পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ফ্যাসিবাদ? নয়া-ফ্যাসিবাদ? নয়া-ফ্যাসিবাদের দিকে ঝোঁকা?

  • 26 February, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 680 view(s)
  • লিখেছেন : আদিত্য নিগম
ফ্যাসিবাদ? নয়া-ফ্যাসিবাদ? নয়া-ফ্যাসিবাদের দিকে ঝোঁকা? আজকের ভারতবর্ষে কি এই নিয়ে বিতর্ক হতে পারে? যেখানে রোজ আমরা দেখতে পাচ্ছি এই বিজেপির স্বরূপ, সেখানে এই তর্ক শুধু অর্থহীন! ফ্যাসিবাদ সবসময় জাতীয়তাবাদের মধ্যেই সম্ভাব্য ছিল এবং এটি জাতীয়তাবাদের একটি রোগব্যাধি—জাতীয়তাবাদ নিজেই তো একটি মতাদর্শগত গঠন।

কী অর্থহীন, মিথ্যা বিতর্ক!
যাঁরা জানেন না, তাদের জন্য বলি—এটি সিপিআইএম-এর খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবনার একটি প্রসঙ্গ; যা আসন্ন এপ্রিলে তাদের কংগ্রেসে চূড়ান্ত করা হবে। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান শাসনকে 'স্বৈরাচারী, নয়া-ফ্যাসিবাদের দিকে ঝোঁকা' হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়টি পার্টির অভ্যন্তরীণ একটি নোটের মাধ্যমে আরো বিস্তারিত ভাবে  আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু ভারতের বর্তমান শাসক যে ইতোমধ্যেই 'নব-ফ্যাসিবাদী' হয়ে ওঠেনি - সেই সম্পর্কে তাঁরা প্রায় নিশ্চিত।  এই অহেতুক বিতর্ক হয়তো বিনোদনমূলক হতো, যদি না এটি আমাদের বর্তমান সময়ের বিশাল ট্র্যাজেডির সঙ্গে জড়িয়ে না থাকত।


একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এক বন্ধু মন্তব্য করেছিলেন—সম্ভবত স্ট্যান স্বামী এবং জি. এন. সাইবাবার ওপর আঘাত কিছুটা হলেও কম পড়ত, যদি তাঁরা জানতে পারতেন যে, তারা কোনো ফ্যাসিবাদী শাসনের হাতে নিহত হননি, বরং একটি স্বৈরাচারী শাসনের শিকার হয়েছেন! কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে প্রশ্ন উঠছে—আসলে কী ঘটছে? ব্যক্তিগতভাবে, আমি এই শাসনকে ফ্যাসিবাদী বলার ওপর বিশেষ জোর দিই না, যতক্ষণ না এটা স্পষ্ট যে, এটিকে পরাজিত করতে সর্বোচ্চ বিস্তৃত ঐক্য দরকার (এককাট্টা ফ্রন্ট, জনফ্রন্ট বা যেকোনো কিছু)। কিন্তু এখানেই কারাটীয় সমস্যা দেখা দেয়। যদি আপনি তা স্বীকার করেন, তাহলে আপনাকে অবশ্যই একটি জনফ্রন্ট গঠনের জন্য গুরুতর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কিন্তু 'রামবাম' লাইন নিয়ে আপনি কি তা করতে পারবেন? যদি আপনি ভাবেন—'আজ রাম, কাল বাম', তাহলে কি আপনি সত্যিই এই শক্তিকে ফ্যাসিবাদী বলতে পারেন এবং একইসঙ্গে নিজের অবস্থানকে ন্যায্যতা দিতে পারেন?
আমার মতে, সমস্যাটি কেবল এই রাজনৈতিক কৌশলের হাস্যকর দিকের চেয়েও গভীর। বর্তমান প্রস্তাবে থাকা কারাটীয় ব্যাখ্যাটি সত্যিই বিস্ময়কর: ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদের সংকট থেকে উঠে এসেছিল, কিন্তু আজ পুঁজিবাদের কোনো সংকট নেই। অতএব, এটি ফ্যাসিবাদ হতে পারে না। বরং, এটি কেবলমাত্র নয়া-উদারবাদী সংকটের ফল। তাই একে ‘নয়া-ফ্যাসিবাদের ঝোঁক’ বলা যেতে পারে। এই ব্যাখ্যার প্রতিটি অংশ চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব। তবে আপাতত তা থাক।
এই কারাটীয় ব্যাখ্যার মানে দাঁড়ায়—যদি আমাদের কাছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইতালি বা জার্মানির সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি না থাকে, তাহলে আমরা বর্তমান পরিস্থিতিকে ফ্যাসিবাদ বলতে পারি না। তাহলে আমার সরল যুক্তি অনুসারে, আরেকটি তাত্ত্বিক উপসংহারও টানতে হয়: মার্কসবাদ উঠে এসেছিল সহিংস পুঁজিবাদের উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে। যেহেতু সেই পরিস্থিতি রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, এমনকি কারাটের নিজের দেশেও ছিল না, তাহলে এসব 'কমিউনিস্ট পার্টি'র নাম ভুল। তারা সর্বোচ্চ নয়া-মার্কসবাদী হতে পারে, অথবা আরও নির্ভুলভাবে বলতে গেলে, 'নয়া-মার্কসবাদের দিকে ঝোঁকা'!
নয়া-ফ্যাসিবাদ, প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাচন বিলোপ করে না এবং গণতন্ত্রের কিছু মাত্রা ধরে রাখে, যেমনই কি না নয়া-সিপিআইএম এখনও হয়তো 'প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব' নিয়ে স্লোগান তোলে!
কিন্তু এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে আসি।
ধারণা (এবং মতাদর্শ) কেবল 'বাস্তব পরিস্থিতি'র সরাসরি ফল নয় এবং একবার জন্ম নিলে, তা আর কখনোই তার উৎস বা বস্তুগত পরিস্থিতির প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থাকে না। ভাবুন বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম বা ইসলাম সম্পর্কে। এগুলো কোন বাস্তব পরিস্থিতিতে জন্ম নিয়েছিল? কত দূর (স্থান ও সময়ের হিসাবে) এগুলো বিস্তৃত হয়েছিল? সেসব জায়গার বাস্তব পরিস্থিতি কী ছিল?
বৌদ্ধধর্ম তার জন্মভূমি থেকে হারিয়ে গেলেও তিব্বত, শ্রীলঙ্কা, চীন, জাপান—কয়েকটি দেশের নাম বললেই যথেষ্ট—এগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। আর খ্রিস্টধর্ম? প্যালেস্টাইনে জন্ম নিয়ে এটি ইউরোপীয় ধর্ম হয়ে উঠল। চেষ্টা করুন—প্যালেস্টাইনের সেই সময়কার বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান বিশ্ব (যা পুরো ইউরোপও নয়) মিলিয়ে দেখতে।
ফলত আমি মনে করি কারাটীয় চিন্তাধারা কেবলমাত্র 'হিস্টেরিকাল ম্যাটেরিয়ালিজম'। আর কিছু নয়।
শেষে, দিমিত্রভ ও কমিন্টার্ন ফ্যাসিবাদকে সব দিক থেকে বোঝেননি। আমি বলব, মার্কসবাদী ধারার মধ্যে সম্ভবত ট্রটস্কিপন্থীরাই একে সবচেয়ে গুরুত্ব সহকারে অধ্যয়ন করেছিলেন। তবে ফ্যাসিবাদ গবেষণার ইতিহাস সেখানেই থেমে যায়নি। বিপুল পরিমাণ ঐতিহাসিক ও তাত্ত্বিক কাজ হয়েছে, যা দেখায় যে, ফ্যাসিবাদ সবসময় জাতীয়তাবাদের মধ্যেই সম্ভাব্য ছিল এবং এটি জাতীয়তাবাদের একটি রোগব্যাধি—জাতীয়তাবাদ নিজেই তো একটি মতাদর্শগত গঠন।


ভারতে ফ্যাসিবাদের বিশেষ চরিত্র সম্পর্কে কিছুই জানা যাবে না, যদি আমরা ক্লান্তিকর দিমিত্রভীয় সূত্রগুলো শুধু পুনরাবৃত্তি করতে থাকি, অথচ ব্রাহ্মণ্যবাদ (যেমন আম্বেদকর একে মতাদর্শ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন) এবং এর ক্ষমতাকে বোঝার চেষ্টা না করি। ব্রাহ্মণ্যবাদী ক্ষমতার প্রকৃতি বোঝা যায় এই বাস্তবতা থেকে যে, এই বিশাল, অভিশপ্ত ভূখণ্ডে প্রায় ৩০০০ বছর ধরে কোনো বিদ্রোহ হয়নি—'বিদ্রোহ'র উচ্চতম রূপ ছিল ভক্তি আন্দোলন!
বর্তমান ফ্যাসিবাদী জাতীয়তাবাদ ও এই মতাদর্শের বিশেষ মিশ্রণটি আমাদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাবে -  যদি আমরা 'ফ্যাসিবাদ'কেই একমাত্র রেফারেন্স হিসেবে ধরে থাকি।

0 Comments

Post Comment