পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

রেশনের চাল-গম-ডাল, হালিম ও রমদ়ান

  • 25 April, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 2071 view(s)
  • লিখেছেন : শামিম আহমেদ
রেশনে গম দেয়, চালও। বন্ধুদের বাড়িতে খেয়ে দেখেছি, বেশ ভাল খেতে। পয়লা রোজার দিন এই সব বলার কী মানে? গমের সঙ্গে (যদি থাকে) একটু ডাল, সঙ্গে খানিকটা চাল দিয়ে তৈরি করা যায় অপূর্ব এক খাবার। গরিবের খাদ্য। শস্তার দু এক টুকরো মাংস তাতে দিতে পারলে আরও ভাল। না পেলেও চলবে, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো সয়াবিন চলতে পারে। হ্যাঁ, একটু সহিষ্ণু হয়ে রান্না করতে হয় পদটি। হালিম।

রেশনে গম দেয়, চালও। বন্ধুদের বাড়িতে খেয়ে দেখেছি, বেশ ভাল খেতে। পয়লা রোজার দিন এই সব বলার কী মানে? গমের সঙ্গে (যদি থাকে) একটু ডাল, সঙ্গে খানিকটা চাল দিয়ে তৈরি করা যায় অপূর্ব এক খাবার। গরিবের খাদ্য। শস্তার দু এক টুকরো মাংস তাতে দিতে পারলে আরও ভাল। না পেলেও চলবে, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো সয়াবিন চলতে পারে। হ্যাঁ, একটু সহিষ্ণু হয়ে রান্না করতে হয় পদটি।

হালিম

halim

আল্লাহ-র নিরানব্বই নামের একটি ‘হালিম’। আরবি শব্দ। অর্থ হল সহিষ্ণু।

ইফতারের একটি পদ হালিম হতে পারে। ইফতার কী? রোজা খোলা হয় যা দিয়ে তাই ইফতার। ‘রোজা খোলা’ হল দৈনিক রোজা শেষ করা। রোজা হল এক ধরণের উপবাসব্রত, তবে নিছক উপবাস নয়। ভারতচন্দ্র লিখেছিলেন, দেবদেবী পূজা বিনা কি হবে রোজায়! সে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ।

হিজরি/হিজরা বছরের নবম মাস হল রমজান/রমদান। নবি মহম্মদ মক্কা থেকে মদিনা চলে যাওয়ার দিন থেকে হিজরাব্দ শুরু হয়। আমির খুসরুর লেখা জ়ে-হাল-এ-মিসকীঁ (state/plight of the poor) গানটা শুনেছেন নিশ্চয়! গুলাম আলি থেকে নুসরত ফতে আলি অনেকেই গেয়েছেন। সেখানে ‘কি তাব-এ-হিজ্রাঁ’ বলে শব্দবন্ধ আছে। ‘কি’ মানে যা (that) আর ‘তাব-এ-হিজ্রাঁ’ হল tolerance for separation। আরবিতে ‘হিজরত’ শব্দের অর্থ স্বদেশত্যাগ। ‘হজরত’-এর শাব্দিক অর্থ ‘উপস্থিতি’—presence, appearance। হিজরি অব্দ নবির স্বদেশত্যাগ থেকে সূচিত হয়। এই অব্দের নবম মাস হল রমজ়ান/রমদ়ান। এই মাসে নবির কাছে ‘ওহি’ (divine revelation) অবতীর্ণ হয়। ফেরেশতা (ফারসি শব্দ, ইংরেজি angel, আরবি ‘মালক”) জিব্রাইল নবিকে আল্লাহ-প্রেরিত যে শব্দটি প্রথম উচ্চারণ করতে বলেন তা হল ইকরা (পড়ো)—সেটিই প্রথম অবতীর্ণ আয়াত (verse)। সে ছিল রমজ়ান/রমদ়ান মাসের সময়। এই শব্দটির ধাতু হল ‘রমিদ়া’ বা ‘রমিজ়া’। এই যে ‘দ়’, তার উচ্চারণ বাংলা ‘দ’-এর মতো নয়। d-এর নীচে একটা ডট বসাতে হবে। ধাতুটির অর্থ হল প্রবল গরম বা শুষ্কতা। আরবি উচ্চারণ এশীয় ও তুর্কি ভাষায় এসে অনেকটা বদলে যায়। ‘দাদ’ নামক বর্ণের dz-এর মতো উচ্চারণ এশীয় জিহ্বায় সম্ভব নয়। তাই পারস্য (ইরান), ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও তুরস্কে লোকে রমজ়ান বলে। এই ‘জ়’-এর উচ্চারণ বাঙালি আবার তার নিজস্ব জিভেই উচ্চারণ করে, ফারসি লব্জে করে না। এ একেবারেই শব্দের উচ্চারণগত ব্যাপার, এর মধ্যে সৌদি ব্র্যান্ড বা ওয়াহাবি/সালাফি রাজনৈতিক ব্যাপার কিংবা পেট্রোল খোঁজা নেহাতই মূর্খের মাস্তানি কিংবা শয়তানি।

