পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

উচ্চবর্ণের কোটা সমতার অধিকার ও সামাজিক অগ্রগতির মূলে আঘাত

  • 21 November, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1117 view(s)
  • লিখেছেন : মলয় তেওয়ারী
এসসি-এসটি-ওবিসি কোটা বাতিল করার দাবি আরএসএস বহুদিন ধরেই করে আসছে। ক্ষমতায় কে আছে না আছে সে কথা মাথায় রেখে তারা মাঝে মাঝে এবিষয়ে লুকোচুরি খেলা খেলে। কিন্তু আরএসএস’এর সমস্ত দীর্ঘস্থায়ী এজেণ্ডা বাস্তবায়নে একের পর পদক্ষেপ নিয়ে চলে ক্ষমতাসীন বিজেপি।

 

গত লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি সরকার সংবিধানের সমতার অধিকারের ধারাগুলিতে নতুন দু’টি ধারা যুক্ত করে সংরক্ষণ ব্যবস্থায় বদল আনে। এ’বছর নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ এই সংবিধান পরিবর্তনকে বৈধতা দিল। এসসি, এসটি এবং ওবিসি ছাড়া বাকি সকল অংশের, অর্থাৎ তথাকথিত উচ্চবর্ণের, যারা আর্থিকভাবে দুর্বল তাদের জন্য শিক্ষা ও চাকুরিতে ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে। ভারতের সংবিধানে সমতার যে ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল তার ওপর এবং সামাজিক ন্যায় আন্দোলনের ওপর এ এক বড় আঘাত। শিক্ষাগতভাবে ও সামাজিকভাবে অনগ্রসর জাতি, জনজাতি ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর জন্য গোষ্ঠীগত সম সুযোগ তৈরি করার ধারণাকে উল্টে দেওয়া হল।

এসসি-এসটি-ওবিসি কোটা বাতিল করার দাবি আরএসএস বহুদিন ধরেই করে আসছে। ক্ষমতায় কে আছে না আছে সে কথা মাথায় রেখে তারা মাঝে মাঝে এবিষয়ে লুকোচুরি খেলা খেলে। আর তার মাঝেই আরএসএস’এর সমস্ত দীর্ঘস্থায়ী এজেণ্ডা বাস্তবায়নে একের পর পদক্ষেপ নিয়ে চলে ক্ষমতাসীন বিজেপি। প্রথমবার পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতার সময়ে তারা নাগরিকত্ব প্রশ্নে সংবিধান সংশোধনী এনে বাংলাদেশ থেকে একাত্তরের পর আসা সমস্ত শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব নাকচ করে দিয়েছিল যা বাংলা ও আসামের বিপুল সংখ্যক নমশুদ্রকে বিপন্ন করে তোলে। মোদি ক্ষমতায় আসার পরে প্রথমেই বিচারক নিয়োগের সাংবিধানিক ব্যবস্থাপনাকে বদলে দিতে সংবিধান সংশোধনী আনে। সুপ্রিম কোর্ট সেটা খারিজ করে দিয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বিচার বিভাগের বড় অংশকে তারা ভেতর থেকে কুক্ষিগত করেছে। একের পর এক রায়ে বিচারবিভাগকে বিজেপি-সরকারের রাবার স্ট্যাম্পে পর্যবসিত হতে দেখা যাচ্ছে। আর অনগ্রসর গোষ্ঠীর  সংরক্ষণের বিরুদ্ধে তো সবচেয়ে ধারাবাহিক আক্রমণ এসেছে একদিকে দেশের অগ্রসর জাতগুলির উচ্চশিক্ষিত অংশ থেকে ও অন্যদিকে আদালতের মাধ্যমে। দুই দফায় বড় বড় আন্দোলন বা অহরহ কোটাকে বিদ্রুপ ও বিষোদ্গার তো আছেই, সমস্ত ধরণের প্রতিষ্ঠানেই উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত উচ্চশিক্ষিত উচ্চবর্ণরা সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার নানাবিধ কায়দা মনযোগ সহকারে অনুশীলন করে থাকে; আর, সংবিধানে সমতার অধিকার গ্রহণের সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত
এসসি-এসটি-ওবিসিদের সংরক্ষণ লাগু হওয়ার প্রতিটি পদে পদে আদালতের বাধা টপকাতে হয়েছে। বর্তমান রায়ে সংখ্যাগুরু বিচারকেরা উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণকে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে সুপ্রিম কোর্টের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করতেও দ্বিধা করেন নি এবং শুধু সেখানেই থেমে না থেকে এসসি-এসটি-ওবিসি কোটা খতম করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রয়োজনের কথাও উল্লেখ করেছেন।

