একের পর এক প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে একেবারে দক্ষিণে, মনে হচ্ছিল একটু গেলেই সাগর এগিয়ে আসবে, একলা ত্যাজ্যপুত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকা এক্সপ্রেস ট্রেনটা দেখতে পেল ইয়াসিন। সাউথ ইন্ডিয়া যাবার প্রায় সব ট্রেন এই দিকের প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে। বন্যার কারণে কয়েকটি ট্রেন বাতিল হওয়ার পর কদিন হল খুলেছে। একাই এতটা পথ লটবহর টেনে গলদ্ঘর্ম হয়ে কামরায় ঢুকে নিঃশ্বাস ফেলল সে। এখনও এ সি চলেনি। চললে অসুবিধেই হত, হঠাৎ লেগে যেত ঠান্ডা। নিজের সিট খুঁজে মালপত্র রেখে চোখ-মুখ ধুয়ে, টুপিটা খুলে আবার পরে নিয়ে, ঘন সুবিন্যস্ত দাড়ি ভেজা হাতে মুছে খানিকটা জল খেয়ে স্বস্তি পেল যেন। একটা কালো ঢাউস ব্যাগকে কিছুতেই কব্জা করতে না-পেরে পায়ের কাছেই রেখে দিল ইয়াসিন।
ট্রেন ছাড়ার মিনিটদুয়েক আগে যে-যাত্রীটি উঠল, তার হাবভাব, হাতে বয়ে আনা জিনিসপত্র দেখে দেখে মনে হল বাস্তব জীবনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেনি তেমন। একা একা কোথাও যাত্রা করেনি কখনও। হতে পারে ইয়াসিনের চোখ যাকে সাদামাটা পোশাকে সুন্দরী মনে করছে, তাকে এই ট্রেনও তেমন মনে করেছে! নইলে ট্রেনটি যেন তাকে নিয়েই যাত্রা করবে বলে এতক্ষণ অপেক্ষা করত না! নাজেহাল ভঙ্গিতে তার সিট নম্বর খোঁজার কৌশল দেখে উৎসুক হবে যে কেউ। ইয়াসিন সেভাবে তাকাতে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, এক্সকিউজ মি... সিট নাম্বার ফর্টি ফাইভ...?
নম্বরটা শুনে শুধু আঙুল বাড়িয়ে সিট দেখিয়ে দেয়ার পর ভাবল ইয়াসিন, খুব কাছে কেউ থাকলে জিজ্ঞাস্য কমে যায়। অথচ ইয়াসিন জিজ্ঞাসার মধ্যে বাস করতে ভালোবাসে। মেয়েটির কাছে জ্ঞাতব্য মালমশলা খারাপ নেই বলেই ইয়াসিনের মনটা দমে গেল। বসলে ইয়াসিনের মুখোমুখি সে, শোবার হলে মেয়েটির লোয়ার বার্থ আর উল্টোদিকের মিডল বার্থে ইয়াসিন। কাছাকাছির আরেক সংকেত হল, পারফিউমের গন্ধ অনবরত সহ্য করে যাওয়া।
ট্রেনটা ছেড়ে দিল। মেয়েটির কণ্ঠ থেকে বেরোনো অস্ফুট ‘আহহ...’ শব্দের মধ্যে এমন আশ্বস্ততা ছিল যে, ইয়াসিনের মনে হল, এরকম শব্দ সে শোনেনি কখনও। মানুষ এমন স্বস্তিতে শেষ কবে ছিল মনে করতে পারে না। তার চারপাশ ঘিরে অনবরত তুমুল অস্বস্তি আর সন্ত্রস্ত সব মানুষের ভিড়। অভাব অভিযোগ কাড়াকাড়ি হিংসা—এ সবের মাঝেই তার জীবননৌকার চলাচল। তাই অমন নরম শব্দটা তাকে মুগ্ধতায় ঘিরে রাখল কিছুক্ষণ।
আশেপাশের যাত্রীদের মধ্যে উচ্ছ্বসিত আলাপ-কথাবার্তার ছড়াছড়ি। একটু দেহাতি স্বভাব রয়ে গেছে বলে এখনো তাদের আন্তরিকতার স্বর কেড়ে নিতে পারেনি মোবাইল-দানব। তারা এই প্রথম এ সি কামরায় ভ্রমণ করছে হবে। সেইসব মায়া-শরীর থেকে আলো সরে যেতে মনে হল, শহর ছাড়িয়ে মাঠ-প্রান্তর পার করছে ট্রেন। মেয়েটি হাতে অযত্নে মোড়া ইংরেজি ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে বন্ধ কাচের জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরে দেখল সেসব। তার তেষ্টা পেল। তখনই মনে হল ওয়াটার-বটলটা ফেলে এসেছে।
ইয়াসিন মোবাইলে মগ্ন ছিল বটে, তবে পরিস্থিতি থেকে নজর সরায়নি। বলা ভালো সরাতে পারেনি। নিজের ঝকঝকে জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন। এটা থেকে খান আপাতত।
মেয়েটি অবাক হল। একটু অপ্রস্তুতও। খুব একটা অনভিপ্রেত মনে হল না যদিও, বলল, না না। লাগবে না। আপনি কী খাবেন?
