“বিজ্ঞানে আস্থা রাখিও”! এই কথাটি স্বাস্থ্য-অস্বাস্থ্য লইয়া তর্কমঞ্চে বর্তমানে সবিশেষ জনপ্রিয়। কথাটি বক্তা এবং শ্রোতা উভয়ের মধ্যেই যেন একপ্রকার সান্ত্বনার বাণী লইয়া আসে। কেবল তাহাই নহে, মাত্র ওই তিনটি শব্দ উচ্চারণ করিয়া ব্যাধি ও নির্ব্যাধি লইয়া যাহারা তর্ক এবং সন্দেহপ্রবণ তাহাদের নিরস্ত রাখা যায়; আর যাহারা ‘কী করিতে হইবে’ ভাবিয়া দোদুল্যমান তাহাদের ভাবলোকে মলম লাগাইয়া দেওয়া যায়। তাই মনে হয়, বিজ্ঞানের প্রতি আস্থার বিষয়টি ইদানীংকালে অধিকতর ব্যঞ্জনাময় হইয়াছে।
আধুনিক হইতে আমাদের অতি-আধুনিক স্তরে উত্তরণ ঘটিতেছে; চিকিৎসাশাস্ত্রেও উহার ব্যতিক্রম নাই। ডাক্তারি বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকগুলি একসময় আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করিত; এক্ষণে উহারা কেবল বুনিয়াদি শিক্ষামালা বলিয়া বিবেচিত হয়। অনেকে মনে করেন, বিজ্ঞানশকট এক্ষণে অতি দ্রুতবেগে ধাবমান। তাই যাঁহারা পিছাইয়া পড়িতে চাহেন না সেই পেশাদারগণ ভাবেন, ওই বুনিয়াদি শিক্ষাগুলি বিগতযৌবনা; বরং পণ্ডিতপ্রবরদিগের আশীর্বাদপুষ্ট, নবতম ডাক্তারি জর্নালগুলির উপর নির্ভর করাই বাঞ্ছনীয়। উহাতে নবতর জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায়।
এই জর্নালগুলি চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে নূতন নূতন সংবাদে পরিপুষ্ট, অর্থাৎ যৌবনমদমত্তা। উন্নত বিজ্ঞানের সেই চমৎকার নিদর্শনগুলি পাঠ্যপুস্তকে আসিতে বিলম্ব হইবে। তাই সাংবাদিক, আইনবিশারদ এবং যাঁহারা কেতাবি জ্ঞানের চর্চা করেন সেই পেশাদারগণও চটজলদি অনুরূপ সংবাদ তথা সুখ আহরণের জন্য উন্মুখ থাকেন। স্বাস্থ্য এবং ব্যাধির উদ্যানে এখন সকলেরই অবাধ প্রবেশ, তাই ডাক্তারি জর্নালের প্রতি অনুরক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছে।
এই বর্ধিষ্ণু পাঠক সম্প্রদায়ের জ্ঞানক্ষুধা নিবৃত্তির দায়িত্ব যেমন ডাক্তারি জর্নলের সম্পাদক গোষ্ঠীর তেমনই লেখক, গবেষক, পরিবেশক ইত্যাদি সকলেরও। তাই নূতন নূতন গবেষণালব্ধ সংবাদগুলি যেন প্রমাণসিদ্ধ হয়, তথ্যসমৃদ্ধ হয়, সেই তথ্যে যেন ফাঁকি না-থাকে ইত্যাদির প্রতি অতীব মনযোগী হইতে হয়। সেখানে ‘স্বার্থের সংঘাত’ থাকিলে, পরিবেশনে অবহেলা থাকিলে, রচনার ভাবলোক মেঘাচ্ছন্ন থাকিলে পাঠকের ক্ষতি, অর্থাৎ শেষ বিচারে মানবতার প্রতি অবিচার।
