুড়ে। মুসলিমদের ওপর পাল্টা হাঙ্গামা চালায় হিন্দু-মহাসভা,আরএসএস ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদীরা।
সেই সময়কার সন্ধিক্ষনে উত্তাল শ্রমিক কৃষক আন্দোলনের উজ্জ্বল পরিবেশের মধ্যেও দেশভাগের অবশ্যম্ভাবিতা সাধারণ মানুষের মধ্যে তখন গেঁথে গিয়েছিলো। কংগ্রেস বা জাতীয় নেতারা সেটা ধরে নিয়েই সংবিধাণের দিশা রচনা করে। তিলক ও জিন্নার মধ্যে স্বাক্ষরিত পুরানো "লক্ষ্ণৌ চুক্তি" তথা ভারত শাসন আইণের অধীনে অনুষ্ঠিত একটা স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া দীর্ঘ-অনুশীলন, যা ছিল মুসলিমদের জন্য "পৃথক নির্বাচকমন্ডলী", তাকে ভ্যানিশ করে দিয়ে জাতীয় নেতারা প্রমান করলেন যে তাঁরা ফেডারল কাঠামোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষ চান না, বরং ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগই চান।
আম্বেদকর, যিনি অনিচ্ছা সত্বেও বাধ্য হয়ে পুনা চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পরেও নিজে তাতে অসন্তুষ্ট থাকায় দলিতের পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর স্বপক্ষেই কথা বলে গেছেন এতকাল, তিনিও আর সেটা সংবিধান রচনাকালীন গণ-পরিষদের বিতর্ক সভায় ওঠাতে চান নি। তিনি তখন বাংলাকে প্রতিনিধিত্ব করতেন। বরং দেশ ভাগ হয়ে যাবার পর বাংলার প্রতিনিধিত্ব ছেড়ে মহারাষ্ট্র থেকে কংগ্রেসের বদান্যতায় জিতে কংগ্রেস মন্ত্রীসভায় যোগদান করে সংবিধানের "ড্রাফটিং কমিটি"র চেয়ারম্যান হন। দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর দাবী হয়তো এজন্যই তিনি নতুন করে আর কখনই ওঠান নি, যে তাহলে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর কথাও আবার জোরালোভাবে উঠে আসবে, আর মুসলিম লীগ ভারতের মধ্যেই থেকে যাবার সম্ভাবনা আবার তৈরী হবে। সেটা উনি কখনোই চান নি। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় প্রচারিত ও বিখ্যাত গ্রন্থ "পাকিস্তান অর পার্টিশান" (১৯৪৫) বইয়ের মূল কথাই ছিল তাই। সামগ্রিক জন্যসংখ্যায় অবিভক্ত ভারতবর্ষ হিন্দু প্রধান দেশ হলেও সৈন্যবাহিনীতে শতাংশ হিসাবে মুসলমানের অধিক্য থাকায় ভারত আগামী দিনে মুসলিম রাষ্ট্র হয়ে যেতে পারে। অথবা তা না হলেও কোনও মুসলিম দেশ ভারত আক্রমণ করলে সেই সৈন্যরা তাদের বাধা না দিয়ে বরং ডেকে আনবে। এতদিন ব্রিটিশের অধীনতায় থেকে তারা তা করেনি নিশ্চয়ই, কারণ ব্রিটিশকে তারা তাদের চেয়ে উন্নততর মনে করে। কিন্তু হিন্দুকে তারা তাদের চেয়ে কম উন্নত মনে করে। তাই হিন্দুর অধীনে মুসলিমরা থাকতে চাইবে না বলে তারা এটা করবেই। তাই মুসলিম সৈন্যমুক্ত ভারতীয় প্রতিরক্ষা গড়া সম্ভব একমাত্র পাকিস্তান গঠন করে আলাদা দেশ সৃষ্টির মাধ্যমেই। অবিভক্ত ভারত রেখে দিয়ে শুধু সেনাবাহিনী থেকে মুসলিম-ছাঁটাই করা সম্ভব নয়। বইটি হট কেকের মতো বাজার গরম করে। কংগ্রেস নেতৃত্ব আম্বেদকরের চিন্তায় প্রভাবিত হয়েই সম্ভবত এরকম সিদ্ধান্ত নেয়, যা দেখা যাচ্ছে। কেননা এর আগে পর্যন্ত তাঁরা এরকম ভাবে কখনও ভাবেন নি। কিছুদিন আগেই "ভারত ছাড়ো" আন্দোলনের পর্যায়ে (১৯৪২) তাঁদের এতদূর পর্যন্ত উচ্চ-নিনাদ শোনা গেছিলো, যে, "প্রয়োজনে মুসলিম লীগের হাতে হলেও শাসন তুলে দাও, তবু বিদেশী ব্রিটিশ তুমি এখান থেকে চলে যাও।" পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে জাতীয় নেতাদের একতরফা এইরকম সিদ্ধান্ত বদলে নেওয়া দেখে, মুসলিম লীগ কর্তৃক কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলির সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া বয়কট ও দাঙ্গাহাঙ্গামার পর সবকিছু বিচার করে ব্রিটেনের নির্বাচনে ক্ষমতায় নতুন আসা লেবার পার্টির সরকার "ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স এক্ট, ১৯৪৭" মারফৎ ভারতে দেশভাগ করে দুটো আলাদা দেশ বানিয়ে স্বাধীনতা প্রদান করে। সংবিধান রচনা শেষে অবশ্য আম্বেদকর আগামী দিনে দেশে হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান ও কট্টর দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আন্দাজ করতে পেরে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন, যাকে তিনি দেশের ভাগ্যকাশে "সম্ভাব্য সবচেয়ে দুর্দিন" বলে চিহ্নিত করেন ।
ভারতের সংবিধান অনুযায়ী ভারতবর্ষ হল আসলে কোয়াজি-ফেডারল চরিত্রের, অর্থাৎ দেখে ফেডারল মনে হলেও গভীর চরিত্রে প্রকৃত ফেডারেল নয়। একেবারে "নাম কা ওয়াস্তে ফেডারেল" নয় নিশ্চয়ই, তবুও বোঝা যায় এখানে কেন্দ্রিকতাই বেশি শক্তিশালী। "কেন্দ্রীয় সরকার" বলে কাজ চলে, যার আসলে নাম হওয়া উচিত ইউনিয়ন গভঃমেন্ট। বাস্তবতা অনিবার্য ভাবে তাই ছিল, তাই, নাম আইনত যাই হোক, কার্যত ভারত সরকার মানে দাঁড়িয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার অনেক দিন আগে থেকেই।
বর্তমান নিবন্ধে বিচার্য এটা, যে এইটাই কি একমাত্র সম্ভাবনা বা ভবিতব্য ছিল? নাকি অন্যরকম ভাবনা-চিন্তাও এদেশে কখনও কোথাও হয়েছিল? ফেডারেল গভর্নমেন্টের প্রস্তাব কি কেবল বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর কালে ব্রিটেনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় এসেই আমাদের জন্য ক্যাবিনেট মিশন পাঠিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলো? তার আগে আমাদের দেশের কেউ কি তা নিয়ে একেবারেই ভাবে নি?
এটা জানতে হলে তাকাতে হবে এদেশের হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অনন্যসাধারণ তাত্বিক প্রবক্তা তথা শ্রমিক আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের দৃষ্টান্তসৃষ্টিকারী সফল সংগঠক বামপন্থী নেতা এম এন রায়ের এই সংক্রান্ত বিষয়ে আন্তরিক প্রচেষ্টার দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীনই ১৯৪৪ সালে "স্বাধীন ভারতের খসড়া সংবিধান"(ড্রাফট কনস্টিটিউশন অফ ফ্রী ইন্ডিয়া) রচনা করে তিনি নিজের সংগঠন ৱ্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সম্মেলনে আলোচনার মধ্যে দিয়ে গৃহীত করান। তারপর ঐ ড্রাফট নিয়ে আলোচনার জন্য দেশ জুড়ে সমস্ত মহলে প্রচার চলে ঐ পার্টির পক্ষ থেকে। সেই খসড়ায় সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর প্রস্তাব রাখা হয়। সংখ্যালঘু বলতে ধর্ম, জাত বা ট্রাইব ইত্যাদির কোনো নির্দিষ্ট উল্লেখ থাকে না। কেবল শহর ও গ্রামের ক্ষেত্রে আলাদা করে দুটি ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জনসংখ্যার কথা প্রস্তাবিত থাকে। ফলে আলোচনার জন্য ও সবার ঐক্যবদ্ধ হবার আগ্রহ সৃষ্টিকারী সবরকম দরজাই খোলা রাখা হয়।
