বিহারের ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর কাজ আপাতত শেষ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ঐ রাজ্যের বুথ স্তরের আধিকারিকেরা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তায় এই কাজ খুব ভালো ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সংবাদ সংস্থাগুলোর জন্য তাঁরা একটি নোট জারি করেছে। সেই নোটে তাঁরা উল্লেখ করেছেন, এই এক মাসের বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর ফলে তাঁরা ২১.৬ লক্ষ মৃত ভোটারের সন্ধান পেয়েছেন। এছাড়াও তাঁরা বলেছেন ৩১.৫ লক্ষ ভোটার পাকাপাকিভাবে অন্য কোথাও বসবাস করছেন। ১ লক্ষ ভোটারদের কাছে বুথ স্তরের আধিকারিকেরা পৌঁছতেই পারেননি সেটাও স্বীকার করা হয়েছে আর পাশাপাশি বলা হয়েছে ৭ লক্ষ ভোটারের নাম অন্তত দুই বা তার বেশী জায়গায় আছে। সর্বমোট প্রায় ৬১ লক্ষ মানুষের নাম নির্বাচন কমিশন যে প্রাথমিক তালিকা আগামী ১ লা আগস্ট প্রকাশ করতে চলেছে, তা থেকে বাদ যেতে চলেছে। এই তথ্য সামনে আসার পর থেকেই রাজনৈতিক মহলে নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।
নির্বাচন কমিশন এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার সাথে সাথে আরো একটা কথা বলেছে, বিহারের এই কাজ সুসম্পন্ন করতে পারার পরে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সারা দেশেই এই ধরনের বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর কাজ শুরু করা হবে। এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে আসার পরে, বাংলা জুড়ে শোরগোল পড়ে গেছে। বিহারে যদি এত মানুষের নাম বাদ যায়, তাহলে বাংলায় এই সংখ্যা তো আরো বেশী হবে। রাস্তাঘাটে, অফিস আদালতে এখন একটাই আলোচনা এই পদ্ধতি নেওয়া গেলে এবং ভোটার তালিকা থেকে ভূতুড়ে ভোটার বাদ দেওয়া গেলে তৃণমূলকে হারানো সম্ভব হবে। বিজেপির সভাপতি থেকে শুরু করে বাংলার বিরোধী দলনেতা জোর গলায় বলছেন, বিহারে ৬১ লক্ষ ভোটার বাদ গেলে বাংলায় কমপক্ষে ১ কোটি ২৫ লক্ষ ভুয়ো ভোটার বাদ যাবে এবং সবাই নাকি বাংলাদেশী রোহিঙ্গা মুসলমান। এটা সরাসরি না বললেও, বামেদের একাংশ বলছেন যে তাঁরা তো দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন বাংলার ভোটার তালিকায় বড়সড় গোলমাল আছে, তাই সেটার সংশোধন করা জরুরি, সঙ্গে অবশ্য এটাও তাঁরা বলেছেন, এই সংশোধনী করতে গিয়ে যেন গরীব, প্রান্তিক মানুষজনের নাম না বাদ পড়ে। বামেদের এই বক্তব্য কিছুটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো ঘটনা। তাঁরা এমনিতে প্রকাশ্যে দেখাতে চাইছেন, যে তাঁরা বিজেপির ভাষ্যটাকে সমর্থন করেন না, কিন্তু নীচের তলার যে কোনও বাম কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যাবে, তাঁরাও বিজেপির ঐ ভাষ্যে রীতিমত বিশ্বাস করেন পশ্চিমবাংলায়, বাংলাদেশী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গেছে। হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ্য ছাত্ররা যে ভাবে কোনও যুক্তি বুদ্ধি কাজে না লাগিয়ে এটা বিশ্বাস করেন যে পশ্চিমবাংলায় তথা ভারতে একমাত্র সমস্যা হচ্ছে অনুপ্রবেশ, তার সমাধান হয়ে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এটাও তাই। সেইজন্যেই বামেদের ঐ অংশ বিহারের ক্ষেত্রে একরকম বলছেন আর বাংলার ক্ষেত্রে অন্যরকম বলছেন।
এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার আগে, আরো কিছু তথ্যের দিকে একটু নজর দেওয়া জরুরি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বিহারে এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনী যেদিন ঘোষণা করা হয়েছিল, সেদিন থেকেই এর বিরোধিতা শুরু হয়েছিল, বিহারের বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রাটিক রাইটস সহ নানান রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা হয়েছে। ঐ প্রক্রিয়া চলাকালীন গত ১০ই জুলাই বিচারপতি ধুলিয়ান এবং জয়মাল্য বাগচীর এজলাসে এই মামলার প্রথম শুনানি হয়। সেখানে বিচারপতি ধুলিয়ানের বক্তব্য ছিল, একজন ভোটারকে নিজেকে সঠিক ভোটার প্রমাণ করার জন্য যে নথি চাওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তা স্বয়ং তাঁর পক্ষেও হয়তো দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি অনুরোধ করেন যে সহজলভ্য যে সমস্ত পরিচয়পত্র আছে, যেমন নির্বাচন কমিশন সূত্রে প্রাপ্ত ভোটার কার্ড, আধার বা রেশন কার্ডকে যেন মান্যতা দেওয়া হয় এই সংশোধনীর ক্ষেত্রে। শুধু তাই নয়, সর্বোচ্চ আদালত কমিশনকে বলে তাঁরা যেন হলফনামা দিয়ে জানায় এই নিবিড় সংশোধনী থেকে তাঁরা কী সত্যে উপনীত হতে চায়। কমিশন অনুরোধ করে, যে তাঁরা হলফনামা জমা দেবে, কিন্তু এই প্রক্রিয়া যেন বন্ধ করা না হয়। আদালতে প্রশ্ন ওঠে সবার কাছে ঐ নথি নাও থাকতে পারে, একমাসের মধ্যে তা জোগাড় করাও প্রায় অসম্ভব। তারপরে একমাস ধরে এই প্রক্রিয়া চালানোর পরে, শোনা যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন ৭৮৬ পাতার একটি হলফনামা জমা করেছে এবং সেখানে তাঁরা বিচারপতি ধুলিয়ানের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে বলেছে যেহেতু আধারের ক্ষেত্রে নানান অভিযোগ এসেছে নানান সময়ে এবং ঐ আধার দেখিয়েই রেশন কার্ড এবং ভোটার কার্ড পাওয়ার নানান ঘটনা কমিশনের নজরে এসেছে, তাই তাঁরা আধার, রেশন কার্ড বা প্যান কার্ড এমনকি কমিশনের আগের ভোটার পরিচয়পত্রকেও মান্যতা দেয়নি।
অনেকেই বলছেন, এই নিবিড় সংশোধনী অত্যন্ত জরুরি একটি প্রক্রিয়া। এর মধ্যে দিয়েই সঠিক ভোটার তালিকা তৈরী করা সম্ভব যার মধ্যে দিয়েই স্বচ্ছ একটি নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে কমিশন, কিন্তু বিষয়টা কি এতটাই সরলরৈখিক? কেন বিরোধী দলগুলো এই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করছেন? কমিশনের বক্তব্য অনুযায়ী যে ৬১ লক্ষ মানুষের নাম প্রাথমিক খসড়া তালিকা থেকে বাদ যেতে বসেছে তাঁরা মূলত কারা? তাঁদের কতজন দলিত, কতজন মহিলা, কতজন মুসলমান এই তথ্যও বলা হয়নি। কিছুদিন আগে যোগেন্দ্র যাদব সহ অন্যান্য বেশ কিছু সমাজকর্মী বিহারের রাজধানী পাটনায় একটি জনশুনানির আয়োজন করেন। তাতে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি, বহু সমাজকর্মী এবং বিহারের গ্রামগঞ্জ থেকে আসা বেশ কিছু মানুষজন। ঐ জনশুনানিতে উপস্থিত মহিলাদের মধ্যে দু-একজনের কথা শুনলেই বোঝা যাবে, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে মূলত কারা বাদ পড়তে পারেন।
