“আনারুল কেন পুলিশ পাঠায়নি”—মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সফর কালে এই প্রশ্নের উত্তর সেদিন খুঁজে পাননি। ফলত রামপুরহাটের ববটুই গ্রামের বহু-নিধন কাণ্ডে স্পষ্টতই ক্রুদ্ধ স্বরে তিনি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে করেই হোক, যেখান থেকেই হোক, আনারুলকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রীর আদেশ বীরভূম পুলিশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। দুঘন্টার মধ্যেই তাকে পুলিশ খুঁজে পেয়েছে এবং গারদে পুরেছে।
আসলে সেদিন আরও দু-একটা প্রশ্ন ম্যাডামের করা দরকার ছিল, যথা, “আনারুল না বললে পুলিশ খবর পেয়েও নিজে থেকেই কেন ঘটনাস্থলে ছুটে যায়নি”, “পুলিশ সেদিনই কেন আনারুলকে গ্রেপ্তার করেনি”, ইত্যাদি। আর এই সব প্রশ্নেরই উত্তর সেদিন হয়ত অজানা ছিল রাজ্যমুখ্যের কাছে। আমাদের কাছেও। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার মতো অবস্থায় রাজ্য থাকলে তো প্রতি-ভাদু দহন কাণ্ড হত কিনা সন্দেহ! এমনকি ভাদু শেখও হয়ত কেয়ামতের ময়দানে না থেকে এখন কোনো জেলে ফরাস পেতে বিড়ি ফুঁকতেন!
যাই হোক, সমস্ত প্রশ্নেরই উত্তর আমরা পেয়ে গেলাম গত কাল। ম্যাডাম পেলেন কিনা সময় বলবে। আজ অবধি যে পাননি সেই ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।
কীভাবে?
নিখিল ভারত তৃণমূল কংগ্রেস দলের বীরভূম জেলা সদর দপ্তরে জেলা শাসক ও জেলা পুলিশ সুপারকে ডেকে এনে অনুব্রত মণ্ডলের বৈঠকের মনোরম নয়ননন্দন দৃশ্যটি অবলোকন করে।
এটি এমন একটি দৃশ্য যা সিপিএম তথা বামফ্রন্টের চৌতিরিশ বছরের অনুরূপ সমস্ত কীর্তিকে এক ধাক্কায় ম্লান করে দেখিয়ে দিয়েছে, আই-ফোন যুগে পুলিশ ও প্রশাসনের প্রকৃত দলদাস হয়ে যাওয়া বলতে কী বোঝায়। অনুব্রত জেলা শাসকের অফিসে গিয়ে তাঁকে কী করিতে হইবে নির্দেশ দিচ্ছেন—এমনটা হলে সেই দৃশ্যটা আমাদের পুরনো চেনা ছকের মধ্যেই থাকত। তাতেও দলদাসত্বের বার্তা দেওয়া যেত। সিপিএম আমলে আমাদের সেই দৃশ্য চক্ষুসহ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ছকটা সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়ে অনুব্রত এবং তাঁর দলনেত্রী জানিয়ে দিলেন, তাঁরা কেবলমাত্র পুরনো মডেলের অনুসরণ বা অনুকরণ প্রিয় নন। নিত্য নতুন মৌলিক ধরনের উদাহরণ সৃষ্টিতে তাঁরা উৎসাহী এবং পারঙ্গম।
বর্তমান রাজ্য প্রশাসনের উচ্চতম কর্তা থেকে শুরু করে থানার ইন-চার্জ পর্যন্ত কেউই জানেন না, তাঁদের শাসক দলের কোন স্তরে কার কার কথা মেনে চলতে হবে, আর কাকে কাকে কখন অগ্রাহ্য করা যায়। সুতরাং চোখের সামনে অপরাধ সংঘটিত হতে দেখেও পুলিশের সাধ্য ছিল না, আরও উচ্চতর হুকুম বিনা, তাতে হস্তক্ষেপ করার। আর—কোট অ্যান্ড আনকোট অনুব্রত—শর্ট সার্কিট হয়ে টিভি ফাটুস কাণ্ডঘটলেপুলিশের এক্তিয়ারেই তা আসে না, অগ্নিকাণ্ড হয়ে দুপাঁচজন আহত না হলে বা মারা না গেলে। দমকলের কথা অবশ্য আলাদা।
