পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

টিচার্স রুম থেকে…

  • 05 September, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1058 view(s)
  • লিখেছেন : মৌমিতা আলম
শিক্ষা হলো সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র ও প্রধান আলো। শিক্ষাই হলো একমাত্র মাধ্যম যা পারে লিঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। পারে এমন একটি সমাজ দিতে যেখানে সকালে উঠে মারি বিস্কুটের সাথে খবরের কাগজে ধর্ষণের খবর চিবোতে হবে না। সমাজ পচে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নারীদের উপর অত্যাচার। সমাজের পচা গলা জলে পচে যাচ্ছে শিশুদের নিরাপদ, সুন্দর ভবিষ্যতে স্বপ্ন।

                

২০১৫ সাল। কোনরকমে দৌড়ে যখন বাস ধরলাম, গরমে হাপাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ বাস চলতেই টের পেলাম বাসের আবহাওয়া আরও গরম। বাসে আলোচনা চলছে আগের দিনের প্রাক্তন মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লার বক্তব্য নিয়ে। বলে রাখা ভালো এই সময় বাসে বেশিরভাগই ডেলি প্যাসেঞ্জার, আর এদের মধ্যে বেশির ভাগই শিক্ষক। মাষ্টার মশাইরা অনেকেই আজ খুব প্রসন্ন। তাদের মনে হচ্ছে যাক এতদিনে প্রাক্তন মন্ত্রী মশাই ধর্ষণের একটি প্রকৃত কারণ বলেছেন। দু একজন মৃদুস্বরে বক্তব্যের বিরোধিতা করার চেষ্টা করলেও সংখ্যা গরিষ্ঠদের দাপাদাপিতে তারা মিইয়ে গেলেন। আসলে মাননীয় প্রাক্তন মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা সাহেব বলেছেন, মহিলাদের পশ্চিমী জামাকাপড় এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এই সব জামাকাপড় ছেলেদের প্রলুব্ধ করে।' আমার সেই মন্ত্রীমশাই আর তার সাথে তার কথায় উল্লাসিত হওয়া প্রত্যেককে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে যে, সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশু থেকে দশ বছরেরও ছোট যে বাচ্চাগুলো ধর্ষিত হয়, তারা কি সব পশ্চিমী পোষাক পরে বলে— যারা ‘ছেলে’ না ‘মেয়ে’ এই দলে ঢোকেনি পর্যন্ত। তারা শুধু 'বাচ্চা'।

 

আমার আলোচনায় ধর্ষণ কেন হচ্ছে বা রেজ্জাক মোল্লা সাহেব কি বলেছিলেন সেটা নয়, কারণ কেন হচ্ছে তার ব্যাখ্যা প্রতিদিন খবরের কাগজ আর নিউজ চ্যানেল গুলোতে আমরা সবাই শুনছি। নারী নির্যাতন যেভাবে মহামারীর আকার ধারণ করছে সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে শিক্ষক সমাজের করণীয় কি এবং আমাদের যা দায়িত্ব তাকি আমরা পালন করছি। কেন, রেজ্জাক মোল্লা যেটা বলেছিলেন মাস্টারমশাইরা সবাই বলতে পারলেন না যে তিনি ভুল বলেছেন— যেখানে কোন অবস্থাতেই কেউ পারে না ধর্ষণের মতো একটি হিসাবে লজ্জিত হতে হয়। ঘৃণ্য নির্যাতনকে জাস্টিফাই করতে। কেন আমরা বেশির ভাগই উল্লসিত হলাম, তবে কি আমরা আগে পুরুষতান্ত্রিকতার ধারক ও বাহক তার পরে শিক্ষক? কিন্তু এটাতো হওয়ার কথা নয়। শিক্ষক হিসাবে সমাজকে গড়ার দায়িত্ব, এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব অনেক বেশি। শিশুদের মন এবং মনন গঠনের দায়িত্ব তো আমাদের শিক্ষক সমাজের। আমরা নিজেরাই যখন ধর্ষণের কারণ ধর্ষিতাদের নিজেদের উপরই চাপিয়ে মহাউল্লাসে পুরুষতান্ত্রিকতার অহংয়ে মহাসুখে নিজেদের জয়ী ভাবি তখন একজন নারী হিসাবে, শিক্ষিক হিসাবে লজ্জিত হতে হয়।

 