ফুলকুমারি দেবী, হাসানগঞ্জ, কাটিহারের একজন ক্ষেতমজুর। তাঁকে বলা হয়েছিল তাঁর একটা ছবি, ভোটার কার্ড এবং আধারের জেরক্স কপি জমা দিতে। যদিও নির্বাচন কমিশন এই নথি চলবে না বলে জানিয়েছে, তা সত্ত্বেও বুথ লেভেল অফিসাররা ঐ নথিগুলোই চেয়েছিলেন, নতুন ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য, কারণ বিহারে বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর কাজ চলছে। ফুলকুমারি দেবীকে, রেশন দোকান থেকে যে চাল তিনি পেয়েছিলেন, তা বিক্রি করে, তাঁকে পাশের শহর থেকে তাঁর একটি ছবি করাতে হয়। দু’দিন তাঁর খাওয়া হয়নি এবং এই কাজ করার জন্য তাঁর কাজও জোটেনি।
সুমিত্রা দেবী, ৬০ বছর বয়স। তাঁকে বলা হয়েছিল তাঁর বাবা মায়ের জন্মের কাগজপত্র দেখাতে হবে। সুমিত্রা দেবীর বাবা- মা, বহুদিন আগে গত হয়েছেন। তাঁকে বলা হয়েছিল, তাঁর জাতির শংসাপত্র দিতে হবে। সুমিত্রা দেবী জানান তিনি ৩০০ টাকা জমা করেছেন ইতিমধ্যেই ঐ নথির জন্য, কিন্তু এখনও হাতে পাননি। তাঁকে বলা হয়েছে, তাঁর নাম উঠবে না নতুন ভোটার তালিকায়।
এইরকম অভিজ্ঞতা অসংখ্য মানুষের। চারিদিকে দালাল চক্র কাজ করছে। এইরকম মানুষদেরই হয়তো নির্বাচন কমিশন বাদ দিয়েছে বলে পাটনায় আয়োজিত জনশুনানিতে শোনা গেছে। কেন এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর বিরোধিতা করা জরুরি, সেই সংক্রান্ত বেশ কিছু আলোচনাও হয়েছে।
প্রথমত প্রতি রাজ্যে এই ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ নিয়মিতই হয়। বিহারও তার ব্যতিক্রম নয়। কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তাঁর নাম যাতে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া উচিৎ, সেটা সবাই জানেন। শহরাঞ্চলে এই সংক্রান্ত সচেতনতাও আছে। মৃত ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে অনলাইন এবং অফলাইন, দু’ভাবেই এই সংক্রান্ত বহু আবেদন জমাও পড়ে। তা সত্ত্বেও দেখা গেছে পরবর্তী নির্বাচনে কিংবা তার পরের কোনও নির্বাচনে ঐ নাম থেকেই গেছে। কোনও আবেদনের ভিত্তিতে কোনও নাম বাদ দেওয়ার কাজটা কমিশনের, তাঁরা যদি এই কাজটা না করেন, তাহলে তার দায় তো মৃত ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর বর্তায় না। হ্যাঁ, গ্রামে গঞ্জে সচেতনভাবে এই তথ্য হয়তো জানানো হয় না কমিশনকে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কমিশনের উচিৎ মৃত মানুষদের নিবন্ধীকরণ তথ্য থেকে মিলিয়ে প্রতি বছর এই তালিকা তৈরী করা, কিন্তু তা না করে, একেবারে নতুন করে নাম তোলা, আগের সমস্ত তালিকা মুছে ফেলা কোনও কাজের কথা হতে পারে না। গত ৭৫ বছরের ভারতের ইতিহাসে আজ অবধি এই পদ্ধতি নেওয়া হয়নি, এমনকি যে ২০০৩ সালের তালিকাকে প্রামাণ্য হিসেবে ধরা হচ্ছে সেই ২০০৩ সালেও এই পদ্ধতি নেওয়া হয়নি।