সংবিধানের প্রস্তাবনায় “মর্যাদা ও সুযোগের সমতা ও উন্নীতকরণ” অন্যতম প্রধান দিশা হিসেবে গৃহীত হয়। “সাম্যতার অধিকার” ধারাগুলি বর্ণনা করা হয়েছে ভারতীয় সমাজে যুগযুগ ধরে চলে আসা জাতভিত্তিক সামাজিক বৈষম্যের কাঠামোটিকে দুর্বল ও বিলুপ্ত করার লক্ষ্যে। জাতবর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের পরিচিতির ভিত্তিতে সমাজে যে “অযোগ্যতা, দায়বদ্ধতা, নিষেধ অথবা শর্ত” চাপানো আছে সেই অসাম্যকে রাষ্ট্র ও সমাজ উভয় পরিসরেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে অনগ্রসর অংশের উন্নতিসাধনের জন্য আইন প্রণয়ন, কমিশন গঠন করে তালিকা তৈরি করা ও তাদের দাবিগুলিকে মান্যতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে সংবিধানে। সাম্যতার এই অধিকার প্রতিষ্ঠার দিশাতে প্রথমে এসসি ও এসটিদের জন্য এবং পরবর্তীতে ওবিসিদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয়। অগ্রসর জাতিগুলির(উচ্চবর্ণ) জন্য সংরক্ষণের নয়া বিধান সংবিধানের মৌলিক দিশাকে আবার পশ্চাদমুখী করে দিল। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের যে দুজন বিচারপতি এই বিধানকে মান্যতা দেওয়ার রায়ে মতবিরোধ ব্যক্ত করেছেন তাঁরাও একে “সামাজিক ন্যায়ের বুনটের অবমূল্যায়ন” হিসেবে চিহ্নিত করে “সাম্যতা বিধির, বিশেষত বৈষম্য না করার নীতির, অবমূল্যায়ন ও ধ্বংসসাধন” বলে অভিহিত করেছেন।

আধুনিক রাজনৈতিক পরিসরে প্রথম মহাত্মা জোতিরাও ফুলের আন্দোলনের ফলে শিক্ষার সুযোগে সমতার লক্ষ্যে দলিত শ্রেণিগুলির (ডিপ্রেসড ক্লাসেস) জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গৃহিত হয়। ব্রিটিশ সরকার কিছু বিশেষ স্কুল, বৃত্তি ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা চালু করে। বরোদা, কোলাপুর ও ত্রবাঙ্কুরের মত দেশীয় রাজ্যেও অনুরূপ ব্যবস্থা চালু হয়। সেই সময়কার এই ব্যবস্থাপনার উপভোক্তাদের অন্যতম হলেন ডক্টর ভীমরাও আম্বেদকর। এই সুযোগের ফলে শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে দলিত শ্রেণীর মধ্যে শিক্ষা, চাকরি ও আত্মমর্যাদার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এবং পরের ধাপে সরকারি চাকরিতে দলিত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তির দাবি ওঠে। চাকুরিক্ষেত্রে ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব আইন’ প্রণয়ন হয়। ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার নেতৃত্বে রাজবংশী অস্মিতার আন্দোলনও সুযোগের সাম্যতার অধিকারের ধারায় সামিল হয়। গুরুচাঁদ ঠাকুর ও পঞ্চানন বর্মার আন্দোলনের পথ বেয়ে, তাঁদের দুই উত্তরসূরী যথাক্রমে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ও নগেন্দ্র নারায়ন রায়ের সুদৃঢ় উদ্যোগে, মূলধারার রাজনৈতিক নেতাদের বাধা অতিক্রম করে, সংবিধানসভায় ডক্টর আম্বেদকরের আসন নিশ্চিত হয়েছিল। এক দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল হিসেবেই ভারতের সংবিধানে সুযোগের সমতার অধিকার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এই অন্তর্ভুক্তি ছিল বৈপ্লবিক কারণ তা যুগযুগ ধরে শিক্ষা, কাজ, সম্পত্তি, সুবিচার ও ক্ষমতাকে মুষ্টিমেয় উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষিত রাখার ধারাকে উল্টে দিয়েছিল।

