বাঙালির ভালোবাসাতে 'মাছ' শব্দটা স্বর্ণাক্ষর দিয়ে লেখা। মাছের সঙ্গে বাঙালির সেন্টিমেন্টাল এই অ্যাটাচমেন্টকে কোন ভাবে ছোট করা যায় না। মাছ বাঙালি খায়। তা নিয়ে বাঙালি গালাগালি খায়নি এমন বলা যাবে না। মনে আছে নিশ্চয়, সর্বাবন্দ বাঙালিকে মৎস্যখেকোর বচ্চার বলে গালাগালি দিয়েছিলেন। তাতে কী! কুছ পরোয়া নেহি। মৎস্য মারিব খাইব সুখে। এই মন্ত্রে কথাও কোন কমতি হবে না।
মাছ বাঙালি খায় কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর যদি খুঁজতে হয়, তাহলে বাংলার ভূপ্রকৃতির দিকে তাকাতে হবে। বাংলার গড়নে নদী জলাভূমির অবদান অনস্বীকার্য। তাই বাংলার শরীর জুড়ে জল। আর জলের ফসল মাছ। কাজেই মাছ বাঙালির খাবারের একটা অঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে, এটা স্বাভাবিক। বাঙলার সংস্কৃতিতে মাছ অংশীদার। কাজেই নৃতাত্ত্বিক অতুল সুরের কথার রেশ টেনে বলতে হয়, ঠিক এই কারণেই বাঙালি সধবা মেয়েরা মাছ খায়।
মাছ খাওয়া বাঙালিদের নানা ট্যাবু আছে। কবে মাছ খেতে হয়, কবে খাওয়া যাবে না...এমন সব নানা নিয়ম কানুন। মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর একটা জ্যান্ত ল্যাটা মাছকে খপাৎ করে চেপে ধরতে হয়। ল্যাটা মাছ পুরুষের লিঙ্গের প্রতীক। মাছ চেপে ধরতে পারলেই পুরুষের কামনা বাসনাকেও বৌ কেন্দ্রিক করে ফেলা যায়, এই বিশ্বাস বহু দিন ধরে চলে আসছে। ইলিশের সঙ্গে বাঙালি মনে প্রাণে জড়িয়ে আছে। বাঙালির ইলিশ চেতনায় ইলিশ মাছ সৌভাগ্যের প্রতীক। বাড়িতে বছরে প্রথম ইলিশ মাছ আসলে ইলিশের আঁশ কিছুটা খাবলা দিয়ে তুলে নিয়ে উঠোনের মাঝে পুঁতে রাখা হত। সরস্বতী পুজোর দিন বাঙালির ঘরে জোড়া ইলিশ আনতেই হবে। ইলিশ বাঙালির লক্ষণ শুভক্ষণ। আবার দশমী পুজোর দিন অনেক জায়গাতেই নিয়ম আছে, মা দুর্গা ইলিশ মাছ খেয়ে মর্তধাম ছেড়ে কৈলাসে পাড়ি দেবেন। আচ্ছা আপনি বলুন তো এই রকম বাঙালিকে কেউ যদি মাছ খাওয়ার খোটা দেয়, তবে বাঙালি কী নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোবে? একেবারেই না। সময়ের বদল হয়েছে। তবে কী জানেন মাছ ভাত খেয়ে বাঙালির একটু ঘুম দেওয়া, সেটা বরাবরের অভ্যেস। অতো সহজে কী পাল্টানো যায়, বলুন তো!
ছোট মাছ নিয়েও বাঙালির ভালোবাসার কমতি নেই। ছোট মাছ তো বাঙালির লক্ষ্মী মাছ। একটু বেগুন, আলু,ছিম, বরবটি দিয়ে মাখা মাখা করে চচ্চড়ি বাঙালির বড্ড ভালোবাসার। শেষ পাতে মাছের টক,সেখানেও মাছের অবদান রয়েছে। এই যেমন ধরুণ মৌরলা মাছের টক। তাহা! মুখে লেগে থাকার মতো। বাঙালির মাছের সঙ্গে পার্বন, বাঙালির মাছের সঙ্গে জীবন, বাঙালির মাছের সঙ্গে রসনা- সব কিছু মিলে মিশে একাকার।
আচ্ছা, আপনাদের নয়না মাছের কথা মনে আছে? এই প্রজন্মের মানুষেরা কেউই জানেন না, এই মাছটার কথা।তবে পুরোনো মানুষদের এখনো মনে আছে। খাল-বিল, হাওর-বাওড় এবং নদীতে ছিল এই মাছের সংসার। জলাশয়ে জলের একেবারে তলায় কাঁদা পাকে থাকতে পছন্দ করতো সে। বর্ষার সময় ধানেক্ষেত বা জলাশয়ে প্রায় উঠে আসত। আবার শীতের সময় এরা জলাশয়ের আগাছার মধ্যে গা লুকাতো। নয়না মাংসল মাছ। খেতেও খুব সু-স্বাদু । এদের কোনো চর্বি নেই। দেহ পাশের দিকটা চাপা। গায়ে দু’পাশে তিনটি করে হলুদ-সবুজাভাব ডোরা। মুখ বড়। দেহের রং কালচে সবুজ। এর লেজ পাখনাটা গোল। আকারে লম্বা। অনেকটা কই মাছের মত। মাছটির চেহারার ঠাট বাট না থাকলেও, বাঙালির খাদ্যতালিকায় পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছিল। মাছের প্রতি ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে নানা কথা মনে চলে আসছে।
আবার বোরোলি, রাসভোরা , দাঁড়কে , মৌরলা , বট কই, পাঁকাল , ফলুই, শরপুঁটি , কাঞ্চন পুঁটি, মেদি, ধানিয়া, ক্যাকচেরা, ক্যাচকেচি, চাপিলা, বৈচা, চাটুয়া, নাপতানি, চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিতপুঁটি, বাইলা, মেনি, শিং, কৈ, টাকি, শোল, ফলই, চেলি, মলা, ঢেলা, কানপোনা, ডানকিনা, বাচা, বাটা, রিটা, পিয়ালি, জয়া, খৈলশা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, চান্দা, কাজলি, চ্যাং, ছোটচিংড়ি, বাতাশি, বড় বাইন, তারা বাইন, শালবাইন, চিকরা বাইন, কাকিয়া, কুচিয়া, তারা, খোকসা, খড়কুটি, দেশি জাতের পটকা, কাশ খররা, টাটকিনি এই গুলো সব মাছের নাম। নদী পাওয়া যেত এই সব মাছ। বাঙালির পছন্দের তালিকায় এই সব মাছ এক বড় রকমের জায়গা নিয়ে ছিল। মৎস্য গবেষকরা হিসেব করে দেখেছেন, বাংলার মিষ্টি জলে কম বেশি ১৪৩ রকমের ছোট মাছ পাওয়া যেত। যার মধ্যে ৬৩ রকমের ছোট মাছ একেবারেই হারিয়ে গেছে।
কাজেই সাবধান করে দিচ্ছি, মাছ খাওয়া নিয়ে বাঙালিকে গালাগালি দেবেন না। বাঙালি মাছের মাথা চিবিয়ে মগজে ভালোই শান দিয়েছে। সে কথা ভুলবেন না যেন!