এইস্থলে ‘স্বার্থের সংঘাত’ কথাটির পৃথক গুরুত্ব আছে। কারণ, ইদানীং লক্ষ্য করা যায় যে, ডাক্তারি বিজ্ঞানের গবেষকগণ নানাপ্রকার স্বার্থের প্রভাবে আবিষ্ট অথবা আহত হইয়া থাকেন। প্রকৃতপক্ষে, বিজ্ঞানের শকট ধীরে ধীরে, অল্প অল্প করিয়া অগ্রসর হয়—যেন গজেন্দ্রগমণ। কখনও গতি বাড়িতে পারে, কিন্তু তাহা ক্ষণকালের জন্য। তাহার সম্মুখে সুবিশাল, আদিগন্তবিস্তৃত অনিশ্চয়তা বর্তমান; অগ্রসরমান বিজ্ঞানচিন্তা যত তথ্যসমৃদ্ধ হয় তত সেই অনিশ্চয়তার পরিধি কমিতে পারে, একথা সত্য; তাই অনেকে ভাবেন, যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ জমিলে অনিশ্চয়তা কাটিবে। কিন্তু তাহা নহে, কেননা সেই তথ্য হইতেই আবার নূতন অনিশ্চয়তার জন্ম হয়। তা ব্যতিত, জগতসংসারে তথ্যের ঘাটতি নাই বটে, কিন্তু উৎকৃষ্ট, বাস্তব তথ্য আহরণ সহজ নহে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্য লইয়া যাহারা স্বার্থলোভী তাহাদের পক্ষে অমন ধৈর্য ধারণ করা যখন অসম্ভব হয় তখন যাহা মিলিয়াছে সেই খণ্ডিত তথ্যকেই ব্যবহার করিবার জন্য তাহারা অতিমাত্রায় উন্মুখ হইয়া উঠে। তখন গবেষকগণ অন্যমনস্ক থাকেন। স্বার্থের এই অন্যায় সংঘাত বিজ্ঞানের চলনের পক্ষে বাধা হইয়া দাঁড়ায়।
মনে হয়, ওই বাধা অবশ্যম্ভাবী। কারণ, যাঁহারা কেতাবি জ্ঞানের চর্চায় নিবিষ্টপ্রায়, যাঁহারা বিজ্ঞানী, যাঁহারা ঔষধশিল্পের কর্ণধার, অতি-আধুনিক কালে তাঁহাদের সকলের মধ্যেই ব্যক্তিগত উন্নতির অদম্য স্পৃহা ও বাসনাবিলাস স্পষ্টতই প্রতীয়মান। সেই বাসনাস্থলে উৎকট প্রতিযোগিতা এমনভাবে বর্তমান যে, জলসিক্ত বা বিতথ্য ভিন্ন প্রকৃত তথ্য জনসমক্ষে লইয়া আসা প্রায় অসম্ভব। বিজ্ঞানের শিক্ষালয়ে এক্ষণে প্রকাশনার সুনামি চলিয়াছে, কেননা গবেষণাপত্র প্রকাশিত না-হইলে পদোন্নতি হয় না, পদোন্নতি না-হইলে হতাশা জন্মে, পরবর্তী গবেষণার জন্য অনুদান মিলে না।১ ইচ্ছা না-থাকিলেও এইস্থলে বাধ্যবাধকতা থাকে, প্রতিষ্ঠান এই ভাবধারাতেই গড়িয়া উঠে। অর্থাৎ অশ্বকে জল পান করাইতেই হইবে, পিপাসা আছে কিনা তাহা বিবেচ্য নহে। আক্ষরিক অর্থে ইহাও ‘স্বার্থের সংঘাত’। এই বিষাক্ত পরিবেশে গবেষণা কলঙ্কিত হইতে বাধ্য।
যাঁহারা বিজ্ঞান গবেষণায় আন্তরিক তাঁহারা জানেন, একটি সমৃদ্ধ জর্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা কীরূপ দুরূহ। কিন্তু যাঁহাদের তেমন আন্তরিকতা নাই, বরং নাম প্রকাশে ও যশোলাভে উদগ্রীব তাঁহারা ওই দুরূহ পথ অতিক্রম করিবার পরিবর্তে ত্রুটিপূর্ণ রচনা লইয়া বাঁকা পথের সন্ধান করেন, কলঙ্কিত পরিবেশে তাহা পাইয়াও যান, এবং এইভাবে প্রকৃত তথ্যের সমাধি ঘটে। ‘নেচার’ নামক এক সর্বজনপরিচিত পত্রিকা জানাইয়াছিল যে, গবেষকদিগের মধ্যে তথ্য লইয়া কারসাজি করিবার প্রবণতা থাকে, দুই শতাংশ গবেষক তাহা স্বীকারও করিয়াছেন এবং চৌত্রিশ শতাংশ গবেষক অন্যান্য প্রশ্নসাপেক্ষ পদ্ধতি অবলম্বনের কথা জানাইয়াছেন।২
