আশির দশকে বাবা-মায়ের সাথে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যেতাম। আমি তখনো প্রাথমিকে, সে কলকাতার এক বিখ্যাত স্কুলের উঁচু ক্লাসে প্রথম সারির ছাত্র। তার ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বরের গর্বে তার বাবা-মা তো বটেই, প্রতিফলিত গৌরবে আমাদের অন্য আত্মীয়স্বজনদেরও মাটিতে পা পড়ে না। তাদের বাড়ি গেলে কিন্তু বোঝা যেত তার বাবা-মা গৌরবে বহুবচন চান না মোটেই। যত নিকটাত্মীয়ই আসুক, সে পড়ার টেবিল ছেড়ে নড়ত না। তেরো চোদ্দ বছরের ছেলেটিকে আমার মনে হত পঞ্চাশোর্ধের মত রাশভারী। এমন নয় যে এই রুটিন কেবল পরীক্ষার আশেপাশে। বারো মাস সে এভাবেই চলত। স্বভাবতই আমার মত শৈশব পার না হওয়া আত্মীয়দের কাছে বড়রা ঐ ছেলেটিকে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে হাজির করতেন। বড়রা বারবার শোনাতেন “ওর মত হওয়ার চেষ্টা করো। দেখেছ কেমন লেখাপড়ায় মন? বাড়িতে যে-ই আসুক, ঝড় উঠুক, বন্যা হয়ে যাক, ও কিন্তু পড়া ছেড়ে ওঠে না।”
বড় পরীক্ষাগুলোতে ভাল নম্বর এবং শিক্ষান্তে মোটা মাইনের চাকরি পাওয়া যদি মানুষ হওয়ার মাপকাঠি হয় তাহলে বলা দরকার যে ছেলেটি মানুষ হয়েছে। আমি নিশ্চিত এই পথে হেঁটে এরকম মানুষ হওয়া মানুষ আমরা সকলেই কাঁড়ি কাঁড়ি দেখেছি গত তিরিশ চল্লিশ বছরে, এখনো দেখছি। প্রশ্ন হল সফল মানুষ আর ভাল মানুষ কি একই? ভাল মানুষ মানেই বা কী? যে মন দিয়ে রোজগার করে সংসার চালায় তার বাকি সমাজের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা না থাকলে, চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন হলেও কি তাকে ভাল মানুষ বলা যায়?
এই প্রশ্নগুলো কদিন আগে করলেও হাঁ হাঁ করে উঠতেন অনেক ভদ্রজন, বাকিরা পাত্তা দিতেন না। কিন্তু রোগ বড় বালাই, বিশেষত অতিমারী। গত দুদিন ধরে যেভাবে সকলে একটি অক্সফোর্ডের ছাত্র এবং তার বাবা-মাকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় অভিযুক্ত করছেন তা দেখে অপ্রিয় প্রশ্নগুলো তোলার ঝুঁকিটা নিয়েই ফেললাম।
নিজের কাছে সৎ থাকতে হলে মানতেই হবে এই প্রশ্নগুলো গত সাড়ে তিন দশক আমরা একেবারেই নিজেদের করিনি, অন্যদেরও করিনি। এগুলো অবান্তর হয়ে গেছে। ছোট থেকেই শিখে গেছি যে আমি মানুষ হয়েছি কিনা তার প্রমাণ হল আমি কোন পেশায় আছি এবং কত রোজগার করি। অতএব আমার ক্লাসের যে ফার্স্ট বয় পরে তত ভাল রেজাল্ট করতে না পেরে এখন সামান্য ব্যাঙ্ককর্মী, তার চেয়ে বেশি মানুষ হয়েছে থার্ড বয়। কারণ সে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে। এমন নয় যে কেবল অন্যরাই এভাবে ভাবে। ফার্স্ট বয় নিজেও ভাবে “আমার দ্বারা কিস্যু হল না। ও শালা স্কুলে কোনদিন আমাকে ছুঁতে পারত না, কপাল জোরে কোথায় উঠে গেল!”
