পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সংসার অনিন্দিতা দে

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 201 view(s)
  • লিখেছেন : অনিন্দিতা দে
(১) অবশেষে আর্য আর ইরার বিয়েটা হয়েই গেল। পরেরদিন ইরার মা মন্দিরে পুজো দিয়ে এসে ওর বাবার কানেকানে বলল—যাক বাঁচা গেছে। একত্রিশ বছরের নাকউঁচু মেয়ে শখানেক ছেলেকে রিজেক্ট করার পরে ফাইনালি স্বেচ্ছায় বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে, এই অনেক। আমাদের দুশ্চিন্তা ও আর কী বুঝবে!

আর্যর মা ঢাক ঢোল পিটিয়ে আত্মীয়দের বলল—দেখেছ আমরা কত লিবারাল! বউমা ছেলের থেকে বয়সে বড়, শাখা সিঁদুর পরবে না, সারনেম পাল্টাবে না, আমরা সব মেনে নিয়েছি। এমন প্রগতিশীল ফ্যামিলি আর একটা খুঁজে দেখাও দেখি!  

ফুলসজ্জার রাতে আর্য ইরাকে হীরের আংটি উপহার দিল। স্বরচিত কবিতা শোনাল। ইরা ফিক করে হেসে ওকে দুটো প্লেনের টিকিট দিয়ে বলল—ভিয়েতনাম কম্বোডিয়া বুকিং ডান। পরশু সকালে ফ্লাইট।

আর্য বউকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। ইরা ভেসে যেতে যেতে ভাবল, কে বলেছে স্বপ্ন সত্যি হয় না? ভাগ্যিস মায়ের কথা শুনে এলিট ম্যাট্রিমনির কোন ভুলভাল ছেলের সঙ্গে ঝুলে পড়িনি।

মাঝরাতে পূর্ণিমার একা চাঁদ বাঁকা হাসল। সে হাসি কারোর চোখে পড়ল না।

 

(২)

হানিমুনপর্ব মিটল নির্বিঘ্নেই। পাগলামি, অসভ্যতামি, গদগদ ছবি, দুষ্টুমিষ্টি রিল—সবই হল। এবার 'প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোহারে' মোড থেকে বাস্তবের মাটিতে ফেরার পালা।

বাড়ি ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ইরা বলল—কাল থেকে আবার অফিস। দু সপ্তাহের জমে থাকা কাজ তুলতে হবে। উফফফফ!

 

আর্য মোজা খুলতে খুলতে বলল—যা বলেছিস। আমার স্কুলের হেডমাস্টারটা তো ভাইরাসের মতো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে চিল্লাবে মনে হচ্ছে।

ইরা এইটুকু বয়সেই সিসিডির রিজিওনাল সেলস ম্যানেজার। সূর্যের আলো পড়া কাচের টুকরোর থেকেও ঝকঝকে ওর কেরিয়ারগ্রাফ। আর্য সেই তুলনায় সাদামাটা। স্কুলটিচার। প্যারা বা সিভিক নয়, সরকারী চাকরি। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বৃত্তের মানুষকে মিলিয়ে দিয়েছে ফেসবুক। আর্য ঘরে বাইরে শান্তশিষ্ট, সর্বংসহা গোছের মেয়ে দেখেই অভ্যস্ত। ইরার মতো একটা ফুরফুরে, স্বাধীনচেতা প্রজাপতিকে দেখে ও মুগ্ধ হয়েছিল। অন্যদিকে আর্যর নারীবাদী ফেবু পোস্টগুলো দেখে, ওর সঙ্গে মেলামেশা করে ইরার মনে হয়েছিল, এ টক্সিক নয়। ওর ডানা ছাটার চেষ্টা করবে না। বাকিটা হয়েছিল মাখনের মতোই। ইরার শেষমেশ কাউকে মনে ধরেছে, এতেই ওর বাবা মা আনন্দে আটখানা হয়ে গেছিল। আর ইরা আর্যর থেকে তিন বছরের বড় হলেও পাত্রী হিসেবে তো জ্যাকপট। সুন্দরী, শিক্ষিতা, ঈর্ষণীয় প্যাকেজ—আপত্তি ওঠেনি আর্যর বাড়ি থেকেও।