দ্বিতীয়ত, আজ অবধি যদি ১৮ বছর বয়সী কোনও মানুষ তাঁর নাম ভোটার তালিকায় তুলতে চাইতেন, তা হলে তাঁকে ফর্ম নম্বর ৬ জমা করতে হতো। অন্যদের করতে হতো না। এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনীতে প্রতিটি ভোটারকে ঐ ফর্ম নম্বর ৬ জমা করতে হচ্ছে নাম তোলার জন্য। এই প্রক্রিয়াও সংবিধানের পরিপন্থী।
তৃতীয় এবং শেষ কারণ এতদিন অবধি ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হতো না। এইবার প্রথম প্রতি ভোটারকে বলা হচ্ছে ‘আপনি নাগরিক কি না, তার প্রমাণ দিন, তবেই আপনার নাম ভোটার তালিকায় উঠবে। এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে আদালত প্রশ্ন করেছিল, যে তাঁদের কি নাগরিকত্ব পরীক্ষা করার অধিকার আছে, তার উত্তরে হলফনামায় সংবিধানের ৩২৪ এবং ৩২৬ নম্বর ধারা উল্লেখ করে তাঁরা জানিয়েছে, তাঁদের সেই অধিকার আছে। অথচ এই ধারা দুটো তে কিন্তু কোথাও লেখা নেই, যে নির্বাচন কমিশনের এই আধিকার আছে। তাঁরা ঐ দুটি ধারার উল্লেখ করলেও ৩২৫ নম্বর ধারার কথা কিন্তু হলফনামায় জানায়নি, যেখানে বলা হয়েছে যে কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ না থাকলে কিন্তু তাঁর নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অধিকার নির্বাচন কমিশনের নেই। এই ধারায় নাগরিকত্বের বিষয় হিসেবে কী বলা হয়েছে, সেই কথাও সবার জানা উচিৎ।
প্রসঙ্গ হিসেবে ছোট করে এই তিনটি ধারা দেওয়া থাকলো।
Article 324: Superintendence, control and direction of national and state-level elections are to be directly handled by the ECI
Article 325: Inclusion and exclusion of names in electoral rolls are based on Indian Citizenship. No citizen of India above the voting age should be excluded from the rolls or included in a special electoral roll based on any criteria such as race, caste, religion or sex.
Article 326: Defines universal adult franchise as the basis for elections to all levels of the elected government.
এছাড়াও সংবিধানের ১০ নম্বর ধারাটির উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেই ধারায় বলা আছে, একজন ব্যক্তি যদি একবার নাগরিক হয়ে থাকেন, তাহলে সেই নাগরিকত্ব এইরকম সরল কোনও পদ্ধতিতে চলে যেতে পারে না। এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল, তার সঙ্গে নাগরিকত্ব আইন, ফরেনার্স অ্যাক্ট এবং আরো বেশ কিছু প্রক্রিয়া যুক্ত। নির্বাচন কমিশন চাইলেই তা করতে পারে না। ১৯৬৬ সালের নাগরিকত্ব আইনে তার উল্লেখ আছে। এতদিন সরকারের দায়িত্ব ছিল একজন ব্যক্তিকে নাগরিক প্রমাণ করার, এখন প্রতিটি ব্যক্তিকে তাঁর নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে। এটা অসম্ভব শুধু নয়, অবাস্তবও বটে।
রাজনৈতিক নেতাদের একটা সুবিধা হলো, যাই হোক কিছু বলে দিলেও কেউ উল্টে প্রশ্ন করেন না। কিন্তু আমাদের তো প্রশ্ন করতে হবে। বেশ, বোঝা গেল বিহারে ৬১ লক্ষ মানুষের নাম আপাতত বাদ পড়তে পারে, সামনের খসড়া তালিকায়, কিন্তু সেই বাদ যাওয়া মানুষেরা কারা? নির্বাচন কমিশন তাঁদের ওয়েবসাইটে বিহারের ২০০৩ সালের নির্বাচক তালিকা প্রকাশ করেছিল। এখন তাঁদের কাছে আমরা কি কিছু দাবী করতে পারি না?
