পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

দোসর পুঁজির কিস্যা পর্ব ৭ এবার রেলের পালা

  • 29 May, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1541 view(s)
  • লিখেছেন : শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
ভারতীয় রেল তার পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য ভারতের করদাতা জনতার টাকায় অনেক লগ্নি করেছে, তার মধ্যে সব কিছুই যে ভারতের জনতার প্রয়োজনে এমন নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের বাধ্যবাধকতা অনেক কেন্দ্রীয় প্রকল্পকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার সুযোগ করে দেয়, যেমন মুম্বাই-আমেদাবাদ “বুলেট ট্রেন” প্রকল্প। কিন্তু রেলের পরিকাঠামোর অন্যান্য অনেক উন্নয়ন রেলের জন্য এবং তা আম জনতার জন্যও প্রয়োজনীয়। এমন একটা প্রকল্প দ্রুতগতি পার্শেল সরবরাহ ব্যবস্থা। পরীক্ষামূলকভাবে এই ব্যবস্থা দিল্লি ও মুম্বইয়ের মধ্যে ১১৩ দিন চালানো হয়। এই ব্যবস্থার নিশ্চিত দ্রুতগামিতায় আশ্বস্ত হয়ে আমাজন ইন্ডিয়া এই ব্যবস্থা ব্যবহার শুরু করে এবং ভারতীয় রেল শুধু আমাজন-এর কাছ থেকেই ২ কোটি টাকা লাভ করে। রেল ব্যবস্থার ছড়িয়ে পড়ার হার বেড়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সারা বিশ্বের রেল-বাজারে ভারতীয় রেল তৃতীয় স্থান দখল করবে, এবং বিশ্বের বাজারের ১০ শতাংশ কব্জা করবে।

ভারতীয় রেলপথের দৈর্ঘ প্রায় ১, ২৩,২৩৬ কিমি। এর সঙ্গে যদি আমরা তুলনা করি মার্কিন দেশের দৈর্ঘের, তবে সেই দৈর্ঘ দাঁড়ায় ১৭,৫৬৩ কিমি, আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড়ো গোটা চল্লিশেক দেশকে যদি হিসেবের মধ্যে আনি তো তাহলে সেই ইউনিয়নের দৈর্ঘ দাঁড়ায় মোটামুটি ৬৬,০০০ কিমি।

এই বিরাট রেল ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত ১৩, ৫২৩টি যাত্রীবাহী ট্রেন, ৯,১৪৬টি পণ্যবাহী ট্রেন। এই বিশাল রেল ব্যবস্থা ১ এপ্রিল, ২০১৯ থেকে মার্চ ১৯, ২০২০ প্রতিদিন সর্বমোট ২, ৩০,০০,০০০ যাত্রী বহন করেছে, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ৩০,০০,০০০টন পণ্য পরিবহন ঘটেছে। এই রেল ব্যবস্থায় মার্চ ২০২০ পর্যন্ত মোট স্টেশনের সংখ্যা ৭,৩৪৯টি। একটি মাত্র সংস্থার ব্যবস্থাপক হিসেবে ভারতীয় রেল ব্যবস্থা সারা পৃথিবীতে কুশলতার সঙ্গে জটিলতাকে সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে রয়েছে। এমনকি যেসব সংস্থা সড়ক পরিবহনের জন্য গাড়ি নির্মাণ বা সেই গাড়ির যন্ত্রাংশ দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পাঠাতে চায়, তারাও তাদের সড়ক পরিবহনের পরিকাঠামো ব্যবহার না করে এই রেল ব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করে থাকে।

শোনা যায়, বিশেষত মোদি সরকারের আমলে, সব সরকারি সংস্থাগুলি নাকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কুশলতার বা দক্ষতার অভাবে ক্রমাগত ক্ষতিতেই চলছে। এই কথা বলে আসছে সরকারের সমস্ত দোসর পুঁজির মালিকরা, যাদের কাজকর্ম আমরা আগের কটা কিস্তিতে বেপর্দা করেছি। নিজেদের ব্যবসা পরিচালনার যে “কুশলতা এবং দক্ষতা”-র কথা এই সব দোসর পুঁজির পাণ্ডারা সজোরে প্রচার করেন, তাদের নিজেদের অবস্থাটা ঠিক কেমন? কয়েকটা প্রতিনিধিত্বকারী উদাহরণ দেওয়া যাক।

