পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

পুলওয়ামার বংশধরেরা এখন অ্যাপে

  • 06 January, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1089 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক মুখোপাধ্যায়
মোবাইল ফোনের প্রযুক্তিটা আজকাল এমন যে একজন মানুষ কোথায় কখন কার সঙ্গে কী কথা বলছেন, কী বার্তা চালাচালি করছেন, সব একটা সেন্ট্রাল সার্ভারে প্রতি দিন জমা হচ্ছে। কেউ দেখতে চাইলেই দেখতেও পারে, তার ভিত্তিতে মনিটরিংও করতে পারে। তার সঙ্গে যদি পেগাসাসের মতো স্পাইওয়ার যুক্ত হয়, কি হতে পারে?

 

খবরটা শুনে আর স্থির থাকতে পারছিলাম না। চটাদার সঙ্গে এটা নিয়ে বিস্তর ঝগড়া হয়েছে। সেই সব বাতচিতের মধ্যে যথেষ্ট গরম ভাব এসে গিয়েছিল। চটাদার অবশ্য স্বভাবই ওরকম। একটু রগচটা মেজাজ বলেই তো পাড়ায় সকলে চটাদা বলে ডাকে। যদিও ওনার তাতে আবার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। আমি সাধারণত কোনো ব্যাপারেই কারও সঙ্গেই খুব একটা রাগারাগি করতে যাই না, আসলে বলা ভালো, পারি না। কিন্তু দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নটাকে ওরকম হেলাফেলা করলে কার না রাগ হয়? আমারও হয়েছিল।

আজকে চটাদা কী বলে শুনতে চাই। একেবারে হাতেনাতে প্রমাণ। এর পর তো আর কোনো কথাই চলতে পারে না। তিনটে সিঙ্গারা হাতে করেই সাইকেলে দৌড়লাম।

যথারীতি তারুকাকার দোকানের সামনে বিদ্যুৎ দপ্তরের আস্ত একটা ভালো ল্যাম্পপোস্ট শুইয়ে দিয়ে বানানো লোকপ্রিয় জন-আসনেই ওনাকে পেয়ে গেলাম। এক গাল হেসে বললাম, এবার কী বলবেন চটাদা?

ও, তুই এসে গেছিস? আয় আয়। এখানে বোস। পাশের খালি জায়গাটা, যেখানটা সরু হয়ে গেছে বলে কেউ সচরাচর বসে না, আমাকে হাত দিয়ে দেখিয়ে চটাদা বসার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমিও, আর জায়গা না পেয়ে ওখানেই বসলাম। আমার হাতের ঠোঙা থেকে একটা সিঙ্গারা টপ করে তুলে নিয়ে চটাদা বললেন, আমি সকাল থেকেই মনে মনে ভাবছিলাম, তুই আজ ঠিক আসবি এই আড্ডায়।

আপনি ভেবেছিলেন? কেন?

বা রে, শিলিপাড়ায় অত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, আর তুই আমার কাছে তার ব্যাখ্যা চাইতে আসবি না—এ আবার হয় নাকি?

গরম সিঙ্গারা খেতে খেতে যে কী করে লোকে এত স্পষ্ট উচ্চারণ করে কথা বলতে পারে, আমি ভেবেই পাই না। তাই একটু ন্যাকা সাজতে চেষ্টা পাই, কোন ঘটনাটার কথা বলছেন চটাদা? আমার এখানে আসার সঙ্গে তার সম্বন্ধই বা কী?

আরে বাবা, তুই তোর দেশপ্রেমের পায়রা দেখানোর এত বড় একটা সুযোগ পেয়ে ছেড়ে দিবি, তা আবার হয় নাকি? সেদিন অত কচলে গেলি, দেশপ্রেমের পুরো বীরু সহবাগিশ খেল দেখিয়ে গেলি, আমি ভুলে গেছি ভাবছিস? তোদের বামস্টারদের সব্বাইকে আমি খুব ভালো করে চিনি, মনে রাখিস। যা চা-টা বলে দিয়ে আয় তারুদাকে।

চা বলতে যাওয়ার আগে আমি আমার ভাগের সিঙ্গারাটা তুলে নিলাম। নইলে ঘুরে এসে ওটা আর দেখতে পেতাম না। তার পর দুটো লাল চায়ের গ্লাস হাতে করে নিজেই নিয়ে এলাম।

চায়ে একটা আলতো চুমুক দিয়ে চটাদা বললেন, বল, এবার তুই কী সাব্যস্ত করতে চাস। আমি রেডি।