আমাদের প্রজন্ম এভাবেই ভাবতে শিখেছে এবং আমরা বাবা-মা হয়েও আমাদের নার্সারি স্কুলে যেতে শুরু করা ছেলেমেয়েদের এভাবেই ভাবতে শেখাচ্ছি। লক্ষ্য করুন, এই চিন্তার সমস্তটা জুড়েই আমি, কোথাও আমরা নেই। বন্ধুর সাফল্যে আনন্দ পাওয়া নেই, বন্ধুর ব্যর্থতায় কষ্ট পাওয়া নেই। দু তিন প্রজন্ম ধরে এ হেন স্বার্থপরতার কৃষিকাজ চালালে যেমন ফসল ফলে আমাদের বিলেত ফেরত বাবুসোনা ভাইটি তাই — তার বেশি কিচ্ছু নয়। আর তার বাবা-মা যে অপরাধ করেছেন তা শুরু হয়েছে তার ছোটবেলায়। সেই একই অপরাধ আমাদের অনেকের বাবা-মাই করেছেন। এমন করে গায়ে লাগেনি বলে সমাজ সেটাকে অপরাধ বলে চিহ্নিতই করেনি এতদিন। ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে কেবল শিখেছে পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে পারলেই তার কাজ শেষ। দুনিয়ার কারোর প্রতি তার কোন কর্তব্য নেই। ঐ যে আমার আত্মীয় সম্পর্কে বড়রা বলতেন “বাড়িতে যে-ই আসুক, ঝড় উঠুক, বন্যা হয়ে যাক” ইত্যাদি। অর্থাৎ ঝড়ে তোমার প্রতিবেশীর ঘরের চাল উড়ে গিয়ে সে নিরাশ্রয় হয়ে যাক, তুমি বাবা-মায়ের বানিয়ে দেওয়া পড়ার ঘরে মোটা মাইনের চাকুরে হওয়ার প্রস্তুতি চালিয়ে যাও। বন্যায় তোমার আত্মীয়ের ঘর ভেসে যাক, তোমার দু ফোঁটা চোখের জল ফেলারও দরকার নেই, তুমি কেশব নাগের অঙ্কগুলো শেষ করো। ভাগ্যিস কেশবচন্দ্র নাগের অঙ্ক বইই কিনে দেওয়া হত আমাদের, তাঁর কষ্ট করে লেখাপড়া করার ইতিহাস পড়ানো হত না। অবশ্য হলেই বা কী হত? আমরা মুখস্থ করতাম আর পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে ভুলে যেতাম। যেমনটা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে করেছি।
তা এইভাবে যে বাবুসোনাদের তৈরি করা হচ্ছে, কী করে আমরা আশা করছি যে তারা নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আনন্দ ফুর্তির বাইরে কিছু ভাববে? গায়ে যখন জ্বর নেই, গলায় ব্যথা নেই, কাশি হচ্ছে না, তখন বাবুসোনা কেন মায়ের অফিসে কলার তুলে ঘুরতে যাবে না? কেন গিয়ে লাইন দেবে হাসপাতালে? তাও আবার সরকারী হাসপাতালে? ওসব হাসপাতাল তো তার বাড়ির কাজের মাসির জন্যে। আর মা-ই বা কেন ছেলেকে আদর করে অফিসে, মলে, ক্লাবে ঘোরাবেন না? কজনের ছেলে অক্সফোর্ডে পড়তে যায়? চুলোয় যাক জনস্বাস্থ্য, চুলোয় যাক সাবধানতা।
খুব খারাপ লাগছে তো কথাগুলো? বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে তো? তাহলে বলি। আমি যে স্কুলের ছাত্র, সেই স্কুলের আন্তঃক্লাস ফুটবল প্রতিযোগিতা হয় প্রয়াত মাস্টারমশাই পাঁচুগোপালবাবুর নামে। তাঁকে আমরা পাইনি। আমাদের ইংরিজির মাস্টারমশাই সোমনাথবাবু একবার হাসতে হাসতে বলেছিলেন “পাঁচুবাবু যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন, তখন হাসপাতালে রাত জেগেছিল আমাদের খারাপ ছাত্ররা, ভাল ছাত্ররা নয়।”
