পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

পিঠেতে খাবার বোঝা তবু খাবার যাবে না ছোঁয়া

  • 05 November, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 2334 view(s)
  • লিখেছেন : অভিজ্ঞান সরকার
২০২০ সালের কালান্তক ভাইরাস ও লকডাউন নাভিশ্বাস উঠিয়ে দিয়েছে অ্যাপনির্ভর তথাকথিত স্বাধীন পেশার পরিষেবা শ্রমিকদের। ইতিউতি চালু হওয়া মাত্র ‘ডেলিভারি পার্টনার’রা ভিড় করে আছেন রেস্টুরেন্টের সামনে, গত বছরের জুলাই মাস থেকে, কিন্তু সেই মত অর্ডার আসছে কোথায় ? কিভাবে চলছে তাঁদের? যে স্বপ্ন দেখতে গিয়ে, এই যুবক যুবতীরা এই ডেলিভারি পার্টনার হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা কি ভালো আছেন আজকে?

প্রিয়াকে মনে আছে? ‘প্রাতঃকৃত্য’, ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক ডান্সড্রামার অন্যতম কুশীলব! প্রিয়া নাটক ও চলচ্চিত্রে কাজ করেন। দ্বিতীয় লকডাউনের পর গত চার মাস প্রিয়া জোমাটোর ফুড ডেলিভারি গার্ল। নাটক করে সংসার টানা কঠিন তাই সপ্তাহে যে কদিন রিহার্সাল বা শো থাকে না সেই কদিন প্রিয়া ফুলটাইম লগ ইন করেন। ফুলটাইম মানে ১১ ঘন্টা মিনিমাম, এই সময় কালে ১৫টি অর্ডার কমপ্লিট করলে ১১০০ টাকা ‘ডেইলি গ্যারেন্টিড পে’। ১১ ঘন্টা বাড়তে বাড়তে ১২-১৩ ঘন্টা হয়ে যায়। দিনে তিনশ টাকার তেল পুড়ে ছাইভস্ম হয়ে যায়। তার মধ্যে হাজার ফ্যাচাং, সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত বারোটার মধ্যে কমপক্ষে চার ঘন্টা লগ ইন থাকতে হবে, সঠিক ঠিকানা খুঁজে পেতে বারে বারে পাড়ার গোলধাঁধায় চক্কর মারতে হবে, গ্রাহকের মুখ ঝামটা খেয়েও হাসিমুখে ভাল রেটিং এর অনুরোধ জানাতে হবে।

রাত পৌনে এগারোটায় দক্ষিণ কলকাতার এক রেস্টুরেন্টের চাতালে বসে কথা হচ্ছিল দেবাশিসবাবুর সাথে, নাইট কার্ফু চলছিল তখন। মাঝে মধ্যে তাকাচ্ছেন মোবাইলের দিকে - আরেকটা খাবাবের অর্ডার ঢুকবে, খাবার তৈরি হবে, সেই খাবার সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে হবে চার বা চল্লিশ তলায় – আর দুটো ঢুকলে ‘ডেইলি গ্যারেন্টিড পে’টা নিশ্চিন্ত হয়। কিন্তু ফুড ডেলিভারি কোম্পানির অ্যালগরিদিমের জ্বালায় তেরো নম্বরেই আটকে আছেন গত একঘন্টা ধরে। ‘তেরো’ সংখ্যাটা বড় অপয়া বুঝলেন’ – বিষণ্ণ হেসে জানালেন তিনি। সকাল এগারোটার মধ্যে সুভাষগ্রাম থেকে সাইকেলে নিত্যদিন আসেন অজয়নগর, বাজারের ফুড ডেলিভারি কোম্পানিদের পরিভাষায় তিনি একজন ‘ডেলিভারি পার্টনার’। এই কাজে সারাদিনে একশ কিমি সাইকেল চালিয়ে ফেলেন তিনি। ‘একশো কিলোমিটার!’ – বিস্ময়ের অনুরণন মেলানোর আগেই দেবাশিস বাবু ব্যাখ্যা করলেন গড়ে দুই কিলোমিটার দূরত্বে ডেলিভারি হলে যাতায়াত মিলে চার কিলোমিটার হয়, চোদ্দটা ডেলিভারির কোটা শেষ করতেই ষাট কিলোমিটার – অধিকাংশ অর্ডারই দুই কিলোমিটারের চেয়ে বেশী দূরত্বের, সেখানেও অ্যালগরিদিমের জট, ফলে বাড়তে বাড়তে সত্তর আশি কিলোমিটার; সাথে সুভাষগ্রামের ঘরে পৌঁছানো - প্যাডেল ঠেলতে হয় হরদরে একশ কিলোমিটারই। দূরত্বের উপর নির্ভর করে ডেলিভারি প্রতি পঁচিশ থেকে চল্লিশ টাকা মেলে কোম্পানি থেকে - যেহেতু দেবাশিসবাবু সাইকেলে ডেলিভারি করেন তার হিসেবটা বাইকধারী ডেলিভারী ‘পার্টনার’দের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন – সাইকেল বাহকরা ট্রিপ প্রতি একটু কম রেট পান। কিন্তু সাইকেলে ডেলিভারি দেবার প্রবণতা বাড়ছে, তেলের দাম বাইকধারীদের গলায় কাঁটার মত বিঁধছে, তেলের খরচ কোম্পানি দেয় না।