রাজ্যবাসীর দুর্ভাগ্য, এই সব দুর্যোগ তাদের বসে বসে আরও বহু দিন দেখতে হবে। কেন না, রাজ্য পুলিশ, সিবিআই, মুখ্যমন্ত্রীর সম্বর্ধনা তোরণ আবৃত পথে ঘটনাস্থল পরিভ্রমণ, ঋণগ্রস্ত রাজকোষ থেকে এক গুচ্ছ ক্ষতি-নিয়ন্ত্রক অনুদান ঘোষণা, আদালতের তদন্ত-আগ্রহ—কোনো কিছুর মধ্যেই এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা তো দূরের কথা, উত্থাপনের আগ্রহও দেখা যাচ্ছে না। অন্তত আজ অবধি।
অথচ, এই জাতীয় প্রশ্ন উত্থাপন না করা হলে এই জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি আটকানোর কোনো সম্ভাবনাই বাস্তবে নেই।
প্রকৃতি বিজ্ঞানে জ্ঞানী লোকেরা কেউ কেউ বলে গেছেন, সমস্যার সমাধান খোঁজার চাইতেও সঠিক প্রশ্ন উত্থাপনই আসল এবং আরও বড় কথা। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, সঠিক প্রশ্ন উত্থাপন করলেই নাকি অর্ধ-উত্তর বেরিয়ে আসতে পারে।
সামাজিক ক্ষেত্রেও এই সব ঋষিবাক্য প্রায় সমান ভাবেই প্রযোজ্য।
শুধু মাত্র যে সমস্ত ঘটনায় মিডিয়া প্রচার হয়ে সাদা ভাবপ্রতিমায় কাদা লাগে তাতে ব্যস্ত হলেই হবে না। যে সমস্ত ঘটনা খবরের কাগজ বা টিভি চ্যানেল খুব একটা পাব্লিককে জানিয়ে শাসক দল বা সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে না বা করতে চায় না, তাতেও প্রশ্ন তুলতে হবে।
এই যে টিএমসি আর বিজেপি ছাড়া কোনো দল বা সংগঠনকেই প্রায় পুলিশ কলকাতার বুকে বা অন্যান্য জেলায় মিটিং মিছিল প্রতিবাদ সভা কিছুই করতে দিচ্ছে না, করতে গেলেই ডি এম অ্যাক্টো লাগিয়ে দিচ্ছে এবং গ্রেপ্তার করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে লাঠিচার্জ ইত্যাদিও করে যাচ্ছে,ডি এম আইনের সুবাদে কম পক্ষে দশ দিনের জেল হাজত আদায় করে নিচ্ছে, এই তৎপরতা পুলিশের কি এমনি এমনি জন্মাল? বহরমপুরে যে অনশন মঞ্চে আন্দোলনকারীদের বসতেই দেওয়া হল না—এসব কার নির্দেশে? যদি সরকারি তরফে এরকম ফরমান জারি করা হয়ে থাকে, তবে সেটা পাব্লিকের এবং সমস্ত গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলির জানা থাকা দরকার। তখন তারা এই রাজ্যে তাদের কোনো মুদ্দাতেমিটিং মিছিল ধর্না করার কোথাও কোনো গণতান্ত্রিক অধিকার বিদ্যমান নেই—জেনেই কর্মসূচি নেবে, কিংবা নেবে না।
আর যদি রাজ্যের উপর মহলের তরফে এরকম নির্দেশনামা না থাকে, তাহলে পুলিশের এই অতি সক্রিয়তাকে সরকারকেই উদ্যোগ নিয়ে বন্ধ করতে হবে। পুলিশকে পরিষ্কার জানাতে হবে, স্বীকৃত সর্ব মান্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আন্দোলনের কোনো কর্মসূচিকে বানচাল করা চলবে না। আয়োজকরা টিএমসি বা বিজেপি-র না হলেও।
এই যে মাস খানেক আগে নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ কামালগাজিতে পথসভা করার সময় একদল যুবককে গ্রেপ্তার করল, সভা করতেই দিল না, ধৃত আন্দোলনকারীদের থানায় নিয়ে গিয়ে বেধরক পেটাল, এবং পরের দিন বারুইপুর আদালতে তোলার সময় তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গেল, এগুলোর প্রত্যেকটাই দেশের এবং রাজ্যের ঘোষিত আইনের ভয়ঙ্কর বিরোধী। কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়াটা সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশিকার সরাসরি লঙ্ঘন এবং বেপরোয়া আদালত অবমাননা। রাষ্ট্র ক্ষমতার কোনো একটা পর্যায়ের পশ্চাদ-মদতে রাজ্য পুলিশের ভাবখানা হচ্ছে, ওরকম আইন অনেক থাকে, আমরা মানছি না, কে কী করবে!