১) টাটা গোষ্ঠীর কিস্যা দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। ভারতে টাটার সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে, ১৯১৫ সালে তারা “টাটা পাওয়ার” নামে একটি কোম্পানি তৈরি করে। ২০১৯ সালের জুন ১৮, অর্থাৎ কোভিড অতিমারির প্রায় এক বছর আগে, এই সংস্থার বার্ষিক সাধারণ সভায় হইচই পড়ে যায়। সংস্থার সর্বোচ্চ ব্যক্তি ঘোষণা করেন যে ২০১৯ সালে শেষ হওয়া আর্থিক বছরে সংস্থাটির ঋণের পরিমাণ ৪৭,৫৫২ কোটি টাকা। যে আর্থিক বছরে এই সভা চলছে, অর্থাৎ ২০১৯-২০২০ সালে, সংস্থাকে তার লাভের প্রতি ১ টাকা পিছু ৭ টাকা ঋণ মেটাতে খরচ করতে হবে! ঋণ শোধের এই বোঝা থেকে টাটা-র প্রায় কোনও নামি সংস্থা রেহাই পায় নি। যেমন টাটা স্টীল বা টাটা মোটোরস। ২০২০তে শেষ হওয়া আর্থিক বছরে টাটা স্টীল-এর মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,০৪,৬২৬ কোটি টাকা, আর টাটা মোটোরস-এর ঋণের পরিমাণ ৪৫,৩৭৬ কোটি টাকা! এই দুটি সংস্থা ছাড়া টাটা-র আরও ১১টি সংস্থার সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ১৪,৭৬৫ কোটি টাকা। ঋণ মেটাতে টাটা টেলি তার মোবাইল সংস্থার যাবতীয় সম্পত্তি ৫,০০০কোটি টাকায় বেচে দিয়ে এবং সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় তার মোবাইল কোম্পানিটির অন্যান্য পরিকাঠামো ভারতী টেলিকম সংস্থাকে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। বহু বিজ্ঞাপিত টাটা মোটরস পশ্চিম বাংলার সিংগুর এবং গুজরাটের সানন্দাতে ব্যর্থ চেষ্টা করে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি করে কোম্পানিটি গুটিয়ে নেওয়ার জন্য তার অন্য একটি চালু কোম্পানি, টিসিএস-এর কাছে থেকে বিপুল অর্থ ( ১৩,৮২৩ কোটি টাকা) ধার নিয়ে সেই কাজ করছে গত কয়েক বছর ধরে।

ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলিকে প্রায় নিঃস্ব করে ব্যবসার নাম করে কতজন গুজরাটের তস্করবৃন্দ মোদি সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, তার তালিকা এখন সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে। যারা অতটা সুবিধে পায় নি, তাদের কী অবস্থা দেখা যাক।

২) কাফে কফি ডে বা সিসিডি নামে খ্যাত সংস্থাটির কর্ণধার ভিজি সিদ্ধার্থ এন্তার ঋণ নিয়ে তাঁর এই সাম্রাজ্য নির্মাণ করেন। ঋণ শোধের জন্য তিনি তাঁর কোম্পানির শেয়ার বাঁধা রেখে অল্প সময়ের জন্য ছোটো ছোটো ঋণগুলো মেটাতে থাকেন। কিন্তু তাঁর এই মাছের তেলে মাছ ভাজার প্রকল্পটি স্বভাবতই স্থায়ী হয় না এবং তাঁর কোম্পানির ঋণ পাওয়ার গ্রহণযোগ্যতা ক্রমাগত কমে আসতে থাকে। এক সময়ে তিনি আত্মহত্যা করার প্রয়াসে মহারাষ্ট্রের একটি ব্রিজ থেকে নদীতে ঝাঁপ মারেন। পুলিশের মতে তাঁর মৃত্যু হয় এই আত্মহত্যার চেষ্টার ফলেই। তাঁর কাছে এক “সুইসাইড নোট”-এ তাঁর আর্থিক কেলেংকারির নানা কথা জানা যায়।

