বছর বছর পাশ করিস কি করে?
প্রতিদিনই সুনীল স্যারের ক্লাসে হিরালালকে এই প্রশ্নটি শুনতে হত। হিরালাল উত্তর দিত না। সে জানত তার পরীক্ষার ফল কোনো বছরই ভালো হয় না। গণিতে একবারও সে পাশ নমবর পায়নি। অন্য বিষয়গুলিতেও টায় টায় নমবর। প্রতিবারই তার কাগজে যা লেখা থাকত তার বাংলা এই যে তাকে অনুগ্রহ করে ওপরের ক্লাসে তুলে দেয়া হয়েছে।
#
যেদিন মারা যায় তার আগের দিনও হিরালাল স্কুলে এসেছিল। সুনীল স্যার আগের দিন যে হোম ওয়ার্ক দিয়েছিলেন করে আনতে পারেনি বলে তার ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমার মধ্যে উড পেনসিল রেখে জোরে জোরে চাপ দিয়েছিলেন। আর ছড়ার সুরে বলেছিলেন, হিরালাল হিরালাল, তোর নাম আসলে হিরাপদ, তুই আসলে চতুষ্পদ।
#
প্রথম প্রথম এমন কিছু ঘটতে দেখে আমরা ক্লাস কাঁপিয়ে হেসে উঠতাম। সুনীল স্যার উৎসাহিতবোধ করে আরো জোরে বেচারার দুই আঙুলে চাপ দিতেন। হিরালাল, আমরা অবাক হয়ে দেখতাম, পাথরের মতো স্থির। উহ আহ করছে না। তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জলও পড়ছে না। ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে এমন ভাবে হাসত, শাদা দাঁত দুটি একটি দেখা যেত। আমরা মনে মনে ভাবতাম, ব্যথা লাগে না নাকি? কারণ, ব্যথা কেমন লাগতে পারে তার ধারণা আমাদের অনেকেরই ছিল।
#
ওইভাবেই হিরালালকে দাঁড় করিয়ে সুনীল স্যার জিগগেস করতেন, বই নিয়ে একেবারেই বসিস না কেন? কী করিস সারাদিন?
হিরালাল তাকিয়ে থাকত, চুপ করে তাকিয়ে থাকত।
#
সারাদিন হিরালাল কী কী করত সেসবের খানিক আমার জানা ছিল। জানা ছিল কারণ তার বাসা ছিল আমাদের বাড়ির ঠিক দক্ষিণে, আর আমাদের বাড়ির অনেকটা কাছেই যে বস্তিটি ছিল সেখানেই। আমি একবার বলেছিলাম, ওকে, স্যার, অনেক কাজ করতে হয়।
#
সুনীল স্যার কাউকেই রেয়াত করতেন না। তাঁর চেহারাটি গোলগাল, শক্তসমর্থ। একটু বেঁটে আর শ্যামলা, আর মাথায় চুল প্রায় ছিলই না। তিনি যখনই কারো ওপর প্রসন্ন হতেন ভয়ে তার বুক কাঠ হয়ে যেত। তিনি আমাকে ডাকলেন। উপায় ছিল না। যেতেই, অল্পের ওপর দিয়ে ছেড়ে দিলেন। আমার বাঁহাতের কনুইএর ওপরের মাংস নৃশংসের মতো খামচে ধরে, টেনে, ছেড়ে দিলেন। আমি কেঁদে ফেললাম।
#
আমি কিন্তু সত্যিসত্যিই জানতাম হিরালাল অনেক কাজ করে। ভোরবেলা বাবার সঙ্গে হাঁটতে যেতে হত। তখন, ফেরার সময় দেখতাম হিরালাল তোলা উনানের সামনে বসে পাতলা লোহার তার দিয়ে ছাই বের করছে। আধপোড়া, মানে, ছাই না হওয়া কয়লাগুলো আলাদা করছে। ঘরের মধ্যে আর কীকী করত সে আমি বুঝতাম না। তবে রোজ সকালে উনান ধরানো তার একটি কাজ ছিল।
#
মাকে জিগগেস করতাম হিরালালকে উনান ধরাতে হয় কেন। মার হাতে তখন চামচ। আমার জন্যে গরম দুধ গ্লাসে ঢেলেছে, তার ভেতর হরলিকস দিয়েছে। এবার চামচ দিয়ে নাড়বে। মা বলত, ওর মা বোধ হয় অসুস্থ।
মা আর কিছু বলত না, বলতে পারত না।
#
যেদিন মারা যায় তার আগের দিনও হিরালাল স্কুলে এসেছিল। শুধু সুনীল স্যারই না, অন্য ক্লাসেও মাস্টারমশায়রা তাকে অন্য ভাবেই দেখতেন। বাংলা পড়াতেন ধনঞ্জয় স্যার। মারধর করতেন না। বকাবকিও করতেন না। বলতেন, মাঝেমধ্যেই বলতেন, স্নানটান করিস না নাকি? সাবান দিয়ে স্নান করবি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়। নাহলে আমাদের শরীর খারাপ হয়, অসুখবিসুখ করে।
