ইদ কি ইসলাম ধর্মের এসেন্সিয়াল পার্ট? ভারত রাষ্ট্র এখনো এই প্রশ্নের মিমাংসা করতে পারেনি। আশা করছি কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা উত্তর পেয়ে যাব। ততদিন আকাশের সরু চাঁদ, কালো আসমান, জাকারিয়া স্ট্রীটের সুগন্ধ, আতরওয়ালার ফোকলা দাঁতের হাসি ও চোখে সুরমা পরবার পর কালো চোখের লালচক্ষু হয়ে ওঠা উৎসবের চিহ্নরূপে খানিক মজা ও ইয়ার্কি করে যাক। ভারত রাষ্ট্র ইয়ার্কি পছন্দ করে।
গত দু'বছর লকডাউনে কেটে গেল। এবারের ইদে কোরোনার ভয় তেমন নেই। বুলডোজারের ভয় রয়েছে। তবে ভয় কী আর উৎসবকে মাটি করতে পারে? কথা হচ্ছিল পচার সঙ্গে। পচা একজন দর্জি। ইদে বউ-এর জন্য নাইটি কিনতে এসেছে। নিজে কিনেছে একখানা সাদা থামি(লুঙ্গি)। বলল, কারবার খুব ঢিলা যাচ্ছে।
-
কেন?
-
ওস্তাগাররা টাকা দিচ্ছে কই? দশ হাজার টাকার কাজ করলে সাত হাজার ধরাচ্ছে। তিন হাজার হাতে রেখে দিচ্ছে।
-
কিছু বলো না?
-
কাকে কী বলবে? দর্জি লাইনে আর আগের মতো মজা নেই গো। এই ক'বছরে কতো ওস্তাগার কারবার ডকে তুলে দিল। এখন যারা আছে, তারাই রাজ করছে। কিছু বলতে গেলে কাজই পাবে না।
প্রচুর দরদাম করে একখানা নাইটি নিল পচা। নাইটিটা তার পছন্দ হয়নি। তাও পলিব্যাগে ভরতে ভরতে বলল, কীসব ম্যারম্যারে কালার দেখালে। গিরিনের উপর বড়ো বড়ো গোলাপ থাকবে, তবে না ইদ মনে হবে।
এক একবছরে, এক একরকম ডিজাইন হিট করে। এবারে হিট করেছে নেটের উপর কাজ করা গাউন। গোলাপি, সবুজ, কমলা, লাল। এগুলো ইদের সময়েই বিক্রি হয়। ইদের পর এসব কেউ ছুঁয়েও দেখে না। ফলে যেগুলো বিক্রি হল না, সেগুলো আগামী বছরের জন্য তুলে রাখতে হয়। মোদ্দা কথা দোকানির লস। টাকাটা আটকে গেল।
দিন পনের আগে এরকমই একটা গ্রাউন কিনে নিয়ে গিয়েছিল অবাঙালী এক মেয়ে। ইদের দু'দিন আগে আবার সে দোকানে হাজির। বলছে, এটা পাল্টে দিতে হবে।
-
এতোদিন পর পাল্টানো যায়?
মেয়েটি নাছোড়, পাল্টাতেই হবে। আমি তো টাকা ফেরত নিচ্ছি না। অন্য জিনিস নেব।
-
এখন আর কী নেবে?
মেয়েটি সালোয়ার পিস দেখায়। এই পিসগুলোর বিক্রি ইদের পরেও হতে পারে। কিন্তু গ্রাউনটা রয়েই যাবে।
দোকানিও তুখোড়। বলল, দু'দিন পর ইদ। এখন আমি ফেরত নিয়ে বিক্রি করব কাকে?
মেয়েটি বলল, এইটা ঘরে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
-
পছন্দ করে কিনলে। আর এখন বলছ ঘরে নিয়ে যাওয়া যাবে না!
-
না, দিদি। ঘরে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
দোকানির কেমন সন্দেহ জাগল। জিজ্ঞেস করল, কেন?
মেয়েটি এবার মাথা নীচু করে নিল। কোনোমতে বলল, হাতাটা পাতলা নেটের তো। পুরো দেখা যায়। কাল ওনার আব্বা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
-
কাপড় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে?
-
বলেছে এরম কাপড় পরলে ঘর থেকে বার করে দেবে।
এর পরের ঘটনা আরো চমকপ্রদ। দোকানি, যেহেতু সে নিজেও মেয়ে, খরিদ্দারকে সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছে খরিদ্দারের বাড়িতে। শ্বশুরকে শায়েস্তা করতে। ভাবা হয়েছিল ঘামাসান লড়াই হবে। মিনিট তিরিশ পর দোকানি যখন মুচকি হাসি নিয়ে বাইরে বেরোলো, দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল খরিদ্দার, তার মুখেও হাসি।
পরে যখন দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, কী কথা হল?