ধুমধাম বিয়ে আর রূপকথা হানিমুনের পরে বাবুই পাখির মতো লাল নীল সংসার গুছিয়ে নিল দুজনে। সোম থেকে শুক্র দুজনেই যে যার কাজের জগতে চরকির মতো ঘুরতে থাকে। আর্যর স্কুলে চাপ কম হলেও ডেলি প্যাসেঞ্জারী করতে হয় ওকে। ফলে রাত আটটার আগে দুজনের ভালো করে দেখাই হয় না। তাতে অবশ্য ভালোবাসায় ধুলো জমেনি একটুও। ড্রয়িংরুমের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ইরার সদ্য কেনা পঞ্চান্ন ইঞ্চির টিভিতে ফ্রেন্ডস দেখতে দেখতে ওরা কফি খায়। ইরা আর্যর বুকে মাথা রাখে। একটু পরে বেডরুমে গিয়ে ভালোবাসাবাসি খেলায় মেতে ওঠে দুজনে।

জীবন মসৃণভাবেই এগোচ্ছিল। শুক্রবার সন্ধ্যেতে বাড়ি ফেরার পথে ইরা কিনল কাবাব আর রেড ওয়াইন। কী মনে হতে একটু ফুলও কিনল ঘর সাজানোর জন্য। সুরা, নেটফ্লিক্স, ব্যাকগ্রাউন্ডে ভায়োলিন, প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য, হাওয়ায় ভেসে আসা ফুলের সুগন্ধ—আর কী চাই জীবনে।   

বাড়ি ফিরে দেখল আর্যর বাবা মা ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাচ্ছে। ওকে দেখে একগাল হেসে শাশুড়ি বলল—তোদের সংসার গুছিয়ে দিতে এলাম।

ইরা অপ্রস্তুত হেসে ওয়াইনটা লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর্যকে বলল—পাপা মামনি এসেছে আমাকে ফোনে বলিস নি কেন? বেশী করে কাবাব আনতাম তাহলে।

আর্যর বাবা একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল—একটা কথা বলছি কিছু মনে করো না মা। বিয়ের পর বর বউ তুই তুই করলে শুনতে খুব কানে লাগে। এইসব সাঁওতালরা করে। ভদ্রসমাজে চলে না।

ইরার মুখটা অপমানে কালো হয়ে গেল। আর্য মিনমিন করে কিছু একটা বলে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করল।

সেদিন ইরার শখের টিভিতে ‘কুমারীর কলঙ্ক’, ‘সোহাগের রঙ লাল’ গোছের একটার পর একটা সিরিয়াল চলতে থাকল ফুল ভলিউমে। অশ্রাব্য ধুমতানা ধুমতানা আওয়াজে ইরার মাথা ধরে গেল। আর্য বিব্রত মুখে বলল—কটাদিনের তো ব্যাপার। তারপর তো ওরা আবার গ্রামের বাড়িতেই ফিরে যাবে। একটু মানিয়ে নে।

ইরা নীরবে মাথা নাড়ল।

(৩)

রবিবারের সকাল। ইরা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজ পড়ছিল। এমন সময় লুচি আলুরদমের প্লেট হাতে আর্যর মার আবির্ভাব। ইরা বলল—এমা তুমি কেন? কনকদি কোথায়?

—তুই আমার একটামাত্র ছেলের একটামাত্র বউ। তোর সাথে আমার কী একটু গল্প করতে ইচ্ছা করেনা বল? গুছিয়ে বসল আর্যর মা। বলল, খেয়ে নে। রবিবার আর ডায়েট করতে হবে না।

জোর করাটা ইরার ভালো লাগল। লুচি ছিঁড়ে মুখে পুরল। আহা, চমৎকার হয়েছে।

আর্যর মা পাশে বসে ফুলপিসি, রাঙামাসি, মদনকাকা সবার হাঁড়ির খবর দিতে শুরু করল। সাতসকালে এই ধরনের আলোচনা ইরার ঘোরতর অপছন্দ। তবু লক্ষ্মী মেয়ের মতো মাথা নাড়তে লাগল ও। শাশুড়ি  পড়াশুনা বেশীদূর করেনি। টেনেটুনে স্কুল পাস। ঘর-গৃহস্থালির বাইরে কোন জগত ছিল না। তার আলোচনার বিষয়বস্তু তো সীমাবদ্ধ হবেই। শাশুড়ি অপর্ণা সেনের মতো হবে, এমন আকাশকুসুম কল্পনা ইরার নেই।

