পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

দোসর পুঁজির কারসাজি: বিমানবন্দর বেসরকারিকরণ পর্ব ৪

  • 17 April, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1584 view(s)
  • লিখেছেন : শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
করোনাকালে যখন দেশের প্রবৃদ্ধি তলানিতে কখন গত এক-দেড় বছরে আদানির ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রবৃদ্ধির হার ২৩০% ছাড়িয়েছে। ভারতীয় জনতা বিজেপির উত্থানের সঙ্গে এই অখ্যাত ও অবজ্ঞাত ব্যক্তিটির নাটকীয় উত্থান, দোসর পুঁজির হাত ধরে গত শতকের ইউরোপের নানা রক্ত-লাঞ্ছিত কাহিনির কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়।

ইংরাজ আমলে ব্রিটিশ পুঁজির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার বদলে, তাদের ফড়ে বনে গিয়ে নিজেদের পারিবারিক সম্পত্তি বাড়ানোর যে পরম্পরা এদেশের হিন্দু, মুসলমান, পার্সি বানিয়া পরিবারগুলো জন্ম দেয়, ১৯৪৭-উত্তর পর্বে সেই পরম্পরা ঐতিহ্যে পর্যবসিত হয়। কেউ ইজারা পায় ইস্পাত শিল্পে, কেউ বা পরিবহনে, কেউ বা সন্তুষ্ট থাকে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে একচেটিয়া সুবিধা নিয়ে।

সময় যত এগিয়েছে, আধুনিক ক্ষেত্রগুলি যত ডালপালা মেলেছে, এই সব নতুন ক্ষেত্রগুলিতে দোসর পুঁজির বান্ধব সরকারগুলি দরাজ হস্তে দেশের সাধারণ সম্পত্তিগুলি তাদের পেটোয়া “পুঁজিপতি”-দের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে।

এই হরির লুটের “মাল কুড়িয়ে নিতে” একদিকে যেমন ভীড় জমিয়েছে বনেদি টাটা-বিড়লা, অন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে “উঠতি” এবং অর্বাচীন আম্বানি-আদানি এবং তাদের সহযোগীরা। এই ভাগ-বাটোয়ারায় অসামরিক বিমানবন্দরের জন্য যে কালনেমির লঙ্কাভাগ শুরু হয়েছে মোদি জমানায়, তা পড়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সুহৃদ, শ্রী গৌতম আদানির ভাগে। সেই কেলেঙ্কারির ব্যাপ্তি দৈর্ঘে-প্রস্তে প্রায় সমান সমান।

মোদি জমানায়, অগস্ট ২০২০-তে বিশ্বভ্রমণের ফাঁকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী “দৈববাণী” শুনলেন —ভারতের বিমানবন্দরগুলিতে নাকি সরকারি লগ্নি “ব্যর্থ” হয়েছে; এই ক্ষেত্রটিতে আশানুরূপ মুনাফার জন্য “বেসরকারি লগ্নি”-র সুযোগ করে দিলে বনবাসী শ্রীরামচন্দ্রের সোনার অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন সুনিশ্চিত। যে কোনও সরকারের “বেসরকারিকরণ প্রকল্প”-এর পেছনে “প্রমাণিত আর্থিক যুক্তি” হলো এর ফলে লগ্নিকারীদের মধ্যে ঘোর প্রতিযোগিতার ফলে একদিকে যেমন প্রকল্পের পরিচালন-দক্ষতা বাড়বে, অন্যদিকে তেমনি কেউই তার নিজের ইচ্ছামতো দর হাঁকতে পারবে না! তবে কিনা রামরাজ্যে আধুনিক অর্থনীতির নিয়ম-কানুন খাটে না। এখানে বেসরকারিকরণ মানে দোসর পুঁজিকে আবাহনের জন্য সদর দরজা খুলে দেওয়া!

এই দেশে, বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ ঘটেছে একটিমাত্র সংস্থার হাত ধরে, তথাকথিত “প্রতিযোগিতা”-র তত্ত্বকে চুলোর দোরে পাঠিয়ে। ভারতে এযাবৎ বেসরকারিকৃত সব কটি বিমানবন্দর পরিচালনা বা দীর্ঘকালীন লীজ পেয়ে বসে আছেন শ্রী গৌতম আদানি মহাশয়, মোদি সরকারের পরম দাক্ষিণ্যে। এই সব আধুনিক পরিষেবা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে চালাতে হলে যে অভিজ্ঞতা এবং সেই বিশেষ ক্ষেত্রে যে দক্ষতা প্রয়োজন, বলাই বাহুল্য, আদানি সংস্থার তা নেই এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি সংস্থার তা রয়েছে। আদানিকে এই অন্যায্য সুবিধা দিতে হলে এখনও পর্যন্ত দেশের মধ্যে এই জমানায় একচেটিয়া বাণিজ্যে লাগাম পরানোর লক্ষ্যে যে কটি আইনের অস্তিত্ব রয়েছে, সেগুলিকে পদদলিত না করে উপায় নেই।