৩) এবার আসা যাক জেট এয়ার লাইনসের কাহিনিতে। এই সংস্থার চেয়ারম্যান শ্রী নরেশ গোয়েল মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে যাত্রী বিমান পরিবহনের ভাড়া এনে দেওয়ায় তিনি মেট্রোপলিটান ভারতের স্বপ্ন-ঘোড়ার চড়নদার জনতার কাছে “আইকন” হয়ে ওঠেন। কিন্তু ক্রমাগত ঋণ করে ঘৃত পানের নিদান মেনে লাগামছাড়া ঋণ নিতে গিয়ে গিয়ে এক সময় দেনার দায়ে তাঁর কোম্পানিটি ব্যাঙ্ক দখল নেয়। ব্যাঙ্ক হাজার চেষ্টাতেও এই কোম্পানিটি বেচে তার পাওনা টাকা উদ্ধারে সমর্থ হয় নি। জেট এয়ার ওয়েজের মালিকদের বিরুদ্ধে ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার তছরুপের মামলা দায়ের হয়, এবং গোয়েল সাহেবের বিদেশ গমনে ভারত সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে। মজার কথা হলো নরেশবাবুকে পুলিশ কখনই গ্রেপ্তার করে নি। পরে মুম্বাই হাইকোর্ট সেপ্টেম্বর ২০২০তে তিনি ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে এনফোর্স্মেন্ট ডিরেক্টরেটের আনা যাবতীয় অভিযোগ খারিজ করে তাঁকে জালিয়াতির মামলা থেকে খালাশ করে দেয়। ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যঙ্ক থেকে তিনি আগের মতই “ঋণ” নিতে নিতে ২০২১-এর কোনও এক সময়ে আবার জেট এয়ার ওয়েজ চালাবেন বলে সাব্যস্ত হয়েছে!

৪) আসা যাক আম্বানিদের গল্পে। অনিল আম্বানির বিদেশি ঋণদাতা, এরিক্সোন সংস্থা ভারতীয় কোর্টে এক মামলায় বলে যে, হয় অনিল আম্বানি সংস্থা তার পাওনা ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তাকে মিটিয়ে দিক, নইলে জালিয়াতির দায়ে অনিল আম্বানিকে জেলে পাঠানো হোক এবং তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হোক। এই মামলায় অনিল আম্বানিকে টাকা ফেরত দেওয়ার যে শেষ সময় দেয়া হয়েছিল, সেই দিন মুকেশ আম্বানি ও তাঁর সংস্থা এই টাকা এরিক্সোন সংস্থাকে দিয়ে দেয় এবং মামলাটি খারিজ হয়।

৫) রিলায়েন্স নাভাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা দেউলিয়া ঘোষণার মুখে। একই অবস্থা রিলায়েন্স ক্যাপিটাল লিমিটেড-এর। চীনা ঋণদাতারা আম্বানিকে লন্ডনের কোর্টে টাকা চুরি, বেআইনি টাকা পাচার, মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাজারে কৃত্রিমভাবে নিজেদের শেয়ারের দাম বাড়ানোর মতো গুরুতর “কর্পোরেট ক্রাইম”-এর অভিযোগ তুলেছে। ইংল্যান্ড সরকার সম্প্রতি অনিল আম্বানির বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছে। ২০১৯ সালে ভারতের দেউলিয়া কোর্টে আম্বানির আর কম টেলি সংস্থা আবেদন করে এবং তার ৪৬,০০০ কোটি টাকার ঋণ এই দেউলিয়া আইন মতে মকুবের আবেদন জানায়।

৬) আদানি সংস্থাও যে পরিমাণে ঋণের জালে ডুবে আছে, তাতে ভারতের “সেবি” সংস্থার মতে আদানির অন্তত গোটা দশেক সংস্থার দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ১০ শতাংশের বেশি, অন্য কয়েকটি সংস্থার জন্য সেই সম্ভাবনা ৭৫ শতাংশের মতো।