দোকানি রাগ দেখিয়ে বলল, ওসব জেনে তোমার কী? সেইতো গল্প নামাবে।
কতো গায়ক এলো, কতো গায়ক গেল। তবে ছোটো থেকে শুনে আসছি মহম্মদ আজিজ একাই কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। আগে চোঙা ছিল, এখন ডিজে বক্স। আগেও আজিজ ছিল, এখনো আজিজ। নিচের লিঙ্কে গিয়ে গানটি শুনে নিন। ইদের ফ্লেবার পেয়ে যাবেন –
এই গানটি যদি না বাজে, তাহলে বুঝবেন, ইদ হচ্ছে না। সরকারি ছুটি থাকলেও সেইদিন ইদ নয়।
ইদের আগের দিনকে বলে চাঁদরাত। চাঁদ দেখে বাচ্চারা সব অলিগলি কাঁপিয়ে দেবে। ইদ মুবারক চাঁদরাত - এই তাদের স্লোগান। যেন তারা না জানালে কেউ জানতেও পারবে না কবে ইদ।
ছোটবেলায়, একবার মনে আছে, রাত তখন প্রায় ১১টা, আচমকা নিউজে জানা গেল আগামীকাল ইদ। ইদের দিনে মাংস রান্না হবে না তা কী করে হয়? অতো রাতে মুরগীর দোকান খুলিয়ে মুরগীর ব্যবস্থা করা হল। জনগণের দাবির কাছে হার মানল কশাই। রাতে গরু জবাই হল। সেই মাংস পৌঁছে গেল বাড়ি বাড়ি। বাড়ির পুরুষেরা থলিতে মাংস ভরে নিয়ে আসছে রাত্রি দুটোয়। সেই মাংস রান্না হবে ভোর থেকে। পুরুষের মুখে যেন যুদ্ধ জয়ের হাসি। মেয়েরা মেহেন্দি পরা হাতে উনুনে আগুন দিচ্ছে। মুখ গম্ভীর।
এই মেহেন্দি পরা নিয়ে বেশ মজার ঘটনা ঘটত। সব মেয়েরা হাতে মেহেন্দির নক্সা নিয়ে পাখার তলায় বসে থাকত। সেই মেহেন্দিতে কেউ আবার কফির গুড়ো মিশিয়েছে, কেউ আবার আরেকটু এগিয়ে খয়ের মিশিয়েছে - যার রঙ সবথেকে বেশি লাল, সে-ই জয়ী। তাকে হিংসা করবে বাকিজনে। এখন বাজারে বিভিন্ন ব্রান্ডের মেহেন্দি পাওয়া যায়। তখন এতোসব ছিল না। মেহেন্দি গাছের পাতা শিলে বেটে তাতে কে কী মেশাল, তা ছিল গোপন রেসিপি। সহজে হদিস পাওয়া যেত না। ছেলেরাও আঙুলের ডগায় গোল করে মেহেন্দি পরে।
ইদ মানে চুলের কাটিং। এইসময় সেলুনে ঢোকা দায়। যারা ঢুকতে পারে, তারা বেরিয়ে আসে অন্য লুকে। ঢোকবার সময় ছিল রুহুল, যখন বেরোলো, এক্কেবারে টিঁয়া পাখি। হলুদ থেকে লাল, নীল থেকে সাদা - সব রঙের চুল দেখা যাবে। সঙ্গে থাকবে সানগ্লাস। হিল তোলা জুতো। কচি কলাপাতা রঙের শার্ট। ইদ, দোলের মতো, রঙেরও উৎসব বটে।
মাচা বানানোর কাজটা পাডার ছোকরাদের। তারা দু'দিন আগে থাকতেই কাঠে পেরেক ঠুকে মাচা বানিয়ে নেবে। সেই মাচায় আবার ঝিনচ্যাক আলো। গান বাজবে - হিন্দি থেকে ভোজপুরির মারলো খাচাখাচ - সঙ্গে চলবে নাচ। কারোকে দেখানোর জন্য নাচ নয়। নিজের জন্যই নিজের নাচ।
ইদের দিনে খাওয়াদাওয়া ছাড়া এমনিতে কোনো কাজ নেই। দুপুর থেকে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন আসতে থাকবে। খালার বাড়ি, ফুফুর বাড়ি যাওয়াটা প্রায় নিয়ম। তবে সকাল থেকেই সকলের পেট ঢাউস হয়ে থাকে। আর যে-বাড়িতেই যাবে, মোটের উপর একই খাবার - ফলে শেষপর্যন্ত কোল্ডড্রিংক্সই ভরসা।
বরঞ্চ মজা হয়, ইদের পরের দিনে। ইদের পরের দিনটা অনেকটাই সরস্বতী পুজোর মতো। প্রেমের দিন। বেড়াতে যাবার দিন। প্রেমে কিক খাবার দিনও বটে।
এই দিনটা নিয়ে পরে বিস্তারিত লিখব। আজ এই পর্যন্তই থাক।
ইদ মুবারক।