বিশুদ্ধবাদী হলে রমজ়ান/রমদ়ান দুই উচ্চারণ সমানভাবে ভুল। যেহেতু বাঙালি ও এশীয় যখন আরবি বর্ণপরিচয় পড়েন তখন আলিফ, বা, তা, সা… সাদ, দাদ (dz) পড়েন। তাঁরা আরবি কেন পড়েন, ফারসি পড়েন না কেন? কারণ, তাঁর ধর্মগ্রন্থ কোরান আরবি ভাষায় লিখিত এবং তা পড়ার জন্য আরবি শিখতে হয়। আরবি বর্ণমালা পড়ে রমজ়ান/রমদ়ানকে নিজস্ব লব্জে উচ্চারণ করেন। ফারসি লব্জেও কেউ কেউ করে থাকেন। এক কালে ফারসি-তুর্কি বাংলা তথা ভারতের রাজভাষা ছিল! এখন ফারসি রাজভাষা নয়। ফারসি জানা লোক ধীরে ধীরে কমে আসছে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে রামমোহন রায়, সিমলের উকিলবাবু সবাই শিখেছিলেন রুটি-রুজির দায়ে। এখন বাঙালি চেনা লোক ইতিহাসবেত্তা অমিত দে ছাড়া ফারসি জানা কাউকে মনে আসে না।

এক সময় ফারসিতে যা উচ্চারণ করা হত, এখনও তাই করতে হবে; নইলে ফারসি শাসকের ভূত ক্যালাতে পারে, এই যুক্তি হাস্যকর। ইরান বাদে তামাম দুনিয়ার মুসলমান ফারসির থেকে আরবির সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত। পুনরুক্তি করে বলি, কারণ তাঁর ধর্মগ্রন্থ ওই ভাষায়। এবং সেই ধর্মগ্রন্থ প্রথম অবতীর্ণ ওই রমদান/রমজান/রমজ়ান/রমদ়ান মাসে। ‘দ়’ অক্ষরটির কোরানীয় উচ্চারণ দ ও জ(z)-এর মধ্যবর্তী। অনেকে চেষ্টা করেন, কিন্তু ‘দ’ বা ‘জ’ হয়ে যায়, বড়জোড় ‘জ়’ অব্দি হয়। কিন্তু তাতে হলটা কী! বাঙালি ‘জ’-কে ‘দ’ বলে ইয়ে হয়ে গেল! তাকে সালাফি, ওয়াহাবি, পেট্রোডলার বলে গালি পাড়তে হবে! বলছি, খিস্তি করার কেস কি কম পড়েছে?