আমাদের সময় থেকেই এমন হয়। কারণ বাবা-মা শেখান পড়াশোনা করা এত বিশাল একটা কাজ যে ওটা করে আর কিচ্ছু করা যায় না। কারো জন্যে হাসপাতালে রাত জাগা যায় না, বাড়িতে কেউ এলে গল্পগুজব করা যায় না, এমনকি পাঠ্যের বাইরে ভাল বই টই পড়াও যায় না। যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি, বাংলা ক্লাসে আমাদের মাস্টারমশাই সুশান্ত বসু এক ভাল ছাত্র কোন এক বিখ্যাত সাহিত্যিকের নাম শোনেনি শুনে হতাশ হয়ে বলে ফেলেছিলেন “এত বয়স হয়ে গেল ওঁর কোন লেখা পড়োনি? জীবনটা কাটাবে কী করে!” কী কুক্ষণেই বলেছিলেন! হোস্টেলে ফিরে অন্য এক ভাল ছাত্র নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিল, যার মূল উপজীব্য “সাহিত্য-ফাহিত্য পড়ে নষ্ট করার মত সময় নেই। এখন সামনে হায়ার সেকেন্ডারি, তারপর জয়েন্ট। এস্ট্যাবলিশড হয়ে নিই, তারপর বই ফই পড়া যাবে।”
আমার সেই সহপাঠীরও দোষ নেই। বাবুসোনা সংস্কৃতির ঐ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া দুনিয়ায় আর কোন কিছু পড়ার কোন দরকার নেই, যারা পড়ে তারা ফালতু। আমার এক মেধাবী বন্ধু উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ে সাড়া জাগানো ফল করেছিল। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফল বেরোবার পর তার বাড়ি গিয়ে আমার মনে হয়েছিল কেউ মারা গেছেন। কারণ ইঞ্জিনিয়ারিঙে তার হাজার তিনেক র্যাঙ্ক হয়েছে, বাবা বলেছেন “ওর লাইফ শেষ”। এই কারণে পিটার উইর পরিচালিত ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’ ছবিটা দেখলেই মনে হয় এটা এই বাংলারই গল্প।
অবশ্য আমাদের বাবুসোনা সংস্কৃতি এমন জোরদার যে জন কিটিং (যে চরিত্রে রবিন উইলিয়ামস অভিনয় করেছিলেন) এর তুলনায় অনেক নিরামিষ কথাবার্তা বলেই আমাদের সুশান্তবাবু ছাত্রদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।
অথচ বাঙালি ছেলেরা এমন বাবুসোনা চিরকাল ছিল না কিন্তু। হলে ক্ষুদিরামকে পাওয়া যেত না, বিনয় বাদল দীনেশ হত না, নকশালবাড়ি আন্দোলন বলেও কিছু ঘটত না। সেকথা থাক, বাবুসোনাদের বিদ্রোহী বিপ্লবী হওয়ার দরকার নেই (ক্ষুদিরাম তো কবেই আমাদের ঠাট্টার পাত্র হয়ে গেছেন), একটু মানুষের মত মানুষ হলেই যথেষ্ট হয়। কিন্তু কী করে হবে? মানুষ যেমন সমাজ তৈরি করে, সমাজও তো মানুষ তৈরি করে। আমাদের সমাজ তো ক্রমশ উন্নততর বাবুসোনার কারখানা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজকাল দেখি পাড়ার বাচ্চারা মাঠে খেলার সময় মায়েরা বসে থাকেন পাশে। পড়ে গেলে দৌড়ে আসেন, খেলতে খেলতে ছোটদের মধ্যে ঝগড়া লাগলে প্রায়শই তা মায়েদের ঝগড়ায় পরিণত হয়। অর্থাৎ শিশু ছোট থেকেই শিখছে সে কখনো ভুল করে না, সে যা চায় সেটাই তার অধিকার।