২০১৯, ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ। ভারতের এয়ারপোর্ট অথরিটি এক ছোট্ট বিবৃতিতে জানায় বিমানবন্দর বেসরকারিকরণের জন্য যে নিলাম হয়েছিল, সেই নিলামে গৌতম আদানি পরিচালিত শিল্প গোষ্ঠী এক ধাক্কায় আমেদাবাদ, জয়পুর, থিরুভানন্তপুরম, লক্ষ্ণৌ এবং ম্যাঙ্গালোর বিমানবন্দর গুলির “উন্নতি এবং পরিচালনা করার” অধিকার পেয়েছে। ঠিক তার পরের দিন, গুয়াহাটি বিমানবন্দরের জন্য সেই একই কাজ করার অধিকার দেওয়া হয় আদানি গোষ্ঠীকে। যে সময়ে দেশের অর্থনীতিতে এই সব গুরুতর অপ্রত্যাহারযোগ্য সর্বনাশ ঘটছে, ঠিক সেই সময়টিকেই মোদি সরকার বেছে নিয়েছে পাকিস্তানের “সন্ত্রাসবাদী শিবিরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক” করার জন্য, ফলে এতবড়ো খবর “দেশপ্রেমের জোয়ার”-এ ভেসে যাবে তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কি আছে!

এই ঘটনা ঘটানোর জন্য জাতীয় স্তরে মোদি সরকারকে কিঞ্চিৎ বেগ পেতে যে হয়নি এমন নয়। রাজ্য সভায় অসামরিক বিমান চলাচল দপ্তরের মন্ত্রক চূড়ান্ত হেনস্থার শিকার হয়ে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয় যে ভারতের এয়ারপোর্ট অথরিটি-র আওতায় থাকা বিমানবন্দরগুলিকে লীজ দিতে গেলে যেসব পদ্ধতি আছে, যেমন ১) স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা, ২) লীজে-র শর্তাবলী জনসমক্ষে প্রকাশ করা, ৩) এই দুই কাজ করার পর পর নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে তবেই দ্বিতীয় আলোচনা, ৪) যে রাজ্যে বিমানবন্দর অবস্থিত, সেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে রাজ্য সরকারের সম্মতি গ্রহণ, এই চারটি এবং আরও গোটা কয়েক বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ আদানি সংস্থাকে বিমানবন্দর লীজ দেওয়ার ক্ষেত্রে একেবারেই পালিত হয় নি। ব্যাপারটি এতদূর গড়ায় যে, তাদের সঙ্গে আইনমতে বাধ্যতামূলক সম্মতি গ্রহণ না করেই থিরুভানন্তপুরম বিমানবন্দর আদানি সংস্থাকে লীজ-এ দেওয়া বেআইনি, এই মর্মে কেরালা সরকার মোদির কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কেরালা হাই কোর্ট-এ মামলা করেছে এবং মামলার পেছনে আইনি এবং অন্যান্য যুক্তি আছে এই বিবেচনায় কেরালা হাইকোর্ট সেই মামলা গ্রহণ করেছে। মামলাটি এখনও চলছে।

ভারত সরকারের একটি নিজস্ব দপ্তর রয়েছে, যার নাম ডিপার্টমেন্ট অফ ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স, যার কাজ সরকার কোনও আর্থিক পদক্ষেপ করলে, তার ভালোমন্দ সম্পর্কে সরকারকে উপদেশ দেওয়া। মোদি জমানার আগে সব সরকারই এই বিভাগের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে সরকারি মতামত পরিবর্তন করে এই বিভাগের পর্যবেক্ষণ সেই পদক্ষেপ করার শর্তাবলীতে অন্তর্ভূক্ত করতো। এই বিভাগের কাছ থেকে যখন মতামত চাওয়া হয়, তখন তারা আদানির দেওয়া শর্তগুলির জন্য ভারত সরকারের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হবে বলে স্পষ্ট মতামত দেয়।

মোদি সরকার ক্ষমতায় এসে ভারতের যোজনা কমিশনকে তুলে দিয়ে নিতি-আয়োগ নামে একটি ঠুঁটো জগন্নাথের জন্ম দেয়। সেই নখ-দন্তহীন নিতি আয়োগ-ও তার নোট-এ কেন্দ্রীয় সরকাকে জানিয়ে দিয়েছে যে কারিগরি, আর্থিক এবং সর্বোপরি আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে আদানি গোষ্ঠীকে যে বরাত দেওয়া হয়েছে তা ভুল, দেশের আইন বিরোধী কাজ এবং তা সংবিধান অনুমোদিত নয়।

সরকার নিয়োজিত দুটি সর্বোচ্চ সংস্থার সুপারিশ অগ্রাহ্য করে, প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে সরকার শেষ পর্যন্ত আদানি গোষ্ঠীকেই বিমানবন্দরের লীজ-এর বরাত পাইয়ে দেয়।

একথা কে না জানে যে অন্যের জমানো টাকা লুটপাট করে যদি হাতিয়ে নেওয়া যায়, তবে সেই টাকা খটিয়ে ব্যবসা করা আসলে মাছের তেলে মাছ ভাজ করা সামিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই সার কথাটি বুঝে ভারতের সম্পত্তি লুট করে তাদের আর্থিক সাম্রাজ্য বাড়িয়েছে। এ যুগে সেই একই কাজ করছে মোদি সরকারের দোসর “পুঁজি”। ভারতের বিমানবন্দর বেসরকারিকরণের কিস্যা সেই বিষয়টিকে আজকের প্রেক্ষিতে আবার সামনে এনেছে।

ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রটির হাতে রয়েছে বিরাট এক আর্থিক সম্পদ, যার দিকে দোসর পুঁজির লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে কংগ্রেসের নরসিমা রাও সরকার-গৃহীত ভারতের কাঠামোগত আর্থিক পুনর্গঠনের সেই প্রথম দিনগুলি থেকেই। বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে ভারতে ছিল দুটি ভিন্ন সংস্থা। একটি ছিল অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে, জাতীয় এয়ারপোর্ট অথরিটি, আর অন্যটি ছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট অথরিটি। যখন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলি বেচে দেওয়ার বিধ্বংসী নীতি গ্রহণ করা হয়, সেই ৯০ দশকের মাঝামাঝি, ১৯৯৫ সালের এপ্রিল মাসে এই দুই সংস্থাকে বিলুপ্ত করে, দুটিকে এক ছাতার তলায় এনে ভারতের এয়ারপোর্ট অথরিটি গঠন করা হয়। এই সংস্থার আওতায় আসে বিপুল পরিমাণের সম্পত্তি। ভারতের ১৮টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা ৭৮টি বিমানবন্দর, ৭টি শুল্ক বিমানবন্দর, একান্তভাবে প্রতিরক্ষার সঙ্গে যুক্ত বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে ২৬টি পরিষেবা কেন্দ্র এই অথরিটি-র আওতায় ছিল। ২০১৭-২০১৮ আর্থিক বর্ষে এই সংস্থার নীট লাভের পরিমাণ ২৮০২ কোটি টাকা। এই সংস্থার হাতে সংরক্ষিত তহবিল রয়েছে ১৪২০১ কোটি টাকার ওপর, যার মালিক ভারতের নাগরিকবৃন্দ, কোনও ফড়ে বেসরকারি সংস্থা নয়!

বিমানবন্দর বেসরকারিকরণের ধারণা আসে অটল বিহারী বাজপেয়ি পরিচালিত এনডিএ সরকারের আমলে, সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে। বাজপেয়ি তাঁদের পিতৃতুল্য সংগঠন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের যে অ্যাজেন্ডা, ভারতকে ব্রিটিশ শাসনের সময়ের মতো আজও বিদেশী ও দেশী বানিয়াদের হাতে যেভাবেই হোক সমর্পণ করা, সে লক্ষ্যে ভারতের সবচেয়ে দুটি ব্যস্ত এবং মুনাফা অর্জনকারী বিমানবন্দর, দিল্লি ও মুম্বাই বিমানবন্দরকে বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নেন।

ইতোমধ্যে ভুবনায়নের হাওয়ার ভর করে, ভারতে তথ্য শ্রমিক এবং জৈব-প্রযুক্তি শ্রমিকের প্রাচুর্যের ওপর নির্ভর করে ব্যাঙ্গালুরু এবং হায়দ্রাবাদে দেশী-বিদেশী লগ্নি ঝাঁপিয়ে পড়ে, প্রয়োজন হয় অনেক বিমান ওঠা-নামা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম আধুনিক বিমানবন্দরের। এই দুই শহরের নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের বরাত পায় এক খিঁচুড়ি সংস্থা। জানুয়ারি ২০০১ সালে তৈরি হয় ব্যঙ্গালুরু ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্ট লিমিটেড, সংক্ষেপে বিয়াল। এই সংস্থার ২৬ শতাংশ শেয়ার ( এক এক জনের ভাগে ১৩ শতাংশ করে) যথাক্রমে কর্নাটক সরকারের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এবং এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার রয়েছে। বাকি ৭৪ শতাংশ শেয়ার ছিল বেসরকারি হাতে। এদের মধ্যে ছিল ফেয়ারফক্স ফিনান্সিয়াল ( ৫৪ শতাংশ) এবং সিমেন্স প্রোজেক্ট ভেনচারস ( ২০ শতাংশ)। নানা হস্তান্তরের পর এইটাই মোটামুটি বর্তমান চিত্র। মাননীয়া অর্থমন্ত্রী তাঁর ২০২১-২০২২ বাজেট বক্তৃতায় বিমানবন্দরগুলিতে সরকারের শেয়ারের যে শতাংশ রয়েছে, সেই অংশও বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ব্যাঙ্গালোর বিমানবন্দরের সরকারি শেয়ার আদানির কুক্ষিগত হতে চলেছে।

হায়দ্রাবাদের নতুন বিমান বন্দর ব্যাঙ্গলুরুর ধাঁচেই বেসরকারি হাতে গেছে। এই বিমানবন্দর চালানোর দায়িত্বে রয়েছে জিএমআর-হায়দ্রাবাদ ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্ট লিমিটেড, যেটিকে প্রোমোট করেছে জিএমআর গোষ্ঠী, যাদের হাতে রয়েছে ৬৩ শতাংশ মালিকানা, মালয়েশিয়ার এয়ারপোর্টস হোল্ডিং বেরহার্ড ( ১১ শতাংশ মালিকানা), বাকি ২৬ শতাংশ মালিকানার ১৩ শতাংশ রয়েছে অন্ধ্র সরকার ও অন্য ১৩ শতাংশ মালিকানা রয়েছে ভারতের এয়ারপোর্ট অথরিটির হাতে।