নির্বাচন কমিশনের উচিত এই নামগুলি কেবল রাজনৈতিক দলগুলিকে জানানোর পরিবর্তে তাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করে জনসমক্ষে প্রকাশ করা। যে কোনও নির্বাচনের আসল শর্ত হলো স্বচ্ছতা। এমনিতেই বিহারের যাঁরা পরিযায়ী শ্রমিক, তাঁরা অনেকেই হয়তো এই প্রক্রিয়ার শর্ত পূরণ করতে পারেননি। কাজের জায়গা থেকে ছুটি পাননি বলে আসতেও পারেননি, তাই অনেকের নাম বাদ গেছে। অনেকেই হয়তো জানেন না, এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা কী কী শর্তে কাজ করেন। বেশীরভাগের কোনও ছুটি নেই। ছটপুজো, ঈদ, দেওয়ালি এবং ভোট দেওয়ার সময় ছাড়া বেশীরভাগ শ্রমিক ছুটিই পান না। তার ওপরে যাতায়াতের খরচ বহন করার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই বেশীরভাগ মানুষের। তাই নির্বাচন ঘোষণা হলে তাঁরা যদি ফিরে এসে দেখেন, যে তাঁদের অনেকের নাম নেই, তাহলে অঞ্চলের বুথ স্তরের আধিকারিক এবং বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে অশান্তি হতে বাধ্য। যদি বাদ যাওয়া মানুষদের নাম নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়, তাহলে নির্দিষ্ট ব্যক্তিও যেমন বুঝতে পারবেন তেমন অন্যান্যরাও বুঝতে পারবেন যে নির্বাচন কমিশন আদৌ সঠিকভাবে কাজ করেছেন কি না। বিভিন্ন খবর যা দেখিয়েছে, অজিত আঞ্জুমের মতো সাংবাদিকেরা যেইরকম দেখিয়েছেন, তাতে তো মনে হচ্ছে না, সঠিক কাজ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের থেকে তো একজন ভোটার এইটুকু স্বচ্ছতা আশা করতেই পারেন। এখন সব চোখ তাকিয়ে রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দিকে, কিন্তু সেখান থেকেও খুব বেশী কিছু কি আশা করা যায়?
এর আগে অন্তত বেশ কিছু মামলার উল্লেখ করা যেতে পারে এই বিষয়ে।
ইন্দরজিত বড়ুয়া বনাম নির্বাচন কমিশন (১৯৮৫)
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মূলকথা
যে কোনো ব্যক্তির নাম একবার ভোটার তালিকায় উঠেছে — সেটাই তার নাগরিকত্বের একটা শক্তিশালী প্রমাণ। তাকে আবার আলাদা করে “নাগরিক কি না” সেটা প্রমাণ করতে বলা ঠিক নয়।ভোটার তালিকা তৈরির সময় নাগরিক না হলে নাম তোলা যাবে না — এটাই ঠিক। কিন্তু একবার যদি কারো নাম ভোটার তালিকায় উঠে যায়, তাহলে তা ধরেই নেওয়া হবে সে ভারতের নাগরিক। কেউ যদি দাবি করে, ওই ব্যক্তি নাগরিক নয়, তাহলে তাঁর উপরই দায়িত্ব পড়ে প্রমাণ করার, ভোটার তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তির নয়।
লাল বাবু হুসেন বনাম নির্বাচনী আধিকারিক (১৯৯৫)
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মূলকথা ছিল ভোটার তালিকা থেকে কারো নাম বাদ দেওয়া খুব গুরুতর বিষয়। এটা সহজে বা সন্দেহের বশে করা যায় না। এছাড়াও কারো নাম বাদ দিতে হলে আগে তাকে জানাতে হবে এবং তাকে তার বক্তব্য বলার সুযোগ দিতে হবে। এই রায়ে সুপ্রিম বলেছিল, নির্বাচন কমিশন বা অফিসারদের যদি সন্দেহ হয়, তাহলেও তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নাম কাটতে পারে না। প্রথমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে লিখিত নোটিশ দিতে হবে। এরপর তাকে শুনানির সুযোগ দিতে হবে। তারপর সঠিক নিয়মে তার নাম বাদ দেওয়া যাবে।
চৌধুরী বনাম নির্বাচন কমিশন (১৯৯৪)
এই মামলার প্রেক্ষাপট ছিল আসামে SIR‑জাতীয় নির্বাচন সংশোধন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন নাগরিকত্ব যাচাই করার চেষ্টা করেছিল। সুপ্রীম কোর্ট বলেছিল ভোটার তালিকা তৈরি করার সময় নাগরিকত্ব যাচাই করা যায় না। প্রাথমিক তালিকা তৈরি হয় শুধু পরিবারের তথ্য বিবরণী (ফর্ম ৪) এর ভিত্তিতে। এর প্রভাব কী ছিল? নাগরিকত্ব যাচাই শুধু খসড়া তালিকা প্রকাশের পরে অভিযোগের ভিত্তিতে হতে পারে, নাগরিকত্ব যাচাই করার নির্বাচন কমিশনের সেই পদক্ষেপে ভ্রান্তি ও আইনবিরুদ্ধতা ছিল।
মহম্মদ রহিম আলি বনাম আসাম রাজ্য ( ২০২৪)
মামলার বিষয় ছিল আসামে মহিলার বংশগত বানান ভুলের কারণে তাকে বিদেশি ঘোষণা করা হয়েছিল, যদিও তাঁর ভোটার তালিকায় নাম ছিল ১৯৬৫ থেকে। সুপ্রীম কোর্ট সিদ্ধান্ত নেয় নামের অল্প ভুল বা তারিখের পার্থক্য দিয়ে নাগরিকত্ব সন্দেহ করা উচিত নয়, বিশেষ করে ভোটার তালিকায় দীর্ঘদিন নাম থাকলে।
মামেজা খাতুন ( ২০২৫)
পরিপ্রেক্ষিত ছিল ডি ভোটার তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের ভোটাধিকার বাতিল এবং তাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে মামলা। দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দেন যে বুথ স্তরের আধিকারিকেরা বা BLO রা সনাক্ত করতে পারেন, কিন্তু নাম কাটার আগে ফরেনার্স ট্রাইবুনালের সিদ্ধান্তই শেষ।
অথচ এই সমস্ত রায়কে অমান্য করেই মোদী-শাহ সরকারের মনোনীত নির্বাচন কমিশন এসআইআর-এর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে! এডিআর যে হলফনামা জমা দিয়েছে সেখানেও এই রায়গুলোর কথা উল্লেখ করেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যদি বলে যে তাঁরাও একটা নতুন আদালত, যাঁদের আগের কোনও মামলার রায় নিয়ে ভাবার কোনও দায় নেই। তাহলে কী হবে, আপাতত সেইদিকে তাকিয়ে পুরো দেশ। বিহারের বিধানসভা থেকে শুরু করে সংসদের বাদল অধিবেশনে বিরোধীরা এই সংক্রান্ত বিরোধিতা এখনও অবধি জারি রেখেছেন এবং তা যৌথভাবেই হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে আগামীদিনে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে এই লড়াই অনেকদূর যাবে, শ্লোগান উঠেছে বিহার থেকে ‘চুনাও চোর গদ্দি ছোড়’। বাংলাতেও এই লড়াই যে আরো জোরদার হবে, তা বোঝাই যাচ্ছে। বাংলায় এই লড়াই নতুন কোনও সমীকরণ এবং নতুন কোনও শ্লোগানের জন্ম দেয় কি না, সেটাও দেখার।