বছর দুয়েক আগে আমাদের এক প্রতিবেশী মারা গেলেন। আমাদের পাড়া থেকে শ্মশান অনেক দূরে হওয়ায় কেউ মারা গেলে ম্যাটাডোরে করে নিয়ে যাওয়া হয় সাধারণত। শ্মশানযাত্রীতে ভরে যায় সে ম্যাটাডোর, অল্পবয়সীরা থাকে বেশি সংখ্যায় — এমনটাই কৈশোর থেকে দেখে আসছি। সেবার দেখলাম ম্যাটাডোরের উপর বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে। আরো যা বিস্ময়কর, একটি বছর কুড়ির ছেলেকে বাদ দিলে শ্মশানযাত্রীদের মধ্যে পঁয়ত্রিশোর্ধ আমিই সর্বকনিষ্ঠ। বাবুসোনারা বোধহয় টিউশনে ব্যস্ত ছিল। আমাদের মফস্বলেই এই অবস্থা, কলকাতার খবর জানি না।
এবার প্রবল আপত্তি উঠবে। যদি শ্মশানে, হাসপাতালেই ঘুরে বেড়ায় পড়ুয়ারা, তাহলে লেখাপড়া করবে কখন? এমন আপত্তি আমাদের বাবা-মায়েরা আর আমরাই করে থাকি। তার আগের লোকেরা করতেন না। বলা হয় আগে নাকি “কম্পিটিশনের যুগ” ছিল না, তাই অন্য সবে মন দেওয়া সম্ভব ছিল। অথচ আমরা এ ধরাকে ধন্য করে দেওয়ার অনেক আগেই দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে, দেশ ভাগ হয়েছে। ভদ্রসন্তানদের পর্যন্ত দু মুঠো ভাতের জন্য করতে হয়নি এমন কাজ নেই। তার চেয়ে বেশি কম্পিটিশনে আমাদের পড়তে হয়েছে কি?
লেখাটা যদি এতদূর অব্দি পড়ে ফেলে থাকেন তাহলে হয়ত খেয়াল করেছেন আমি কেবল ছেলেদের কথাই বলে যাচ্ছি, ভদ্রলোকের মেয়েদের কথা বলছি না। তার মানে এই নয় যে ভদ্রজন মেয়েদের দারুণ সামাজিক জীব তৈরি করছেন। এ যুগের আলালদের ঘরে কেবল দুলাল তৈরি হয় না, বিলক্ষণ দুলালীও হয়। সেই সোনামণিরা বাবুসোনাদের চেয়ে যে মোটেই আলাদা নয় তাও দেখা যাচ্ছে কয়েকজন বিলেত ফেরতের খবরে। বিলেত না যাওয়া মেমদের কোরোনার কারণে স্কুল কলেজ না থাকার সুযোগে দলবদ্ধ ফুর্তি দেখেও টের পাওয়া যাচ্ছে। তবু একে বাবুসোনা সংস্কৃতিই বলছি কারণ এই ধারাটি বাঙালি তৈরি করেছিল পুত্রসন্তানদের কথা ভেবেই। তার প্রমাণ এক দেড় দশক আগেও বিজ্ঞান শাখায় বাঙালি মেয়ের অভাব।
বাবা-মায়েরা বলতেন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হলে জীবন বৃথা। তারপর বেশ নিঃসঙ্কোচে বলতেন “মেয়ে হলে অত চিন্তা করতাম না। কিছু না হলে বিয়ে দিয়ে দেব, মিটে যাবে।” তাই সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ বানানোর তাগিদ মেয়েদের বেলায় কম দেখা যেত। ফলত আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা ইঞ্জিনিয়ারিঙের ছাত্র তারা দুঃখ করত “তোদের আর্টসের ক্লাসগুলোতে কত মেয়ে থাকে, আমরা তিরিশটা ছেলে আর দুটো মেয়ে। প্রেম করতেও কম্পিটিশন।” কথাটা মজা করে বলা হলেও একটা বড় সত্য বেরিয়ে আসে, তা হল ছেলেরা যা হলে মানুষ হয়েছে বলে বাবা-মায়েরা মনে করতেন মেয়েদের তা না হলেও চলত। মেয়ে মাস্টারি করলেও মানুষ, ছেলে মাস্টার হলে “ফেলিওর”।
