পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

হারজিত নয়, উত্তরণ

  • 18 April, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 2569 view(s)
  • লিখেছেন : মনসুর মণ্ডল
বিশ্বে বিস্ময় জাগিয়ে চীন করোনার গ্রাস থেকে মুক্ত। পশ্চিমী দুনিয়ায় শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশগুলিতে করোনা মহামারিতে জনজীবন বিধ্বস্ত। কী বার্তা বয়ে আনে এই বৈপরীত্য?


চলতি বছরের শুরুর সময়। ভারতে তখন এসএআরএস-সিওভি-২ বা নোভেল করোনার আঁচড় লেগেছিল মাত্র। চীন তখন এই ভাইরাস সংক্রমণে জর্জরিত। করোনা মহামারি রুখতে প্রাণপণ সংকল্পে চীন লড়ে চলেছে। অসম লড়াইয়ে ভারসাম্য আনতে নিয়োজিত করেছে তার সমস্ত মেধা ও অধ্যবসায়। ভারতে তখন আপাত নিরাপদ দূরত্ব-বলয়ে থাকার সুবাদে একটা অংশ থেকে চীন সম্পর্কে কুৎসা ও কল্পকথার ফুলঝুরি ছড়ানো চলছিল।
নোভেল করোনা ভাইরাস নাকি চীনের ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে তৈরি করে রাখা ছিল। চীনা সরকারের বদ মতলব ছিল, সেদেশে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটিয়ে কোটি কোটি গরিব ও বৃদ্ধ মানুষকে মেরে ফেলবে। এদের দায় ঝেড়ে ফেলে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে। বিশ্বে অপ্রতিরোধ্য মহামারি ঘটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধ্বস নামাবে। এভাবে চীন পরাশক্তি হয়ে সারা বিশ্বকে তার অলঙ্ঘ্যনীয় নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলবে। কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে ল্যাব-দুর্ঘটনায় করোনা ভাইরাস পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ায়। আমাদের দেশে শাসক শিবিরের ধূর্ততায় এইসব কল্পকথা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। নেটদুনিয়ার চমৎকারিত্বে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ভাইরাল ভিডিও ও কল্প-আখ্যান।
বাংলাদেশে মুসলিম মৌলবাদী শিবির থেকে প্রচার, চীনে উইঘুর মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর চীনা সরকারের অত্যাচারের বদলা নিতে আল্লাহ্’র তরফে সেখানে গজব ( মহা বিপদ ) নেমে এসেছে। নোভেল করোনা ভাইরাস হ’ল অত্যাচারী চীনাদের বিনাশকারী আল্লাহ্ প্রেরিত দূত। ভারতে বাংলাভাষী মুসলিমদের অনেকের কাছে এই প্রচার সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পৌঁছে গেছে। উইঘুর মুসলমান সম্পর্কে ভারতে সাধারণভাবে মুসলিমদের মধ্যে ধারণা নেই। সেদিক থেকে এই ভাইরাল ম্যাসেজে এদেশের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা চাক্ষুষ না হলেও পিছনে মুসলিম মৌলবাদী শিবিরের কারো কারো হাত আছে বলে মনে হয়।
করোনা কুৎসার চমকপ্রদ পটভূমি আছে। মার্কিন লেখক ডিন কুনৎজ’এর লেখা কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক উপন্যাস ‘দ্য আইজ অফ্ ডার্কনেস’-এ উহান-৪০০ নামে ভাইরাসের কথা বলা হয়েছে । কিন্তু ১৯৮১’তে প্রকাশিত উপন্যাসটিতে উহান-৪০০ নয়, গোর্কি-৪০০ নামে ভাইরাসের উল্লেখ ছিল। গোর্কি-৪০০ ভাইরাস জীবাণু-অস্ত্র হিসেবে সংরক্ষণের দায় চাপানো হয় সোভিয়েত রাশিয়ার ঘাড়ে। কিন্তু উপন্যাসটির ১৯৮৯’এর সংস্করণে ‘গোর্কি-৪০০’ হয়ে যায় ‘উহান-৪০০’। কারণ তখন রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র পতনোন্মুখ হয়ে পড়ায় তার নাম ভাঁড়ানোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। চীন তখন বিশ্বে চ্যালেঞ্জিং বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক দেশ। অতএব ডেস্টিনেশন চায়না। এখন উহান-৪০০ নবীকৃত হয়ে নোভেল করোনা খেতাব নিয়ে পুঁজিবাদের পাপস্খলনে রত। ভারতে এর প্রাথমিকতা মার্কিন মুলুক-অনুপ্রাণিত।