#
লাস্ট বেঞ্চের দেয়াল ছুঁয়ে হিরালাল বসত। সেখানেই দাঁড় করিয়ে ধনঞ্জয় স্যার এইসব কথা বলতেন। যখন এইসব কথা ও শুনত, আমরা দেখে নিতাম আমাদের জামাপ্যান্ট পরিষ্কার আছে কিনা। কারণ, ওই সময় ওই বয়েসে, পরিষ্কার কি ময়লা এসব নিয়ে আমরা কেউ একটুও মাথা ঘামাতাম না।
#
একদিন হল কি, টিফিনের সময় আমরা মাঠে ফুটবল নিয়ে গেছি। হিরালালকেও ডেকেছি। ও আসত আমাদের সঙ্গে, কিন্তু খেলতে পারত না। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের খেলা দেখত। তো আমরা কজন বাই-সাইকেল কিক অভ্যাস করছিলাম। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াও করছিলাম, আবার গলাজড়াজড়ি করে ভাবও করছিলাম। হিরালাল সব দেখছিল। মাটি ভেজা ছিল। তার ফলে, আমাদের জামাপ্যান্টে অলঙ্করণও হল। আমদের কী যায় আসে? টিফিনের পরই ছিল ধনঞ্জয় স্যারের ক্লাস। আমাদের মূর্তি দেখে তিনি তো বেজায় রেগে গেলেন। বকতে লাগলেন। বকতে বকতে বললেন, তোমরা দেখছি হিরালাল হয়ে যাচ্ছ। গা দিয়ে গন্ধ বের হবে।
#
আমি পেছন ফিরে হিরালালের দিকে তাকালাম। তার মুখে কোনো ভাবান্তর নেই, ঠোঁটটা সামান্য খোলা, একচিলতে হাসি সেখানে, সবসময় যেমন থাকে।
#
আমি একবার জিগগেস করেছিলাম, রোজ তোকে দেখি ভোরবেলায় উনান ধরাতে। তোর মার কী অসুখ?
হিরালালের মুখের ভাব এমন যেন এ জিজ্ঞাসার কোনো অর্থ হয় না। বলল, উনান ধরাতে হয়।
তোর মা?
মা! মা চলে গেছে।
কোথায়?
জানি না।
কারো মা চলে যেতে পারে, আর যার মা চলে গেছে সে জানে না কোথায় গেছে--- এমন কিছু সম্ভব বলে মনে হয়নি। তবু বললাম, তুই তবে কার কাছে থাকিস?
আর একজন মা আছে।
তোকে যে এক একদিন বিকেলে দেখি একটা পুচকে বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস, সে কে?
আমার ভাই। আর একজন মায়ের ছেলে।
#
রাত্রে আমি দাদুকে জড়িয়ে শুতাম। দাদুকে সব বললাম। বললাম, দাদু, আর একজন মা কী?
দাদু বলল, তোমাকে মিছাই রামায়ণের গল্প বলেছি। রাজা দশরথের কয় রানি?
তিন রানি।
কে কে?
রামের মা কে?
কৌশল্যা।
কৈকেয়ী রামের কে?
ও, বুঝেছি, বুঝেছি--- বলে দাদুকে আমি জড়িয়ে ধরি।
#
বিকেলে আমরা খেলতে যেতাম রেলবাগানের মাঠে। হিরালালের ঘরের গা দিয়েই যেতাম। হিরালালকে দেখতাম ঘরের বাইরের উঠানে জল ছিটিয়ে ঝাঁট দিচ্ছে। আমাদের দেখে ঝাঁটা হাতে দাঁড়িয়ে পড়ত। ফেরার সময় চোখে পড়ত রাস্তার ধারের কলের কাছে ডাঁই-করা বাসন সামনে। লজ্জা বা সঙ্কোচ নেই। জিজ্ঞেস করে দেখেছি চুপ করে থাকে। আর চেপে ধরলে বলে, করতে হয়।
#
যেদিন মারা যায় তার আগের দিনও হিরালাল স্কুলে এসেছিল। কেউ ভাবতেও পারেনি বেচারা আর একদিন মাত্র বাঁচবে।
#
স্কুলের সবাই অবশ্য সুনীল স্যার বা ধনঞ্জয় স্যার ছিলেন না। সবচাইতে ভালো ছিলেন শান্তনু স্যার। সপ্তাহে তিন দিন ক্লাসে আসতেন। টিফিনের আগের পিরিয়ডে। সংস্কৃত পড়াতে আসতেন। আমাদের কারো সংস্কৃত পড়ার ইচ্ছে ছিল না। শান্তনু স্যারও বুঝতেন। তিনি ক্লাসে এসে সোজা হিরালালের কাছে চলে যেতেন। তার পাশে বসে পড়তেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। আদর করতেন।
#
শান্তনু স্যার পড়াতেন না। গল্প বলতেন। জাহাজডুবির গল্প, লিলিপুটদের দল্প, একলব্যের গল্প। কত গল্পই যে জানতেন! এই সময়ে, হিরালাল কখনো কখনো মুখ খুলত, তারপর? তির মেরে কুত্তার মুখ বন্ধ?