--আজ বোধহয় জলওয়ালাদের বনধ নেই!
ইয়াসিনের কথা শুনে সামান্য হাসল সে। ভেতরে হাসল অনেকটাই। লোকটাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে! বেশ হিরোয়িক চেহারা, টিভিতে দেখেছে? বিদেশি টিভিতে?
একটা প্লেট বার করে তাতে স্ন্যাক্স ঢেলে খাবে এবার। কিছুতেই তা হচ্ছে না। হয় প্লেট পড়ে যাচ্ছে কোল থেকে। নয়তো স্ন্যাক্স বাইরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। যখন দুটো ব্যাপারই ঠিকঠাক, তখন জানালা দিয়ে কেউ কিছু ছুড়তে গেলে জড়োসড়ো—ব্যাস।
ইয়াসিন হঠাৎ বলে ওঠে, আসল ঘরে প্রদীপ নেই / গোয়ালঘরে মশাল!
--আপনি বাংলা প্রোভার্বও জানেন, আপনি বাঙালি?
মাথা নাড়ে ইয়াসিন--দেখে কী মনে হয়, গুজরাটি?
-- না ঠিক তা নয়...আসলে...
--রজনীকান্ত-নজরুল-মিহিদানার দেশের মানুষ আমি।
--কিন্তু ওই প্রোভার্বটা কি আমাকে টার্গেট করে বললেন?
--এখানে তো তা বোঝার মতো কাউকে দেখছি না।
--মানেটা...?
--অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ভালো না সবসময়। আর জানেনই তো ‘আত্মনির্ভরতা’-ও আজকাল ফেক কথা! বলছি কী, একা একা জার্নি করলে নিজেকে মুক্ত মনে করা যায়, কিন্তু অসুবিধের কথাটা মাথায় রাখলে ভালো হত আরকি।
--আপনি দাদা পারফেক্ট অবজার্ভার তো!
-- উঁহু, আমার নাম ইয়াসিন মল্লিক।
ইয়াসিনের কথার কায়দায় জোরে হেসে উঠল মেয়েটি--আমি রুনা মিত্র।
ট্রেন কোনো এক ছোটো স্টেশনে থামল। ততক্ষণে রুনার খাওয়া শেষ। ইয়াসিন দ্রুত নেমে গিয়ে একটা জলের বোতল কিনে ফিরে এল কামরায়। রুনার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এটা নিন এবার, এতে আমার এঁটো নেই।
--কী আশ্চর্য, তা কেন? আর আপনি কিনে আনতে গেলেনই বা কেন?
--এরপর আর জল পাওয়া সম্ভব নয় রাতে। নিন...
রুনা নিয়ে নিল। লোকটার কী এক ক্ষমতা আছে যে, কিছুতেই এড়ানো যায় না। তীক্ষ্ণ স্টিলের তরবারি যেন, নুইয়ে দিলেও স্থির প্রত্যয়ে দাঁড়ায়।
টিটি এসে পড়েছেন। রুনার দিকে একপলক দেখে ইয়াসিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়ে বোরা আপকি হ্যায়?
--হ্যাঁ, কেন?
--ও বোরা মে ক্যা হ্যায়?
টিটির উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হল না ইয়াসিনের। সন্দিগ্ধ চাউনি। মানুষ মানুষকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। অবিশ্বাস, সংশয়, সন্দেহ...তায় আবার টিটি, সরকারি সন্দেহবাতিক।
--ইজ দ্যাট ইয়োর কনসার্ন? ইয়াসিন শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করে।
--আরে ভাই বোলনে মে ক্যা দিক্কত?