মোদি সরকার চেন্নাই ও কলকাতা বিমানবন্দর বেসরকারিকরণের কাজেও হাত দেয় ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যেই। মনে রাখা দরকার, জনগণের করের ২৩০০ কোটি টাকা খরচ করে মোদি সরকার প্রথমে চেন্নাই এবং কলকাতা বিমানবন্দরকে আধুনিক করার জন্য লগ্নি করে তবে বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে! এই টাকা খরচা করে মোদি সরকার বিমানবন্দরগুলির হাল অনেকটা বদল করে ফেলছে, যে বেসরকারি সংস্থা এই বরাত পাবে, তারা প্রথম থেকেই যে সরকারের কাছ থেকে অন্যায্য সুবিধা পেয়ে গেলো, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আরও মজার কথা, বিমানবন্দর সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের দায়িত্ব ভারতের প্রশাসনিক মতে অসামরিক বিমান মন্ত্রকের হাতে, কিন্তু ভারতের সংবিধানকে উপেক্ষা করে মোদি জমানায় সেই দায়িত্ব পালন করছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, যা বেআইনিও।

২০০৮ সালে একটি আইন মতে ভারতের এয়ারপোর্ট রেগুলেটরি অথরিটি নির্মিত হয়। মোদির সরকার ক্ষমতা হাতে পেয়েই সেই আইন সংশোধন করে তার দোসর পুঁজিকে অন্যায্য সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। এই আইনের সংশোধন কেন প্রয়োজন? উত্তর সহজ— গত কয়েক বছর ধরে বেসরকারি সংস্থাগুলি ভারতে কয়েকটি বিমানবন্দর “সফলতার” সঙ্গে চালাচ্ছে, এদের দক্ষতার ফলে এরা একচেটিয়া হয়ে উঠতে পারে। সেই প্রবণতা রোধ করার জন্য আরও বেসরকারিকরণ প্রয়োজন, আইনে সেই সুযোগ সৃষ্টি করতেই আইনের এই পরিবর্তন! অসাধারণ যুক্তি, সন্দেহ নেই!

নভেম্বর ৮, ২০১৮। প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি-র নেতৃত্বে একটি মিটিং-এ নীতিগতভাবে ভারতের বিমানবন্দরগুলিকে ক্রমে ক্রমে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এই মিটিং-এ এই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য উচ্চ শ্রেণির আমলাদের নিয়ে যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমটি গঠিত হয়, সেই কমিটি তার রিপোর্ট পেশ করে মাত্র ৯ দিনের মাথায়, ১৭ নভেম্বর। ডিসেম্বর ৪ সেই রিপোর্ট গৃহীত হয় আর ১০ ডিসেম্বর অন্যান্য যে সর মন্ত্রকের হাত ঘুরে এই কাজ সম্পন্ন করতে হবে, সেই সব মন্ত্রককে এই রিপোর্টটি পাঠিয়ে যত দ্রুত সম্ভব, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। ১১ ডিসেম্বর ৬টি বিমানবন্দর বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এই মর্মে যা যা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা দরকার, সেগুলি প্রকাশিত হয়।

লর্ড ক্লাইভকে সিরাজের সঙ্গে যুদ্ধ করে ভারতের সম্পত্তির দখল নিতে হয়েছিল, আর যারা ইংরাজ রাজত্বের পুরো সময়টা জুড়ে ইংরাজের সহযোগীর ভূমিকায় ছিল, তাদের উত্তরসূরীবৃন্দ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় দেশের সম্পত্তি বেসরকারি ফড়েদের হাতে তুলে দিল।

এই তুলে দেওয়ার বিষয়টি দোসর পুঁজির জন্য কেমন বেআইনি পদ্ধতিতে হয়েছে, তার কয়েকটা নমুনা দেওয়া যাক। ভারতের যেকোনও বিমানবন্দরে যেকোনো বেসরকারি সংস্থা বড়ো আকারের যেকোনো লগ্নি করলে সেই লগ্নির কয়েকটা দিক বিবেচনা করার এবং সেই বিবেচনার ভিত্তিতে মতামত দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সংস্থার নাম ভারতের অসামরিক বিমান মন্ত্রক বা মিনিস্ট্রি অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন। আদানি এবং অন্যান্য যাঁরা ভারত সরকারের এই বিমানবন্দর বেসরকারিকরণ প্রস্তাবের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন, তাঁদের সব কাগজপত্র দেখে এই মন্ত্রককেই তাদের মতামত দেওয়ার কথা। কিন্তু এই মন্ত্রক ঠিক কী করেছে? ১) বেসরাকিকরণের জন্য শর্তাবলী ঘোষণা করে বিধিসম্মত দরপত্র বা “কোটেশন” চাওয়ার বয়ান তৈরি করেনি, যেটা করার জন্য এই মন্ত্রক আইনত দায়িত্বপ্রাপ্ত, ২) কোন কোন বিষয়ে কী কী জিনিশ সরকারকে বাধ্যতামূলকভাবে জানাতে হবে, বা “রিকোয়েস্ট প্রোপোশাল” তৈরি করেনি এবং ৩) যে সংস্থা শেষ পর্যন্ত সরকার উপরিউক্ত দুই আইনি দলিল মোতাবেক নির্বাচিত হবে, সেই সংস্থা সরকারের কাছ থেকে কী ধরণের ছাড় ও অন্যান্য ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পাবে, সেই গুরুত্বপূর্ণ দলিলটি, বা “ ড্রাফট কনসেশন এগ্রিমেন্ট”-ই তৈরি করেনি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে এত বিরাট বেসরকারি লগ্নির বিষয়টি নির্দ্ধারিত হলো?