শুধু পুরুষতান্ত্রিকতার অহংয়ে কেউ কেউ গর্বিত বোধ করেই চুপ থাকেন না, মাঝে মাঝে তার কুৎসিত কদাকার রূপ চলে আসে সবার সামনে। খুব পরিচিত কাছের একজন মাষ্টার মশাই বিয়ে করছেন শুনে জানতে চাইলাম, মেয়ে কি করে। তিনি গর্ব করে বললেন সবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। মাষ্টারমশাইয়ের বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। এত কম বয়সের মেয়েকে বিয়ে করছেন শুনে আমি অবাক হওয়ায় যেটা বললেন তাতে আমি আর আমার সহকর্মী একই পেশার সাথে যুক্ত ভেবে লজ্জিত বললেও কম বলা হয়। তিনি যেটা বললেন তার সারমর্ম এই যে, কম বয়সের মেয়ে—তাই পৃথিবী কম দেখেছে। তাই তার পুরুষবন্ধু কম হবে। তাই তার ভারজিনিটি অক্ষুণ্ণ থাকার সম্ভবনাই বেশি। যেন পুরুষবন্ধু থাকলেই ভারজিনিটি থাকবে না, আর সে মেয়েটি অপবিত্র হয়ে যাবে। আচ্ছা একজন শিক্ষকের মানসিকতা যদি এই রকম থাকে, তাহলে তিনি কি মানুষ তৈরী করবেন তা সহজেই অনুমেয়। এমন তো হতেই পারে যে কোন মেয়ে যে ধর্ষিতা হয়েছে বা কোনো পাচার হয়ে যাওয়া মেয়ে তার ছাত্রী, তাহলে সেই ছাত্রীর প্রতি সংশ্লিষ্ট মাষ্টারমশাইটির ব্যবহার কিরকম হবে। উত্তরটা মনে হয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন যে ছাত্রী আর জীবন সঙ্গিনী দুটো আলাদা বিষয়। কিন্তু একটি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী তো তার মনোভাবেই প্রতিফলিত হয়। সেই ছাত্রীকে সে অপবিত্র ভাববে। জীবন দুর্ঘটনার শিকার সেই ছাত্রীটি যদি সেই মাস্টার মশাইয়ের সাহায্যার্থী হয় তবে হতাশা ছাড়া কিছুই পাবে না। সমাজের কাছে পরাজিত সেই মেয়েটি হয়ত কোনো আলোর সন্ধান না পেয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। একজন শিক্ষক হিসাবে সেটা একটা ঘৃণ্য কাজ ছাড়া কিছুই না ।

 

একদিন শুনলাম এক মাস্টারমশাই আর একজনকে বলছেন, 'ভালই করেছ কমবয়সী মেয়েকে বিয়ে করেছ, নিজের মত বানিয়ে নিতে পারবে।' জানতে ইচ্ছে করছিল, যাকে বিয়ে করছেন সে কি মাটির তাল যে  ইচ্ছেমতো বানিয়ে নেওয়া যাবে। আসলে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধ্বজাধারী মাষ্টারমশাই এটাই বিশ্বাস করেন যে "আমি পুরুষ, আমি তোমায় ধ্যান দিব, ধারনা দিব, তুমি ফাঁকা বাক্স। আমি তোমাতে সব কিছু ভরে দিব যা আমি চাই। তোমার নিজস্বতা কিছু থাকতে নেই। তুমি যতই জীবনসঙ্গিনী হও তুমি আমার অধঃস্তন, তুমি আমার কমরেড নও, তুমি আমার গোলাম।" এই মাষ্টারমশায় তার ছাত্রদের কতটা লিঙ্গ সমতার মানসিকতায় তৈরী করতে পারবেন ভাবলে ভয় হয় ।

 

মাষ্টারমশাইদের পণ নেবার ব্যাপার ভাবলেই শিহরিত হতে হয়, আনন্দে নয় আশঙ্কায়। পণ নেবার রূপ এখন একটু বদলেছে। এখন মাষ্টারমশাইরা পণ নেননা। চাকরীজীবী খোঁজেন। একজন মাষ্টারমশাইয়ের চাকরীজীবি কোনা মহিলার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে পাশের মাষ্টারমশাইয়ের খোঁচা, 'ভালই পটিয়েছ, প্রতি মাসে....' তারপর যেটা বললেন সেটা না হয় উহ্যই থাক। এদের আলোচনা শুনে আরেক মাষ্টার মশাইয়ের ‘খোঁচা চাকরিজীবি বউ দেখবে তোমাকে গোলাম হয়ে থাকতে হবে।' পুরুষতান্ত্রিকতার ধারক ও বাহক এই মাষ্টারমশাইদের মধ্যে একবারও কেউ বলতে পারলো না কিংবা কারো মাথাতেও এলো না যে সেই শিক্ষিতা চাকরিজীবি মহিলাটি সেই মাষ্টারমশাইকে জ্ঞানে, গুণে সমৃদ্ধ করতে পারবে— এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে তার পরবর্তী প্রজন্মকে। এদের কাছে মেয়ে মানে ‘কমোডিটি' বা ‘পণ্য’ তাতে শুধু লাভ বা লোকসান থাকে। মেয়েরা এদের কাছে আশ্রিতা আর তারা আশ্রয়!