খাওয়া যখন প্রায় শেষের পথে, আর্যর মা বলল—ফ্রেশ হয়ে একবার রান্নাঘরে আয় তো। আজ ভাবছি ডুমুর চিংড়ি করব। আমাকে হাতে হাতে সাহায্য করবি। কাজের লোক দিয়ে কী আর সব হয়?

ইরা ব্যাজার মুখে বিছানা ছাড়ল। রান্নাটা ও একেবারেই পারেনা। কিন্তু গত তিনমাস ধরে ‘মেয়েদের বেসিক রান্নাটা জানা উচিত’, ‘মাঝেমাঝে দু একটা পদ তো বানাবি’, ‘একটু চেষ্টা করলেই পারবি। রান্নাটা মেয়েদের রক্তে মিশে থাকে’ গোছের কথাবার্তা শুনে শুনে ইরার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। সারা সপ্তাহ কর্পোরেট সেক্টর নিংড়ে নেয়। শনি রবি একটু বিশ্রাম চায় ইরা। দুটো কাজের লোক রেখেছে। সংসারের বেশীরভাগ খরচটাও ওই দেয়, যাতে ছুটির দিনগুলো একটু আরামে থাকতে পারে। কিন্তু তাতে কারোর সন্তুষ্টি নেই। বাড়ির বউকেই রান্নাঘরে ঢুকতে হবে, নাকের জলে চোখের জলে হতে হবে, সেই দৃশ্যটা এরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে, তবেই না মজা! সবকিছু সবার দ্বারা হয় না, এটুকু কেন এরা বোঝে না?

আর্যর কাছে একবার অনুযোগ করেছিল ইরা। আর্য হাসতে হাসতে বলেছিল—আরে, রান্নাটা তো লাইফ স্কিল। ছেলে মেয়ে সবারই শেখা উচিত।

ছেলে মেয়ে সবারই যখন রান্না জানা উচিত, আর্যকে কেউ কখনো রান্নাঘরে ঢুকতে বলে না কেন? আর আর্য যে ইরার চারভাগের একভাগ মাইনে পায়, ঘরে বাইরের বেশীরভাগ খরচ ইরাকেই সামলাতে হয়, কই তখন তো দুজনের মধ্যে তুলনা হয় না? তখন সবাই ফেমিনিজমে বিশ্বাসী, সবাই খুব উদার। কিন্তু ইরা রবিবারে একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমালেই সবার উদারতার বেলুনগুলো চুপসে যায়। আসলে বিয়ে ব্যাপারটাই অসাম্যের উপর দাঁড়িয়ে। 

জিভের ডগায় আসা কথাগুলো গিলে নিল ইরা। আজকাল অনেক কিছুই হজম করতে শিখছে ও। তবে যত দিন যাচ্ছে ততোই বুঝতে পারছে, এত মানিয়ে গুছিয়ে থাকা ওর পোষাবে না। বীরেন্দ্র সেহবাগ মোডে ব্যাট চালাতে হবে এবার।

(৪)

পরের শনিবার আর্যর মা ইরাকে ভেটকি মাছের পাতুরি বানানোর টিউটোরিয়াল দিতে এলে ও হাসতে হাসতে বলল—তোমাদের জন্য সারপ্রাইজ আছে। আজ তো আমরা বাইরে খেতে যাব।

বাইপাসের ধারে নামী রেস্তোরায় জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হল। পোলাও, গন্ধরাজ চিকেন, পাতুরি, ডাব চিংড়ি, পায়েস। ইরা বিল পেমেন্ট করতে গেলে আর্য বলল—কত হয়েছে?

