পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ফুল্লরা

  • 22 October, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1236 view(s)
  • লিখেছেন : সাত্যকি হালদার
সকাল আটটা নাগাদ ফোন। ভোরবেলা কাগজ চলে আসে। সেদিনই অ্যাডটা বেরিয়েছে। ঠাণ্ডা স্বরে লোকটা বলল আপনাদের কত দিনের মধ্যে দরকার? সেদিন বেরোবে জানতাম। আমার তখনও দেখে ওঠা হয়নি। অবাক-ই হলাম। লোকটা আমার সংশয় বুঝল হয়ত। বলল আপনার নম্বরের শেষটা ডবল টু ডবল ফাইভ তো? আজকের কাগজে আপনারা ছোট একটা বিজ্ঞাপণ করেছেন।

প্রভাতী দৈনিক কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। সকাল হতে না হতে তাই সাড়া। বললাম ঠিকই দেখেছেন। বলুন।

ও পাশের গলা বলল আপনারা কিন্তু লেখেননি কত দিনের মধ্যে দরকার। বিষয়টা কত জরুরি।

বললাম ঠিক আছে। তার আগে আপনার নাম আর কোথা থেকে ফোন করছেন বলুন।

সবার নাম ঠিকানা লিখে রাখার নির্দেশ দেওয়া ছিল আমাকে। সঙ্গে মোবাইলে ওঠা নম্বর। দরকার অনুযায়ী পরে যোগাযোগ করে নিতে হবে। লোকটা বলল আমি বিনয় পুরকায়েত। মেদনিপুরের সাঁইপলা থেকে বলছি।

বেশ। বলুন।

বিনয় পুরকায়েত বললেন রক্তের গ্রুপ এবি-পজিটিভ বলেছেন। আমারও তাই। কিন্তু আপনাদের ক দিনের ভেতর দরকার!

বললাম এ সব ক্ষেত্রে যা হয় তাই। রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে আসছে। ডায়ালিসিসেও আর সামলানো যাচ্ছে না। ডাক্তাররা খুঁজতে শুরু করতে বলেছেন। মাস তিনেকের মধ্যে কিডনি বদলাতে হবে।

উনি চুপ হয়ে শুনলেন। ফোনের ও পাশে আবছা আরও কিছু শব্দ। হয়ত কাছাকাছি রান্নাঘর। সকালে বাসন ধুয়ে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। দূরে কোথাও একটা সাইকেলের বেলও। ফোনের ও দিকের গলা এ বার নামল। বললন তা হলে আমার হচ্ছে না। সব কিছু মিলে গেলেও আমার কিডনি পেতে মাস চারেক তো লাগবেই।

Like our Facebook Page

বললাম অতখানি সময় তো হাতে নেই। ডাক্তারের কথা তো আপনাকে জানালামই। আমাদের কী-ই বা করার! কিন্তু আপনি কি সময়টাকে মাস কয় এগিয়ে আনতে পারেন না?

লোকটা বললেন ক মাস?

ডাক্তারের মত তো শুনলেন। ফলে আপনি যত তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করবেন তত ভালো। তা ছাড়া রক্তের গ্রুপ মিললেই যে কিডনি দেওয়া যায় তেমন নয়। আরও কিছু বিষয় না কি মেলানোর আছে। ফলে আপনি এগোলে আমরাও এগোই।

আমার আর এগোনো! টেলিফোনে বিনয় পুরকায়েতের শ্বাসের শব্দ। গলার স্বরে মনে হল প্রৌঢ় মানুষ। ওনার বয়সের কিডনি চলবে কি না কে জানে। তা ছাড়া এমন বয়সে বিক্রির কথা ভাবছেন-ই বা কেন! তাও আবার মাস চারেক পর!

তবে কী জানেন তো! মনে হল বিনয় পুরকায়েত আরও কিছু বলবেন। বললেনও।

সমস্যা হচ্ছে সাঁইপলা থেকে দু মাইল দূরে ডাউকি গ্রামে এ বারও চৈত্র মাসে বড় গাজন হবে। প্রতি বারই হয়। আর আমাদের গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে অনেকে যায়। নদীর চর বরাবর পথ। আমি ভেবেছি এ বার ডাউকি যাব। চৈত্র আসতে তো এখনও মাস চারেক।

ধান ভানতে শিবের গীত শুনতে এমন কি না কে জানে! আমাদের সহকর্মী-বন্ধু দুর্জয়ের কিডনির ব্যারাম চলছিল কয়েক বছর। বাড়তে বাড়তে ইদানিং ওষুধ ও ডায়ালিসিসের সীমা ছাড়িয়েছে। দ্রুত কিডনি বদল ছাড়া উপায় নেই। ডাক্তাররা অবশ্য বলেছেন এ দেশে ঠিকঠাক কিডনি বদল হলেও বাড়তি আয়ু মেরেকেটে দশ বছর। তাও সেই সময়ে বিভিন্ন সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকায় প্রায় দরজাজানালা বন্ধ করে ঘরে থাকতে হবে। বাড়ির লোকের কাছে দশ বছর অনেক সময়। এবং কথা বলে বুঝেছি ক্লান্ত অবসন্ন দুর্জয়ের মনের ইচ্ছেও তাই।

