হায় মারাদোনা, হায় দিয়েগো, ২০২০ সালে এই নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখেই এই পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছিলে তুমি চিরতরে। দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা শুধু একটা নাম নয়, একটা আবেগ, একটা ফুটবলময় জীবন, ফুটবলে মাঠের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্র, একাধারে ফুটবলের রাজকুমার আবার অন্যদিকে একইসাথে ফুটবলের মহানায়ক আবার ট্র্যাজিক নায়ক দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। ১৯৮৬-র বিশ্বকাপ জয়ের সেই আবেগমোথিত আস্ফালন, আবেগে ভেসে যাওয়া খুশির কান্না, ১৯৯০-এর বিশ্বকাপের ফাইনালে পরাজিত মারাদোনার হৃদয়মোচন করা কান্না, ১৯৯৪-এর ইউএসএ বিশ্বকাপ থেকে নিষিদ্ধ ড্রাগ সেবনের দায়ে বিশ্বকাপ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর সেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ, সেই আবেগ। বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের তুমি ফুটবল আবেগ শিখিয়েছিলে। বাঙালির একাংশকে যে বিশ্বকাপের সময় নীল-সাদা এলবিসেলেস্তের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় তার কারণ এখনও তুমি দিয়েগো, শুধু তুমিই, মারিও কেম্পেস বা বুরুচাগা বা বাতিস্তুতা নন। মেসি যে আজও বাঙালির মণিকোঠায় তা সে তোমার উত্তরসূরি বলেই দিয়েগো। কিন্তু হায় দিয়েগো, হায় মারাদোনা ২০২২-এর কাতার বিশ্বকাপে তোমার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর ঠিক আগে নীল-সাদা জার্সি প্রথম ম্যাচেই যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল তাকে এককথায় ইন্দ্রপতন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
অথচ শুরুটা মোটেও এভাবে হয়নি। সৌদি আরব যে মেসির নেতৃত্বাধীন আর্জেন্টিনাকে আটকাতে শারীরিক ফুটবল খেলবে তা জানাই ছিল। ২০১৯ সাল থেকে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকা আর্জেন্টিনা দলও শুরু করেছিল ঝটিকা আক্রমণে। খেলার দশ মিনিটের মাথায় সৌদি রক্ষণভাগ অনর্থক ফাউল করে পেনাল্টি উপহার দেয় আর্জেন্টিনাকে। লাওনেল মেসি মাথা ঠান্ডা রেখে বল জালে জড়িয়ে দিতে ভুল করেননি। সেই সময় নীল-সাদা জার্সিদের বেশ ঝলমলে লাগছিল লুসেইল আইকনিক স্টেডিয়ামের মাঠে। প্রথমার্ধটা আর্জেন্টিনা শাসন করেও সৌদি রক্ষণভাগ এবং বিশেষত তাদের গোলরক্ষকের অসাধারণ পারফরম্যান্সের দৌলতে স্কোর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি আর্জেন্টিনা।
দ্বিতীয়ার্ধে কিন্তু পাওয়া গেল নতুন সৌদি আরবকে। এর আগে ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপে আল-ওয়াইরানের দুর্ধর্ষ গোলে বেলজিয়ামকে হারানো ছাড়া এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপের মূলপর্বে সেরকম কোনও উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স ছিল না সৌদি আরবের। আল-ওয়াইরানের সেই গোল মনে পড়িয়ে দিয়েছিল ১৯৮৬-র মেক্সিকো বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দিয়েগো মারাদোনার সেই বিশ্বশ্রেষ্ঠ গোলকে। আর্জেন্টিনা আর সৌদি আরবের পারস্পরিক আন্তর্জাতিক ম্যাচের ইতিহাস বলছে এর আগে তিনবার একে অপরের বিরুদ্ধে সাক্ষাতে ১৯৮৮ সালে বাইসেন্টিকারী কাপে ২-০ গোলে জয়ী হয়েছিল আর্জেন্টিনা, ১৯৯২ সালের কনফেডারেসন কাপে আর্জেন্টিনা জিতেছিল ৩-১ গোলে, ২০১২ সালে কিন্তু এই দুই দলের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ম্যাচ অমীমাংসিত ছিল গোলশূন্যভাবে। কোথাও হয়ত আত্মতুষ্টি গ্রাস করেছিল কোপা চ্যাম্পিয়নদের। মারাদোনার মৃত্যু পরবর্তী এই প্রথম বিশ্বকাপে তাই থমকে গেল লাতিন আমেরিকীয়দের মাঝমাঠ রক্ষণভাগ। ঠিক যেমন থমকে গিয়েছিল ২০১০-এর দক্ষিণ-আফ্রিকা বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে, যখন দিয়েগো স্বয়ং ছিলেন আর্জেন্টিনার কোচ। সেবারে প্রতিপক্ষ জার্মানি ৪-০ গোলে ধ্বংস করেছিল আর্জেন্টিনাকে। এবারে এলবিসেলেস্তের বিপর্যয় ডেকে আনলেন এশিয় সৌদি আরব। আগের দুটি ম্যাচে দুই এশিয় দেশ আয়োজক কাতার আর ইরানকে অসহায় লেগেছে। কিন্তু কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের সমালোচনাকারী তাদের প্রতিবেশী দেশ সৌদি আরব কিন্তু ঝলসে উঠল। ম্যাচের ৪৮ আর ৫৩ মিনিটে ফুটবল বিশ্ব প্রত্যক্ষ করল দুটো বিশ্বমানের গোল। ১১ নম্বর জার্সিধারী সালেহ আলসেহরীর দুর্দান্ত গোলটির সময় আর্জেন্টিনার মাঝমাঠ থেকে রক্ষণভাগ পুরো দাঁড়িয়ে পড়েছে অসহায়ের মতন। ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আরেক ১০ নম্বর জার্সিধারী সৌদি অধিনায়ক সালেম আলদাওসারী যে গোলটা করলেন তা আবার সেই দিয়েগোকেই মনে করালো। কিন্তু এই গোলটাই দিয়েগোর দেশের কাছে আপাতত দুঃস্বপ্ন হয়ে রইল। মেসিকে দ্বিতীয়ার্ধে যেন কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রেখে দিলেন সৌদি ডিফেন্ডাররা। নিজেদের রক্ষণভাগে নেমে এসেও সেই ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে পারলেন না দিয়েগোর উত্তরসূরি। খেলার শেষের দিকে বারংবার সৌদি রক্ষণভাগে আক্রমণ শানিয়েও ম্যাচে সমতা ফেরাতে পারলেন না ডি’মারিয়া, আলভারেজরা।
বিশ্বকাপের ইতিহাস বলছে এর আগে একমাত্র একবারেই নিজেদের প্রথম ম্যাচে হেরেও বিশ্বকাপ জিতেছে এমন দেশ একটিই। ২০১০-এর বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের কাছে ০-১ গোলে পরাজিত হয়েও বিশ্বকাপ জিতেছিল দেল বস্কির প্রশিক্ষণাধীন তিকিতাকা স্পেন। আর ১৯৯০-এর ইতালি বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে রজার মিল্লার ক্যামেরুনের কাছে ০-১ গোলে হেরেও ফাইনালে পৌছে জার্মানির কাছে হেরে গিয়ে রানার্স হয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে সেসময় বিশ্বকাপের মূলপর্বে অংশ নিত ২৪টি দল। প্রতিগ্রুপের সেরা দুই দল ছাড়াও সব গ্রুপ মিলিয়ে সেরা ৪টি তৃতীয় হওয়া দলও পরের পর্বে যাওয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু ৩২ দেশের বিশ্বকাপে প্রতি গ্রুপ থেকে দুটির বেশি দলের পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার জায়গা নেই। আর গ্রুপ-সি তে থাকা অন্য দুটি দল হল মেক্সিকো আর পোল্যান্ড। সেই অর্থে খাতায় কলমে থাকা সবচেয়ে দুর্বল দলের কাছেই হেরে রইল আর্জেন্টিনা। অন্যদিকে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে নিঃসন্দেহে এশিয় ফুটবলের প্রতিনিধি হিসাবে বিশ্বকাপের মঞ্চে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে সৌদি আরব। তবে ফিফা বিশ্বকাপের রঙ্গমঞ্চে যে নাটক জমে উঠেছে তা আর বলতে বাকি রাখে না। ঘটনা-অঘটনের ঘনঘটা ঘটতে শুরু করেছে