ইরা বলল—আমি দিচ্ছি রে।

আর্যর বাবা উঁকিঝুঁকি মেরে বিলের অ্যামাউণ্টটা দেখে চোখ কপালে তুলল।

—পনেরো হাজার? এর থেকে তুমি আর তোমার মামনি বাড়িতে পদগুলো বানালে দুহাজারে হয়ে যেত।

এরকম একটা পরিস্থিতির জন্য তৈরী ছিল ইরা। হেসেই বলল—আমার রান্না করতে ভীষণ বিরক্তি লাগে পাপা। পারিও না তেমন। এইসব করতে আমার যে সময় আর এনার্জি খরচ হত, তা বাঁচাতে আমি পনেরো হাজার খরচ করতে রাজি আছি।

আর্যর বাবা এমন জবাব আশা করেনি। থতমত খেয়ে চুপ করে গেল। ইরা কার্ডে পেমেন্ট করে পাঁচশো টাকা টিপ দিল ওয়েটারকে। আর্যর বাবা-মা কটমট করে নোটটা দেখল একঝলক, কিছু বলল না।

পরেরদিনই শ্বশুর শাশুড়ির ঘরে তলব পড়ল ইরার। আর্যর বাবা গম্ভীর গলায় বলল—তোমাকে কয়েকটা কথা বলার আছে।

—হ্যাঁ বলুন?

—আমরা সিম্পল লাইফস্টাইলে বিশ্বাসী। তুমি এই যে হাজার হাজার টাকার ড্রাইফ্রুটস, ক্রিম-পাউডার অর্ডার করো, আমার তা পছন্দ না। অত দামী কফি খাওয়ারই বা কী আছে? আমি তো দশটাকার কফি আর তোমার কফির মধ্যে কোন ফারাকই বুঝতে পারিনা।

ইরার কান গরম হয়ে উঠল। আজ ও কিছুতেই সহ্য করবে না।

শাশুড়ি পাশ থেকে মিহি গলায় বলল—প্রতিদিন আমাজন মিন্ত্রা থেকে পার্সেল আসছে। আমাদের সময়ে বছরে দুবার শাড়ি পেলেই আমরা বর্তে যেতাম। আজকালকার মেয়েরা বড্ড উড়নচণ্ডী।

ইরা ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিল—এই সংসারে সবথেকে বেশী টাকা আমি দি। হ্যাঁ আমি নিজের জন্য খরচ করি বটে, কিন্তু তোমাদের বা আর্যর একটা পয়সাও ওড়াই না। আমি ভালো রোজগার করি, আমার সামর্থ্য আছে, তাই আমি খরচ করি। এই নিয়ে আমি কাউকে কোন কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।

ঘরে কয়েক মুহূর্তের জন্য পিনড্রপ সাইলেন্স। একটু পরে আর্যর বাবা একটু সুর নরম করে বলল—কিন্তু পয়সা জমানোও তো দরকার মা। নইলে ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তে পারো। তাই বলছিলাম আর কি। তুমি অন্যভাবে নিও না যেন।

আর্যর মা তালে তাল দিল, বলল—তুমি এক কাজ করো না, তোমার ব্যাঙ্কের কাগজপত্র ওর বাবাকে বুঝিয়ে দাও। ওর তো অখণ্ড অবসর। এসব ভালো বোঝে। আমি তো সারাজীবন ওর উপরেই ভরসা করে এসেছি টাকাপয়সা রিলেটেড ব্যাপারে।

ইরা কেটে কেটে বলল—তোমার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না, সংসারের বাইরে কিছু বুঝতে না, সেটা তোমার অক্ষমতা মামনি, আমার নয়। আর মেয়েদের রান্নাটা এমনিতেই আসে, মেয়েরা বৈষয়িক ব্যাপার বোঝে না, এইসব স্টিরিওটাইপ থেকে বেরোও এবার। আগেও বলেছি আবারও বলছি, সংসার খরচ দেওয়ার পর আমার টাকা আমি কতটা ওড়াব, কতটা জমাব সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। পার্সোনাল স্পেসের কনসেপ্টটা একটু বুঝতে শেখো তোমরা। সব ব্যাপারে এত অনধিকার চর্চা ভালো নয়।

