রাজস্থানের এক সমৃদ্ধ জনপদ যোধপুর। একদা এটি ছিল রাজার অধীন। যোধপুরের বেশ কিছুটা মরুভূমি। ভোপালগড় এমনই মরু অঞ্চল। আছে ছোট ছোট পাহাড়ও। বাগোরিয়া এমনই মরু-পাহাড়ের গ্রাম। এখানে পাহাড়ের উপরে আছে এক দেবীমন্দির। দুর্গামন্দির। সমস্ত নিয়ম ও পদ্ধতি মেনে এখানে নিত্য পুজো হয়। নবরাত্রিতে হয় বিশেষ পুজো। মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের বয়স এখন ৮২ বছর। তাঁর নাম জামালুদ্দিন খান।
বাগোরিয়ায় ও সংলগ্ন এলাকায় জামালুদ্দিনের ব্যাপারই আলাদা। তাঁর মতো সম্মান আর কেউ পান না। কারণ, মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছাড়াও দু-বছর আগে পর্যন্ত তিনিই ছিলেন মসজিদের নামাজ পড়ানোর কারী সাহেব। বয়সের ভারে এখন প্রতিদিন ৪০০ পাহাড়ি সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে যাওয়া-আসা সম্ভব হয় না বলে মসজিদের দায়িত্ব ছেড়েছেন। এখন মন্দিরেই থাকেন, নিত্যপুজো তাঁর দায়িত্ব। সংবাদমাধ্যমকে জামালুদ্দিন বলেছেন, “৬০০ বছর ধরে আমার পূর্বপুরুষরা এই মন্দিরের পুরোহিত। এখন আমি করছি। তারপর আমার ছেলে মেহরুদ্দিন করবে। আমার কাছেই সবকিছু শিখেছে। মা দুর্গার প্রতি আমাদের বংশের সকলেরই অগাধ ভক্তি, শ্রদ্ধা।”
.
কিন্তু মুসলমান হয়েও দুর্গাপুজো কেন? তাও ৬০০ বছর ধরে?
.
একটি অলৌকিক ঘটনাই সে দিকে মোড় ঘুরিয়েছে। একদা সিন্ধের বাসিন্দা ছিল এই মুসলমান পরিবার। ছয় শতাব্দী আগে ভয়ঙ্কর খরার কারণে সিন্ধ ছেড়ে পরিবারটি উটের পিঠে যাবতীয় সম্পদ চাপিয়ে মধ্য ভারতের কোনও বাসযোগ্য স্থানের খোঁজে রওনা হয়। জামালুদ্দিন বলেছেন, “একদিন হঠাৎ দুটো উটের পা ভেঙে গেলে পূর্বজনেরা এই মরুভূমিতেই দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হন। কয়েকটা দিন খাবার আর পানীয় জলের অভাবে গোটা পরিবারই প্রায় মৃত্যুমুখে। তখনই একদিন রাতে পরিবারের এক সদস্য স্বপ্নে দেখেন, মা দুর্গা কাছেই এক জায়গায় পানীয় জলের ধাপ কুঁয়ো বা স্টেপ ওয়েলের সন্ধান দিলেন। পথও বলে দিলেন। আর বললেন, সেই কুঁয়োর নিচে তাঁর একটি মূর্তি পড়ে আছে। সেটিকে উদ্ধার করে তাঁরা যেন পুজোর ব্যবস্থা করেন।
পরদিন সেই পথনির্দেশ মেনে সেই ধাপ কুঁয়ো পাওয়া যায়। জল পেয়ে প্রাণ বাঁচল সকলের। মূর্তিও উদ্ধার হল। জামালুদ্দিন বলেছেন, “আমাদের পূর্বপুরুষরা সিদ্ধান্ত নেন, আর কোথাও যাওয়া নেই। এখানেই মায়ের পুজোর ব্যবস্থা হবে। ধীরে ধীরে তাঁরা মন্দির পড়ে তোলেন। মন্দিরে পুজো দিতে থাকেন তাঁরাই। মন্ত্র জোগাড় করে শেখেন, শেখেন পুজোর পদ্ধতিও। আবার স্বধর্মের মসজিদও পড়ে তোলেন। সেখানেও নামাজ আদায়ের দায়িত্ব নেন। সেই থেকে পাঁচ ওয়ক্ত নামাজ পড়া আর নিত্যসেবা দুটিই পরিবারের সকলের কাজ।
.
বাগোড়িয়ায় বহু হিন্দু বাস করেন। তাঁদের নিয়ম মেনে নবরাত্রির সময় বাগোড়িয়ায় সব বাড়িতে নিরামিশ রান্না হয়। এখানকার সরপঞ্চ থানারাম জাখর বলেছেন, “শিশুকাল থেকেই জানি, মা দুর্গার নির্দেশে এই সিন্ধি মুসলমান পরিবারের সদস্যরাই এই মন্দিরের পুরোহিতরা হবেন। মায়ের ইচ্ছা, আমরা তাঁকে সম্মান করি।” বিগত ৬০০ বছরে অনেক বদলে গেছে বাগোড়িয়া। কিন্তু সেই ধাপ কুঁয়ো এখনও তেমনই আছে। গ্রামের মানুষের কাছে এই কুঁয়ো পরম শ্রদ্ধার। বাইরের লোকজন এলে তাঁরাও কুয়োর জল ছুঁয়ে আসেন, আশির্বাদ কামনা করেন মা দুর্গার কাছে। ধর্মীয় বিরোধে দেশ উত্তাল হলেও, টুকরো হলেও এখানে কখনই তাঁর ছায়াও পড়েনি।