এর বিপরীতে আমরা ভারতীয় রেলের ব্যবস্থাপনা এবং দক্ষতার দিকে নজর ঘোরাতে পারি। অতিমারির আগের আর্থিক বছরে, অর্থাৎ ২০১৮-১৯ আর্থিকবর্ষে ভারতীয় রেলের নিট লাভ হয়েছে ২৭.১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত আর্থিক বছরের তুলনায় বৃদ্ধি ঘটেছে ৬ শতাংশের কিছু বেশি। সবদিক মিলিয়ে, অর্থাৎ, যাত্রীভাড়া, পন্য পরিবহন খাত ও অন্যান্য পরিষেবা মিলিয়ে গত আর্থিক বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধির হার ১২.৫ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি ২০২০তে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় রেলের মোট রোজগার দাঁড়িয়েছে ১,৮৩,০৯২ কোটি টাকা বা প্রায় ২৬.২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে, ভরা অতিমারির সময়কালে, যখন দীর্ঘ সময়ে ট্রেন পরিষেবা বন্ধ ছিলো, তখনও রেলের আয় শূন্যের কোঠায় পৌঁছয় নি, প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে রেল। এই সময়েও রেলের উন্নয়নের কাজ থেমে থাকে নি। ২০২০-র নভেম্বরেই রেল ঘোষণা করেছে যে তার ফ্রেট করিডোরের ৪০ শতাংশ অঞ্চল সে নভেম্বর ২০২১-এর মধ্যেই চলাচলের জন্য খুলে দেবে, বাকি অংশ খুলবে জুন ২০২২।

ভারতীয় রেল তার পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য ভারতের করদাতা জনতার টাকায় অনেক লগ্নি করেছে, তার মধ্যে সব কিছুই যে ভারতের জনতার প্রয়োজনে এমন নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের বাধ্যবাধকতা অনেক কেন্দ্রীয় প্রকল্পকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার সুযোগ করে দেয়, যেমন মুম্বাই-আমেদাবাদ “বুলেট ট্রেন” প্রকল্প। কিন্তু রেলের পরিকাঠামোর অন্যান্য অনেক উন্নয়ন রেলের জন্য এবং তা আম জনতার জন্যও প্রয়োজনীয়। এমন একটা প্রকল্প দ্রুতগতি পার্শেল সরবরাহ ব্যবস্থা। পরীক্ষামূলকভাবে এই ব্যবস্থা দিল্লি ও মুম্বইয়ের মধ্যে ১১৩ দিন চালানো হয়। এই ব্যবস্থার নিশ্চিত দ্রুতগামিতায় আশ্বস্ত হয়ে আমাজন ইন্ডিয়া এই ব্যবস্থা ব্যবহার শুরু করে এবং ভারতীয় রেল শুধু আমাজন-এর কাছ থেকেই ২ কোটি টাকা লাভ করে। রেল ব্যবস্থার ছড়িয়ে পড়ার হার বেড়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সারা বিশ্বের রেল-বাজারে ভারতীয় রেল তৃতীয় স্থান দখল করবে, এবং বিশ্বের বাজারের ১০ শতাংশ কব্জা করবে।

দোসর পুঁজির ভেল্কিবাজি

একথা সবাই জানে যে লাভজনক সংস্থাকে রুগ্ন সংস্থা হিসেবে প্রচার করে দিতে পারলে সেই সংস্থাকে জলের দরে কিনে নেওয়া যায়। আরও ভালো হয়, যদি সেই সংস্থার “উন্নতি”-র জন্য বিপুল পরিমাণে অর্থ সংস্থাটিকে জলের দরে কেনার আগে সরকারকে দিয়ে লগ্নি করানোর কাজটিও সেরে নেওয়া যায়। এই দুটি বিষয়ই দোসর পুঁজির জন্য সোনায় সোহাগা!

ভারতীয় জনতা পার্টির চৈতন্যে “আত্মনির্ভরতা” আসলে “দোসর-পুঁজি নির্ভরতা”। অতএব ভারতীয় রেলের মতো একটি বিপুল বিত্তের মালিক সংস্থাকে পেয়ারের “শিল্পপতি”-দের হাতে সমর্পণ না করা পর্যন্ত বারান্দায় প্রিয় ময়ূরকে খাওয়ানোতে সুখ মিলছিল না!

