মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে গিয়ে এক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। হোয়াইট হাউজে। যা ব্যর্থ হয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আমেরিকার এটর্নি জেনারেল জানিয়েছিলেন যে তিনি হোয়াইট হাউজ ছাড়ার সময় বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ নথি নিয়ে চলে গেছেন। তা সত্ত্বেও তার টিকি পর্যন্ত ছোঁওয়া হয়নি। শুধুই তাঁর বাড়ি থেকে যতগুলো সম্ভব ফাইল উদ্ধার করে আনা হয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের এই ধরনের সম্মান যে কোনো গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত। ইংল্যান্ডে সদ্য যাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল সেই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কথাও আমরা জানি। তাঁকে সরে যেতে হলো, কিন্তু তার বেশী কিছু হয়নি। পার্টি তাঁকে সরিয়ে দিয়েছে। বুর্জোয়া গণতন্ত্রে দেখা যায় যদি কখনো জনপ্রতিনিধিকে গ্রেপ্তার করাও হয়, যা মোটেই সহজ নয়, তবুও যাতে তিনি সংসদে উপস্থিত হতে পারেন তা নিয়ে কোনো নিষেধ থাকে না। যতক্ষণ না সংসদ তাঁকে রেহাই দিচ্ছে তাঁকে ইচ্ছেমতো গ্রেপ্তার করা যায় না। কিন্তু এফবিআই যে কিছুটা হলেও ট্রাম্পকে হেনস্থা করেছে সেটা নিয়েও ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠে গেছে সেই দেশে। আমরা ভারতের বাসিন্দারা এতদিন গর্ব করতাম যে অভ্যন্তরীন গণতন্ত্রে আমরা অন্তত আমেরিকা-ইয়োরোপকে টক্কর দিতে পারি। এদেশেও এতকাল জনপ্রতিনিধিদের সম্মান বিরাট ছিল। আমলা, পুলিশ বা সামরিক বাহিনী নয়, আমাদের দেশে শেষ কথা বলেন নির্বাচিতরাই। অন্যদিকে পাকিস্তানে ইমরান খান যখন সরে গেলেন, আশা হচ্ছিল এবার দুর্নীতির বা খুনের অভিযোগ তুলে রাষ্ট্রপ্রধানকে গ্রেপ্তার করার চিরচারিত অভ্যেসে বুঝি বা ছেদ পড়লো। সেদেশে মিলিটারিই দেশ চালায়। ভোট, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী--- নিছকই কলের পুতুল। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে ইমরান খানও গ্রেপ্তারের মুখে দাঁড়িয়ে।
আর আজ ভারতের পরিস্থিতি নিদারুণ। যখন তখন মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদদের গ্রেপ্তার করে নেওয়া হচ্ছে। সবই দুর্নীতির অভিযোগে। শুধু একটা দল বাদ দিয়ে। ২০১৪ সালে ইডি রামদেবের ব্যবসার এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বালকৃষ্ণের উপর থেকে মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আম্বানি প্রায় ৭০০ কোটি টাকার গম কারাবারের বরাত পেলেন, বিজেপির কোন মন্ত্রী ঘুষ পেয়েছে--- কোনো তদন্ত দেখা যায় না।