--আয়্যাম নট বাউন্ড টু ডু সো। হিয়ার ইজ মাই টিকেট।
সন্দেহটা এবার যেন ছড়িয়ে পড়ল রুনার চোখেও। তাই তো, এতক্ষণ খেয়াল করেনি, বস্তাটা সামনেই ছিল! আড়চোখে তাকাচ্ছিল রুনা ইয়াসিনের দিকে, আবার তার মোটাসোটা বস্তার দিকেও। সত্যিই তো, ওই বস্তাতে কী থাকতে পারে? একজন টুপি পরা দাড়িওয়ালা যুবক, সঙ্গে মোটা বস্তা! দুই আর দুয়ে চার হতে কয়েক সেকেন্ড লাগে কারও মনে। খানিকটা চাপ কাটাতে ইয়াসিনের দেখাদেখি সে-ও টিকিট বার করে দেখাল টিটি-কে। সব চেক করে পেনের আঁচড় কাটতে কাটতে তিনি বললেন, ম্যাডাম আপ চাহেঁ তো বগলওয়ালি কামরে মে আ শকতে হ্যাঁয়। জাগা খালি হ্যায়...
কেন? টিটি-কে জিজ্ঞাসা করার আগে প্রশ্নটা উঠেই মিলিয়ে যেতে দিল রুনা। কিন্তু টিটির নজর বস্তার ওপর এবং তার মালিকের ওপর হেনে গেল যাবার সময়।
রাত বাড়ছে যেন ট্রেনের দ্রুতগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। একটা বড়োসড়ো স্টেশনে এসে থামতে প্রায় কামরা খালি করে যাত্রীরা নেমে গেল। সারারাত এখন এই কামরায় দুজন মানুষ। ইয়াসিন বলল, আপনি নিশ্চয়ই সামনের স্টেশনে নেমে যাবেন না? তার কণ্ঠে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।
--সকাল অব্দি আছি। ঠিক তেমন স্বাভাবিক ছন্দে জবাব দিল রুনা।
ইয়াসিন বেসিনে গিয়ে ওজু করে নিল। সঙ্গে জায়নামাজ বয়ে নিতে ভোলে না। সেটা বিছিয়ে বন্ধ দরজার যাতায়াত-পথের ফাঁকটায় পেতে নামাজ পড়তে শুরু করল। রুনার কেমন যেন কাঁপন জাগছে বুকে! ইয়াসিন কি তার সাহসের অবলম্বন হবে, না সমস্ত বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠবে! যা-ই হোক সে হারবে না। মানুষের সম্পর্ক কি শুধুই শারীরিক! পাশাপাশি বাস করে একাকী সব নারী-পুরুষ যৌনতা নিয়েই কি! কিন্তু, কোথায় গেল লোকটা? পা টিপে টিপে কামরা পার করে গিয়ে উঁকি মেরে দেখল প্রার্থনায় রত ইয়াসিন। এইবার কিছুটা সাহস ফিরে এল। বস্তার সামগ্রী নিয়ে প্রচণ্ড কৌতূহল তাড়া করছে। এই সুযোগে দ্রুত ফিরে এসে গেল বস্তাটার কাছ পর্যন্ত। কিন্তু খুলে দেখার সাহস হল না। কিংবা রুচিতে বাধল হবে।
ইয়াসিন ফিরে এল। এসেই জিজ্ঞাসা করল, বস্তা খুলে দেখলেন, কী সব অস্ত্র-শস্ত্র আছে?
--না, মানে...আমাকে অতটা ডিসঅনেস্ট ভাবলেন? তবে...সত্যিই তো, কী আছে, মানে... বলবেন?
--ওতে কিছু মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। ইয়াসিন তীব্র দৃষ্টিতে তাকায় রুনার দিকে। রুনা পরের প্রশ্নে যেতে সাহস হারিয়ে ফেলে। কিন্তু চোখ থেকে চোখ সরায় না। কত কিছুতেই বেঁচে থাকার অধিকার রচনা করা যায়। সমবেত চিকারে, গণ আন্দোলনে, কবিতায়, গানে...ভোট দিয়ে...। রুনা জানায় সে কথা।
--না। ভোট দিয়ে আর বেঁচে থাকার অধিকার অর্জন করা যাচ্ছে না। নির্বাচিত পাবলিক সার্ভেন্টরা এখন জনগণকেই দাস ভাবছে! নিজেদের ভাবছে মালিক!
তাহলে কি সত্যিসত্যিই অস্ত্রশস্ত্র বহন করছে লোকটা? রুনা সরাসরি সেভাবে না জিজ্ঞাসা করে ঘুরিয়ে জানতে চাইল, ওতে কি তাহলে ত্রাণসামগ্রী আছে?