জুলাই ১, ২০২০। অতিমারিতে দেশ কাঁপছে। সংসদ প্রায় বন্ধ, জমায়েত, বিক্ষোভ, মিছিল সব বন্ধ। ভারতের রেল মন্ত্রক সব ধরণের আলোচনার পরিসর এড়িয়ে এক তরফাভাবে ঘোষণা করলেন যে ভারতীয় রেলের সবচেয়ে লাভজনক ১৫১ জোড়া (অর্থাৎ, যাতায়াত মিলিয়ে, বা রেলের ভাষায়, আপ-ডাউন) ট্রেনের মধ্যে ১০৯ জোড়া ট্রেনকেই “বেসরকারি ক্ষেত্র দ্বারা পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো”। এই কাজ করার জন্য এই সব বেসরকারি সংস্থা সর্বমোট ৩০ হাজার কোটি টাকা লগ্নি করবে ( যেখানে রেল সাধারণ করদাতা জনতার টাকায় এই পরিমাণের ২২.৮ গুণ টাকা গত তিন-চার বছরেই লগ্নি করে বসে আছে!)। বেসরকারি “মালিক” দ্বারা পরিচালিত এই নতুন রেল ব্যবস্থায় রেলের হাতে থাকবে শুধু ট্রেনের ড্রাইভার এবং গার্ড, যাদের মাস মাইনে, ঠিকই ধরেছেন, রেল মেটাবে। অন্যান্য যাবতীয় কর্মীরা হবেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী, তাঁদের দায় বেসরকারি সংস্থার, যেখানে সরকারের চাকুরি সংক্রান্ত কোনও নিয়মই খাটবে না। এইসব বেসরকারি সংস্থা তাদের মনোমতো সংস্থা থেকে রেলের কামরা এবং যন্ত্রাংশ কিনতে পারবে। যদি এই সব বেসরকারি সংস্থা, সরকারের রেলের ওয়ার্কশপ থেকে কামরা বা যন্ত্রাংশ কিনতে চায়, তবে তার দাম ঠিক করবে বেসরকারি সংস্থা, এতে সরকারের কোনও কিছু বলার থাকবে না। এর অর্থ হলো, রেলের ওয়ার্কশপ-এ যে বিপুল পরিকাঠামো রয়েছে, তা ব্যবহারের অভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই সেগুলিকে “অকেজো” বলে ঘোষণা করে আবার সেই সব বেসরকারি সংস্থাকেই জলের দলে “বেচে” দেওয়া হবে, আর কাজ হারাবেন রেলের মূল কর্মীর ১৩ শতাংশ কর্মী, সংখ্যাটা ২.৫ লক্ষ-র আশপাশে হবে। পুরোদমে এই বেসরকারিকরণ চালু হবে ২০২৩ এপ্রিল থেকে, যদিও পরীক্ষামূলকভাবে আদানি, আম্বানি এবং টাটা সংস্থা এই কাজ এখনই শুরু করে দিয়েছে।