বাবুসোনা সংস্কৃতি কী দিয়েছে বাঙালিকে? সমাজ সংসার ভুলে লেখাপড়া করে কজন বাঙালি প্রযুক্তিতে আলাদা করে বলার মত অবদান রেখেছে গত তিরিশ বছরে? গত চল্লিশ বছরে কজন বাঙালি ডাক্তারকে সারা ভারত এক ডাকে চিনেছে? নাহয় অত বড় না-ই হল, স্থানীয় মানুষ নাম শুনলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত করে এমন ডাক্তারই বা কজন হয়েছে সারা পশ্চিমবঙ্গে? উত্তরে লবডঙ্কার বেশি কিছু পাওয়া শক্ত। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সাড়া জাগানো কটা কবিতা লেখা হয়েছে বাংলায় বা কটা ফিল্ম তৈরি হয়েছে এই সময়ে সে প্রশ্ন করার কোন মানেই হয় না কারণ ওসব লাইন যে মেধাবীদের জন্যে নয় তা তো বাবুসোনা সংস্কৃতি বলেই দিয়েছে। একই সঙ্গে ভুলিয়ে দিয়েছে যে সংস্কৃতি মানে কেবল নাচ, গান, ছবি আঁকা, নাটক করা, সাহিত্য রচনা নয়। বিজ্ঞানচর্চা, রাজনীতি — এসবও সংস্কৃতির অঙ্গ।
আসলে বিজ্ঞানচর্চা হবে কী করে? বাবুসোনা সংস্কৃতিতে বিজ্ঞান পড়ার উদ্দেশ্য তো বিজ্ঞান শেখা নয়, মোটা মাইনের চাকরি পাওয়া। আমার আরেক মাস্টারমশাই শাশ্বত ভট্টাচার্য যেমন একবার ক্লাসে বলেছিলেন “তোমরা বিজ্ঞান পড়ো এই কারণে নয় যে তোমরা বিজ্ঞান শিখতে চাও বা তোমরা বিজ্ঞানমনস্ক। তোমরা বিজ্ঞান পড়ো কারণ ওটা পড়লে বেশি ভাল চাকরি পাওয়া যায় বলে প্রচার আছে। যদি প্রচার থাকত কুসংস্কারে অনার্স পড়লে বেশি ভাল চাকরি পাওয়া যায়, তাহলে তোমরা কুসংস্কারেই অনার্স পড়তে।” কথাটা যে নেহাত অন্যায় বলেননি তা সেদিনের যে বাবুসোনারা সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এখন সোশাল মিডিয়ায় দক্ষিণপন্থী ভুয়ো খবরের সপক্ষে গলা ফাটায় তাদের দেখলেই পরিষ্কার হয়।
আর রাজনীতি? ওরে বাবা! লেখাপড়া করে হাসপাতালে অসুস্থ লোককে দেখতেই যাওয়া যায় না, আবার রাজনীতি করা যাবে কী করে? করা যে যায় তার কিন্তু অনেক প্রমাণ আছে।
উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়া দীপঙ্কর ভট্টাচার্য (বাবুসোনাদের বাবা-মায়েদের প্রিয় নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র) সি পি আই এম এল লিবারেশনের সর্বক্ষণের কর্মী হয়েছেন, সর্বভারতীয় সম্পাদক হয়েছেন। সি পি আই এমের সর্বভারতীয় সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও সি বি এস ই র সর্বভারতীয় পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। অবশ্য বাবুসোনাদের বাবা-মায়ের বিচারে দুজনেই “ফেলিওর”। টাকা, গাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি — কিছুই করে উঠতে পারেননি। তবে সে বিচারে মানুষ হওয়া লোকেদের মধ্যেও কিন্তু ছাত্রনেতা পাওয়া যায়। সুপ্রিম কোর্টে আইন ব্যবসা করে প্রভুত সম্পত্তির অধিকারী এবং পরবর্তীকালে দেশের অর্থমন্ত্রী হওয়া প্রয়াত অরুণ জেটলি ছাত্র রাজনীতি করতেন।
সুতরাং বাবুসোনা আর সোনামণিরা স্বার্থপর, দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে ওদের উপর রাগ করবেন না। আমাদের ছানা পোনাগুলোও তো অমনিই হবে। দিল্লীতে নাকি লোকে আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে যা ইচ্ছা করার যুক্তি হিসাবে বলে “জানতা হ্যায় মেরা বাপ কৌন হ্যায়?” আমরা বাঙালিরা তো প্রগতিশীল, তাই হয়ত আমাদের ছেলেটি কোরোনাকে “জানিস আমার মা কে” বলে নিশ্চিন্ত হয়েছিল।