দেবাশিসবাবুর বাড়ির লোকেরা এখনও বুঝতে পারেনি রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার পৌঁছে দেবার চাকরিটা কেমন ব্যাপার? দেবাশিসবাবুও বোঝাতে পারেননি যে বাজার, লগ্নীপুঁজি ও স্টার্টআপের ত্রাহ্যস্পর্শে নতুন ক্ষেত্র, নতুন পরিষেবা তৈরি হচ্ছে। নতুন সংস্কৃতির ফ্ল্যাটবাড়ির ব্যস্ত মানুষ আর সব্জির বাজারে গিয়ে ফল, সব্জি কিনবেন না, রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবে্ন না, সেলুনে গিয়ে চুল কাটাবে না, ওষুধের দোকানে যাবেন না বরং বাজারই হাজির হয়ে ডোরবেল বাজাবে, স্মার্টফোনের অ্যাপ হবে জাদুকাঠি। পরিষেবা দানের জন্য প্রয়োজন নতুন ধরনের কর্মসংস্থান – অ্যামাজনে ডেলিভারি বয়, সুইগি জোমাটোয় ডেলিভারি পার্টনার, ওলা উবেরে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট কনট্রাকটর’ অর্থাৎ গাড়ি বা বাইক চালক।

উবর, ওলা, সুইগি, জোমাটো ইত্যাদি ডিজিটাল অর্থনীতিকেন্দ্রিক ব্যবসার একটা গালভরা নাম আছে - গিগ ইকনমি । ডিজিটাল যুগের নতুন প্রজন্মের কর্মসংস্থানকে বিপুল ভাবে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করেছে এই গিগ কোম্পানিগুলি - এদের কর্ণধাররা দাবী করছেন তাঁরা এক নতুন কর্মসংস্কৃতি আমদানী করেছেন পৃথিবীতে, এখানে কর্মপ্রার্থীরা বাঁধাধরা গতের বাইরে, এক নমনীয়, স্বেচ্ছাধীন, নিজস্ব শর্তে কাজ করতে পারবে। ধরুন আপনি দশটা পাঁচটার অফিস ডিউটির বদলে বিকেল ৬টা থেকে ১০ টা অব্ধি ওলা বাইক চালালেন, তারপর ১০ টা থেকে ১২ টা অব্ধি জোমাটোতে কাজ করলেন, ইচ্ছে না হলে করলেন না, প্রয়োজন হলে বেশি কাজ করে টাকা উঠিয়ে নিলেন - একসঙ্গে তিন চারটে কোম্পানিতে যখন ইচ্ছে কাজ করার সুযোগ। অফিস বস, ম্যানেজার বা সরকার মাথার উপর টিকটিক করার জন্য নেই, 'আমরা সবাই রাজা' মন্ত্রে যখন ইচ্ছে অ্যাপ চালু করা - ড্রিম জব বলতে বোঝায় এক্কেবারে তাই! শ্রমজীবীর কাজের সাথে 'ইন্ডিপেনডেন্ট', 'ফ্রি চয়েস' ইত্যাদি আকর্ষনীয় শব্দবন্ধের ব্যবহার করে প্রায় শ্রমিকের শৃঙ্খলা থেকে মুক্তিই ঘোষণা করে দিয়েছিল গিগ কোম্পানিগুলি- নয়া উদারিকরণের নীতি প্রবক্তারা যতবার 'ফ্রি চয়েস' আর 'লিবারেশন' শব্দদুটি ব্যবহার করছে, অন্য কেউ করেনি বোধহয়।