সংখ্যালঘু ও স্বতন্ত্র ধর্মবিশ্বাস হেতু সংখ্যাগুরুসুলভ বৈরিতায় ভারতীয় মুসলমান সমাজে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবদমন নেমে আসার দৃষ্টান্ত কম নেই। কিন্তু করোনা আবহে এক আদি প্রেরণায় হিন্দুত্ববাদ ও মুসলিম মৌলবাদের কন্ঠ এক স্বরে মিলে গেল। সে হ’ল সমাজতান্রিক ব্যবস্থার প্রতি, কমউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি বিরোধ। এবং তা আজ নিকৃষ্ট বৈরী চেহারায় প্রদর্শিত। পশ্চিমবঙ্গে প্রধান রাজনৈতিক ধারায় বামবিরোধী আবহে চীনবিরোধী করোনা-কল্প ভালই বাজার করেছে। নোভেল করোনা যে ল্যাব-প্রোডাক্ট নয়, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা দূরে থাক, স্কুলের জীববিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ে, যেমন এরাজ্যে অষ্টম শ্রেণির বিজ্ঞানপাঠ্য ‘পরিবেশ ও বিজ্ঞান’, যেখানে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে প্রাথমিক ও জরুরি কথা বলা আছে, চোখ রাখলে বিষয়টা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা হতে পারে। সেকথা ‘চীনা ভাইরাস’পন্থীরা জানে না, এমন হয়তো নয়। কিন্তু কমিউনিজমের আতঙ্ক বড়কত্তা-ছোটকত্তা-ছোটেমিয়াদের এক মনোবিকার বিশেষ। সর্বোপরি, সমাজতান্ত্রিক শিবিরে অভ্যন্তরীণ বিতর্ক যাই থাক, চীন বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ শক্তি বটে।
মার্কিন সংস্থা দ্য স্ক্রিপ্স রিসার্চ ইন্সটিটিউট জানিয়ে দিয়েছে, নোভেল করোনা ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়নি। এটি প্রাকৃতিক ভাইরাস। ক্রিশ্চিয়ান জি অ্যাণ্ডারসন, রবার্ট এফ গ্যারি, এমন বাঘা বাঘা ভাইরোলজিস্টরা এটিকে প্রাকৃতিক ভাইরাস বলে উল্লেখ করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই তত্ত্বেই সিলমোহর দিয়েছে। ফলে পুঁজিভজা কত্তা- মিয়ারা অনেকটাই দমে গেছে। কিন্তু ভাইরাল হওয়া কুৎসা-কাহিনী লাখো মানুষের মননে খেলে বেড়াচ্ছে। মানবসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি তো কম হবে না। ‘চীনা ভাইরাস’ তত্ত্ব হাতছাড়া হলেও নিজামুদ্দিন মার্কাজ- মওকা পেয়ে গেছে হিন্দুত্ববাদীরা। তাদের অসম্ভব হীন উৎসাহে দেশের আনাচে-কানাচে ইসলামোফোবিয়ার নবোদ্ভূত ভাইরাস মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। মিলিজুলি তৈরি মিথ্যার সরণিতে এখন হিন্দুত্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তখন মুসলমান সমাজে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি তো কম নয়।
বিশ্বে বিস্ময় জাগিয়ে চীন করোনার গ্রাস থেকে মুক্ত। এ বিস্ময় বেদনার্তও ; পশ্চিমী দুনিয়ায় শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশগুলিতে করোনা মহামারিতে জনজীবন বিধ্বস্ত। আজ বহু লিবারাল চিন্তাবিদ তাঁদের চিন্তা-ভাবনা নবীকরণ করছেন এই মর্মে যে, মহামারির মতো সভ্যতার সঙ্কটে, মানবিক সঙ্কটে একমাত্র সমাজতন্ত্র আশা-ভরসার আশ্রয়। সমাজতন্ত্রই পারে সমাজ ও সভ্যতাকে মানবকল্যাণ ও প্রগতির প্রসারতায় আঁকড়ে ধরতে। এই চর্চা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে। আজ সভ্যতার অভূতপূর্ব সঙ্কটে কারোর জিত আর কারোর হার নয়, বিশ্বজনীন সমগ্রতায় এ এক উত্তরণ। এই উত্তরণের পর্যায়-সারণিতে আজকের খণ্ড খণ্ড বিভেদনীতি, কুৎসা, শঠতা সব একদিন চাপা পড়ে যাবে, এ বিশ্বাস রাখা যায় – এ বিশ্বাস রাখতে হবে।

ছবি ঃ পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

0 Comments

Post Comment