বেসরকারি বিমান সংস্থার কাজ আমরা এতদিন ধরে দেখে আসছি। জানলার ধারে আসনের জন্য বাড়তি টাকা, খাবার জলের জন্য টাকা, ট্রেনে সুগন্ধী ছড়ানোর জন্য টাকা, শৌচালয় পরিষার করার জন্য বাড়তি টাকা— সর্বোপরি আছে দিনের বিভিন্ন সময়ে, সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে, মাসের বিভিন্ন সপ্তাহে এবং বছরের বিভিন্ন মাসে একই যাত্রার জন্য বিভিন্ন ভাড়া! তারপরেও আমরা দেখেছে জেট, স্পাইসজেট, মোদি, ইস্টওয়েস্ট ইত্যাদি বিমান সংস্ত্রহাগুলির ঝাঁপ গুটিয়ে নেওয়া এবং ভারতীয় ব্যাঙ্ক-এর ঋণ খেলাপ করে তাদের মালিকদের বিদেশে চম্পট দেওয়া। সেই ট্র্যাজেডির পুনরাভিনয় হবে না তার নিশ্চয়তা কী? একটা কথা বলে রাখি, রেলওয়ে বোর্ড তার সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বেসরকারি সংস্থাগুলি তাদের ইচ্ছামতো ভাড়ার হার নির্ধারিত করতে পারবে, আর ভারতীয় রেল চাইলে সে তার ভাড়ার হার বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে “সামঞ্জস্যপূর্ণ” করার কথা ভাববে! আর একটা ছোট্ট খবর দিয়ে রাখি— ২০২০র শেষে, দেশ যখন কৃষক আন্দোলন, এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল, ঠিক তখনই রেল মন্ত্রক, নিয়ম মাফিক কোনো সভা, কোনও বিজ্ঞপ্তি বা আলোচনা ছাড়াই রেলের সবচেয়ে বড়ো সাতটি রেলের উৎপাদন সংস্থাকে এক ছাতার তলায় এনে একটি পিএসইউ গঠন করে, যার গালভরা নাম ইন্ডিয়ান রোল স্টকিং কোম্পানি। মনে রাখতে হবে যে এই সাতটি সংস্থা যখন আলাদা আলাদা ইউনিট ছিলো, তখন তাদের “নিলাম” করে আদানি-আম্বানি-টাটা-দের “বেচে” দেয়ার ব্যাপারে প্রচুর নিয়ম কানুন, মিটিং, নিয়মের পরিবর্তন ইত্যাদি করতে হতো। কিন্তু সেই নরসীমা রাও জমানা থেকে মনমোহন সিং, বাজপেয়ি এবং অধুনা মোদি জমানায় পিএসইউ সংস্থাকে বেচে দেওয়া জলভাত হয়ে গেছে। ফলে রেলের সঙ্গে নৈবেদ্য হিসেবে, একটা কিনলে একটা ফ্রি পদ্ধতিতে অতঃপর এগুলিও বিক্রির লাইনে অচিরেই দণ্ডায়মান হলো বলে!

এই বেসরকারিকরণ কেমনভাবে হবে, তার রূপরেখা নির্মাণ করেছে ভারত সরকার নিযুক্ত “বিবেক দেবরায় কমিটি”। সেই কমিটির সুপারিশ অনুসারে কী ঘটবে তার একটা চিত্র আঁকা যাক।

বেসরকারি অপারেটররা রেলের সমস্ত পরিকাঠামো ব্যবহার করবে, এই পরিকাঠামো ব্যবহারের জন্য রেল তার নিজস্ব রুটের ট্রেনের জন্য অগ্রাধিকার কমিয়ে এই বেসরকারি ট্রেনগুলিকে অগ্রাধিকার দেবে। যেমন ধরা যাক, খড়্গপুর স্টেশনে রেলের নিজস্ব বোম্বে মেল ভায়া নাগপুর বা গীতাঞ্জলি ট্রেনটি আগে পৌছলো। তারপর, ধরা যাক ১৫ মিনিট পরে আদানি বোম্বে মেল বা টাটা-কোম্পানির বোম্বে মেল খড়্গপুর স্টেশনে পৌঁছলো। ভারতীয় রেলের নিজস্ব গাড়ি, ধরা যাক, সেই স্টেশনে থামার কথা মাত্র ৫ মিনিট। কিন্তু এখন ( মানে ২০২২ সালের শেষের দিকের কোনও এক সময় থেকে) রেলের ট্রেন দুটি এই দুই বেসরকারি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করবে। টাটা বা আদনির ট্রেন আসার পর ভারতীয় রেলের সাফাই কর্মীরা রেলের নিজস্ব ট্রেনের পরিচর্যার বদলে এখন টাটা বা আদানি-র ট্রেনের ধোয়া-মোছা-শৌচালয় পরিস্কার করবে, এর জন্য যাত্রীরা ভাড়ার সঙ্গে সাফাই চার্জ দিয়েছেন, কিন্তু এই সংস্থা গুলি এই কাজ করবে রেলের জল ও ডিজেল ব্যবহার করে। তার জন্য এই সব বেসরকারি কোম্পানিগুলি তাদের লভ্যাংশের সামান্য এক অংশ রেলকে দেবে, তাও বেসরকারিভাবে রেল চালিয়ে ১০ শতাংশ লাভ করার পর থেকে। রেল তার পাওনা, রেলের নিজস্ব মাইনে করা লোক দিয়ে হিসেব রাখবে। ভারতে রেলের টিকিট কাটার যে কম্পিউটার চালিত যাত্রী ব্যবস্থা রয়েছে, বেসরকারি কোম্পানিগুলি সেই একই ব্যবস্থা ব্যবহার করবে। এই ব্যবস্থায় বেসরকারি ট্রেনকে যদি অগ্রাধিকার দেওয়া হয় তো রেলের এই ব্যবস্থায় যাত্রী পিছু যে খরচ হয় তা এই বেসরকারি সংস্থাগুলি ১০ শতাংশ লাভের পর তা মিটিয়ে দেবে। আর যদি তাদের এই আসন সংরক্ষণ ব্যবস্থায় কোনও অগ্রাধিকার না থাকে তো রেল এই বেসরকারি সংস্থাগুলিকে “ক্ষতিপূরণ” হিসেবে সেই একই পরিমাণ অর্থ প্রতি সপ্তাহে মিটিয়ে দিতে দিতে যাবে। এছাড়াও রেলের কর্মীরা রেলের থেকে মাইনে নিয়ে বেসরকারি সংস্থার টিকিট বাবদে যে টাকা প্রতিদিন পাওনা হচ্ছে, তার হিসেব রাখবেন এবং প্রতিদিন প্যাসেঞ্জার চার্ট বের করার সঙ্গে সঙ্গে সেই টাকা কোম্পানিকে মিটিয়ে দেবে। সংক্ষেপে এইগুলি বিবেক দেবরায় কমিটির সুপারিশ! ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কথা যদি পাঠকদের মনে উঁকি দেয় তো আমি নাচার!

