পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বামপন্থীরা কীভাবে আবার সামনের সারিতে আসতে পারেন?

  • 25 July, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 866 view(s)
  • লিখেছেন : মালবিকা মিত্র
যদি ভারতে বামপন্থীরা সব ছেড়ে শুধু পরিবেশ আন্দোলনে গুরুত্ব আরোপ করতো, তাহলে এই আন্দোলনে আদিবাসী মূলবাসী মানুষের অধিকার রক্ষা, জল জমি জঙ্গল রক্ষা, অনিয়ন্ত্রিতভাবে পরমাণু গবেষণা, মহাকাশ গবেষণা, বিদ্যুতের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বন্ধ করে বিদ্যুতের উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করা, এর মাধ্যমে নতুন নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করা । এগুলোর বিরুদ্ধে বামপন্থীরা একটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকৃত অর্থে সমগ্র মানবতার পক্ষে একটা গণ-আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে।

বামপন্থীদের সম্পর্কে একটা সাধারণ অভিযোগ হল, এদের পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা, আস্ত আস্ত, গোটা গোটা কেতাবি পরিভাষা ব্যবহার, ফলে মানুষ এদের কথা সবটা বুঝে উঠতে পারে না। বাম তত্ত্ব কথাগুলো একটু সহজবোধ্য করে, পুস্তিকা ও ইশতেহারের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। যেখানে বিশ্বায়ন শব্দটাই থাকবে না, যেখানে পুঁজিবাদ, মুদ্রাস্ফীতি, একচেটিয়া কারবার, এগুলো থাকবে না। আমি বলতে চাইছি সাম্যবাদ সম্পর্কে নজরুল যেমন বলতেন :

এই পৃথিবীর যাহা সম্বল

বাসে ভরা ফুল রসে ভরা ফল

সুস্নিগ্ধ মাটি সুধা সমাজ জল

পাখির কণ্ঠে গান

সকলের এতে সম অধিকার

এইটার ফরমান ভগবান ভগবান।

ভাবা যায় ফরাসি বিপ্লবের ইশতেহারে মানুষকে জীবনমুখী করে তোলা হচ্ছে ও ধর্মযাজকদের মৃত্যু চিন্তা প্রচারকে সমালোচনা করছে : মৃত্যু চিন্তা অহেতুক, কারণ তা জীবনের মতোই স্বাভাবিক। জন্মিলে মরিতে হবে। প্রতিদিন রাতেই আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি, তার সাথে মৃত্যুর একটাই পার্থক্য, সকালে আবার জেগে উঠি। মৃত্যু হলে আর জাগবো না । সেখানে ইশতেহার রচনাকারী লিখছেন, ঈশ্বরের দুনিয়ায় সকলেই সমান। ঈশ্বর সকলের স্রষ্টা। অতএব সমতা বিধান করা ও রক্ষা করা ঐশ্বরিক কর্তব্য। অসাম্য কিছু দুষ্ট মানুষের সৃষ্টি। এই ভাষায় যাজকীয় দর্শনের আদিকল্পকে আঘাত হেনেছিল ইস্তাহার রচনা কারীরা।