সত্যিটা হল স্বপ্নের রাংতা মোড়া গিগ ইকোনমির শ্রমিকের কোন স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা নেই, জীবনের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাই মূলমন্ত্র এখানে - স্থায়ী চাকরি হটিয়ে শ্রমিককে বিপন্ন করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা। এই পরিষেবা শ্রমিকদের মিল এক জায়গায়- তাদের পেশা তাৎক্ষণিক, অসুরক্ষিত। দুনিয়া জুড়ে এই ধরণের ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট কন্ট্র্যাক্টর’/‘ডেলিভারি পার্টনার’ ও গিগ ইকোনমির চিত্রটি একইরকম – এই পেশার শ্রমিকরা ক্রমাগত লড়ে যাচ্ছেন কাজের অনিশ্চয়তা, পরিবর্তনশীল মজুরি, খামখেয়ালি ইনসেনটিভের পলিসির সাথে। উবর বা লিফটের মত কোম্পানির বিরুদ্ধে একের পর এক বিক্ষোভ হয়েছে চালক, ফুড ডেলিভারি বয়, সেলুনে বা কন্সট্রাকশনে কাজ করা শ্রমিকের - মামলা চলেছে আমেরিকা, ইউরোপে। ক্যালিফোর্নিয়াতে ২০১৯এ আইন পাশ হয়, উবর ও অন্য কোম্পানিগুলিকে শ্রমিকদের ইন্ডিপেন্ডেন্ট কন্ট্র্যাক্টার এর বদলে কর্মচারী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে - তাদের নূন্যতম বেতন কাঠামো আর বেকারিত্বজনিত ইনসিউরেন্সের আওতায় আনতে হবে। গিগ ইকনমির হর্তাকর্তারা হাঁহাঁ করে এর বিরোধিতা করে যাচ্ছেন, এতে নাকি কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির বিরাট ক্ষতি হবে। কিভাবে এই অর্থনীতি টিকে আছে তা প্রহেলিকা, ২০১৯ সালের আগস্ট নাগাদ ত্রৈমাসিকে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছিল উবর, পরিমানটা ছিল তিনশ কোটি ডলার। পুঁজির ফাটকাবাজির খেলায় তবুও উবরের চাকা গড়গড়িয়ে চলেছে, আমাদের বোঝার সাধ্যের বাইরে । আমাদের শহরের বেকার যুবক যুবতীদের নিয়ে গান বেঁধেছিলেন কবীর সুমন, 'শনিবারে যারা দেয় ছুট' তাঁরা শহরের কানাগলিতে ঘুরপাক খায় এখন, বাইক নিয়ে দুধ-ভাতের চিন্তায়, তথাকথিত স্বাধীন আর অনির্দিষ্ট বাঁচার তাগিদে।

শুরুর দিকে যারা এই কাজ করতেন তাদের কাছে শোনা যাবে বছর তিন চার আগে স্বর্ণযুগের কথা - ট্রিপ প্রতি উঁচু রেট, ইনসেন্টিভ, যখন ইচ্ছে কাজ করার সুযোগ, লোভনীয় ইনকামের উপায়, মাসে কুড়ি পঁচিশ হাজার টাকা ঢুকেছে অনেকের ই-ওয়ালেটে। ঝাঁকে ঝাঁকে শহর ও শহরতলির যুবক, বাইক আর স্মার্টফোন নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন, এমনকি অন্য প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি ছেড়ে, স্বাধীন পেশায় মর্জিমত কাজের আশায়। প্রচুর মানুষ দশটা-পাঁচটার চাকরি করে সন্ধ্যার সময়ে খাবার ডেলিভারি অ্যাপে লগ ইন করতেন অতিরিক্ত ইনকামের আশায়। ২০১৯ সালের শেষের দিকে সুইগির সিইও শ্রীহর্ষ মাজেতি নতুন তিন লক্ষ কর্মী, অর্থাৎ ডেলিভারি পার্টনার নিয়োগের সম্ভাবনা ঘোষণা করেছিলেন, গর্বের সাথে জানিয়েছিলেন আর্মি ও ভারতীয় রেলের পরে সর্ববৃহৎ কর্মীসংস্থা হতে এগিয়ে যাচ্ছে সুইগি। সুইগি জোমাটো ওলা উবেরের মত অনলাইন খাদ্য ও যাতায়াত পরিষেবা সংস্থায় কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারি সমস্যার মোকাবিলা করা যাবে বলে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা নরেন্দ্র মোদি সরকারকে চিঠি লিখেছিলেন ফিকির প্রেসিডেন্ট সন্দীপ সোমানি। গিগ ইকোনমিতে মোদিদেরও সুবিধা - আত্মনির্ভরতার বগল বাজিয়ে চাকরি বাকরি তৈরির দায় থেকে হাত তুলে নিতে, জনকল্যানমূলক রাষ্ট্র থেকে নিওলিবারাল রাষ্ট্রের মেটামরফোসিসে। মোদির পকোরা ভাজা আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চপ ভাজার নিদান কিন্তু এমনি এমনি নয়।