খসড়ায় জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা জোরের সঙ্গে থাকে। প্রস্তাব হয়, ত্রি- স্তরীয় ব্যবস্থা। ফেডারল ব্যবস্থা, যাতে প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও মুদ্রা ব্যবস্থা ছাড়া আর সমস্ত কিছুই থাকবে প্রদেশগুলির হাতে, এমনকি নিজস্ব প্রদেশিক সংবিধান পর্যন্ত। প্রদেশগুলির নিজেদের অসুবিধার কারণে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকারও দেওয়া হয়। আর নীচু তলায় তৃতীয় স্তরে জনগণের কমিটি। ব্যক্তি জীবনে নিজের মতো উপাসনা করার (ওয়ারশিপ )পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে। সকলের জন্য চোদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত বাধ্যতামূলক অবৈতনিক সেকুলার শিক্ষাব্যবস্থা। রয়েছে জমি, খনিজ ও প্রধান শিল্প বা অর্থনৈতিক বিষয়গুলির রাষ্ট্রীয়করণ। অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাকে মৌলিক অধিকারের মধ্যে রাখা হয়। বিচার ব্যবস্থার মাধ্যম ছাড়া কোনো নাগরিককে গ্রেফতার করা যাবে না। আইন প্রণয়ন সংস্থা(লেজিশ্লেসন) সহ, কার্যনির্বাহক সংস্থাকেও (এগজিকিউটিভ) জনগণের নির্বাচনের আওতায় আনার প্রস্তাব থাকে। নির্বাচিত প্রতিনিধিকে প্রত্যাহারের অধিকার কয়েকটি বিস্তারিত ধারার মাধ্যমে খুবই মুন্সীয়নার সাথে রাখা হয়। গভর্নর জেনারেল সারা দেশের আপামর নাগরিকের প্রত্যক্ষ্য ভোটে জিতবেন। পর্যায়কাল শেষ হবার আগেই প্রয়োজনে তাঁর পদ প্রত্যাহারের বিষয়টিও ভালোভাবেই রয়েছে।
ভূমিকায় শ্রী রায় লিখেছেন "এই খসড়া সংবিধান গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ফসল নয়।" তার সীমাবদ্ধতার উল্লেখ রয়েছে। ড্রাফটের ধারায় লেখা আছে এই রাষ্ট্রের ভিত্তি হল "সংগঠিত গণতন্ত্র" (অর্গানাইজ্ড ডেমোক্রেসি)। কোনও "জনগণতন্ত্র" বা "বিপ্লবী গণতন্ত্র" জাতীয় শব্দবন্ধ নাই। সংবিধান নিজেই যাতে ক্রমশ একটা ঐক্যের জায়গা গড়ে তুলতে মানুষের আছে শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠতে পারে তার প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। সবার আগ্রহ সৃষ্টির কারণে পরবর্তীতে ভারতের সংবিধান রচনার পর(১৯৪৯) তাকে আম্বেদকর বলেছিলেন "অগণতান্ত্রিক ভিত্তিভূমির ওপর এক সাজানো পোশাক", যে বাক্যাংশে একটা স্বরূপ-উন্মোচনকারী তির্যক থাকলেও তা এক নৈরাশ্য সূচক ব্যঞ্জনার সম্ভাবনাও রাখে। তার চেয়ে একই বাস্তবতা স্বীকার করেও প্রত্যয়-সূচক ও আশাব্যঞ্জক শব্দ চয়ন "সংগঠিত গণতন্ত্র" হয়তো একটু বেশি প্রেরণাদায়ক।
ফেডারেল কাঠামো, মৌলিক অধিকার ইত্যাদি মার্কিন সংবিধানকে মাথায় রেখে বা তার অনুপ্রেরণায় এসেছে ঠিকই। কিন্তু নীচুতলার "জনগণের কমিটি" এসেছিলো একেবারেই সোভিয়েতকে স্মরণ করে। প্রতিনিধি প্রত্যাহার ও এগজিকিউটিভকেও জনগণের "অডিট"এর এখতিয়ারে আনা অতীতের "প্যারি-কমিউন"এর কথা ভাবায়। শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকারকে মৌলিক অধিকার ও পবিত্র বলা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো সংবিধান কোনোদিন বরদাস্ত করে নি। খসড়ার মধ্যে চিন্তার জায়গায় সেটা সবচেয়ে মৌলিক। কমনওয়েলথকে ইন্দো-ব্রিটিশ কমনওয়েলথ না আখ্যা দিলে তাতে না থাকা, এবং ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রতে যারা থাকতে চাইবেনা, বা কোনও রাজণ্যবর্গ যারা ফেডারেশনে যোগ দেবেন না, তাদের নিয়েও একটি সমন্বয়ধর্মী কিছু কমনওয়েলথ গড়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার কথা রয়েছে।