গটগট করে বেরিয়ে গেল ইরা। আর্যর মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—এর থেকে কোন অল্পবয়সী ঘরোয়া মেয়ে দেখে বিয়ে দিলেই ভালো হত। এতো দেখছি সবদিক থেকেই লস।

(৫)

আজকাল ইরার অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছাই করেনা। সারা সন্ধ্যে ড্রয়িংরুমে গাঁ গাঁ করে সিরিয়াল চলে। যখন টিভি বন্ধ থাকে, তখন সোফায় বসে তারস্বরে রিল দেখে দুজনে। ইরা ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলে শাশুড়ির গোসা হয়। ঘুমানোর আগে বেডরুমের দরজা বন্ধ করা মানে নাকি বাড়ির বড়দের অপমান করা! চুপচাপ বারান্দায় বসে গান শুনলেও ওদের গাল ফোলে। বাড়ির বউ ওদের সঙ্গে গল্প না করে একা একা বসে থাকবেই বা কেন? সারাদিন হাড়ভাঙা খাটনির পরে ইরার শরীর ভেঙে আসে তখন। তবুও বাড়ি এসে চা জলখাবার বানাতে হয় ওকে। কনকদির হাতের চা আজকাল শ্বশুরমশাইয়ের মুখে রোচেই না নাকি!  

পৃথিবীতে যা কিছু অঘটন ঘটে, সবকিছুর জন্য দুজন দায়ী—নরেন্দ্র মোদী আর ইরা! একদিন পার্টিতে ইরার স্লিভলেস পরা নিয়ে শাশুড়ি অশান্তি বাঁধাল। রান্নাবান্না না পারা নিয়ে টিটকিরি তো লেগেই আছে। সেদিন বডিশপ একটা ফেসক্রিম কিনে কী মনে করে ইরা প্রাইস ট্যাগটা তুলে ব্রান্ডের প্যাকেটটা ফেলে দিয়ে ক্রিমটাকে ভ্যানিটি ব্যাগে পুরল, যেন আগ্নেয়াস্ত্র পাচার করছে! আর্যকে কিছু বললেই ও পাশ কাটায়, কথা ঘুরিয়ে দেয়। নিজের মাকে ফোন করলেও একই ফাটা রেকর্ড বাজতে থাকে—মেয়েদের অনেক কিছু সহ্য করতে হয় রে। কম্প্রোমাইজ ছাড়া কোন সম্পর্ক টেঁকে না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

অফিসের সায়নী বলল—নিজের স্ট্যাটাসের কোন ছেলেকে বিয়ে করলে তোর জীবনটা হয়তো অনেক সহজ হত।

—ব্যাঙ হত। সেই ডাক্তার ছেলেটার মা তো মুখের উপর বলেই দিয়েছিল, বাড়ির বউয়ের এতক্ষণ বাইরে থাকা চলবে না। মেয়েদের জন্য টিচিং প্রফেশনই ঠিক আছে, এইসব। ওদের ‘করা যাবে না’র লিস্ট আরো বড় ছিল রে।

—সেই তুলনায় এখানে তো অনেক বেশী স্বাধীনতা পাচ্ছিস। মেনে নে কী আর করবি!

ইরার মাথাটা গরম হয়ে গেল হঠাৎ। দিনরাত পরিশ্রম করে স্বাবলম্বী হয়েছে, নিজের মেরুদণ্ড শক্ত করেছে এই দিনটার জন্য? আর্যর মা-বাবা ওকে স্বাধীনতা দেওয়ার কে? এভাবে অন্যের হাতের পুতুল হয়ে ইরা বসু বেঁচে থাকতে যাবে কেন?

ইরা ধরা গলায় বলে উঠল—আমি আর পারছি না রে।

(৬)

আর্যর মা চোখ কপালে তুলে ‘বিধবার স্বপ্নে’র মোক্ষদার ঢঙে বলল—হ্যাঁ রে, সকাল সকাল এসব কী নাটক শুরু করলি? সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় নাকি?