কখনো আরজেডির চারজন, পরক্ষণেই শিবসেনার দু জন। একদিকে আপের দুজন তো অন্য দিকে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী। পার্থ চ্যাটার্জী, আবার নীতিশ কুমারের দলের কেউ। কখনো সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, আবার কখনো কেরালার বিজয়ন মন্ত্রী সভার এক প্রাক্তন মন্ত্রী। ভারতে এখনোও মিলিটারিকে ফ্যাসিস্টরা পুরোটা কব্জা করতে পারেনি, কিন্তু ছড়ি ঘোরাচ্ছে সিবিআই আর ইডি। ইডি রাতের অন্ধকারে পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়ছে চিদাম্বরমের বাড়িতে। সোনিয়া গান্ধীকে তলব করে ১০ ঘন্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ফ্যাসিস্ট অভ্যুত্থানের সমস্ত প্রাক-শর্ত প্রস্তুত, দেশলাই কাঠি জ্বালানোটাই যা বাকি। ২০২৪ সালের আগে বিজেপি সেই উদ্দেশ্যেই এক বিরাট পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছে। কারণ তার সামনে এখন দুই রকম বিপদ।
এক, ২০১৯ সালের সেই তথাকথিত ধর্মীয় উন্মাদনা নেই। বিজেপি তথাকথিত হিন্দুত্বের রসায়নের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারবে না। সীমান্তে যুদ্ধের উপরও নয়। সীমান্তে চীন উপস্থিত, কতটা ভেতরে সে ঢুকেছে তা নিয়ে রাহুল গান্ধী প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। ফলে পুরোনো অস্ত্রগুলো অনেকটাই ভোঁতা। অথচ আসনের পরিস্থিতিও সুবিধার নয়। কেরালা, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, ওড়িশা, তামিল নাডু, পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাব, এই রাজ্যগুলির ১৭৮ টি লোকসভা আসনে বিজেপি বড়জোর ১৫টি আসন পাবে। গতবার তারা পেয়েছিল ৩১। পশ্চিমবঙ্গের ১৮টির একটিও পাবে না। অন্য রাজ্যগুলিতে আগের ভোটের সব আসন অটুট থাকবে, তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হচ্ছে। যদিও পাঞ্জাব ও তামিল নাড়ুতে পরিস্থিতি তাদের আরও খারাপ হয়েছে। বাকি রাজ্যগুলিতে বিরোধীরা যদি ভোটের আগে বিভক্তও থাকে, তারা সবাই মিলে ১২৫ টা আসন পেলেই বিজেপি ক্ষমতাচ্যুত হবে। এদিকে বিহার হাতছাড়া হয়েছে, মহারাষ্ট্র হাতে এলেও শিবসেনা টক্কর দেবে। উত্তর প্রদেশেও অখিলেশ যাদব ভাল ফল করবে। ফলে সব মিলিয়ে দুশ্চিন্তায় বিজেপি।
দ্বিতীয় বিপদটিও কম নয়। বিরোধীদের মধ্যে এক অলিখিত ঐক্য তৈরি হয়েছে। বিজেপিকে হারাতেই হবে। কোন প্রক্রিয়ায় তা নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও। রাজ্যে রাজ্যে জোট হবে নাকি যে যেখানে শক্তিশালী সেখানে তারই দায়িত্বে বিজেপি হারবে--- বিতর্ক চলছে। কিন্তু মিডিয়াও এখন বিজেপি বিরোধী জোটের কথা বলছে বার বার। বিজেপির কাছে এই ঐক্য অনভিপ্রেত। সামান্য ভীতিপ্রদও বটে।
ফলে বিজেপির নয়া স্লোগান #জয়শ্রীইডি। যার সাহায্যে এই দুই বিপদকেই তারা মোকাবিলা করতে পারবে বলে ভাবছে। তারা রাজ্যে রাজ্যে অ-বিজেপি সরকারগুলিকে ভেঙে দিতে পারবে, আবার একই সাথে বিরোধী ঐক্যের পরিবেশটিকেও বিষিয়ে দিতে পারবে।
ইডি দেবতার সব থেকে বড় সুবিধা হল, অসুর এখানে দুর্নীতি। অভিযুক্তের পক্ষে দাঁড়াতে বিরোধীদের মধ্যেও দ্বিধা কাজ করবে। যেহেতু বাস্তব হল, প্রতিটি দক্ষিণপন্থী দলের বহু নেতারাই কম বেশী দুর্নীতির সাথে যুক্ত। চাকরির বিজ্ঞাপনই দিয়ে উঠতে পারে না সরকারগুলি, ডিবিটি প্রকল্পের উদ্দেশ্যও কিছুটা দুর্নীতি সংক্রান্ত নৈরাজ্য থামানো। পদ ১০০, অথচ বিজ্ঞাপন দেওয়া মাত্রই নেতারা ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়েন, পদপ্রার্থী এক লাখ বেকারের কাছ থেকে টাকা তুলতে। দেশ জুড়ে একই চিত্র। (শোনা যাচ্ছে উচ্চশিক্ষায় ভর্তিকে কেন্দ্র করে এক বিরাট চুরির প্রকল্প ফাঁদা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির পরীক্ষা। প্রতি ছাত্র ১৩টি বিষয়ের জন্য আবেদন করতে পারবে। সুতরাং মাথা পিছু আবেদনকারী খরচ করবে ১৩০০ টাকা। ফর্ম তুলেছে দেড় কোটি। সুতরাং টাকা উঠবে ২০০০ কোটি।) ফলে দাঙ্গা করলে, দলিত খুন করলে, কাশ্মীরে হত্যালীলা চালালে, রামমন্দির নিয়ে রাজনীতি করলে, বিলকিস বানোর অপরাধীদের মক্তি দিলে বিজেপি বিরোধী দল ও মানুষের মধ্যে যে ঐক্য তৈরী হয় অনায়াসে, তা এক্ষেত্রে হবে না। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীকে ইডি তলব করলে বাকিরা চুপ করে থাকেন। শিবসেনার সঞ্জয় রাউতের ক্ষেত্রেও দেখা গেল তাই। সোনিয়া রাহুলের ক্ষেত্রেও যে এই ভাবে বিরোধী দলগুলি নীরব শ্রোতা হবে তা আশাতীত ছিল। আবার আপের মন্ত্রী সিসোদিয়াকে তলব করার পর দিল্লি কংগ্রেস বিজেপি অফিসের বদলে আপ অফিসে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলো। পাঞ্জাবের চরণজিত সিং চান্নির ভাই আর ভাইপোর ক্ষেত্রেও শোরগোল হল না। ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত সোরেনের ছেলে আলমগির, খান। অথচ সকলে নীরব। ছত্তিসগড়ে মুখ্যমন্ত্রী ভুপেশ বাঘেলের বিরুদ্ধেও নেমেছে তারা। দেশ জুড়ে বা রাজ্যগুলির ভেতরে এর বিরুদ্ধে বিরোধীরা একজোট হওয়া তো দূরের কথা, তারা পরস্পরের বিরুদ্ধেই কাদা ছোঁড়াছুড়ি করেছে। এদিকে কেরালাতে বিজয়ন। সেখানকার প্রাক্তন মন্ত্রী টমাসকে ইতিমধ্যেই ডেকেছে ইডি। কংগ্রেস সেখানে মূল বিরোধী, ফলে তারা পথে নামবে না। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের নেতাদের ধরার জন্য রাজ্য বিজেপির থেকেও সিপিআইএম এবং রাজ্য কংগ্রেস বেশি সরব। এক কথায় বললে, রাজ্যে রাজ্যে এক দলের বিরোধী সরকার ফেললে বিজেপি পাশে পাবে অন্য এক বিরোধী দলকে।
ফলে এই বিষাক্ত পরিবেশে ২০২৪ সালের জন্য যে ঐক্য কিছুদিন আগেও তৈরি হচ্ছিল তাতে ফাটল ধরে যাচ্ছে।
বিজেপির কাছে ২০২৪ সালের ভোটের অস্তিত্বটাই শিরঃপীড়া। রাশিয়া, চীন, ইরান, আফগানিস্তান দেখে মোদীর মনেও এই লোভ হওয়া স্বাভাবিক যে বড়ই ভাল হতো যদি ২০২৫ সালে আরএসএস-এর শতবর্ষে, যার অনুষ্ঠান ২০২৪ থেকেই শুরু হবে, ভোটহীন হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করতে পারতো তারা। যে সংবিধানও ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে গেছে। একমাত্র তাহলেই বিজেপি-আরএসএস-এর দুর্নীতির সাম্রাজ্য নিশ্চিন্তে এগোতো। এমনকি দিলীপ ঘোষও বুঝতে পারছেন যে সেই হিন্দু রাষ্ট্রে তাদেরও স্থান হবে আরএসএস বর্গিদের পায়ের কাছে।
যাই হোক্, এই কাজে সফল হতে গেলে ২০২৪ সালের আগেই বিরোধী দলগুলির অস্তিত্ব ধ্বংস করতে হবে। তাদের শুকিয়ে মারতে হবে। তাদের দলের নেতাদের হয় বসিয়ে দিতে হবে, নচেৎ বিজেপি বানিয়ে ফেলেতে হবে। বিরোধী দলগুলির টাকার উৎস বন্ধ করে দিতে হবে, যাতে ভোটে লড়ার কোনো সংস্থান তাদের আর না থাকে। এবং এই প্রতিটি কাজে ইডির ভূমিকা অপ্রতিদ্বন্দ্বি।
সিবিআই নয়, এই দুই পাখি মারতে পারবে একমাত্র ইডি। সিবিআই-এর কোনো না কোনো ভাবে রাজ্যের অনুমতি লাগে। তাছাড়া বন্ধ ঘরে তদন্ত হয় না। দেখাও গেল, সিবিআই-এর উকিলরা অনুব্রতর উকিলের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। ইডির উদ্দেশ্য চোর ধরা নয়। পার্থ চ্যাটার্জী বা অনুব্রত যদি সদলবলে আজই বিজেপিতে নাম লেখান তবে ইডির সব কেস বাতিল তো হবেই, উপরন্তু পার্থ চ্যাটার্জীকেই হয়তো পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিজেপি সরকারে উপমুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত করে দেবে বিজেপি। ইডির ইতিহাস বলছে, তাদের জালে ধরা সাড়ে পঞ্চান্ন হাজার কেসের মধ্যে মাত্র ২৩ জনকে শাস্তি দেওয়া গেছে। ইডি ছুঁলেই আঠারো না, একবারে আঠারোশো ঘা। কার্যত দেশটাকে প্রথমে বিরোধী শূন্য করে তার পর ভোটটাকেই বাতিল করা যাবে। যদিও অবসরের আগে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রামান্না মূল দুটি ইডীয় ক্ষমতাকে পর্যালোচনা করার অনুমতি দিয়ে গেছেন, তবু এখনও পর্যন্ত মোদী আমলের সংশোধিত আইনে যা ক্ষমতা ইডিকে দেওয়া হয়েছে তার ফলে, ---
ᴥ কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় ইডি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেখাতে বাধ্য নয় ইডি। কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই যে কোনো সময়ে, রাতের অন্ধকারে তারা এসে তুলে নিয়ে যেতে পারেন।
ᴥ রাজ্য সরকারের কোনো অনুমতি লাগবে না।
ᴥ সিজার লিস্ট বা যে কোনো বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তির রেকর্ড গোপন রাখতে পারে তারা।
ᴥ যা যা বাজেয়াপ্ত করেছে ইডি সেগুলো ১৮০ দিন পর্যন্ত ‘আসামী’ ফেরত চাইতে পারবেন না। তার কোনো হদিসও তিনি জানবেন না।
ᴥ সেই সব সম্পত্তি সম্পর্কে ইডি যখন কোর্টে যাবে তখন রিপোর্ট বন্ধ খামে পেশ করবে। আগে থেকে অভিযুক্তের উকিল কিছুই জানতে পারবেন না। পার্থ চ্যাটার্জী বা চিদাম্বরমের বাড়িতে লাশ পাওয়া গেল নাকি হীরে খচিত কমোড।
ᴥ বার্ডন অব্ প্রুফ গ্রেপ্তার হওয়ার মানুষটির। ইডি ধরা মাত্র সিসোদিয়া বা পার্থ চ্যাটার্জী অপরাধী হয়ে গেলেন। এবং তারা যে অপরাধী নন সেটা প্রমাণ করতে হবে তাঁদেরকেই। অথচ বুর্জোয়া বিচারনীতির সময় প্রমাণিত শিক্ষা হল: দোষী ছাড় পাক ক্ষতি নেই, কিন্তু নির্দোষ যেন শাস্তি না পায়। (এটি অবশ্য সম্প্রতি পুনর্বিবেচনা করার রায় দেওয়া হয়েছে।)
ᴥ যেহেতু ইডি ধরা মাত্র যে কেউ অপরাধী হয়ে গেলেন, অতএব যতক্ষণ না তিনি নিজেকে নিরাপরাধ প্রমাণ করতে পারছেন, কোনো বেলও তিনি পাবেন না। ইডি ধরলে বেল পাওয়া যায় না এই কারণেই। অথচ আইনের কেতাবি নিয়ম অনুসারে বেলটাই স্বাভাবিক (bail is the rule), জেলটা ব্যতিক্রম।
ᴥ সাধারণভাবে এফআইআর ছাড়া ন্যায় বিচার শুরুই হয় না। অথচ ইডি কোনো এফআইআর করবে না, তারা ইসিআইআর করবে, কিন্তু তার কোনো কপি শুধু আসামী নয়, এমনকি আসামীর উকিলকেও দেবে না। (এটিও পুনর্বিবেচনা করার রায় দেওয়া হয়েছে।)
ᴥ ইডি যে তদন্ত করবে সেখানে তারা ভারতের সিআরপিসি মানবে না। তাদের পছন্দ মত তারা মানবে, চাইলে নাও মানতে পারে।
ᴥ ইডি গ্রেপ্তার করবে, জবানবন্দী নেবে, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে, তদন্ত শুরু করবে, সার্চ করবে যেখানে সেখানে, কেস সাজাবে, অর্থাৎ পুলিশের যাবতীয় কাজ তারা করবে, কিন্তু তবু নাকি তারা পুলিশ নয়। আর তাই পুলিশের দায়বদ্ধতাগুলো তারা পালন করবে না।
ᴥ যেমন, পুলিশের সামনে দেওয়া জবানবন্দির কোনো আইনি গুরুত্ব নেই আদালতে। আমেরিকা-ইয়োরোপে গ্রেপ্তার করা মাত্র গ্রেপ্তারকারী আধিকারিকের প্রথম দায়িত্ব হল জানিয়ে দেওয়া যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিটি চাইলে পুলিশের সামনে কোনো কথা নাও বলতে পারে। নীরব থাকার মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি এটি। ভারতেও ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি একমাত্র গ্রাহ্য হয়। কিন্তু ইডির সামনে পার্থ-সিসোদিয়া-সোনিয়ার তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। ইডির সামনে তাকে মারছে না ধরছে কেউ জানে না। অথচ সেই জবানবন্দিই চূড়ান্ত। (ভারতের বিখ্যাত সব মামলাগুলির রায়ের উপর দিয়ে ট্রেন, ট্রাক চালিয়ে পিষে মেরে আদালত আজকাল বলছে, সেই সব অধিকার নাকি আহামরি কিছু নয়!! এমনকি পুটুস্বামী মামলার রায়টিকেও অগ্রাহ্য করা হল।)
ᴥ যদিও পার্থ চ্যাটার্জীর উকিল জানতে পারবেন না যে পার্থ চ্যাটার্জির বাড়িতে হীরেসজ্জিত কমোড পাওয়া গেছে, কিন্তু খবরের কাগজে সেই কমোডের ছবি আমরা এবং পার্থবাবুর উকিলও একই সাথে দেখতে পাবেন। কারণ ইডি আবার তদন্ত চলাকালীন অনবরত সংবাদমাধ্যমকে রোজকার তথ্য দিতে পারবে, এবং ওই একতরফা তথ্য নিয়েই সংবাদমাধ্যম মেতে উঠতে পারবে, জনতাকেও মাতিয়ে তুলতে পারবে। যেমন, আমরা জানতে পেরেছি ২৪টা বিশাল ট্রাঙ্কে আছে ৫০ কোটি টাকা!
অথচ ইডির যেটা করার কথা সেটা তারা এখনো করেনি। কারণ, পার্থ চ্যাটার্জী বা সিসোসিয়া বা সঞ্জয় রাউত কত বড়লোক সেটা দেখার দায়িত্ব ইডির নয়। সেই ধন সম্পত্তির কতটা আইনি, কতটা বে-আইনি সেটা দেখার কাজও তার নয়। সেই দায়িত্ব আয়কর দপ্তরের। যদি ভুপেশ বাঘেলার বা পার্থ চ্যাটার্জীর আয়কর বহির্ভুত সম্পত্তির হদিস আয়কর দপ্তর পায়, আয়কর আদায় করে আনবে তারা। অথবা মামলা করবে। ইডির দায়িত্ব সেই সম্পত্তি খোঁজা যা আন্তর্জাতিক তালিকাভুক্ত কোন অপরাধে খাটছে। ড্রাগ, নারী পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য, ইত্যাদি। অথচ মিডিয়াতে আমরা শুধু টাকার বাড়তে থাকা অংক দেখছি। অন্যদিকে ‘হু কিলড হেমন্ত করকরে’ বইতে বিজেপির সাথে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের যোগাযোগ নিয়ে ইঙ্গিত মিলেছে। আবার মুন্দ্রা বন্দর মারফত আদানি আন্তর্জাতিক ড্রাগ কারবার করছেন বলে অভিযোগ। তার কোনোটাতেই ইদিকে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে না।
গত কয়েক বছর ধরে অনবরত ইডির বর্তমান ডিরেক্টরের চাকরিতে এক বছর করে মেয়াদ বাড়িয়ে যাচ্ছে মোদী সরকার, সরকারকে তিনি যেন অক্লেশে তুষ্ট করে যেতে পারেন। আমাদের দেশে সবার উপর প্রধানমন্ত্রী। ইডির মাথায়ও তিনিই।
হয়তো দেশবাসী ভাবছেন যে ভোট আসুক, ভোটের মধ্য দিয়েই তারা বিজেপিকে এর সমুচিত জবাব দেবেন। কিন্তু সেই সুযোগ তারা আদৌ পাবেন তো? বিরোধী দলই যদি না থাকলো, থাকলেও যদি তারা ভেঙে চৌচির হয়ে গেলো, তবে কাকে ভোট দেবেন জনগণ? বাস্তব হলো, পশ্চিমবঙ্গে ৭০ জন তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ককে চুরির দায়ে ফাঁসিয়ে যদি ইডির দপ্তর মারফত তাদের বিজেপির সদস্য করা যায়, সাথে যদি একজন একনাথ শিন্ডে পাওয়া যায় তবে কেল্লা ফতেহ।
দেশ জুড়ে জনপ্রতিনিধিদের কোমরে দড়ি পড়ানোর ফ্যাসিস্ট চক্রান্ত রুখে দিন।
ভোট বানচাল করার পরিকল্পনা ব্যর্থ করুন। বিজেপি বিরোধী প্রতিটা চোর দল বেঁচে থাক, ভোট লড়ুক। আপাতত তাদের রক্ষা না করে আমাদের উপায় নেই। বিজেপি না থাকলে এদের কাউকে জনগণ আর তোয়াজ করবে না, ছুঁড়ে দেবে আস্তাকুঁড়ে, এটাই যা ভরসা।
সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের --- সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্য নামবো নাকি সংসদীয় গণতন্ত্র ধ্বংস করতে? সংসদীয় গণতন্ত্র মানে সেই ব্যবস্থা যা নিজের দেশে ধনীদের অধিকার দেয় আর অন্য দেশে ভগৎ দের ফাঁসিতে ঝোলায়। এহেন সংসদীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করলে আপনার সাথে থাকবে বিজেপি বিরোধী সংসদীয় দলগুলো। আর দ্বিতীয়টি বেছে নিলে আপনি পাশে পাবেন বিজেপিকে। আসুন প্রথম কাজটা করতেই রাস্তায় নামি। যে ওয়েস্টমিনিস্টার সিস্টেমকে কার্যত অস্বীকার করে আমাদের দেশ চলছে তা মুখ বুজে মেনে নেওয়া চলে না। যদি সত্যিই জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতি রোধ করতে হয় তবে প্যারী কম্যুনের শিক্ষা অনুযায়ী তাদের প্রত্যাহার করার বা রিকল করার ক্ষমতা দেওয়া হোক। যদ্দিন সেটা না হচ্ছে, নিয়ম কানুন না মেনে পদে থাকাকালীন গ্রেপ্তার ও হেনস্থা মানা যায় না।
হ্যাঁ, গ্রেটার ইভল লেসার ইভল আছে। যেমন চুরি করে নেতারা জেল খাটলেও ডিএমকে এডিএমকে আরজেডি বামেদের কাছে লেসার ইভল, অনেক চুরি দুর্নীতির অভিজ্ঞতা নিয়েই কংগ্রেস আজ সিপিএম-এর কাছে বিজেপি সাপেক্ষে লেসার ইভল, তেমনই বিজেপি সাপেক্ষে টিএমসি-ও লেসার ইভল। ইভল বাট লেসার ইভল।
আর একটা আশার কথাও আছে, একবার যদি বিজেপিকে তাড়ানো যায়, ইডি নামক সংস্থাটিকেও ব্যবহার করা যাবে আদানি, আম্বানি, টাটাদের বিরুদ্ধে। তাদের যাবতীয় আন্তর্জাতিক অপরাধের টাকা বাজেয়াপ্ত করে দেশের কোষাগারে জমা করা যাবে। আর বিজেপির ঘরে ইলেকশন বন্ড মারফত যে গোপন টাকা খাটে, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধের যোগাযোগটাও তখন বের করা যাবে, তাই না? জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে মামলা আর বহুজাতিকদের বিরুদ্ধে মামলা, ইডির এই দুরকম মামলার অনুপাত কত---সবই জানা যাবে।