প্রশ্ন হলো, এই কমিটি কেন এই কাজটি করেনি? মন্ত্রককে পাঠানো তাদের নোট-এ তারা স্পষ্ট জানিয়েছে যে “the numbers to determine financial viability mentioned in the PPPAC memo and the project report were vastly different”; অর্থাৎ, এই নিলামে উৎসাহী বিভিন্ন সংস্থার প্রস্তাব বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী দ্বারা নিয়োজিত উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির যে সারাংশ কমিটি মন্ত্রককে পাঠিয়েছে, সেখানে যেসব বিভিন্ন সংখ্যা আছে, আর বিভিন্ন সংস্থা নিজেরা তাদের প্রস্তাবে যে সংখ্যা দিয়েছে, তাদের মধ্যে ফারাক বিস্তর। সরকারের সারাংশের ওপর ভিত্তি করে তাই কোনও রিপোর্টই প্রস্তুত করা সম্ভব হয় নি!

ভারত সরকারের অর্থ বিষয়ক বিভাগ, বা ডিপার্টমেন্ট অফ ইকোনমিক আফেয়ার্স, যার অধীনে রয়েছে এই দেশের “পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ সেল” বা পিপিপি সেল, তারা সরকারের কাছে স্পষ্ট ভাষায় তাদের সুপারিশ জানিয়ে দেয়ঃ কোনও একটি সংস্থাকে দুটির বেশি বিমানবন্দরের বরাত দেওয়া দেশের পক্ষে ক্ষতিকর হবে, আর্থিক ঝুঁকি বাড়বে, সরকারের সম্ভাব্য নজরদারির খরচও বাড়বে। সর্বোপরি, যে “প্রতিযোগিতা”-কে উৎসাহ দেওয়ার নিমিত্ত বেসরকারিকরণের এই বিপুল আয়োজন, তার “মুণ্ডচ্ছেদ” ( “beheading”, সরকারি নোট-এর ভাষা!) ঘটবে। এই বিভাগটি সরকারের নিজের অনতি-অতীতের উদাহরণ টেনে জানায় যে, দিল্লি এবং মুম্বই বিমানবন্দরের উন্নতির জন্য সরকার দেখেছিল যে জিএমআর গোষ্ঠীই একমাত্র যথাযথ বরাত-পাওয়ার-যোগ্য সংস্থা, তৎসত্ত্বেও এই দুই বিমানবন্দরের বরাত এককভাবে জিএমআর সংস্থাকে না দিয়ে দুটি সংস্থার মধ্যে তা ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। দিল্লি শহরের শক্তি বণ্টন ব্যবস্থার বেসরকারিকরণের সময়েও একাধিক সংস্থাকেই বরাত দেওয়া হয়েছে এবং তা ঘটেছে এই সরকারের আমলেই। প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি-র প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বিমানবন্দরের নিলামের ক্ষেত্রে সরকার তার নিজের দপ্তরের সুপারিশকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দোসর পুঁজির স্বার্থে।

সারা পৃথিবীতে বিমানবন্দর বেসরকারিকরণের আর্থিক মডেল হলো সরকার ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে মুনাফা-ভাগাভাগি করে নেওয়ার মডেল। এক টাকা মুনাফা হলে সরকার কতো পাবে এবং সংস্থা কতো পাবে, কতদিন এই চুক্তি চালু থাকবে, কতো দিন অন্তর এই চুক্তির পুনর্বিবেচনা হবে, এই নিয়ে দু পক্ষের মধ্যে লিখিত চুক্তি থাকাই আন্তর্জাতিক দস্তুর। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে দোসর পুঁজির স্বার্থে অবস্থাটা ভিন্ন। এখানে চালু হবে লগ্নিকারী সংস্থা সরকারকে যাত্রী পিছু কত টাকা দেবে তার চুক্তি, যে বেশি টাকা দেবে, বরাত সে পাবে! এবং একবার চুক্তি হলো তা সাধারণ ভাবে চলবে যতদিনের জন্য সংস্থাকে এই বরাত দেওয়া হয়েছে তত দিন পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই সময়সীমা সাধারণত কুড়ি বছর, বিশেষ ক্ষেত্রে তা ২৫ বছর। ভারতে তা দোসর পুঁজির স্বার্থে এক ধাক্কায় ৫০ বছর! চুক্তি পুনর্বিবেচনা বাধ্যতামূলক নয়!

ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ ইকোনমিক আফেয়ার্স সরকারের কাছে জানতে চায় যে ১) মুনাফা-ভাগাভাগি মডেলের চেয়ে যাত্রী-পিছু টাকা পাওয়া কী অর্থে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মডেল, ২) ভারত সরকারের নিয়ম হলো যে কোনও বেসরকারি সংস্থা যদি সরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগ দেয়, তাহলে সংস্থাটির প্রযুক্তিগত সামর্থ হতে হবে প্রস্তাবিত প্রকল্পে যতটা প্রযুক্তিগত সামর্থ প্রয়োজন, অন্তত তার দ্বিগুণ সামর্থ। আর সংস্থাটির আর্থিক সামর্থ হতে হবে প্রযুক্তিগত সামর্থের তিন-চার গুণের মতো। এখানে বলে রাখা ভালো যে আদানি সংস্থার বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার প্রযুক্তিগত সামর্থ এবং অভিজ্ঞতা একেবারেই শুন্যের কোটায়, আর আর্থিক সামর্থ নিয়ে প্রশ্ন না তোলাই ভালো। তারা নিজেরাই জানিয়েছিল যে তাদের অর্থের উৎস হবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে স্বল্প বা বিনা সুদের ঋণ!