সরল পাটিগণিতের হিসাবে ডেলিভারির শ্রমিক বেশি হয়ে গেলে ব্যক্তিপ্রতি অর্ডার কমতে থাকে - স্বাধীন পেশায় তাৎক্ষনিক উপার্জনের খোয়াব ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে থাকে; অর্ডার ঢোকার তিতিবিরক্ত অপেক্ষা বাড়তে থাকে। তথ্য দেখাচ্ছে এই ডেলিভারি শ্রমিকদের অধিকাংশই একটি পর্যায় অব্ধি শিক্ষিত, অনেকাংশেই উচ্চশিক্ষিত – দেশ ও সমাজ গঠনে মূল্য যোগ করতে সক্ষম যুবক – অথচ যুক্ত থাকছেন নিচু মাত্রার সার্ভিস সেক্টরের কাজে, তরতাজা প্রাণের করুণ অপচয়। বাজারটাই বোধহয় এমন হয়ে গেছে, শক্তিশালী মূল্য উৎপাদনের কাজের বদলে ছুটকো ছাটকা পরিষেবার বাজার, অ্যাপনির্ভর স্টার্ট আপের রমরমা। ডেলিভারি কোম্পানিগুলিরও বলিহারি, সবকটিই বাৎসরিক দুই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার লোকসানে চলে, অথচ ফাটকা অর্থনীতির ভোজবাজিতে, বাৎসরিক বৃদ্ধির হারের অঙ্ক দেখিয়ে বছরের পর বছর ইনভেস্টমেন্ট ক্যাপিটাল জোগাড় করে কোম্পানি চালায়। কোনো রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানি এই পরিমান লোকসান করলে কবেই উঠে যেত!

২০২০ সালের কালান্তক ভাইরাস ও লকডাউন নাভিশ্বাস উঠিয়ে দিয়েছে অ্যাপনির্ভর তথাকথিত স্বাধীন পেশার পরিষেবা শ্রমিকদের। ইতিউতি চালু হওয়া মাত্র ‘ডেলিভারি পার্টনার’রা ভিড় করে আছেন রেস্টুরেন্টের সামনে, গত বছরের জুলাই মাস থেকে, কিন্তু সেই মত অর্ডার আসছে কোথায় ?

উমেশ মাহাতোর মতে এখন অর্ডার ঢোকা, ইনসেন্টিভ পাওয়া, দূরত্বের উপর নির্ভর করে ট্রিপ প্রতি রেট সবটাই ভূতুড়ে ব্যাপার – কিভাবে সেইগুলো কে ঠিক করে উমেশরা জানে না, বোঝেও না। মাসে মাসে এই হিসাব নিকেশ পরিবর্তন হচ্ছে, অ্যালগরিদিমের দৌলতে। উমেশ এই বছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে, বাইক থাকার সুবাদে গত বছর থেকে পার্ট-টাইম ডেলিভারি করত, বিকেল ছটা থেকে সাড়ে দশটা – গড়ে ছটা সাতটা অর্ডার ঢুকলে মেরেকেটে আড়াই তিনশ টাকা পেত, তেলের দাম বাদ দিলে হাত খরচাটুকুই উঠত। এখন সে কলেজে ভর্তির প্রস্তুতির পাশাপাশি ফুলটাইম কাজ করছে ডেলিভারির - উমেশ একদিনও ইনসেনটিভ পায়নি গত কয়েক সপ্তাহের কাজে। অ্যালগরিদমের ভূত উমেশদের বেশি ছোটাচ্ছে, বেশিক্ষণ অপেক্ষা করাচ্ছে আর উপার্জন কমিয়ে দিচ্ছে। সদ্য কলেজে ঢোকা উমেশ সুযোগ পেলেই এই কাজ ছেড়ে দিতে চায়, বাঁধা কোন চাকরিতে ঢুকবে। দেবদাস ঘোষ মার্কেটিং এর চাকরি ছেড়ে এই কাজে নেমেছিলেন, ফুলটাইম, এখন ছটফট করছেন, কোথাও অন্য কোনো কাজও নেই, কোথাও যাবার উপায়ও নেই লকডাউন পরবর্তী পৃথিবীতে। প্রিয়া বললেন দৈনিক বারো তের ঘন্টা বাইকের পিঠে সওয়ার হয়ে এক দুবছরের বেশি একাজ করলে শরীর মনকে ছিবড়ে করে দেবে। সচেতন নাট্যকর্মী প্রিয়া, বেদনার সাথে জানালেন নাট্যকর্মীদের বর্তমান অবস্থা সুইগি জোমাটোর পরিষেবা কর্মীদের চেয়েও খারাপ, তাই এই কাজে কিছুদিনের জন্য এসেছেন।