এইবার আমি পড়ে গেলাম মুশকিলে। চার্জ করবার মুডে বলতে পারলে সহজেই বলে ফেলা যায়। কিন্তু এই যে এখন আমাকে একটা ইনডায়রেক্ট ফ্রি কিক মারতে হবে—এতে কীভাবে শুরু করব, সব ঘুলিয়ে যায়। তার মধ্যে আজকাল চা-ও বানাচ্ছে তারুকাকা এমন যে বুদ্ধি ঠিক আসল সময়েই থেবড়ে যায়! তিনটে স্লো চুমুকে বেশ অনেকটা ভেবে নিয়ে বললাম, বেশ, তুমি যখন জেনেই গেছ, তখন বল, এবার তো মানছ, এই ঢুকিসাস প্রযুক্তিটার দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে দরকার ছিল।

না, মানছি না। চটাদা অবুঝ কিশোরের মতন মুখখানাকে ঘুরিয়ে বললেন।

মানছ না? ওটা ছিল বলেই তো ধরতে পারল। নাকি ধরেছে যে সেও মিথ্যে?

কী ধরেছে? যাকে ধরেছে সে কী কী করেছে বলে ওরা ঢুকিসাস দিয়ে জেনেছে? ভালো করে ভেবে ভেবে গুছিয়ে বল। তাড়াহুড়ো করিস না।

এই বার আমি আমার খেলার মাঠটা খুঁজে পেলাম বলে বোধ হল। চটাদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ধর, এই যে একজন ইউপি-র লোক শিলিপাড়ায় এসে উবেরে কাজ করছিল আর দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করে যাচ্ছিল, এটা ওই মোবাইলে আগে থেকে ঢুকিসাস অ্যাপটা না ঢোকাতে পারলে জানা যেত কোনো দিন? ওটা ইনস্টল করার ফলেই তো লোকটা কবে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে কথা বলছে, কবে কাকে কী মেসেজ পাঠাচ্ছে—সব কিছুই একে একে ধরা পড়ে গেল ঠিক জায়গায়।

বলছিস?

চটাদা এমনভাবে কথাটা ছুঁড়ে দিল যেন আমার যুক্তিটার কোনো মূল্যই নেই। আমার খুব রাগ হল। হ্যাঁ বলছি তো। বললামই তো। এবার তুমি কিছু পালটা বল। ভুল কী বলেছি বোঝাও।

মার্ক টোয়েনের নাম শুনেছিস?

হ্যাঁ। কিন্তু এখানে তাঁর নাম আসছে কেন? কী প্রসঙ্গে?

তোর প্রসঙ্গেই আসছে। তোর মতো যত বুদ্ধিমান ছাগলদের সম্পর্কেই উনি একটা ভারি কেজো কথা বলে রেখে গেছেন। আমাদের যাতে সময় নষ্ট কম হয়। জানিস সেটা?

উনি রসিক লোক, অনেক মজার কথা বলেছেন জানি। ঢুকিসাস প্রসঙ্গে আপনি ওনার নাম আনছেন কেন?

এক জায়গায় উনি বলেছেন, বোকাদের সঙ্গে তর্কে নেম না। কথা বলতে বলতে ওরা তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে ফেলবে যে তোমার যুক্তি তর্ক কোনো কাজেই লাগবে না। পুরো সময়টা বেকার খরচা হয়ে যাবে।

আমার সঙ্গে কথা বলে আপনার সময় ফালতু খরচা হচ্ছে? থাক, কিছু বলবেন না তবে। ছেড়ে দিন। আমি চলি।

রাগ করলি তো! বোঝার চেষ্টা কর। ঠান্ডা মাথায় ভাব। মোবাইল ফোনের প্রযুক্তিটা আজকাল এমন যে তুই কোথায় কখন কার সঙ্গে কী কথা বলছিস, কী বার্তা চালাচালি করছিস, সব একটা সেন্ট্রাল সার্ভারে প্রতি দিন জমা হচ্ছে। কেউ দেখতে চাইলেই দেখতেও পারে, তার ভিত্তিতে মনিটরিংও করতে পারে। পারে তো?

তা পারে।

এবার ভেবে বল, তোর ঢুকিসাস অ্যাপ এক্সট্রা কী করছে?

আরও ভালো ভাবে আরও নিখুঁতভাবে কে কোথায় কী তথ্য চালাচালি করছে ধরে ফেলছে এবং একটা বিশেষ সার্ভারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এটাই এর কাজ! আমি বেশ গর্বভরে বললাম।

কার ফোনে ইনস্টল করবি?

. . .   . . .   . . .   . . .  . . .   . . . 

আরে, চুপ মেরে গেলি কেন? কিছু বল? কার ফোনে বসাবি?

. . .   . . .   . . .   . . .   . . .   . . .

আচ্ছা, আমিই বলি। বুঝতে পেরেছি যে তুইও এবার বুঝতে পেরেছিস। সকলের ফোনেই বসাতে হবে। সেটা জানিয়েও করা যেতে পারে, না জানিয়ে গোপনে চুপিসাড়েও হতে পারে। তাই না?