অর্থ দপ্তর আরও বলে যে প্রকল্পের সময়সীমা বিমানবন্দরের নির্ধারিত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হওয়া যুক্তিযুক্ত। এই বিমানবন্দরের বিকাশের কাজে যে সব প্রযুক্তি, পরিকাঠামো ও অন্যান্য সম্পত্তি গড়ে উঠবে, তা প্রকল্প শেষে ভারত সরকারের সম্পত্তি হবে, এই জন্য সংস্থা কোনও অর্থ দাবি করতে পারবে না।.অর্থ দপ্তর এই নিলামে প্রথম থেকেই লীজ দেওয়ার বিরোধিতা করে এসেছে। তাদের বক্তব্য ছিল লাইসেন্স প্রথায় সরকারের লাভ বেশি আর লীজ প্রথায় সংস্থার লাভ বেশি। লাইসেন্স-এর বদলে লীজ দিলে সরকারের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হবে।

ভারতের নিতি আয়োগ ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগের এই সর সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়। তাদের মতামত তারা সরকারকে ১০ ডিসেম্বর জানিয়ে বলে,.

(a) project experience in the sector to which (the) proposal pertains;

(b) project experience in other core sectors;

(c) construction experience in the sector to which (the) proposal pertains; and

(d) construction experience in other core sector(s).

এই চারটি বিষয়ের কথা চিন্তা করে আদানি সংস্থাকে এত বড়ো বরাত দেওয়া যায় না, কেননা তারা এই চারটি ক্ষেত্রে তাদের উপযুক্ততা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে!

তাদের আরও স্পষ্ট বক্তব্য ছিল,

While the challenges of monitoring and finalising the gross revenue, in case of gross revenue share model is valid, (the) challenges with the proposed parameter may also need to be evaluated. It needs to be noted that the actual payment received by the authority in this case shall be determined by the actual passenger volume every month/year. Hence during periods of low passenger volume, the receipts shall be adversely impacted. From the concessionaire’s perspective, on the other hand, the passenger volume shall only impact part of his revenues and in a scenario where the passenger volume for particular periods are low but … other aeronautical revenues are high, the authority shall lose out on the portion of non-passenger related revenues. Under the gross revenue share model, no party can be unilaterally disadvantaged/benefitted because of fluctuation in passenger volume, real estate rates etc. In light of this there may be a case to re-consider the financial bid evaluation parameter.” এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেও সরকার এইসব সুপারিশ উপেক্ষা করে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই জাতীয় যাবতীয় অস্বস্তিকর প্রশ্ন এড়িয়ে যায়।

বলাই বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের “চাপে পড়ে”, সরকারের আর্থিক বিভাগ বা নিতি আয়োগ, এই দুই সংস্থাই এই সব গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশকে জঞ্জালের ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে, দেশের আর্থিক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে দোসর পুঁজির মালিক, শ্রী গৌতম আদনানিকে মোদি সরকার ৬ টি বিমানবন্দরের লীজ ৫০ বছরের জন্য যাত্রী-পিছু দরের ভিত্তিতে উপহার দেয়।

১১ ডিসেম্বরের যে মিটিং-এ এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যাচ্ছে যে সেখানে সর্ব মোট ১৩ জন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় যাঁরা অর্থ দপ্তর থেকে ছিলেন, তাঁরা বলেন যে এই সব প্রকল্প মঞ্জুর করার জন্য যে সময়সীমা আছে, সেই সময়সীমা দৃড়ভাবে মেনে চলা হোক। এই সময়সীমা মতে তিন সপ্তাহ ধরে এই প্রকল্পের সব কাগজপত্র পরীক্ষা চলবে। তারপর আরও তিন সপ্তাহ লাগবে সংস্থার দাবি গুলি বিচার করতে। যদি সেই বিচারে সংস্থাটি প্রথমিকভাবে উতরে যায়, তবে তাকে নীতিগতভাবে ছাড়পত্র দেওয়া হবে এবং তার কাছ থেকে এর পর আরও বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জোর দিয়ে বলা হয় যে এই প্রকল্পটি “বিশেষ প্রকল্প”, প্রধানমন্ত্রী নিজে চান যে এটি দ্রুত ছাড়পত্র পাক, তাই এই “বিশেষ ক্ষেত্রে” সময়সীমা কমিয়ে এনে আজই একে নীতিগত নয়, পূর্ণ ছাড়পত্র দেওয়া হলো বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

নিলামের ক্ষেত্রে বরাত-প্রাপকদের প্রযুক্তিগত বাস্তব সক্ষমতা কেমন থাকতে হবে, সেই বিষয়ে উচ্চ-ক্ষ্মতাসম্পন্ন সচিবদের কমিটি একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করে। কিন্তু সরকারি স্তরে সেই রিপোর্ট নিয়ে কোনও আলোচনা মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর কোনও মিটিং-এই করতে দেয় নি। কী ছিলো সেই উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি, যেটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর গড়ে দিয়েছিল, তার রিপোর্ট-এ? ১) নিলামে তারাই অংশ নিতে পারবে, যাদের বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনার প্রমাণিত সক্ষমতা ও সামর্থ রয়েছে, ২) সেই সক্ষমতা ও সামর্থ বিচার করার সময় দেখতে হবে নিলামে অংশগ্রহণকারী সংস্থার গত সাতটি অর্থবর্ষ জুড়ে সংস্থাটি বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে কিনা, ৩) তারা কোনও একটি পরিকাঠামো-ব্যবস্থাপনায় ৩৫০০ কোটি বা তার চেয়ে বেশি নিজস্ব টাকা লগ্নি করেছে কিনা। এ ছাড়াও সংস্থাগুলির কী কী সক্ষমতা থাকতে হবে তা মোদি সরকার নিয়োজিত কমিটি ১৭ নভেম্বরে তার প্রথম মিটিং-এই সিদ্ধান্ত নেয়, যেটি “ হারমোনাইজড মাস্টার লিস্ট অফ ইনফ্রাস্ট্রাকচার সাব-সেক্টর” নামে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