বিনয় পুরকায়েত বললেন আপনারা কোথায় থাকেন জানি না। হয়ত কলকাতার দিকে। ডাউকির মেলায় কখনও আসেননি নিশ্চয়ই। নামও শোনেননি। চৈত্র মাসের শেষ দিকে ডাউকিতে কারও বাড়িতে জায়গা খালি থাকে না। গাঁয়ের সব ঘরে আত্মীয় অনাত্মীয়। নদীর ধারে মস্ত মেলা। আপনারা কিডনির সব কিছু মিলে গেলে কত টাকা দেবেন ভেবেছেন?

ফোনের ও প্রান্তে যতই অবান্তর কথা থাকুক কাজের কথাটাও পরিষ্কার করে নিতে হবে। এ সবে তো আর পাত্রী চাই-র মতো একগাদা ফোন আসবে না। দুটো বা তিনটে হয়ত কল। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কথা যেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।

বললাম দেখুন কিডনি ডোনেশনের বাজারে এখন যেমন রেট আমরা তেমন-ই দেব। একটা কিডনিতে লাখ দেড়েক।

লাখ দেড়েক! বলেন কী মশাই! আপনারা তো অনেক বেশি দিচ্ছেন। গত মাসে একটা খবর এসেছিল, সেটা অবশ্য খবরের কাগজ মারফত নয়। তারা টাকা বলেছিল পঁচিশ হাজার। তাও এক সঙ্গে নয়, দু বারে দেবে। ওই টাকায় আমি আর এগোইনি। ওতে আমার কোনও কাজ হবে না।

লোকটা বকছে, তবু লাইনটা ছেড়ে দিতে চাইছি না। প্রথমত লোকটার চাহিদা দুর্জয়ের হিসাবের বাইরে নয়। দ্বিতীয়ত লোকটা আগ্রহী। আমি বললাম আপনার কাজ মানে? টাকা তো বেশির ভাগ লোক ব্যাঙ্কেই রাখে।

ব্যাঙ্কে রেখে আর আমি কী করব! কার জন্যই বা রাখব! ফোনের ও পাশে লোকটা শুকনো হাসল। আমার চার পাশে এখন আর কেউ নেই। ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা দূরে থাকে। গত বছর আমার স্ত্রী মারা গেছেন। ফলে আমি এখন একা। কারও জন্য রাখা বা জমানোর দরকার নেই। তবে দরকার যেটা আছে সেটা কি আপনি শুনবেন?

আমি চুপ করে থাকি। লোকটি বলে দরকারটা শুনে আপনারা হয়ত হাসবেন। আপনি না হয়ে অন্য কেউ হলেও হাসত, তবু আমি তো আমার মতো করেই ভাবব। এই যে আমাদের গাঁয়ের নদী ফুল্লরা, শুনেছি হাজার বছরেরও পুরনো নদী। আমাদের এলাকায় যখন মানুষ আসেনি তখন না কি ফাঁকা মাঠ আর তার মাঝে ছিল এই নদী। এই নদীর ধারে ধর্মঠাকুরের থান, বটগাছ, বছর বছর চাষ, তবু ফুল্লরার এখন কী হাল তা জানেন? বর্ষাকাল ছাড়া স্রোত নেই, শ্যাওলায় ভরা, গাঁয়ের ঘাটে যেখানে ছোটবেলায় সারা দিন সাঁতরেছি, সেখানে চানের জলটুকুও নেই। দেড় লাখ টাকায় তো আর পুরো একটা নদীকে ফিরিয়ে আনা যাবে না, তবু আমি যট্টুকু পারি করব। পাকুড়তলার নীচে গাঁয়ের যে ঘাটে বাপ-ঠাকুর্দার শ্মশান সেটুকুর সংস্কার করাব। পরে যদি আমার দেখাদেখি আর কেউ করে।

বলে কী লোকটা? দুর্জয়ের জন্য একটা কিডনি চেয়ে বিজ্ঞাপণ দিয়ে সাত-সকালে পাগলের পাল্লায়! অবাক হয়ে আমি যে চুপ তাও লোকটা বুঝছে না। কিংবা বুঝলেও তার যা বলার তা বলবে। ফলে ধীর গলায় আবার ও পাশের কথা শুরু হল।

সারা জীবন হাইস্কুলে মাস্টারি করে রিটায়ারের পর সাড়ে তিন লাখ টাকা পেয়েছিলাম। ছেলেমেয়ের এখন টাকার দরকার নেই। দরকার থাকলেও এ টাকা তারা পাবে কেন? আমার টাকা আমি ফুল্লরাকেই দিয়েছি।

দিয়েছেন মানে? টাকা জলে ফেলে দিলেন না কি!