 

আমার ভাইঝির খুব মন খারাপ। কারণ তার প্রাইভেট টিউশন মাষ্টারমশাই তাকে নিয়ে খুব উপহাস করেছে, কারণ আমার ভাইঝিটি বলেছে সে বড় হয়ে ব্যবসা করতে চায়। অন্যরকম কিছু করতে চায় বলে যে মাস্টারমশাইয়ের উচিত ছিলো তাকে উৎসাহ দেওয়া। তিনি তার উল্টোটাই করেছেন। তার পুরষতান্ত্রিক মানসিকতা তাকে প্রলুব্ধ করেছে আমার ভাইঝিটিকে বোঝাতে যে মেয়েরা হাউসওয়াইফ কিংবা বড়জোর একটি সরকারী চাকরি করতে পারে তার বেশি কিছু নয়। বাকি কাজগুলো করার অধিকার শুধু পুরুষদের।

 

আর আমরা যারা মহিলা এই শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত তার। কতটা সচেতন সমাজের এই ‘আদার’ ভেবে নেওয়া অংশকে সমাজের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করতে? আমাদের ভূমিকাও খুব উজ্জ্বল ভাবলে ভুল ভাবা হয়। চেতনে বা অবচেতনে আমরা অনেকেই পুরুষতান্ত্রিকতারই এজেন্ট, মহিলাদের মধ্যে আমরা প্রতিষ্ঠিত বলে আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য সবার আগে সমাজের বাকি মহিলাদের এগিয়ে নিয়ে আসা। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার সমাজের অন্যান্য মহিলাদের মধ্যে হয়তো আমরা অর্থনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি কিন্তু মানসিক বাধা অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তাই ডিভোর্সি কোনো শিক্ষিকা কে দেখলে আমাদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে - 'জান না! ও ডিভোর্সি!' যেন ডিভোর্স হওয়া টা একটা পাপ! এই মানসিকতা নিয়ে কিভাবে ডিভোর্সি বা পাচার হয়ে যাওয়া কোনো শিশুকে শিক্ষার মূল অঙ্গনে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো?

সেই পাচার হয়ে যাওয়া ছাত্রীর কাউন্সেলিং করার আগে, কাউন্সেলিং দরকার আমাদের, শিক্ষক সমাজের। ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এর কথা না ভেবে যদি সমাজের 'আদার' হয়ে যাওয়া মেয়েদের, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মূল অঙ্গনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কথা ভাবি, তবে শিক্ষক হিসেবে নিজের পেশার সাথে সাথে সুবিচার করা হবে সে সমস্ত পিছিয়ে পরা প্রান্তিক মহিলাদের, যাদের আমরা প্রতিনিধি।

 

শিক্ষা হলো সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র ও প্রধান আলো। শিক্ষাই হলো একমাত্র মাধ্যম যা পারে লিঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। পারে এমন একটি সমাজ দিতে যেখানে সকালে উঠে মারি বিস্কুটের সাথে খবরের কাগজে ধর্ষণের খবর চিবোতে হবে না। সমাজ পচে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নারীদের উপর অত্যাচার। সমাজের পচা গলা জলে পচে যাচ্ছে শিশুদের নিরাপদ, সুন্দর ভবিষ্যতে স্বপ্ন। আত্মসমীক্ষা, আত্মমূল্যায়ন শিক্ষক সমাজকে করতেই হবে। সেটা শুরু হোক টিচার্স রুম থেকেই। নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠুক টিচার্স রুম সমস্ত লিঙ্গের শিক্ষকদের জন্য। দরকার লিঙ্গ গণতান্ত্রিক অভিধান।

 

আমরা , শিক্ষকরা যেন সর্বনাম গুলিয়ে না ফেলি। সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের দেই সর্বনাম নির্বাচনের স্বাধীনতা।

They/She/He/ - সবার যেন মুক্ত হয়ে উঠুক শিক্ষাঙ্গন। আমরা যেমন শেখার উপর গুরুত্ব দিই, তেমন যেন গুরুত্ব পায় গোঁড়ামি, পূর্বসংস্কার unlearn করার প্রতিদিনের চেষ্টা। ক্লাস রুম গুলো হয়ে উঠুক রামধনু। আর সব রঙের সমতার শিক্ষা শুরু হোক টিচার্স রুম থেকেই।

0 Comments

Post Comment