ইহাও যেন বাহ্য। ইহার উপরে আছে ঔষধশিল্প, তাহার প্রভাব এমন প্রকট যে, তথ্যের খনন, লালন এবং পরিবেশনায় তাহার অঙ্গুলিনির্দেশ যেন অপরিহার্য। রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রভাবে বিজ্ঞান গবেষণায় সরকারি অনুদানের পরিমাণ যেমন কমিয়াছে, অ-সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষত ঔষধশিল্পের অনুদান তেমনই বৃদ্ধি পাইয়াছে। ডাক্তারি গবেষণায় বর্তমানে তাহারই প্রাধান্য। অর্থাৎ বকলমে, ডাক্তারি গবেষণা বৃহৎ ব্যবসায়ে পরিণত হইয়াছে। যেকোনোও গবেষণা কোনও না-কোনওভাবে যেন তাহার ব্যবসায়িক প্রয়োজন মিটায়, ঔষধশিল্পের নজর সেইদিকেই স্থির থাকে। পরিবেশ-পরিস্থিতি এক্ষণে এমনই যে, ধৈর্য, তিতিক্ষা, আয়াসসাধ্য কর্ম এবং গবেষণার প্রতি আন্তরিকতা ইত্যাদি ক্রমশ দুর্লভ হইয়া পরিত্যক্ত, প্রায়।
ডাক্তারি গবেষণার জগতে যতকাল শিল্পসাম্রাজ্যের নজর পড়ে নাই ততকাল একরকম ছিল। গবেষণার গতি শ্লথ ছিল বটে, কিন্তু সত্যের প্রতি আনুগত্য বজায় ছিল, কেননা গবেষণার প্রতি বাণিজ্যের হাতছানি প্রকট ছিল না। এক্ষণে, এই নষ্টকালে কোন গবেষণা চলিবে অথবা চলিবে না, কোথায় কীভাবে কাহার দ্বারা সংঘটিত হইবে, কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় তাহা কোথায় কখন প্রকাশিত হইবে ইত্যাদি সকল ছকই শিল্পপতির জেব্বায় থাকে, গবেষকরা শ্রমজীবী প্রজামাত্র। কর্মস্থলে বা নিয়োগস্থলে টিকিয়া থাকিতে হইলে তাঁহাদের পক্ষে ‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করা অসম্ভব—ডাক্তারি নীতিশাস্ত্রের এমনই পরিণতি।৩ শিল্পসাম্রাজ্যের এই প্রভাব ডাক্তারি জর্নলগুলি অবধি বিস্তৃত। প্রভাবিত থাকিলে জর্নলগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বরং লাভবান হয়; শিল্প নির্দেশিত রচনাপত্র প্রকাশ করিলে তাহাদের অর্থপ্রাপ্তিও ঘটে। রচনাপ্রতি সেই প্রাপ্তির পরিমাণ এমনকী, দশ লক্ষ টাকা বা এক মিলিয়ন ডলার হইতে পারে।৪
ইহা আমাদের অজানা ছিল না। শিল্পসাম্রাজ্য কী ভয়ংকরভাবে ডাক্তারি গবেষণাকে গ্রাস করিতেছে এই মর্মে দুই দশক পূর্বে ‘নিউ ইংল্যান্ড জর্নল অফ মেডিসিন’, ‘ল্যান্সেট’, ‘জর্নল অফ আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশন’ ইত্যাদি বিখ্যাত ডাক্তারি জর্নল-এর অন্তত দশজন সম্পাদক অন্য একটি স্বনামধন্য জর্নলে একটি সম্পাদকীয় লিখিয়াছিলেন।৫ তাহাতে স্পষ্ট হইল যে, অনুমান হইতে তত্ত্বে উপনীত হইবার যে-পদ্ধতি ডাক্তারি গবেষণায় চিরকাল গ্রহণযোগ্য ছিল তাহার বিসর্জন ঘটিয়াছে, কেবল বিক্রয়যোগ্য ঔষধ তৈয়ারির অভিমুখে গবেষণা ধাবিত হইতেছে, এবং এইভাবে গবেষণা যেন এক উপহাসে পরিণত হইয়াছে।
কিয়ৎকাল পরে ‘ল্যান্সেট’ পত্রিকার সম্পাদক রিচার্ড হর্টন সরাসরি জানাইয়া ছিলেন যে, ডাক্তারি জর্নলগুলিতে প্রকাশিত গবেষণাপত্র যেসকল তথ্য জানায় তাহাতে ঔষধশিল্পের স্বার্থ রক্ষিত হয়।৬ ‘নিউ ইংল্যান্ড জর্নল অফ মেডিসিন’-এর পূর্বতন সম্পাদক মার্সিয়া এঞ্জেলও একই কথা বলিয়াছিলেন—শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি কেবল ব্যবসার কথাই ভাবে এবং সেইমতো যেকোনোও প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে।৫ ‘ব্রিটিশ মেডিকেল জর্নল’-এর পূর্বতন সম্পাদক রিচার্ড স্মিথ বলিয়াছিলেন, ডাক্তারি জর্নলগুলি ঔষধশিল্পের বিপণন প্রক্রিয়ায় আপন হস্ত বাড়াইয়া দেয়।৭
এতদসত্ত্বেও বিগত দুই দশক যাবত ডাক্তারি গবেষণার মানে ক্রমশ অধোগমণ ঘটিয়াছে। কোভিডকালে কেবলমাত্র কোভিড সংক্রমণ লইয়াই সর্বাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হইয়াছে, এবং কৌতূহলের কথা এই যে, একইসঙ্গে গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের হারও এইসময়ে সর্বাধিক!৮ এই সময়কালে গবেষক, পণ্ডিত, লেখক এবং বিজ্ঞানীরা গবেষণা এবং প্রকাশনার যাবতীয় নিয়মকানুন এবং নীতি বিসর্জন দিয়া আপনাপন বৃত্তিতে উন্নতির সোপান সন্ধানে উন্মত্তের ন্যায় আচরণ করিয়াছেন। এইভাবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ যেন তথাকথিত পণ্ডিতগণের ছদ্মবেশ ছিন্ন করিয়া প্রসিদ্ধ জর্নলে রচনা প্রকাশ করিবার লিপ্সার উলঙ্গ রূপ দেখাইয়া দিল।
বিজ্ঞানের নামে এই সময়কালে সর্বাপেক্ষা জঘন্য জালিয়াতি ঘটিয়াছিল সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ, প্রভাবশালী জর্নলে৯,১০ প্রকাশিত দুইটি রচনায়। এই দুই রচনায় যেসকল তথ্যের সমাহার ছিল তাহাদের ভিত্তি ছিল আমেরিকার ‘সার্জিস্ফিয়ার কর্পোরেশন’ নামক একটি মিথ্যা, বানোয়াট তথ্যশালা। এই বুজরুক প্রতিষ্ঠানটির দাবি ছিল, তাহারা নাকি অন্তত এক লক্ষ কোভিড-১৯ সংক্রমিত রোগীর তথ্য আহরণ করিয়াছিল বিশ্বব্যাপী ৬৭১-টি হাসপাতাল হইতে। প্রতারণা ধরা পড়িবার পরে ওই দুই রচনাই প্রত্যাহার করা হয়। তাহাতে কিন্তু ওই দুই জর্নলের সম্মান বাড়ে না, কেননা পরিবেশিত তথ্যগুলি যে মিথ্যা তাহা রচনা প্রকাশ করিবার পূর্বেই ধরা উচিত ছিল, সম্ভবও ছিল, নহিলে আর কীসের প্রসিদ্ধি!