সংবিধানে গৃহিত সমতার এই দিশাকে বদলে দেওয়াটা আরএসএস-বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্র এজেন্ডা বাস্তবায়নের মূল কাজ হিসেবে রয়েছে- নাগরিকত্বে সমতা ধ্বংস করতে ধর্মের ভিত্তিতে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) আনা এবং সমাজে সুযোগের সমতার অগ্রগতি থামিয়ে দিতে সংরক্ষণের ভিত্তিকে উল্টে দেওয়া। সংবিধান রচনা ও গ্রহণের সময়েই আরএসএস স্বাধীন ভারতের সংবিধানকে বিরোধ করেছিল এবং মনুস্মৃতিকে সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত বিধান বলে অভিহিত করে ঘোষণা করেছিল যে তাদের স্বপ্নের হিন্দুরাষ্ট্রের সংবিধান হবে ‘মনুস্মৃতি’। মনুসংবিধানে শুদ্রদের শিক্ষা, কাজ, সম্পত্তি ও সুবিচার পাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। উচ্চবর্ণের আধিপত্য খর্ব করে কোনও শুদ্র মাথা তুলতে চাইলে কি কি শাস্তি হবে তার বিধান পয়েন্ট বাই পয়েন্ট লেখা আছে মনুস্মৃতিতে। মনুস্মৃতির দণ্ডবিধিতে বৃক্ষচ্ছেদন অপরাধেরও শাস্তি ঘোষণা করা আছে, কিন্তু বিধান দেওয়া আছে ব্রাহ্মণ শুদ্রকে হত্যা করলেও কোন শাস্তি হবেনা। শুদ্রের একমাত্র বৈধ কাজ হবে কায়মনবাক্যে উচ্চবর্ণের সেবা করা। ভারতের সংবিধানে সাম্যতার অধিকার প্রতিষ্ঠায় এইসব “অযোগ্যতা, দায়বদ্ধতা, নিষেধ অথবা শর্ত”-কেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এবং সাভারকার যখন বলেন, "আজও কোটি কোটি হিন্দুর জীবন ও অনুশীলনের নিয়মনীতির মূল ভিত্তি মনুস্মৃতি। মনুস্মৃতিই হিন্দু আইন", তখন তিনি সেই সত‍্যই প্রকাশ করে দেন যা আমরা রোহিত বেমুলা থেকে ইন্দ্র মেঘওয়াল বা চুনি কোটাল থেকে পায়েল তড়ভির মত অসংখ‍্য জীবনের বাস্তবতা হিসেবে আজও দেখছি। আরএসএস যখন বলে যে মনুস্মৃতি পৃথিবীর সর্বত্র প্রশংসিত তখন কার প্রশংসার কথা বলে তারা? তারা আসলে নিৎসের কথা বলে। বাবাসাহেব আম্বেদকর দেখিয়েছেন জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি মতাদর্শের আকর হিসেবে দার্শনিক নিৎসের রচনা মনুস্মৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে রচিত। সেই সময়ে দাঁড়িয়েই মনুবাদ ও ফ্যাসিবাদের সম্পর্ক চিহ্নিত করে গেছেন আম্বেদকর। ভারতের সংবিধান, গণতন্ত্র ও সামাজিক অগ্রগতি এই গভীর ফ্যাসিবাদী আক্রমণে বিপন্ন।

0 Comments

Post Comment