--আপনারা যাকে ত্রাণ বলেন, আমি তা মনে করি না। দেশের মানুষকে বিপর্যস্ত করে দয়া দেখানোটা রাজনৈতিক কৌশল। তা মানুষের অধিকার ভঙ্গের পর্যায়ে পড়ে। সেটাই মেরামত করতে চাইছি আমরা, একটা টিম...। যাকগে, রাতে কী খাবেন, ভেবেছেন?
-- একদিন না-খেলে কিছু হবে না।
--ও। শখের ডায়েটিং?
রুনা কিছু বলে না। কেমন যেন অভিভাবকসুলভ আচরণ। মাথা পেতে নিতে আনন্দ হয়।
ইয়াসিন হ্যাভারস্যাক খুলে টিফিন বাক্স বার করে। রুটির গায়ে তরকারির রঙ লেগে আছে। একটা থালা বার করে তাতে খাবার রাখে। টিফিন বাক্সে বাকিটা। থালা ধরিয়ে দিয়ে রুনাকে বলে, এটা খেয়ে নিন, রাতে ডায়েটিং স্বাস্থ্যকর নয়। আর, এটা আমার মায়ের হাতে তৈরি...। প্রসঙ্গত, আমার মা একজনই, বাবার চারজন স্ত্রী নেই...
--আচ্ছা, আমাকে কী ভাবছেন বলুন তো, এভাবে কেন বলছেন ? জানি আমাদের মধ্যে অনেকের এমন ধারণা আছে। তা বলে...। দিন দিন। না খেলে আরও কত কী বলবেন কে জানে।
--কিছুই না, শুধু বলব—একটু সিমিপ্যাথি। একটু যদি সিমপ্যাথি নিয়ে পাশের মানুষকে দেখেন, তাহলে অনেক বাধাই সরে যায়।
রাত ঘন হয়ে এল আরও। এবার বিশ্রাম নেবার আয়োজন করতে হবে ওদের। রুনার এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না। সে তার সিটে গিয়ে ম্যাগাজিন নিয়ে বসল। ইয়াসিনের দেরি করলে চলবে না, সারাদিনে অনেক কাজ করার আছে। তার সঙ্গীসাথীরা এই ট্রেনেই অন্য কামরায় আছে। স্টেশনে নেমে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাড়ি দেবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। আলো জ্বেলে পড়া শুরু করেছে রুনা। কপাল পর্যন্ত চাদর টেনে দিয়ে আলো আড়াল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ইয়াসিন। বাইরের অন্ধকার প্রকৃতির কোনো সাড়া কামরার মধ্যে এসে পৌছোচ্ছে না। শুধু ট্রেনের গুমরে ওঠা একটানা আওয়াজ। যেন সেই আঁধার চিরে চিরে কোনো এক পবিত্র আলো আনবার জন্যে তিরগতিতে ছুটে চলেছে।
কারও ছায়া পড়ল কামরায়। ছায়া দীর্ঘ হয়, কিন্তু এ ছায়াটি বলিষ্ঠ। ছায়ার পেছন পেছন আবার এলেন টিটি।দেখা গেল তাঁর চোখমুখও বেশ কঠিন। কঠিন দৃষ্টিতে একবার ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে গার্জেনি অথচ চাপা সুরে বললেন রুনাকে, আপ বগলওয়ালি কামরে মে আ জাইয়ে প্লিজ। এঁয়াহা আপকা রহনা রিস্ক হো জায়েগা। হাম রিস্ক নেহি লেনা চাহতে। সমঝ গয়ে না আপ? আইয়ে....