বাংলায় বহু শব্দ ফারসি, তুর্কি, আরবি ইত্যাদি ভাষা থেকে এসেছে। তাদের সব উচ্চারণ সম্ভব বাঙালি লব্জে সম্ভব নয়! আচ্ছা বলুন তো, আপনি মুর্ধণ্য-ন (‘ণ’) উচ্চারণ করতে পারেন? দন্ত্য-ন (‘ন’) হয়ে যায় না? হাসছেন? চেষ্টা করে দেখুন। ‘শ’ আর “ষ’ আলাদা উচ্চারণ কজন করতে পারেন, গানের স্যার ছাড়া? দ ও জ-এ ফিরে যাই। বেহেশতের পাহারাদার যে বেচারা, তাঁর হবে ভারি মুশকিল! বাঙালি তাঁকে বলবেন ‘রিজওয়ান’, আরব ডাকবেন ‘রিদ়ওয়ান’, ফারসি উচ্চারণ করবেন ‘রিজ়ওয়ান’। ইন্তেকালের পর মানুষের জবানে দাঁত, তালু জিভ ঠিক থাকবে তো!

আমাদের দেশের কিছু গুণী ভাষাবিদ মানুষ, আরবি লব্জে ‘বিশুদ্ধ’ উচ্চারণ করতে পারেন। কিন্তু যে আমজনতা এখনও কাপড় পড়ে আর বই পরে তারা সে সব ‘শুদ্ধ’ শোনার পর উচ্চারণ করতে হিমসিম খেয়ে যাবে! ফলে ‘রমদান’, রমজান, ‘রমজ়ান’ তিনই অশুদ্ধ। যেহেতু ভাষার বিচারে আরবি হল মূল শব্দ, তাই বলতে হবে ‘রমদ়ান’। অবশ্য আরবি এই শব্দটি কোথা থেকে এসেছিল তা জানতে গেলে শ্রীলঙ্কা কিংবা জেড্ডায় যেতে হবে। কেন? সে বিষয়ে পরে (পড়ে নয়) কথা হবে। আপনি যদি বলেন ফারসি ‘ৰহি’ বলতে হবে, আমি কেন শুনব? আমি বাংলা উচ্চারণে ‘ৰই’ বলব। আমি ভুল হলে আপনিও ভুল। আমি অধম (তদ্ভব) আপনি মধ্যম (অর্ধ-তৎসম)। উত্তম হল ‘বহি’ (wahi), সেটি আরবি শব্দ। যা নাজিল (অবতীর্ণ) হয়েছিল এই রমদ়ান মাসে।

কথা শুরু হয়েছিল হালিম দিয়ে। বাংলায় ‘হালি’ বলে একটা শব্দ আছে। সবুজ মুগ। হালি-র সঙ্গে ‘ম’ মেশালেই হালিম।

কীভাবে বানাবেন?

আগের রাতে গম, চাল, ডাল ইত্যাদি ভিজিয়ে রাখলেন। তার পর মশলা (কাসুন্দি টাইপের যা খুশি তাই দিয়ে দেবেন না) যা যা পাবেন সে সব দিয়ে মাংস বা সয়াবিন অ্যাড করে জল বা পানি দিয়ে চাপিয়ে দিলেন উনুনে। ঢিমে আঁচে রান্না হবে, স্লো কুকিং। শ্রমিকদের রান্না। কাজ শেষে ফিরে খাবেন তাঁরা। ততক্ষণ হবে। তেল দেবেন না। রান্না হয়ে গেলে পেয়াজ লাল করে ভেজে (যাকে বেরেশতা বলে) মিশ্রণে দিয়ে দিন। ইচ্ছে হলে পাতিলেবু বা টকজাতীয় কিছু মেশাতে পারেন খাওয়ার সময়। সব মিলিয়ে দারুণ হবে খেতে। পেট ভরা খাবার। শস্তা ও পুষ্টিকর।

‘হালিম’ মানে হল সহিষ্ণু।

শুভ রমদ়ান মুবারক।

0 Comments

Post Comment