বেসরকারিকরণের যে সব চিহ্ন আমরা এখনই দেখতে পাচ্ছি, তার একটা দুটো উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। পেরাম্বুরে ভারতীয় রেল-এর যে নিজস্ব কামরা তৈরির কারখানা রয়েছে, সেখানে ভারতীয় রেলের ইঞ্জিনিয়ারদের নিজস্ব নক্সা অনুসারে “ট্রেন-১৮ কোচ” তৈরি শুরু হয়, একেকটির দাম পড়ে ৯৮ কোটি টাকা। এই কামরা সর্বোচ্চ ১৬০ কিমি গতবেগে চলতে সক্ষম। কিন্তু...। ভারতের রেল মন্ত্রক এই জাতীয় যে ৪৫ কামরা তৈরির বরাত দিয়েছিল, আচমকা সেই বরাত তারা প্রত্যাহার করে নেয়। দিল্লি-লক্ষ্ণৌ যে “তেজস এক্সপ্রেস” ট্রেন-এ এই কামরাগুলি জোড়ার কথা ছিল, ভারতীয় রেল সেই ট্রেনটি আম্বানিকে চালানর জন্য দিয়ে দেয়। এই ট্রেনে দিল্লি-লক্ষ্ণৌ ভাড়া ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। ভারতীয় রেল এই রুট-এ এক সপ্তাহের জন্য “অনিবার্য কারণে” সব ট্রেন তুলে নেওয়ায় সেই সপ্তাহে “নিলাম”-এর টিকিটের দাম ওঠে ৪৭০০ টাকা। এই বেসরকারি ট্রেনটি ভারতীয় রেলের যে ট্রেনটি চালু ছিল, তার চেয়ে মাত্র ১০ মিনিটি আগে পৌঁছনর কথা এবং এই ট্রেনটি একটি অতিরিক্ত স্টেশনে থামে। কিন্তু রেল চলাচল নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতার অভাবে এই বেসরকারি ট্রেনটি গড়ে রোজই ৩০ মিনিট দেরিতে ঢোকে!

রাজ্যসভার এক প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে যে প্রথম ১২ জোড়া বেসরকারি ট্রেন নিয়মিত ভাবে চলা শুরু হবে এপ্রিল ২০২৩ থেকে। এরপর প্রতি অর্থবর্ষে কিছু কিছু করে নতুন বেসরকারি ট্রেন নিয়মিতভাবে চলতে শুরু করবে। ২০২৭ সালের মধ্যে ১৫১ জোড়া বেসরকারি ট্রেন চলবে। রাজ্যসভায় সরকার জানিয়েছে যে টেন্ডারের ভিত্তিতে যে যে বেসরকারি সংস্থা বরাত পেতে চলেছে তাদের তালিকা এই রকমঃ আদানি পোর্টস, এসেল গ্রুপস, টাটা রিয়েল্টি অ্যান্ড ইনফ্রাস্টাকচার, বম্বাডিয়ের এবং অ্যালস্টম।

গুজরাটে মোদি যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তাঁর বদান্যতায় আদানি গোষ্ঠী ভারতীয় রেলের সহায়তায় ৩০০ কিমি ব্যাপী এক বেসরকারি রেল ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা তার সমুদ্র বন্দর থেকে বিভিন্ন স্থানে মাল পাঠানর কাজে লাগে। রেল চালানো ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আদানির অভিজ্ঞতার পুঁজি কেবল এইটুকুই!