ইরা শান্তভাবে ফ্ল্যাটের চাবিটা টেবিলের উপর রেখে বলল—আসি তবে।

আর্যর মা আঁচলটা মুখে চাপা দিয়ে কান্না জুড়ল হঠাৎ—একটা মেয়ে এসে সংসারটা ছারখার করে দিল গো। একটামাত্র ছেলেকে বুড়ো মা-বাবার থেকে আলাদা করে ছাড়ল। কী কুক্ষণে এই মেয়ের সাথে……

ইরা মাঝপথে শাশুড়িকে থামিয়ে দিয়ে বলল—বাগবানগিরি না করে আমার কথাটা আগে ভালো করে শোনো। আমি টালিগঞ্জে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি, যাতে বিপদে আপদে তোমাদের কাছে চলে আসতে পারি। তাছাড়াও আমি আর তোমার ছেলে ঠিক করেছি যে সপ্তাহে দুদিন ও এখানে এসে তোমাদের সঙ্গে থাকবে। আমিও আসব মাঝে মাঝে। আমরা একসাথে খেতে যাব, ট্যুরেও যাব……

ইরার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আর্যর মা বলল—আর বাকিদিনগুলো আমরা ছেলেকে ছাড়া থাকব কী করে, সেটা ভেবে দেখেছিস? স্বার্থপর মেয়ে একটা।

—ঠিক যেভাবে আমার বাবা-মা থাকে! ছেলের বাবা-মা বলে তোমরা কত এক্সট্রা প্রিভিলেজ পাবে বলো তো?

আর্যর বাবা গোলমাল শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। গমগমে গলায় বলল—মাথা গরম করে সিদ্ধান্ত নিলে পরে নিজেকেই পস্তাতে হয়। কত শ্বশুরবাড়িতে মেয়েদের উপর নির্যাতন হয়, তবুও তারা মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। আমরা তো তোমার চাকরিবাকরি কোনকিছুতেই বাধা দিই নি। তাহলে এরকম হঠকারিতা করার মানে কী?

কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পরে ইরা বলল—তোমরা আমার গায়ে হাত তোলো নি, বা আগুনে পুড়িয়ে মারোনি, তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। তোমরা শুধু চেয়েছ আমার অ্যাকাউণ্ট ডিটেলস, আমার সপ্তাহান্তের অবসর। প্রতি মুহূর্তে আমার পার্সোনাল স্পেসে নাক গলিয়েছ, আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছ।

—বাসনকোসনও একসঙ্গে থাকলে ঠোকাঠুকি লাগে, তার জন্য সংসার ভাঙে না কেউ।

—সংসার তো ভাঙছি না। একটু দূরত্ব বাড়াচ্ছি শুধু। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আমি একটু জিরোতে চাই, নিজের পছন্দের ওয়েব সিরিজ দেখতে চাই, হাফ প্যান্ট পরে সারা বাড়িতে হেঁটে বেড়াতে চাই। শনি রবি আমি নিজের পছন্দের বই পড়তে, সিনেমা দেখতে, পার্লারে যেতে, বরের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে চাই। রান্নাঘরে ঢুকে মাছ-মাংসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না। আমার পোশাক, বাবা-মা, বেশী ইংরেজি বলা নিয়ে টিটকিরি শুনতে চাই না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মেয়েরা সংসারের শান্তির জন্য নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গলা টিপে মেরে এসেছে, কিন্তু আমি অত স্বার্থত্যাগী দয়ার সাগর হতে পারব না। নিজেকে ভালো রাখাটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা কেউ ভিলেন নও, কিন্তু এইভাবে একসাথে থাকতে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমার একটু নিজস্ব স্পেস চাই।

পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে আর্যর মা-বাবা।

ইরা শাশুড়ির হাত ধরে বলে—আমি আসছি। তোমার ছেলে স্কুল থেকে এসে তোমাদের সঙ্গে দেখা করে ওখানে চলে যাবে। আপাতত বেশী কিছু নিলাম না। উইকএন্ডে প্যাকার্স অ্যাণ্ড মুভার্স থেকে লোক এসে কটা জিনিস নিয়ে যাবে কেমন?

লাল ট্রলিব্যাগটা নিয়ে গাড়ির চাবিটা ঘোরাতে ঘোরাতে বেরিয়ে যায় ইরা। আর্যর মা-বাবা আগুন চোখে তাকিয়ে থাকে ইরার যাওয়ার দিকে……

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment