পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নির্বাচনে ‘পরিবেশ’

  • 05 March, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1832 view(s)
  • লিখেছেন : মধুরিমা বক্সী
মানুষের দৈনন্দিন জীবনচর্যা থেকে উঠে আসা পরিবেশ সংক্রান্ত দাবিসনদকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে আরও আলোচনা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শক্তিশালী করে ছড়িয়ে দেওয়া ও তার পাশাপাশি বাস্তবের মাটিতে জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সম্পদ, মানব সম্পদ তথা পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ে ভাগীদার হয়ে ‘আন্দোলনজীবী’ হয়ে উঠতে পারলে আখেরে লাভ কিন্তু আমাদেরই। এটাই হোক একুশের ডাক, এটাই হোক অঙ্গীকার।

টিভির রিমোট ঘোরালেই বোঝা যাচ্ছে বাংলায় নির্বাচন আসন্ন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাংলা খবরের চ্যানেল ‘ঘণ্টা খানেক’, ‘যুক্তি তক্কো’ আর ‘প্রাইম টাইম’ এর প্যানেল ডিসকাশনের হইহট্টগোলে সরগরম। কান পাতলেই ভেসে আসবে ‘দলবদল’ আর ‘পালাবদল’-এর মত কিছু চেনা শব্দবন্ধ। কয়েকদিন পরপর এরকম কিছু চ্যানেল দেখলেই বোঝা যাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা সব জায়গায় হয়ে চলেছে। তর্ক বিতর্ক কিসের উপর হবে তাও মোটামুটি ঠিক করে দেওয়া। এই মুহূর্তে দেশে এমন একটা সময় যখন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের বেশিটাই ঘৃণা আর বিভাজনের বেসাতি করা একটি রাজনৈতিক দলের পকেটে, আর সেই গণমাধ্যম ব্যবহার করে মানুষকে ঠিক কি কি দেখানো হবে সেটাও মোটামুটি ছকে দেওয়া। নির্বাচনের প্রাক্কালেও তাই খবরের নামে দেখানো হবে তরজা, মিথ্যা খবর প্রচার করে চলবে হিংসা ও বিভাজনের রাজনীতি; আর পিছনে থেকে যাবে মানুষের কথা, মানুষের দাবি, বেঁচে থাকার বুনিয়াদী প্রয়োজনের কথা। অথচ নির্বাচন তো হওয়া উচিত মানুষের এজেন্ডায়। ধর্ম বর্ণ শ্রেণী নির্বিশেষে মানুষের দাবি দাওয়ার কথা নিয়েই তো আলোচনা হওয়ার কথা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, গণতন্ত্রর দাবি; সুস্থ ভাবে সকলে মিলে বেঁচে থাকার, খোলা হাওয়ায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া ও শুদ্ধ পানীয় জলের অধিকার, এই সবই তো জনগণের মৌলিক চাহিদা। এদিকে নির্বাচনের বিতর্ক আর বক্তৃতার ডামাডোলে এগুলোই হাওয়া।

ব্রাত্য পরিবেশ

পরিবেশের প্রশ্নে আশ্চর্য ভাবে নীরব দেশের বেশীরভাগ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। এদিকে কিন্তু সংবিধানের ধারা ২১, ৪৮এ, ৫১এ(জি) ইত্যাদিতে দূষণহীন পরিবেশের অধিকার, পরিবেশ রক্ষায় রাষ্ট্র ও নাগরিকদের দায়িত্বের কথা পরিষ্কার ভাবে বলা আছে। পরিবেশের বিষয়ে এই উপেক্ষা, অনাগ্রহ তথা অসচেতনতার এক অন্যতম কারণ এখনো পর্যন্ত নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে পরিবেশের প্রশ্নকে একটি বিচ্ছিন্ন বিষয় হিসেবে দেখা। পৃথিবী জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও গৃহহীন মানুষদের জন্য ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’ নামের এক নতুন শব্দবন্ধই তৈরি হয়েছে। আমেরিকার ট্রাম্প সরকার ক্ষমতায় এসেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়, আর বিডেন এসেই ঘোষণা করে আমেরিকা প্যারিস চুক্তিতে আবার সামিল। এই খামখেয়ালিপনার মধ্যে কার্বন নিঃসরণ আর পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ক্রমেই বেড়ে চলে; বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই যার ভুক্তভোগী হতে হয় সেই প্রান্তিক মানুষদের যাদের ভূমিকা এই বিপর্যয় ঘটার পিছনে সবথেকে কম। পরিবেশের নীতি প্রণয়ন তাই সমাজের আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতই ভীষণ ভাবে রাজনৈতিক। ব্যক্তিগত উদ্যোগ, বৃক্ষরোপণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ; কিন্তু রাষ্ট্রের সদিচ্ছা ও পরিবেশবান্ধব নীতি প্রণয়ন আরও বেশী জরুরী। কৃষকবিরোধী কৃষি নীতি প্রণয়ন করে যারা কৃষিতে কর্পোরেট রাজ কায়েম করে, তাদের নীতির ফলেই কর্পোরেট স্বার্থে জল জমি জঙ্গলের সুরক্ষার প্রশ্ন জলাঞ্জলি দেওয়া হয়। প্রাকৃতিক সম্পদের উপর কর্পোরেট লুঠের ছাড়পত্র দিতে আর ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য পরিবেশ আইন শিথিল করে দেওয়া হয়, আর অন্য দিকে পরিবেশ সম্পৃক্ত জনজাতির অধিকার কেড়ে নিতে আইনের ফাঁকে আনা হয় হরেক রদবদল। ইতিমধ্যেই দেশের একচল্লিশটি কয়লা ভাণ্ডার নিলামে উঠেছে, সিস্টেমেটিক ভাবে বিভিন্ন সরকারী বিজ্ঞপ্তি জারি করে অরণ্যের অধিকার আইন খর্ব করে আদিবাসীদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বাজার ও মুনাফাকেন্দ্রিক এই তথাকথিত উন্নয়নের মডেল মানবসভ্যতা তথা পরিবেশের জন্য নিয়ে এসছে এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ। বিগত দশকগুলিতে হিমালয় জুড়ে একের পর এক বাঁধ প্রকল্প, নদীর স্বাভাবিক গতি রোধের চেষ্টা, চিরাচরিত (conventional) শক্তির উপর মাত্রাধিক নির্ভরশীলতা, বৃহৎ শিল্পে প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ ব্যবহার, মানবকেন্দ্রিক পরিকল্পনা ইত্যাদি নানান কারণে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতা, দূষণ ও পরিবেশের ক্ষয় আজ ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। দুর্ভাগ্যবশত, পরিবেশ বিপর্যয় আসার পরে পাল্লা দিয়ে ত্রাণ দেওয়ার প্রতিযোগিতা ও ত্রাণ দুর্নীতি এই নিয়ে সংবাদমাধ্যম বা পাড়ার আড্ডায় যত আলোচনা হয় তার সিকি ভাগও হবে না এর পিছনে দায়ী নীতি বা তার কার্যকরী বিকল্প সমাধান নিয়ে।

আজ সময় এসেছে পরিবেশ রক্ষা ও মুক্ত খোলা পরিবেশের অধিকারকে দৈনন্দিন ও বুনিয়াদী দাবির অংশ করে তোলার, জনতার দাবিসনদের অংশ করে তোলার, সরকারকে দায়বদ্ধ করার। প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের শোষণের বিরুদ্ধে একযোগে জনমত গড়ে তোলার।

২০২১ বিধানসভা নির্বাচনঃ একুশের ডাক মানুষের দাবি

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যে কর্পোরেট ফ্যাসিস্টদের সার্বিক ভাবে মোকাবিলা করতে গেলে তাদের পরিবেশ বিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াটাও তাই সমান ভাবে জরুরী। পশ্চিমবঙ্গের সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যাপক অংশের মানুষের সাথে আলোচনা করে নাগরিক উদ্যোগে ‘একুশের ডাক মানুষের দাবি’ শিরোনামে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গের জনগণের দাবিসনদ ২০২১ এর মধ্যে একগুচ্ছ পরিবেশের দাবিকে সুত্রায়িত করা হয়েছে। যদিও পরিবেশের প্রশ্নকে দেশ বা রাজ্যের সীমারেখার মধ্যে বেঁধে ফেলা যায় না, তবু আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে যদি এই দাবিগুলিকে প্রকৃত অর্থেই সামনে তুলে আনতে পারা যায় তবে নিঃসন্দেহে তা আগামীতে দেশের অন্যান্য নির্বাচনের জন্য পথপ্রদর্শক হতে পারে।

একুশের ডাকে আওয়াজ উঠছে এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট (EIA) প্রক্রিয়াকে শিথিল করে দিয়ে পরিবেশগত আইন লঘু করার উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা EIA খসড়া বিজ্ঞপ্তি, ২০২০ বাতিল করতে হবে। সামাজিক ও জীববৈচিত্র্যসহ বাস্তুতন্ত্রের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব বিশ্লেষণ না করে কোনও নির্মাণকার্য করা যাবে না। রাজ্যের সমস্ত জলাভূমির বৈজ্ঞানিক ম্যাপিং করে রক্ষণাবেক্ষণ সুনিশ্চিত করতে হবে। পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ও সুন্দরবন উপকূলের মত সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্রের বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। বৃহৎ কোম্পানি নির্ভর চাষের চাষের পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে দেশীয় বীজ-বৈচিত্র্য বিকাশ, নদী ক্যানেল ও জলাধারগুলির পূর্ণাঙ্গ সংস্কার সাধন করে ভূপৃষ্ঠ সেচের উন্নয়ন ও প্রসারে সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার দাবি আছে। আর্সেনিক রোধে কৃষিতে ভূপৃষ্ঠ সেচ ব্যবস্থার বিকাশ, কীটনাশকের সুদূরপ্রসারী সমস্যা থেকে মুক্ত হতে কৃষিকে ধীরে ধীরে কর্পোরেট পদ্ধতি থেকে সরিয়ে আনতে হবে। খাস বেনামী জমি উদ্ধার, বাস্তুহীনদের বাস্তুজমি ও জমির পাট্টা প্রদান সর্বোপরি প্রয়োজন ল্যান্ড ব্যাংকের তথ্য সর্বসমক্ষে আনার কথা তুলেছে জনতার দাবিসনদ। দেশের ‘বনাধিকার আইন, ২০০৬’ কে ক্রমাগত লঘু করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। এই আইন সার্বিকভাবে লাগু করে বনের গ্রামবাসীদের অধিকার সুনিশ্চিত করা, প্রয়োজন আদিবাসী তথা চিরাচরিত বনগ্রামবাসীদের প্রথাগত জ্ঞানভাণ্ডারের সংরক্ষণ ও আধুনিক ব্যবহারের লক্ষ্যে বিশেষ প্রকল্প/একাডেমি গঠন। পরিবেশ বিনষ্টকারী সেবক-রংপো রেলওয়ে, পুরুলিয়ার ঠুরগা প্রকল্প সহ দেউচা-পাচামি-হরিনসিঙ্ঘা কয়লা খনি প্রকল্প থেকে সরে এসে বিকল্প শক্তির উপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অবিরল নির্মল নদীপ্রবাহকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমস্ত শহর, কলকারখানার বর্জ্য, রাসায়নিক কীটনাশক মিশ্রিত চাষের জল নদীতে নিষ্কাশন বন্ধ করে; নদী তীরবর্তী সকল অঞ্চলের ভূমিক্ষয় ও ধ্বংসকরণ বন্ধ করতে সক্রিয় নীতি প্রণয়ন করার দাবি উঠেছে। নদীবক্ষ থেকে বালি তোলার কাজ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করতে উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, পাথর খাদান ও ক্রাশারগুলোতে কঠোরভাবে পরিবেশবিধি লাগু করতে জোর দিয়েছে এই দাবিসনদ। বড় শহরে প্রাইভেট কার/অটোমোবাইল গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত করে সাইকেল ব্যবহারকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা আশু প্রয়োজন। নদীভাঙ্গনে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন প্রশ্নে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ জাতীয় নীতি ঘোষণার জন্য বিধানসভায় রেজোলিউশন পাস করতে হবে। ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ বা ‘সংরক্ষিত জলাশয়’-এর নামে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠির অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না। ‘সাগরপাড় নিয়ন্ত্রণ এলাকা নির্দেশিকা (সি আর জেড) ২০১৮’ বাতিল করে ‘সাগরপাড় সুরক্ষা এলাকা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে যা সমুদ্র উপকূলের স্বাভাবিক বাসিন্দা তথা মৎস্যজীবীদের চিরাচরিত অধিকার স্বীকার করে সমুদ্রতট সুরক্ষিত রাখবে। ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা ভুপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক জলসম্পদের সবচেয়ে বড় দায়ভাগী ও স্বাভাবিক রক্ষাকর্তা।

মানুষের দৈনন্দিন জীবনচর্যা থেকে উঠে আসা এই দাবিসনদকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে আরও আলোচনা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শক্তিশালী করে ছড়িয়ে দেওয়া ও তার পাশাপাশি বাস্তবের মাটিতে জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সম্পদ, মানব সম্পদ তথা পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ে ভাগীদার হয়ে ‘আন্দোলনজীবী’ হয়ে উঠতে পারলে আখেরে লাভ কিন্তু আমাদেরই।


0 Comments

Post Comment