একই সাথে কমরেড রায় স্বাধীন ভারতের জন্য একটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনাও পেশ করতে নেতৃত্ব দেন দলের তিনজনের একটি টিমের মাধ্যমে। সেটিও খুবই শিক্ষণীয়। ঐ সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় যাঁরা সহযোগী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আম্বেদকর, রায় এবং সিপিআই। নিজের নিজের মতো করে তাঁরা কাজ করতেন। উদাহরণ-স্বরূপ, আম্বেদকর শ্রম-মন্ত্রী হিসাবে মহিলা-শ্রমিকদের জন্য প্রসূতি-কালীন ভাতা ও ছুটির ব্যবস্থা চালু করেন, রায় খাদ্য-রেশব্যবস্থা চালু করার সফল আন্দোলন করেন, সিপিআই দুর্ভিক্ষের সময়ে "ধর্মগোলা" চালু করে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচানোর কাজ করে। বিশেষ করে রায় এবং আম্বেদকর এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাহচর্য্য ও বোঝাপড়া ছিল। কিন্তু ঐক্যের পাশাপাশি আবার মতানৈক্যটা বোঝা যায় এখন থেকে যে অন্য কেউই এই খসড়া-সংবিধানকে গুরুত্ব দেয়নি। বরং ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে, এই খসড়ার ওপরের দিকের বিষয়বস্তুর ও বৈশিস্ট্যের কিছু মিল পাওয়া যায়। কিন্তু সামগ্রিক আধুনিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নিচুতলার গণতন্ত্রের বিষয়টা ধরতে অনেকেরই অনেক সময় লাগারই কথা। অনেক বছর পরে জয়প্রকাশ নারায়ণ এক সময়ে এই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও খসড়া-সংবিধানের দিকে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। উপমহাদেশের মহা-সমন্বয়ধর্মী ঐক্য অনেক পরে বিপ্লবী গণতন্ত্রের কোনো কোনো অংশকে আকৃষ্ট করেছিল।
কমরেড এম এন রায় ভারতে সংবিধান রচনার জন্য "কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলি"র ধারণা প্রথম এদেশে আনেন বিদেশ থেকে পাঠানো পার্টি পত্রিকা মারফত, এবং তা ১৯২৮ সালে জার্মানিতে তাঁর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অফিসে থাকাকালীন। সাইমন কমিশন এর মধ্যে ভারতীয়দের কোনো প্রতিনিধি না থাকায় জাতীয়তাবাদীরা প্রতিবাদী আন্দোলন করেছে, আর বঞ্চিত মানুষের একেবারে প্রান্তিক অংশের কিছু অধিকার অর্জনের জন্য কমিশনকে কাজে লাগানোর কথাও আম্বেদকরের মতো কিছু অর্গানিক বুদ্ধিজীবীরা ভেবেছিলেন। তখনও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক থেকে রায়কে বিতাড়িত করা হয়নি, ষষ্ঠ কংগ্রেস চলছে। সেই প্রেক্ষিতেই কমরেড রায়ের তরফে সাইমন কমিশনের প্রত্যুত্তর ছিল, বিধান সভা ভিত্তিক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত "কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলি" গঠনের মাধ্যমেই দেশের জন্য আইন তৈরী করা। শুধু ভারতীয় হলেই হবে না, তাকে নির্বাচিতও হতে হবে।
পরবর্তীতে জনগণের অধিকাংশই ঐ ধারণা গ্রহণ করেন। ঐ বিষয়ে তাঁর অবদান একাডেমিক জগতে স্বীকৃত। কিন্তু দেশের সংবিধান রচনায় তাঁর প্রচেষ্টা তথা ভারতবর্ষকে ঐক্যবদ্ধ রাখার বৌদ্ধিক প্রয়াস ও আধুনিক গণতন্ত্রের জন্য আন্তরিক আর্তির মূল্য কেউ দেয়নি। গণতন্ত্রের অস্তিত্বের লড়াইয়ের পর্যায়ে তাঁর সেই বার্তাকে ফিরে দেখা আজও প্রাসঙ্গিক।