অতি সাধারণ ইতিহাসের বোধ বুদ্ধি দিয়ে এ কথা বলতে পারা যায়, রুশো ভলতেয়ার মন্টেস্কু ডেনিস দিদেরোর দর্শন পড়ে ফ্রান্সের মানুষ বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। বরং এই সমস্ত দার্শনিকদের রচনাগুলিকে অতি সহজ ভাষায়, প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে, ইশতেহার ও পুস্তিকা লেখকরা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এর ফলে মানুষ পরিবর্তনের দর্শনকে আত্মস্থ করে, দর্শনকে বুঝে নয়, না বুঝে, নিজের মনের মত ব্যাখ্যা করে নিয়ে, বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে। জর্জ রুদ লিখেছেন, বিপ্লবী পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক অসংহতি, রাজনৈতিক সংকট, এই সব শর্ত উপস্থিত থাকলেও বিপ্লব সংঘটিত হয় না, যদি না মানুষের মধ্যে একটা সর্বজনীন পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বিরাজ করে। জর্জ রুদ দেখিয়েছেন তার ক্রাউড ইন হিস্ট্রি বইতে, বহু ক্ষেত্রেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিপ্লবী সংগ্রামে জনতা বা ক্রাউডের স্বতঃস্ফূর্ততা আন্দোলনের গতিপথ নির্দিষ্ট করে দেয়। নেতৃত্ব সেখানে দর্শক হয়ে থাকে। ফলে প্রশ্ন হল এই ক্রাউডের হাতে ক্ষমতা পৌঁছানো, নাকি এলিটের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হবে, কোনটা ঘটেছে বা ঘটছে। ভাবা যায় ৭৮ জন বাছাই করা অহিংস সত্যাগ্রহী কে নিয়ে গান্ধীজি তার ডান্ডি অভিযান করেন ২১ মার্চ ১৯৩০ সালে। অথচ আমরা দেখেছি সমগ্র যাত্রা পথে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আইন অমান্য কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে একটি সর্বভারতীয় রূপ তৈরি করলেন। এমনকি পূর্ব উপকূলে মেদিনীপুর, উড়িষ্যা, অন্ধ্র, তামিলনাড়ুতে ডান্ডি অভিযানের মডেলে জনতা অসংখ্য লবণ আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলেন। গান্ধীজী আন্দোলনের ঘোষণা করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই আন্দোলনকে ব্যাখ্যা করেছেন সাধারণ জনতা, ক্রাউড। ১৯২০ সালে বরদলৈ সত্যাগ্রহ ঘোষণার পরেও সেই আন্দোলন বরদলৈতে সীমাবদ্ধ থাকলো না, সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাস গড়লো জনতা, ক্রাউড। কারণ ক্রাউডের মধ্যে বিরাজ করছিল এক স্বতঃস্ফূর্ত মরিয়া পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা থাকাটা পরিবর্তনের জরুরী শর্ত।

প্রবাসী ছাত্রের কাছে শুনেছিলাম,  জার্মান প্রেসিডেন্ট মর্কেল নির্বাচনে হন মূলত সে দেশের বামপন্থীদের সমর্থনে। আমার বিস্ময় দেখে সে বলেছিল, জার্মানিতে বামপন্থী আন্দোলনের একটি বড় ধারাটি হলো গ্রীন মুভমেন্ট। বামপন্থীরা এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন পুঁজিবাদী সভ্যতার অনিয়ন্ত্রিত বেড়ে ওঠার বিরুদ্ধে, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন করেন। একই সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার জন্য গণপরিবহনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, যেটা পরোক্ষে পুঁজিবাদী বিকাশ কে আঘাত করে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রাইভেট কারের ব্যবহার বন্ধ করার প্রচার চালায়। ট্রাফিক আইনের ক্ষেত্রে পথচারী ও বাইসাইকেলকে গুরুত্ব দিয়ে, তাদের জন্য পৃথক লেনের দাবী করে। কারণ বাইসাইকেল হলো পরিবেশবান্ধব। এমনকি ট্রাফিক আইনকে পথচারী ও বাইসাইকেল আরোহীর পক্ষে সুসংহত করার কথা বলে থাকে। সাইকেল বা পথচারীর সাথে যে কোন মোটরযানের সংঘাতে - দুর্ঘটনায় মোটরযানের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রস্তুত করা হয়েছে গ্রীন মুভমেন্টের ফলে।

সেই ছাত্রের মতে যদি ভারতে বামপন্থীরা সব ছেড়ে শুধু পরিবেশ আন্দোলনে গুরুত্ব আরোপ করতো, তাহলে এই আন্দোলনে আদিবাসী মূলবাসী মানুষের অধিকার রক্ষা, জল জমি জঙ্গল রক্ষা, অনিয়ন্ত্রিতভাবে পরমাণু গবেষণা, মহাকাশ গবেষণা, বিদ্যুতের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার  বন্ধ করে বিদ্যুতের উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করা, এর মাধ্যমে নতুন নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করা । এগুলোর বিরুদ্ধে বামপন্থীরা একটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকৃত অর্থে সমগ্র মানবতার পক্ষে একটা গণ-আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে। সমস্যা হলো, যেন জল জমি জঙ্গলের দাবিটা মেধা পাটকারের, কৃষি আইনের বিষয়টা রাকেশ টিকায়েতের, আর জনগণতান্ত্রিক বা নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দায়িত্বটা বামপন্থী কমিউনিস্টদের।

0 Comments

Post Comment