বসে থাকেন তাঁরা, রেস্টুরেন্টের সামনে তাদের নির্দিষ্ট জোনে, বিড়ি আর চায়ের রোজনামচা – ফুলটাইম কর্মীরা বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসেন, রুটি- তরকারি, ডিমসেদ্ধ, কলা এইসব, শহরের ভাতের হোটেলগুলো খোলেনি এখনো। কমবয়সীরা খুব এগরোল খায়, চিকেন রোলের দাম পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে সর্বত্র। ব্যাগে যে মূল্যের খাবার বইছেন প্রতিবার, সেটা তাদের দৈনিক ইনকামের চেয়ে বেশি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ব্যাগগুলিও কিনতে হয় সুইগি জোমাটো থেকে, দাম সাতশ টাকা। বাস্কিন রবিনসের আইসক্রিম ডেলিভারির অর্ডার এলো উমেশের, দুটো স্কুপ সাড়ে তিনশ টাকা, উমেশ হিসাব দিল তার দশটা ট্রিপের ইনকাম। কেমন সেই আইসক্রিম, কিভাবে চেটেপুটে খেতে হয় তা জানা নেই। পিঠের ব্যাগ থেকে উঠে আসা ভুরভুরে সুগন্ধ মাথায় ধাক্কা মারলে নির্বিকার হয়ে থাকাটাই এদের শিক্ষা। কোনো অর্ডার ক্যানসেল হলে সুইগি জোমাটোর নির্দেশ সেগুলি পথশিশু বা ভিখারিকে বিলিয়ে দেবার, সেই খাবার তারা নিজেরা খেয়েছেন কখনো সখনো। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার সেই সুখাদ্য আচমকা সুখের অনুভূতি দেয়। উমেশের হাসি দেখে বোঝা গেল। প্রিয়া বললেন পিঠের খাবারের কোনো তাৎপর্য নেই তাঁর কাছে, ওটি স্রেফ পণ্য হিসেবেই দেখেন।

'উবরাইজেশন' সবে শুরু হয়েছে এই দেশে, গিগ ইকোনমির কর্ণাধাররা ক্রমবর্ধমান ব্যবসার সাফল্যে শহর থেকে মফঃস্বল, সেখান থেকে গ্রামেগঞ্জে প্রসারের স্বপ্ন দেখছেন। কল্যাণীতে এআইএমস হসপিটালের আশেপাশে আমাজনের ইনভেনটারি ওয়্যার হাউস তৈরী হচ্ছে, নিকটবর্তী গাঁয়ের বিরাট মজুত বাইক (বেকার) বাহিনী ঝাঁকে ঝাঁকে ওই কোম্পানিতে নাম লেখানোর আশায় বুক বাঁধছে – অ্যালগরিদিমের দাসত্বশৃঙ্খলে বাঁধা পরতে। ধনতন্ত্র ডিজিটাল প্রযুক্তিকে একচেটিয়াকরণ করছে, অ্যাপ ব্যবহার করে পরজীবী অর্থনীতিকে চালনা করছে, কতদিন এই নতুন শোষন পদ্ধতি চলে সেটা দেখার।

0 Comments

Post Comment