রাজ্য পুলিশ এই মনোভাব কোথায় পেল, যদি না তাদের জানা থাকে যে বামপন্থী আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রে যে কোনো আইন ভাঙলে রাজ্য সরকার এবং সরকারি দল খুশি হবে! কোনো পুলিশ কর্মীর এতটকু অসুবিধায় পড়তে হবে না।
রাজ্য সরকার যে এই সব ঘটনা জেনেও পুলিশকে তাদের এই সব বে-আইনি অসভ্য কাজের জন্য এযাবত কোনো তিরস্কার করেনি, তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ছিল আনিস হত্যাকাণ্ড। এখন সাদা কাপড়ে কালির দাগ লেগে যাওয়ায় দুচারজন পুলিশ কর্মচারিকে শাস্তি দিয়ে মুখ লুকোতে হচ্ছে, কিন্তু আজকের দিনের মিডিয়া এবং সোস্যাল মিডিয়ার সর্বাত্মক সিসিটিভি-র সামনে এসব কাণ্ড ঘটার পর মুখ রক্ষা করা মুশকিল। এক জেলার পুলিশ দুপুর বারোটায় বামপন্থী কর্মীদের নিশ্চিন্তে কোমরে দড়ি পরাতে পারে বলেই অন্য জেলার পুলিশ রাত বারোটায় কারও বাড়িতে বিনা ওয়ারেন্টে বিনা সাক্ষী ঢুকে পড়তে পারে।ছাদে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করতেও পারে। নির্যাতনের শিকার ছাদ থেকে পড়ে গেলে জলের ভাঙা পাইপও আবিষ্কার করতে অসুবিধা নেই। আবার এক জায়গার ভাঙা পাইপই আর এক জায়গায় টিভি বার্স্টের গল্পরূপ ধারণ করে। আপাত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এই ধরনের ঘটনাসকল এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা।
সিপিএমকে রাজ্যপাট থেকে নির্বাসিত করা যেত না, যদি সিপিএম নিজেই তার ব্যবস্থা সাজিয়ে গুছিয়ে না করে দিত। বাধা টপকে উত্তরবঙ্গের চাঁদমনি বাগানে নেওটিয়াকে বসিয়ে এবং দক্ষিণ বঙ্গে লোহা সিমেন্ট ফেলার ঘটনায় সিঙ্গুর থেকে বাড়তি সাহস পেয়ে নন্দীগ্রামে তারা যখন মানুষের বিরুদ্ধে আরও বড় আগুন জ্বালাতে গেল, সেই দিন শুরু হল তাদের পতনের দিন ক্ষণ। দুহাজার দুইয়ের বুদ্ধদেব স্যরের মতন আজ দুহাজার বাইশের মমতা ম্যাডামও মনে করতেই পারেন, তাঁদের নবান্নের আসন চির-পাকা। আর কেউ তাঁদের এখান থেকে টলাতে পারবে না। কিন্তু দেউচাপাচামিতে আদানিকে এনে সিঙ্গুর কাণ্ডের জেরক্স, আনিস কাণ্ডে রিজয়ানুর ঘটনার প্রতিচ্ছবি, আর সাম্প্রতিক কালে রামপুরহাটের এই নারকীয় ভাদু-আনারুল খাণ্ডবদাহ—কেন জানি না, এক অন্য সঙ্কেত জ্ঞাপন করছে বলে মনে হচ্ছে। যে ক্ষমতার বলে রিক্সাচালকের পক্ষে চার পাঁচ বছরের মধ্যে তিন মঞ্জিলা প্রাসাদ বানানো সম্ভব হয়ে ওঠে, সেই ক্ষমতার ভাগ তখন আরও এত জন পেতে চাইবে, যে সমস্ত অনুরূপ প্রাসাদেই হয়ত টিভি ফাটতে শুরু করে দেবে! তোলাবাজির পেছন পেছনই আসবে ফেলাবাজি! দ্বন্দ্বতত্ত্বের অমোঘ নিয়মে! পতনের আভিকর্ষিক নিয়মকে তখন ঠেকাবে কে?
গণতন্ত্রে ফিরে এলে সেই দিনটা পেছতেও পারে। নইলে গণতন্ত্র তার ফিরে আসার অন্য রাস্তা খুঁজে নেবেই। ফরাক্কায় গঙ্গানদীর বাঁধ পালানো পাড় ভাঙার মতো করে।