#
একদিন, শান্তনু স্যার চলে যাবার পর, অর্ক, আমাদের কজনকে ডেকে চুপিচুপি বলল, জানিস, শান্তনু স্যার না হিরালালকে টাকা দিল?
আমি বললাম, ধ্যাত!
আমি নিজের চোখে দেখেছি। মাইরি বলছি।
সত্যি হতে পারে কিনা ভাবছিলাম। অর্ক আমার চিবুক ধরে আমার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আবার বলল, মা কালীর দিব্যি। আমি নিজের কানে শুনতে পেলাম শান্তনু স্যার জিজ্ঞেস করছেন, আজও তুমি না খেয়ে এসেছ? একটা বন্ড রুটি কিনে খেয়ে এসো। খাবে কিন্তু। আমি দেখব তোমার দাঁতে রুটি লেগে আছে।
#
সন্ধেবেলা বই নিয়ে বসেছি। সামনেই পরীক্ষা। ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই পড়তে ভাল লাগে না। যতদূর অব্দি পরীক্ষার পড়া, বারকয়েক পড়ে ফেলেছি। অঙ্ক করতে হবে। যে অঙ্কই করি, যতবারই করি, মনে হয় উত্তরমালায় সব উত্তরই ভুল দেয়া আছে। তার ওপর বেজায় ঠান্ডা। এত ঠান্ডা কেউ যেন জীবনে কখনও দেখেনি। টেবিলে হাত লাগলেই, অরে ব্বাস, কী ঠান্ডা! পকেট থেকে হাত বের করতে ইচ্ছে করছে না।
#
কে একজন এসেছে সামনের বারান্দায়। মা তাকে বলছে, আমি আর পারছি না, ভাই। কাজের মেয়েটা ডুব দিয়েছে। সাত দিন ধরে আসছে না।
যে এসেছে সে বলল, হিরালালকে ডেকে নিচ্ছ না? ওর সৎমাওকেকাজেলাগাতেচাইছে।
হিরালাল? ও তো আমার ছেলের সঙ্গে পড়ে।
মার গলা।
সব পারে। সব কাজ পারে। বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর ঝাঁট দেয়া, ঘর মোছা--- মুখে একটাও কথা নেই। তা বাদে বাচ্চা তো। পাঁচ দশ টাকা কম দিলেও চলবে।
মা বলল, ওর মা? নিজের মা?
তাকে ওর বাপ বেচে দিল না? সে ওর যখন পাঁচ সাল বয়েস।
মা বলল, ও।
কিন্তু বাচ্চাটা ভাবে ওর মা একদিন আসবে। ওকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে।
মা বলল, ওকে কেমন করে বলব?
তোমাদের ঘরে তাও ভাল থাকবে। দেখছ তো কেমন ঠান্ডা পড়েছে।
কী জানি। দেখি---
কে যে এসেছিল আমি দেখিনি। মা আবার বলল, কাল একবার এসো তো। পুরানো একটা সোয়েটার নিয়ে যেও। ওর জন্যে।
#
হিরালালের মাকে ওর বাবা বেচে দিয়েছিল, কথাটা সেদিন আমি ধরতে পারিনি। মাকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, মা কিছু বলতে চায়নি। দাদুকেও জিগগেস করেছিলাম। দাদু বলেছিল, রামায়ণ-মহাভারতে মানুষ মানুষকে বিক্রী করছে এমন কিছু বোধ হয়--- দাদুভাই, এসো আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।
#
পরের দিন। ফাস্ট পিরিয়ডে ক্লাস টিচার রোল কল করার সময় হিরালালের নাম ডাকলেন। তিন বার। তারপরে চোখ তুলে পেছনের বেঞ্চের দিকে দেখলেন, বললেন, একলা বসে থাকে লাস্ট বেঞ্চে কালো মতো ছেলেটা --- আসেনি?
আমরা বললাম, না, স্যার।
কাল ওকে বকাবকি করলাম জামার বোতাম নেই বলে। যাক গে।
সারাদিন, টিফিনের আগে ও পরে সব মিলিয়ে সাত সাতটি পিরিয়ড। তার মধ্যে কেউই, না আমরা না কোনো স্যার, হিরালালের কথা তুললাম। ক্লাস টিচারই, কী জানি কী ভেবে, আর একবার বলেছিলেন, টাইটেল নেই, শুধুই নাম…
#
ফেরার সময়, হিরালালদের ঘরের সামনে একটা ছোটখাটো ভিড় দেখতে পেলাম। কোনোদিন যাইনি। যাব কি যাব না ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যেতেই ধূপের গন্ধ নাকে এল।
মাটির ওপর, চার টুকরো বাঁশ ঘিরে একটা বিছানা। তার ওপর হিরালালের শরীরটা চিৎকরেশোয়ানো।ঠোঁটদুটোয়সামান্যফাঁক, দাঁত দু-তিনটে একটুখানি দেখা যাচ্ছে, একটুখানি হাসি।
#
গতকালও হিরালাল স্কুলে এসেছিল।