হ-হ-হ-হ-হ-হ্যাঁ।

তাহলে কে চোর জোচ্চোর গুপ্তচর—তুই কিছুই জানিস না, কিন্তু সন্দেহ বশে তুই দেশের সতেরো কোটি স্মার্ট ফোনের সিস্টেমে সেই অ্যাপ ঢুকিয়ে দিলি। তাহলে আগে যেমন তোকে সতেরো কোটি ফোনের কাজকর্মকে মনিটর করতে হচ্ছিল এখনও তাই হচ্ছে। তাই না?

আমাকে একটা ম্যান্ডেটরি হ্যাঁ এবার বলতেই হল।

তাহলে আগে যা ছিল তার থেকে দেশের নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা তুই কোথায় পাচ্ছিস বল।

তা বটে।

কিন্তু দেশের সমস্ত নাগরিকের ফোনে তুই একটা নজরদারি অ্যাপ ঢুকিয়ে দিলি সেই কাজের কথা বলেই।

আর একটা করে চা বলি? আমাকে এখন একটা রিসেস নিতেই হবে, যে করেই হোক।

সে বল, কিন্তু এই কথাটা শেষ করে নিই বরং।   

আচ্ছা, বলে নিন।

যাকে ধরেছে সে গুপ্তচর হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। চটাদা হেসে বলল, খবরের কাগজে যা বেরিয়েছে, তাতে কিছুই ঠিক মতো বোঝা যাচ্ছে না।

বা রে, এই তো বেরিয়েছে, সামরিক ঘাঁটির বিভিন্ন তথ্য পাচার করছিল। ক্যাম্পের সামনে থেকে ছবি তুলে পাঠাচ্ছিল। সেগুলো দেখেননি?

তুই কখনও কোনো মিলিটারি বেস ক্যাম্পের সামনে দিয়ে যাতায়াত করেছিস?

আমি একটু ভেবে নিয়ে বললাম, করেছি।

গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিস? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু দেখেছিস? সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া টেনেছিস সেখানে?

আরে না না, খুঁটিয়ে দেখব কি, এক মিনিটও দাঁড়াতেই দেয় না। গেটের সিকিউরিটির লোক এসে বলে, ভাগ যাও ইহাঁ সে। ইধর তুমহারা ক্যায়া কাম হ্যায়?

একজ্যাক্টলি! শোন, ভেতরের লোক না হলে মিলিটারির ব্যাপারে তুই কিছুই তথ্য বের করতে পারবি না। বড় জোর বলতে পারবি, অমুক জায়গায় একটা এত নম্বর ক্যাম্প আছে। সে আর এমন কী গোপন ব্যাপার?

তাহলে আপনি বলছেন, লোকটাকে ফালতু ধরেছে?

সে আমি বলছি না। হয়ত ওর ভেতরে কেউ কনট্যাক্ট আছে। তার মাধ্যমে তথ্য পেতেও পারে। সে সব তো বেরয়নি। যা কাগজে বেরিয়েছে তার কথাই বলছি। তাতে সেই লোক যা তথ্য পেয়েছে, তার জন্য গুপ্তচর হতে হয় না, এমনিতেই পাওয়া যায়। আর তা জানবার জন্য তোর ওই ঢুকিসাস অ্যাপ না কী বলিস, তারও দরকার নেই। মোবাইলের নিয়মিত যে মনিটরিং হয় তাতেই ধরা পড়ে।

আমাকে মানতেই হল, চটাদার কথায় কিছু যুক্তি আছে, যা খণ্ডানোর মতো আমার হাতে মালপত্র নেই। মেজাজটা একটু খিঁচরে গেল। চটাদাকে এক বার অন্তত ঘোল খাওয়াব ভেবে ছুটে এলাম, অথচ এখন নিজেই ওনার কথার জবাবে ঠান্ডা মেরে যাচ্ছি। কী বলব বুঝতে পারছি না।

চটাদাই গলা চড়ালেন, তারুদা, বাইরে দুটো গোটা চা।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নে, চা খেয়ে মাথাটাকে রিইনস্টল করে একবার রিস্টার্ট করে নে।

আমি বেজার মুখে বললাম, অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে, খবরের কাগজে যা লেখে তার কিছুই প্রায় বিশ্বাস করা যাবে না!

তা কেন? চটাদা উদার কণ্ঠে বললেন, খেলার খবর, আবহাওয়ার পূর্বাভাষ যা লেখে বিশ্বাস কর না যত খুশি। কিন্তু যে সব খবরে রোজানা রাজনীতি আছে, প্রচার আছে, ভোটমূল্য আছে, সেখানে ছাঁকনি লাগাবি।

বুঝলাম। বলে উঠে পড়লাম। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে যখন উঠতে যাচ্ছি, তখন—

আর শোন, টিভি দেখিস না তো?
0 Comments

Post Comment