কিন্তু ডিসেম্বরের মিটিং-এ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অবস্থা সম্পূর্ণ বদল হয়ে যায়। সেখানে সরকার কমিটি দ্বারা গৃহীত যাবতীয় সিদ্ধান্ত বদল করে ঠিক হয়, ১) একজন নিলামকারী যতগুলো খুশি নিলামে অংশ নিতে পারবে, ২) বিমানবন্দরগুলির যাত্রী পরিবহনের সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, নিলামকারীকে সেগুলিকে একই রকম ধরে নিয়ে নিলামে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকবে। নিলামকারীর স্বাধীনতা থাকবে কোন বিমানবন্দরের গড় যাত্রী সংখ্যা ধরে সে তার হিসাব কষবে। ( সাদা বাংলায়, মুম্বই বিমানবন্দরের যাত্রীসংখ্যা সর্বাধিক আর লক্ষ্ণৌ বিমানবন্দের যাত্রী সংখ্যা সর্বনিম্ন। নিলামকারী তার মুনাফার হিসেবে লক্ষ্ণৌ বিমানবন্দরের যাত্রীসংখ্যা এবং মুম্বই বিমানবন্দরের যাত্রী সংখ্যা সমান ধরে হিসেব কষতে পারে!), ৩) বিমানবন্দরের “উন্নতির জন্য” শহরের দিকে নিলামকারী সংস্থা তার ইচ্ছেমতো পরিমাণ জমি দাবি করতে পারে। যদি বিমানবন্দরের মালিকানায় ঐ পরিমাণ জমি না থাকে, তবে সরকার নিজ খরচে সেই পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করে সংস্থাকে লীজ দিয়ে দেবে এবং এই জন্য বাড়তি অর্থ চাইবে না, যদিও সরকারি নিয়ম হলো বর্তমানে বিমানবন্দরের আওতায় যতটা জমি রয়েছে, তার ওপর সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ জমি সরকার চাইলে সংস্থাকে দিতে পারে, ৪) লীজ-এর সময় শেষ হওয়ার পর বিমান-পরিবহন সংক্রান্ত যাবতীয় পরিকাঠামো ও যন্ত্রপাতি সংস্থা যদিও সরকারকে বিনামূল্যে ফিরিয়ে দেবে, কিন্তু শহরের দিকে যে সব “উন্নতি ও বিকাশ” সংস্থার হাত ধরে ঘটেছে, সেই সব পরিকাঠামোর জন্য সরকার সেই সময়ের বাজারের দামের ৫০ শতাংশ দাম সংস্থাকে দিলে তবে সংস্থা সেই সব পরিকাঠামো সরকারকে ফেরত দেবে, ৫) যে ছটি বিমানবন্দর ভারতের এয়ারপোর্ট অথরিটি-র অধীনে সবচেয়ে বেশি দক্ষতায় চলছে, পরিকাঠমোর দিক থেকে সবচেয়ে আধুনিক এবং সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে, সেগুলিকেই সর্বপ্রথম লীজ-এ বেসরকারি সংস্থাকে নিলামের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে।

সরকারের ছকটি খুবই স্বচ্ছ। ভারতের করদাতা জনতার টাকায় বিমানবন্দরকে আধুনিক করার কাজ সম্পন্ন করে সেই একই কাজ করার জন্য বেসরকারি সংস্থার হাতে পরিকাঠামোটি ছেড়ে দেওয়া হবে এবং তারা এই উন্নত পরিকাঠামো ব্যবহার করে, একচেটিয়া মালিকানার সুবাদে লাগাম-ছাড়া মুনাফা লুটবে। এইবার দেখা যাক, এই সব বিমানবন্দরের পেছনে সরকার করদাতা জনগণের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার টাকার কী পরিমাণ অর্থ এই খাতে লগ্নি করেছে। জয়পুর বিমানবন্দরের জন্য সরকার এই বেসরকারিকরণের আগেই লগ্নি করেছে ৭৮২.৩ কোটি টাকা। লক্ষ্ণৌ বিমানবন্দরের জন্য ৫৮৩ কোটি টাকা। আমেদাবাদ বিমানবন্দরের জন্য ৩৮৪.৪ কোটি টাকা, ৩৬৩ কোটি টাকা ম্যাঙ্গালোর বিমানবন্দরের জন্য এবং থিরুভানন্তপুরম বিমানবন্দরের জন্য ৪০০.৫ কোটি টাকা। গুয়াহাটি বিমানবন্দরের সম্পূর্ণ আধুনিকীকরণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে অনুমিত খরচের ( ৬৮৪ কোটি টাকা) চেয়ে ঢেড় বেশি টাকা খরচ করে, লগ্নির পরিমাণ ৮২৩.৭ কোটি টাকা!