কিসের রিস্কের কথা বলছেন, রুনার অজানা নয়। তবু কথাটা অমান্য করার ইচ্ছে হল না। কাগজ খুললেই সেই খবর নিত্যই চোখে পড়ে। তাছাড়া সে সত্যিই কি জোর দিয়ে বলতে পারে, তার কোনো ক্ষতি করবে না এই অচেনা মানুষটা! সুস্থ, সুন্দর মনের ভেতরই তো লুকিয়ে থাকে একেকটা দানব। প্রয়োজনে দাঁত নখ বের করে হাজির হয়। উঠে দাঁড়াল রুনা। সন্তর্পণে কয়েকটা জিনিস গুছিয়ে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়াল। টিটিকে দেখে মনে হচ্ছে এই একটি কাজের জন্যে ঈশ্বর তাঁকে প্রেরণ করেছেন। পেছন ফিরে ইয়াসিনের দিকে দেখার ইচ্ছে হল। ইয়াসিন উঠে বসে আছে তার ওপরের বাঙ্কে। মৃদু স্বরে বলল, আলোটা নেভাতে হবে।
যেটুকু আলো ইয়াসিনের মুখে পড়ছিল তাতে কথাটা রুনার শোনা হল না। অদ্ভুত এক অপমানে ইয়াসিনের দু-চোখ ভারী হয়ে আছে। আলো নেভানোর ঘোষণাটা সেই অপমানের অংশ হয়ে উঠল।
সেই কামরায় এক-দুজন যাত্রী ঘুমে আচ্ছন্ন। তাদের মেয়েলি পোশাকের কিনার ঝুলে আছে। শুয়ে পড়ল রুনা। নিজের নানা স্বপ্নময় জীবনের কথা ভাবতে চেষ্টা করল। স্টেশনে রজত তাকে রিসিভ করতে আসবে, ভাবতে চাইল তা-ও। তবু ঘুমোতে পারছে না রুনা। কোনো আনন্দময় খবর তাকে ঘুমের ভেতর নিয়ে যাচ্ছে না। সবকিছু ছাপিয়ে বারবার ইয়াসিনের অপমান ভরা চোখদুটো ভেসে আসছিল। ভোর হয়ে আসছে। সে এই অস্বস্তি নিতে পারছে না। থাকতে না-পেরে চলে এল নিজের কামরায়।
প্রথমেই ইয়াসিনের বাঙ্কে নজর দিল। কেউ নেই। কামরা ভুল করল নাকি? না, এই তো তার ছেড়ে যাওয়া ম্যাগাজিন, বড়ো ট্রলি—সব নিখুঁত সাজানো রয়েছে। যেভাবে ছেড়ে গেছিল, তার চেয়ে বেশি গোছালো মনে হচ্ছে। কোথায় গেল ইয়াসিন? চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে যাওয়া তো সম্ভব নয়! তবে কি মাঝে কোনো স্টেশনে নেমে গেল, যা খেয়াল করেনি সে! ট্রেনটা গতি কমাচ্ছে। সামনে কোনো স্টেশন হবে, থামবে হয়তো।
দরজা খুলে উঁকি দিল রুনা বাইরে। একটু শীত শীত করছে। মন জুড়ানো শীত। এমন অচেনা জায়গায় টুক করে নেমে পড়তে ইচ্ছে করে। অচেনা মানুষ, অচেনা জায়গায় ইচ্ছে করে হারিয়ে যেতে। যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে একে একে। মাইকে কী এক ভাষায় ঘোষণা চলছে—কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। অনেকে নেমে চা-বিস্কুট খেতে লেগেছে। ট্রেনটা কিছুক্ষণ দাঁড়াবে মনে হল। সেও নেমে দাঁড়াল। তখনই দেখল দূরে একদল মানুষ, জটলার মতো। উত্তেজিত স্বরে তারা চেঁচাচ্ছে। সেদিকে চলেছে যে লোকটা, তাকে চিনতে পেরেই শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন—ইয়াসিন! সেই কালো বস্তাটা নিয়ে জটলার দিকে চলেছে। রুনার মনে হল এক্ষুনি তার কাছে পৌছানো দরকার। তার অপমানটুকু যে কোনো উপায়ে মুছে নেয়া দরকার। রুনা দৌড় দিল। কালো বস্তা ভেদ করে কী যেন পড়ে গেল প্ল্যাটফর্মের চাতালে। কোনো অস্ত্রশস্ত্র! রুনা দেখতে পেল বেখেয়াল ইয়াসিনকে কেউ কেউ জানাচ্ছে তা। পেছন ফিরল ইয়াসিন। কুড়িয়ে নিল একটা প্যাকেট। বাচ্চাদের পোশাকের প্যাকেট, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্যে ত্রাণ! রুনা হাত ওঠাল, চেঁচাল—ইয়াসিন, ইয়াসিন...
ইয়াসিন কি থমকে দাঁড়াল। শুনতে পেল কি রুনার চিৎকার? ভিড়ের মাঝে রুনার সবকিছু কেমন হারিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনটা বাঁশি দিল। যে কোনো একটা দরজা দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়া ছাড়া আর কিছু করার উপায় নেই তার।
ঋণঃ জনৈক পারমিতা চক্রবর্তীর সংবাদপত্রে প্রকাশিত পত্রের ভাবানুসারে লিখিত।