এসেল গোষ্ঠী মোদি সরকারের বদান্যতায় রেল বিষয়ে প্রায় কোনও অভিজ্ঞতা না নিয়েও কলকাতা-চেন্নাই ফ্রেট করিডোর প্রকল্প রূপায়ণে সহায়তা করে। বেসরকারিকরণকে সর্বরোগহর বটিকা বলে বিশ্বায়নের প্রবক্তারা যতই চেঁচান না কেন, পণ্ডিত মানুষদের নিরলস গবেষণা কিন্তু আমাদের কাছে এই বিষয়ে এক বিপরীত চিত্রই তুলে ধরে। যেমন দুই অর্থনীতিবিদ, ডান বোগার্ট এবং লতিকা চৌধুরী দেখিয়েছেন যে ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় রেলওয়ে সেই সময়ে চালু বেসরকারি ব্যক্তি মালিকানায় চলা রেলওয়ের চেয়ে ১৪ শতাংশ কম চালু খাতে খরচা করে বেসরকারি ব্যক্তি মালিকানায় চলা রেলওয়ের চেয়ে ভালো পরিষেবা প্রদান করতো।

ভারতের মতো দেশগুলো যখন তাদের অর্জিত সম্পদ দোসর পুঁজির কাছে সমর্পণ করে দিচ্ছে, বিশ্বায়নের মদতদাতা দেশগুলি তখন নিজেদের দেশে বিপরীত রাস্তায় হাঁটার পথ ধরেছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা ব্রিটেনের কথা ধরতে পারি। মার্গারেট থ্যাচারের হাত থেকে বেটন নিয়ে জন মেজর যখন ব্রিটেনের শাসনভার গ্রহণ করেন, তখন তিনি ব্রিটিশ রেলওয়েকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে ২৫ শতাংশ রেলকে বেসরকারি হাতে তুলে দেন। সময়কাল ১৯৯৩, আমাদের দেশে তখন নরসীমা রাও-এর হাত ধরে বিশ্বায়নের নিদান, “ কাঠামোগত আর্থিক পুনর্গঠন”-এর বাসন্তিকা বাতাস বইতে শুরু করেছে। আমাদের দেশে বিবেক দেবরায় কমিটি জন মেজরকৃত এই মডেলটিকে আত্মসাৎ করেছে, তাই ব্রিটেনের ইতিহাস আমাদের কাছে শিক্ষার বিষয়। আবার ভবিষ্যতে কী ঘটবে তার এক দিকচিহ্ন বলেও ভাবা যেতে পারে। ব্রিটেনের মানুষ বেসরকারি “দক্ষতা”-র যা স্পর্শ পেয়েছেন, তার ফলে তাঁরা এই বিষয়টি ২০১৩ সালের পর থেকে নতুন করে ভাবতে বসেন। এই বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ, ডাঃ ইয়ান টেলর, বিবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে রেল ব্যবস্থা বেসরকারি ও সরকারি, এই দুই বিপরীত ব্যবস্থায় বিভক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে ক্ষতি হচ্ছে “over £1bn per year, enough to cut fares by 20% if the railway were reunified as a public company.” বেসরকারি মালিকানার রেল ব্যবস্থায় রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে ১৩ গুণ। রেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়া হয়েছে জটিল, ক্ষতিপূরণের পরিমাণের মধ্যে সমতা নেই এবং এক একটি মামলা মিটতে সময় লাগছে গড়ে দেড় দশক!
এই হলো অতি সংক্ষেপে ভারতীয় রেলকে নিংড়ে নেওয়ার দোসর পুঁজির কারসাজি!

0 Comments

Post Comment