অবশ্য আমরা যদি ভাবি, ডাক্তারি গবেষণার জগতে ইহাই সর্বাপেক্ষা গর্হিত কর্ম, তাহা ভুল। উক্ত গবেষণাপত্রগুলি প্রকাশিত হইয়াছিল ২০২০ সালে। ন্যায় নীতি এবং নিয়মকানুন বিসর্জনের ন্যায় গর্হিত কর্ম ইহার পরে আরও ঘটিয়াছে। ফাইজার কোম্পানিতে কর্মরত এক মহিলা কর্মী ওই প্রতিষ্ঠানে কোভিড-এর টিকা লইয়া কী ভয়ানক দুষ্কাণ্ড ঘটিতেছে তাহার প্রমাণ দাখিল করিয়াছিলেন কোম্পানির নিকট। কোম্পানি তাঁহাকে পাত্তা দেয় নাই। ইহার পরে তিনি সেই প্রমাণ দাখিল করিলেন খোদ ‘ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন’ নামক সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিকট।১১ সরকার অবশ্য ফাইজার কোম্পানির ন্যায় নিশ্চুপ ছিল না; পত্রপাঠ সেই দিন, সেই ক্ষণেই তাঁহাকে বরখাস্ত করিয়াছিল। কে কাহার শয্যাসঙ্গিনী তাহা বুঝিতে বাকি থাকে না।
‘ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন’ (এফডিএ) নামক প্রতিষ্ঠানটি এমনিতেও নিষ্ক্রিয় থাকে না। কর্মচঞ্চল প্রতিষ্ঠান—নূতন নূতন ঔষধ বিক্রয় করিবার লাইসেন্স থাকে ইহারই হস্তে। তাহার জন্য ঔষধ কোম্পানিগুলি তাহাকে দর্শনী দিতে বাধ্য থাকে। লাইসেন্স যাহাতে শীঘ্র মিলে তাহার জন্য এফ ডি এ দর্শনীর পরিমাণ বৃদ্ধি করিয়াছিল।১২ ঔষধ কোম্পানিগুলি তাহাতে বিরক্ত হয় নাই, বরং হাস্যমুখে অধিক পরিমাণে দর্শনীর বিনিময়ে নানান ঔষধের লাইসেন্স হস্তগত করিয়াছিল। ইহাও একপ্রকার ‘স্বার্থের সংঘাত’। পরে অবশ্য ব্যবহারযোগ্য মনে না-হওয়ায় কিছু ঔষধের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী হইয়াছিল, কিন্তু ক্ষতি যাহা হইবার হইয়া গেল।
দরিদ্র দেশগুলিতে ‘স্বার্থের সংঘাত’-এর মূল আরও গভীরে থাকে, কেননা বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ থাকে কম। তাই এমনকী, সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিও অ-সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কেতাদুরস্ত খেলোয়াড়দিগের সহিত গাঁটছড়া বাঁধিতে বাধ্য হয়।
গবেষণার ময়দানে পরিস্থিতি যদি এমনই হয় তবে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত স্তরে গবেষণার ধরন কী হইবে, ইহার ভবিষ্যতই বা কী এবং এই বিষয়ে কীই বা করা যায়? কর্মস্থলে একপ্রকার স্বাধীনতা, স্বকীয়তা, মৌলিকতার সুযোগ না-পাইলে গবেষকগণ স্বস্তি পান না। তাই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অনুরূপ পরিবেশ রচনা করা প্রথম কর্তব্য। এই পরিবেশ রচনা করিতে হইলে পদোন্নতি এবং যশোলাভের জন্য প্রতিযোগিতার ধারণা ত্যাগ করিতে হইবে। ইহা না-করিলে গবেষক কোনও না-কোনও কৌশলে শিল্পসাম্রাজ্যের শিকার হিসাবে গণ্য হইবেন। অর্থাৎ গবেষণার প্রতি সরকারকে যথেষ্ট যত্নবান হইতে হইবে।
এবং সর্বোপরি, এফডিএ-র ন্যায় আমাদের দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলিকে আর্থিক বা অন্যান্য ‘স্বার্থের সংঘাত’ হইতে মুক্ত রাখিতে হইবে। যাঁহারা ডাক্তারি করেন এবং ডাক্তারি সম্পর্কে উৎসাহী থাকেন তাঁহাদের নূতন করিয়া শিখিতে হইবে কীভাবে জর্নলে প্রকাশিত রচনাগুলি অধ্যয়ন করিতে হয়, কোথায় তাহার অপূর্ণতা। সেখানে স্বার্থের সংঘাত আছে কিনা বা থাকা সম্ভব কিনা তাহা ভাবিয়া দেখিতে হইবে, কেবল রচনাকারের বয়ানের উপর ভরসা রাখিলে চলিবে না। এই অভ্যাস যদি আমরা করিতে না-পারি তবে টিকা, ঔষধ এবং ব্যবহারযোগ্য ডাক্তারি যন্ত্রপাতি লইয়া স্বার্থান্বেষী মহলের প্রচারে আমরা বিভ্রান্ত হইতেই থাকিব, যেমন হইয়াছি।
বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা লইয়া আমরা প্রশ্ন তুলিয়াছিলাম। কেবলমাত্র নূতন অভ্যাস রপ্ত করিতে পারিলেই সেই আস্থা জন্মাইবে, নতুবা নহে।
ত থ্য সূ ত্র:
১) Ioannidis JPA. Why most published research findings are false. PLoS Med 2005;2:e124. doi: 10.1371/journal.pmed.0020124.
২) Martinson BC, Anderson MS, de Vries R. Scientists behaving badly. Nature 2005;435:737-8. doi: 10.1038/435737a.
৩) Abramson J. The Commercial Takeover of Medical Knowledge. In: Overdosed America. New York. Harper Perennial. 2005;93-110.
৪) Smith R. Medical journals and pharmaceutical companies: Uneasy bedfellows. BMJ 2003;326:1202-5. doi: 10.1136/bmj. 326.7400.1202.
৫) Davidoff F, DeAngelis CD, Drazen JM, Hoey J, Højgaard L, Horton R, et al. Sponsorship, authorship, and accountability. Ann Intern Med 2001;135:463-6. doi: 10.1001/jama.286.10.1232.
৬) Deruelle F. The pharmaceutical industry is dangerous to health. Further proof with COVID-19. Surg Neurol Int 2022;13:475. doi: 10.25259/SNI_377_2022.
৭) Smith R. Medical journals are an extension of the marketing arm of pharmaceutical companies. PLoS Med. 2005;2:e138. doi: 10.1371/journal.pmed.0020138.
৮) Yeo-Teh NSL, Tang BL. An alarming retraction rate for scientific publications on Coronavirus disease 2019 (COVID-19). Account Res 2021;28:47-53. doi: 10.1080/08989621.2020.1782203.
৯) Mehra MR, Desai SS, Ruschitzka F, Patel AN. Retracted: Hydroxychloroquine or chloroquine with or without a macrolide for treatment of Covid-19: A multinational registry analysis. Lancet 2020;S0140-6736:31180-6. https://doi.org/10.1016/S0140-6736(20)31180-6.
১০) Mehra MR, Desai SS, Kuy S, Henry TD, Patel AN. Cardiovascular disease, drug therapy, and mortality in Covid-19. N Engl J Med 2020;382:e102. DOI: 10.1056/NEJMoa2007621.
১১) Thacker PD. Covid-19: Researcher blows the whistle on data integrity issues in Pfizer's vaccine trial. BMJ 2021;375:n2635. doi: 10.1136/bmj.n2635.
১২) Josefson D. US drug companies will meet more than half the cost of drug approval. BMJ 2002;324:808.
(ডা অমিতাভ ব্যানার্জি মহারাষ্ট্রের পুনেতে ডা ডি ওয়াই পাতিল মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, রিসার্চ সেন্টার-এর কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান। রচনাটি ওই প্রতিষ্ঠানের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, ২৩-শে জানুয়ারি, ২০২৩। স্বচ্ছন্দ ভাষান্তর: ডা স্থবির দাশগুপ্ত।)