পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অতিমারির শাব্দিক ও পৌরাণিক সন্ধান

  • 05 April, 2020
  • 1 Comment(s)
  • 11479 view(s)
  • লিখেছেন : শামিম আহমেদ
অতিমারী, মহামারী, মড়ক, মারী কত নামই যে হয় এই সব ভয়াল সংক্রমণের! নামগুলো এমন কেন? সব কি মরণের ইঙ্গিত? শব্দ বিশ্লেষণে কী উঠে আসে? পৌরাণিক আমলেও কি এমন ভয়াল ছোঁয়াচে রোগ ছিল? মহামারী বা অতিমারী নিয়ে প্রাচীন সাহিত্য কী বলে?

‘মারি’ বা ‘মরক’ শব্দটি নতুন নয়। তার সঙ্গে বিভিন্ন উপসর্গ যোগ করে ‘অতিমারি’, ‘মহামারি’, ‘মহামারী’ প্রভৃতি শব্দ তৈরি হয়েছে। ‘অতি’ ও ‘মহা’ উপসর্গ দুটির মধ্যে বড় একটা ফারাক নেই। ‘মরক’ বা ‘মড়ক’ শব্দের ধাতু হল ‘মৃ’, যার অর্থ মরণ। মড়কের কথা বিষ্ণুপুরাণে আছে, আছে বৃহৎসংহিতায়। মহাকাব্যেও এর নানা বর্ণনা পাওয়া যায়।

ইদানীং কালে যে কোরোনার প্রাদুর্ভাব, সেই রোগজীবাণুর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল সেই ১৯৬০ সালে। মুরগির মধ্যে। কিন্তু কোভিড ১৯ সাম্প্রতিক সময়ের। রোগজীবাণু কালে কালে তার রূপ পালটায়। যেমন রূপ পালটায় প্রকৃতি। আগে ফসলের নানা বৈচিত্র্য ছিল, জীবজগতের বৈশিষ্ট্যও তার উপরে নির্ভর করত। কিন্তু এখন মাঠের পর মাঠ, একই হাইব্রিড বীজ থেকে একই ফসল ফলে, একই উপায়ে; ঠিক যেন সব পোলট্রির মুরগি। এই রকম অশৈলী কাণ্ড এখন সর্বত্র। বড় বড় পণ্ডিত বা দক্ষদের তাই খুব রমরমা। তাঁরা শুধু মুনাফা খোঁজে। এমন কঠোর বিকল্পে সত্যিই কোনও পরিশ্রম নেই। এ মতো অবস্থায় নানা প্রকারের ব্যাধি এসে যে উপস্থিত হবে, তা বলা বাহুল্য মাত্র।

অভিধানে অতিমারি বা মহামারি বোঝাতে আর একটি শব্দের ব্যবহার আছে, সেটি হল ‘মহামার’। বিধাতার মহামার কিনা তা জানা নেই, তবে তার অর্থ হল মহাদৌরাত্মকারী। মনসামঙ্গলে আছে, “মোর দেশে পরদল আইল মহামার।” কবিকঙ্কণ-চণ্ডীতে উল্লিখিত হয়েছে, “সভে বলে দক্ষযজ্ঞে হৈল মহামার।” দক্ষ বা নিপুণদের যজ্ঞে শিব অর্থাৎ প্রযতি (impulse) কী কাণ্ড ঘটিয়েছেলেন সে কথা সকলেরই জানা। শেষমেশ দক্ষের কর্তিত মাথায় ব্রহ্মার অনুরোধক্রমে শিব ছাগমুণ্ড বসিয়ে দেন। এখন মনোযোগের ক্ষেত্র হল সতী বা প্রকৃতির পুনর্জীবন। ছাগমুণ্ড দক্ষ বা পণ্ডিতরা যদি প্রকৃতি কিংবা সতীর ভার নেন, তাহলে কবিকঙ্কণ-চণ্ডীকে স্মরণে আনতে হয়। শরণ নিতে হয় দক্ষ-পরিবর্তের। নইলে জীবকুল রক্ষা পায় না। সেই জন্য বোধ হয় চৈতন্যভাগবতে আছে, “(জীব) মুঞি করোঁ বোলোঁ বলি পায় মহামার।”