কী ভাবে জলে ফেলব! নদীতে তো এখন জল নেই। আর জল আনার জন্যই টাকাটা খরচা করেছি আমি। গাঁয়ের পশ্চিমে যেখান থেকে নদী ঢুকছে, সে জায়গাটা বালি জমে উঁচু হয়ে যাচ্ছিল। লোক লাগিয়ে সেটা সরিয়েছি। পনেরো দিন ধরে দু মাইল জায়গার শ্যাওলা আর পানা তুলিয়েছি। ঘাট বাঁধানো হল দুটো। এতেই তো তিন লাখ মোটামুটি শেষ। অনেকে বলেছিল ছোটখাটো কোনও কন্ট্রাকটরকে দিয়ে করাতে। কিন্তু আমার পরিশ্রমের টাকা। ফলে সবই দাঁড়িয়ে থেকে করালাম।

আমার মোবাইলে আর কোনও কল ঢুকছিল। হয়ত বিজ্ঞাপণ দেখে আর কেউ যোগাযোগ করতে চাইছে। বললাম আচ্ছা পুরকায়েতবাবু কবে নাগাদ তা হলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হতে পারে?

একটু দেরিতে উত্তর এল ও পার থেকে। ওই যে বললাম চৈত্র মাস, মানে এপ্রিল। এখনও মাস চারেক।

নমস্কার জানিয়ে ফোনটা ছেড়ে দেওয়াই যেত। শুধু যোগাযোগ জিইয়ে রাখতে ওনাকে হতাশ করলাম না। আর হয়ত মিনিট দুই কথা বলবেন। তারপর মিসড্ কলে ফোন করা যাবে। বললাম একেবারে ওই চৈত্র মাস?

আবার উৎসাহ ওনার গলায়। যেন নতুন উদ্যম।

আসলে ডাউকিতে আপনারা কখনও আসেননি বলে জানার কথা নয়। সেখানে শেষ চৈত্রে গাজনের মেলা এক আশ্চর্য ব্যাপার। কত দূর থেকে যে লোক আসে! ছেলেপুলে কাঁখে-পিঠে নিয়ে পায়ে হেঁটেই চলে আসে। নদীর একটা বাঁক, উল্টো দিকে যত দূর চোখ যায় নদীর বালি। এখন অবশ্য লরিকে লরি সেই বালি শহরে পাচার যাচ্ছে। তবু তার ভেতর দিয়ে সারা রাত মানুষ আসে। আসলে কী জানেন তো! কিডনি দেওয়া মানে তো একটা রিস্ক। সব বড় অপারেশনেই তাই। ভাবি কিডনি দিয়ে সামনের চৈত্র মাস পর্যন্ত যদি না বাঁচি!

উদাস ভাব বিনয় পুরকায়েতের গলায়। তখন তিনি-ই এক মাত্র বক্তা, আমি শ্রোতা। বললেন তবু আপনাদের যখন এত সংকট একটা কাজ তখন করা যায়। সেটার জন্য আপনাদের কিন্তু গাঁয়ের পাঁচ জনের সামনে সই করে লিখে দিতে হবে। চার মাস আমি যদি না বাঁচি তা হলে যার জন্য কিডনি খুঁজছেন তাকে এক দিন মেলা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাবেন। তখন ওই আর কী... এক কাজে দুই কাজ।

আমি বললাম আপনাকে ফোন করলে কটা নাগাদ করব?

উনি উদাস উৎসাহে বললেন রাতে, অনেক রাতে। তার আগে নদীর পাশে ঘুরে বেড়াই। সারা দিন, সারা বিকেল, সন্ধ্যে। রাত বাড়লে অন্ধকারে একটা হারিয়ে যাওয়া নদী খুঁজি। একা একা খুঁজি। গল্পে শোনা হাজার বছর আগের নদীর কথা মনে হয়। যখন নদী ছাড়া আর কিছু নেই। আমি অন্ধকারে পাকুড়তলায় একা বসে থাকি।

স্বর থামল। আমি ধীর গলায় বললাম রাখি তা হলে পুরকায়েতবাবু।

উনি বললেন রাখুন।

কল লিস্ট দেখলাম। দেখি দুর্জয়ের-ই মিসড্ কল। ব্যাক করতে ও ক্ষীণ স্বরে বলল কেউ কি যোগাযোগ করেছে রে!

           

0 Comments

Post Comment