এখানে বলে রাখা ভালো যে কেরালা সরকার থিরুভানন্তপুরম বিমানবন্দরের নিলামে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিল, কিন্ত কেন্দ্রীয় সরকার এই বিষয়ে কেরালা সরকারের সঙ্গে চূড়ান্ত অসহযোগিতা করে এবং কেরালা সরকার যাতে এই নিলামে হটে যায় সেই জন্য আদানি সংস্থার দর বেশি করে দেখায়। কেরালার এই বিমানবন্দরটি শহরের প্রান্তে প্রায় ৬৩৭ হেক্টর জমির ওপর অবস্থিত, বিমানবন্দরের ৯৯ শতাংশ জমির মালিক কেরালা সরকার। কেরালা সরকার এয়ারপোর্ট অথরিটি ও ভারত সরকারকে জানায় যে তারা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মুনাফা ভাগাভাগির ভিত্তিতে এই বিমানবন্দরটি চালাতে চায়। কিন্তু সরকার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কেরালা সরকারকে নিলামে যোগ দিতে উপদেশ দেয়!

সবকটি বিমানবন্দরের নিলামের জন্য প্রযুক্তিগত দিকের দরপত্রগুলি ১৬ ফেব্রুয়ারি খোলা হয়, দেখা যায় যে সর্বমোট ৩২টি সংস্থা নিলামে অংশগ্রহণের আগ্রহ দেখিয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি খোলা হয় আর্থিক দরপত্রগুলি, এই ক্ষেত্রে গুয়াহাটি-র দরপত্রগুলি খোলা হয় না। এই দিন বিকেলেই আদানি গোষ্ঠীকে পাঁচটি বিমানবন্দরের জন্য ৫০ বছরের লীজ দেওয়া হয়, দুদিন পরে গুয়াহাটি বিমানবন্দরের লীজ-ও আদানি সংস্থার হস্তগত হয়। এই লীজ দেওয়ার বিষয়ে যাত্রীপিছু দামকেই একমাত্র উপাদান হিসেবে ধরা হয়, অন্য কোনও ধরণের সক্ষমতা বা প্রযুক্তিগত দক্ষতা বা বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনার বিষয়ে অভিজ্ঞতা, কোনও কিছুকেই হিসেবে আনা হয় নি।

ভারতের অসামরিক বিমান মন্ত্রক পরে আদালতে স্বীকার করে যে বিমানবন্দর বেসরকারিকরণের জন্য যে যে রাজ্যে ঐ সব বিমানবন্দর অবস্থিত, সেই সেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সম্মতি সাপেক্ষেই মাত্র এই বেসরকারিকরণ চলতে পারে। কিন্তু এই ছয়টি বিমানবন্দর বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই এই নিয়মটি মানা হয়নি। এর আগে রাজ্যসভার এক প্রশ্নের উত্তরে অসামরিক বিমান দপ্ত্ররের পক্ষ থেকেও এই একই কথা জানানো হয়। কলকাতা থেকে সপ্তর্ষি দেব নামে এক ব্যক্তি তথ্য জানার অধিকার আইন প্রয়োগ করে এই একই বিষয় জানতে চান, যার জবাবে সরকার পক্ষ থেকে জানানো হয় যে রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে পরামর্শ ও সম্মতি গ্রহণের আগেই বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

কেরালা সরকার কেরালা হাইকোর্ট-এ কেন্দ্রীয় সরকারের থিরুভানন্তপুরম বিমানবন্দরের বেসরকারিকরণের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে একটি মামলা দায়ের করে। এই জনস্বার্থ মামলায় কেরালা সরকার জানায় যে নিয়ম-বহির্ভূত উপায়ে আদানি সংস্থাকে বিমানবন্দরের উন্নতি, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করার ভার দেওয়া কোনও মতেই জনস্বার্থের আওতায় পড়ে না। এ ছাড়াও এই বেসরিকরণ ভারতের এয়ারপোর্ট অথরিটি-র আইনের পরিপন্থী এবং তা রাজ্য সরকারের অধিকারে থাকা জমির মালিকানা সংক্রান্ত অধিকার ভঙ্গের সমান। এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া আদালতে তাদের বক্তব্যে বলে যে এই বিমানবন্দরের ৯৯ শতাংশ জমির মালিক কেরালা সরকার; কেরালা সরকারের এই বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা, উন্নতি এবং পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা আছে এবং যদি দেখা যায় যে এই নিলামে অন্যন্যদের মতো কেরালা সরকারের দরপত্র সমতুল্য, তাহলে কেরালা সরকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ।

কিন্তু দোসর পুঁজির সেবাদাস-রা এই সব সুপরামর্শ শুনতে আদৌ প্রস্তুত নয়। করোনা কালে যেখানে দেশের প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হয়েছে, সেখানে গত এক-দেড় বছরে এই আদানি সাহেবের ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রবৃদ্ধির হার ২৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ভারতীয় জনতা পার্টির উত্থানের সঙ্গে এই অখ্যাত ও অবজ্ঞাত ব্যক্তিটির নাটকীয় উত্থান, দোসর পুঁজির হাত ধরে গত শতকের ইউরোপের নানা রক্ত-লাঞ্ছিত কাহিনির কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়।

0 Comments

Post Comment