অতিমারি বা মহামারি এসে গ্রামের উপর গ্রাম উজাড় করে নিয়ে যায়, জনপদ খাঁ খাঁ করতে থাকে। কিন্তু যাঁরা বেঁচে যান তাঁদের পরবর্তী জীবন হয়ে পড়ে দুঃসহ। তখন জীবনের চেয়ে জীবিকা তাঁদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময় অরাজক দেশে পরস্পরের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ শুরু হয়। মাৎস্য-ন্যায় প্রবল হতে থাকে। এমন দেশে ভয়ে ভয়ে কাল কাটাতে হয়, সে কথা বলেছিলেন শমীক মুনি। মহাভারতে তিনি তাঁর পুত্র শৃঙ্গীকে শুনিয়েছেন ওই সব কথা। তখন দরকার হয় শাসকের সাম, দান প্রভৃতি নীতির, যদি সেই শাসক হন শিব, দক্ষ বা ছাগমুণ্ড নন।

‘মহামারী’ শব্দের তিনটি অর্থ বলেছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষে। এক, মহামারাত্মক রোগ, সংক্রামক রোগ। দুই, অতিশয় মরক এবং তিন, কালী। এই যে তৃতীয় অর্থ তা আমাদের ভাবায়। এই ‘কালী’ শব্দটি এসেছে ‘কাল’ থেকে—কাল মৎ অস্ত্যর্থে; স্ত্রী –লা, -লী। কালকে আমরা ঘড়ি এবং ক্যালেন্ডার দেখে বুঝি, সে কিন্তু সময় নয়। যদি পারমার্থিক জায়গা থেকে কালকে বুঝতে হয়, তাহলে তার কুলকিনারা পাওয়া যায় না। ফলে কালীর স্বরূপ নির্ণয় সাধন, সে বড় অসম্ভব ব্যাপার। তার চেয়ে বরং রামায়ণে প্রবেশ করে দেখা যাক সেখানে অতিমারী বা মহামারী নিয়ে কী বলা আছে? মহামারী-উত্তর পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া হয়েছে?

সীতার জন্মের প্রেক্ষাপটে আছে মহামারী। মিথিলা রাজ্যে অকাল মহামারীতে দেশ প্রায় উজাড়। খাঁ খাঁ করছে এক সময়ের সমৃদ্ধিশালী রাজ্য। এখানে ওখানে মৃতদেহ পড়ে আছে। চাষ আবাদ নেই। কে লাঙল দেবে? রাজা তো অস্ত্র ধারণ করেন, তাঁর পরিচয় হল তিনি দণ্ডনীতির দণ্ডমুণ্ডকর্তা। রাজা জনক দার্শনিক মানুষ, সাংখ্য-যোগ নিয়ে থাকেন। তিনি কোনও সমাধান খুঁজে না পেয়ে চলে গেলেন কুলগুরু শতানন্দের কাছে। শতানন্দ তাঁকে উপদেশ দিলেন, তুমি লক্ষ্মীর উপাসনা করো।

লক্ষ্মী কিন্তু অর্থের বা সম্পদের দেবী নন, তিনি সমৃদ্ধির দেবী। অর্থ-সম্পদ আর সমৃদ্ধি এক কথা নয়। সম্পদের দেবতা হলেন কুবের। ধোপা বা কুম্ভকারের বাহন যেমন গাধা, তেমনি কুবেরের বাহন হল মানুষ। সে গাধার মতোই মানুষকে দিয়ে সম্পদ বহন করায়, যে সম্পদের উপর গাধা, থুড়ি, মানুষের কোনও অধিকার নেই। লক্ষ্মী তা নন, তিনি মানুষকে সমৃদ্ধি দান করেন। শস্যের, ক্ষুধা নিবারণের, শান্তির আশ্রয়ের।

রাজর্ষি জনক লক্ষ্মীর আরাধনা করতে লাগলেন। যে সব মানুষের জীবন আছে, অতিমারীতে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের জীবিকা কী হবে? এই আকুল প্রশ্নে দেবী লক্ষ্মী সাড়া দিলেন। তিনি বললেন, হে পিতা! আপনার রাজকোষ উজাড় করে আপনি নিজ হাতে লাঙল ধরুন। নিজের শ্রমে চাষ করুন, ফসল ফলান। যে রাজা প্রজার শ্রমে অংশীদার হন না তিনি কীসের রাজা! আপনি হল কর্ষণ করুন, শুধু সাংখ্য আর যোগ-চর্চা নয়। আপনার প্রজারা আবার সুখে সমৃদ্ধিতে রাজ্য আলোকিত করবে।

রাজা জনক হলকর্ষণ করেই পেয়েছিলেন লক্ষ্মীকে, যাঁকে আমরা সীতা বলে জানি।

রাম তখন বালক।

1 Comments

sujata mukherjee

01 September, 2023

Enriching article But references are needed mentioning full names of books, essays used, page numbers, names and places of publishers and publication, editions.

Post Comment