অন্তত একজন মাস্টারমশাইকে চিনি যিনি খুব ছোটবেলায় পিতৃহীন হন, বাবা খুব সামান্য কাজ করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর মা লোকের বাড়িতে বাসন মাজা, কাপড় কাচার কাজ করে ছেলেকে বড় করেন। আমার বছর কুড়ির ছাত্রজীবনে অন্তত পাঁচ জন সহপাঠীকে পেয়েছি যারা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া, কিন্তু মেধা এবং পরিশ্রম করার ক্ষমতায় অন্য সকলের চেয়ে দু তিন গুণ এগিয়ে। নিজেদের ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে তারা সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছে। প্রাথমিক স্তরে একটা স্কুলে দু দফায় দু তিন বছর পড়েছিলাম, যেখানে প্রত্যেক ক্লাসে প্রায় নব্বই শতাংশ পড়ুয়াই প্রথম প্রজন্মের। আমার বাবা যে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সেই স্কুলেরও অনেক ছাত্রছাত্রী স্কুল শেষ করতে পারত না। লেখাপড়ার চেয়ে, পরীক্ষা পাশ করার চেয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের তাগিদ তাদের এবং তাদের পরিবারের অনেক বেশি। বাবার মুখে শুনতাম, এখন গঞ্জ এলাকার স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রীর কাছেও শুনি, অনেক ছাত্রীর মেধা থাকা সত্ত্বেও বিয়ে হয়ে যায় মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই। বেশি লেখাপড়া শিখলে পাত্র পাওয়া মুশকিল হবে, বরপণের অঙ্কটা তখন নাগালের বাইরে চলে যাবে। অনেক ছাত্রী স্কুলে এসে থেকে কেবল জানতে চায় কখন মিড ডে মিল পাওয়া যাবে, কারণ বাড়ি থেকে ভরপেট ভাত খেয়ে আসার সৌভাগ্য তাদের হয় না।
এই আমাদের দেশ। এ দেশের শিক্ষানীতি নিয়ে আমরা কথা বলছি।
এটা মার্ক জুকরবার্গের দেশ নয়। আমরা ক্রমশ ভুলে যাচ্ছি যে সুন্দর পিচাই, সত্য নাডেলারা এখানে ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়। আর তাদের গুগল, মাইক্রোসফটের সি ই ও হয়ে বসায় এ দেশের একটি মানুষেরও এক কণা লাভ হয়নি। ওগুলো কোন ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, কারণ ওতে ওঁদের দুজনের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ফুলে ফেঁপে ওঠা ছাড়া পৃথিবীর আর কারো কোন লাভ বা ক্ষতি হয়নি। প্রথম অনুচ্ছেদে যাদের কথা লিখেছি, তারাই এ দেশের মানুষ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। আমার পরিচিত মাস্টারমশাই যে শেষ পর্যন্ত মাস্টারমশাই হতে পেরেছেন, আমার ঐ সহপাঠীরা কেউ কেউ বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে, অধ্যাপনা করে তাক লাগিয়ে দিতে পেরেছে, তার কারণ অনেক দূর পর্যন্ত তাদের পড়াশোনার খরচের সিংহভাগ বহন করেছিল সরকার। তখনো বিপুল মাইনের বেসরকারী স্কুলে দিগ্বিদিক ভরে যায়নি (বিশেষত যারা অভিভাবকদের বলতে পারে দরকার হলে বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করে মাইনে দিন, নয়ত স্টুডেন্টকে নিয়ে যান), টাকা থাকলেই ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হওয়ার ঢালাও সুযোগ ছিল না। কিন্তু মেধা থাকলে পড়া আটকাত না। কারণ পড়তে পুঁজির দরকার হত না, সরকারই ছিল মধ্যবিত্ত এবং গরীব বাবা-মায়ের পুঁজি। “লম্পট”, “দুশ্চরিত্র”, “দুর্বল” প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আর তাঁর বিরোধীদের আসনে থাকা “গোঁড়া”, “সেকেলে”, “শিল্পবিরোধী”, “দেশদ্রোহী” বামপন্থীরা এমন ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত জানত দারিদ্র্যের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে বড় সুযোগ লেখাপড়া করা। এমন নয় যে তখন পাশ করলেই টপাটপ চাকরি জুটে যেত, দেশে বেকারত্ব ছিলই না। কিন্তু মেধা আছে, পুঁজি নেই বলে লেখাপড়া শেষ হবে না — এমনটা ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছিল।
সে ধারা গতিপথ বদলাতে শুরু করেছিল আজকের উচ্চবিত্তদের পরম পূজ্য মনমোহন সিং আর নরসিমা রাওয়ের আমল থেকে। আমাদের ছাত্রজীবনের শেষদিকেই দেখেছি অনেকে উষ্মা প্রকাশ করছে “ব্যাঙ্গালোর ট্যাঙ্গালোরে কত অপশন। একটু টাকা খরচ করলেই ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া যায়। এখানে লেফটিস্টগুলো না ইন্ডাস্ট্রি রেখেছে, না কলেজ খুলতে দিচ্ছে।” কোয়ান্টিটি-কোয়ালিটির ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কের কথা তখন কেউ শুনতে চায়নি। বামফ্রন্ট সরকারও, শেষ অবধি, ঢালাও কলেজ খোলার অনুমতি দিলেন। ক্যাপিটেশন ফি কথাটা আমাদের অভিধানে জাঁকিয়ে বসল। সেই সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের রমরমা হল। তাদের সোম, বুধ, শুক্র একরকম ইউনিফর্ম; মঙ্গল, বৃহস্পতি অন্যরকম। সেখানে না পড়লে মনুষ্য জন্ম বৃথা বলে জানা গেল। ভদ্রসন্তানদের ইংরেজি শিখতে না দেওয়ার বামপন্থী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সে এক যুগান্তকারী আন্দোলন। কোন মাধ্যমে পড়াশোনা হচ্ছে সেটাই হয়ে দাঁড়াল মুখ্য। কী পড়ানো হচ্ছে, কত ভাল পড়ানো হচ্ছে, কারা পড়াচ্ছেন — সেসব ছেঁদো ব্যাপার হয়ে গেল। সরকারী স্কুলগুলো হয়ে পড়ল প্রান্তিক। কারণ ভদ্রসন্তানরা আর ওমুখো হলেন না, ফলে মাস্টারমশাই দিদিমণিদের পড়ানোর উৎসাহ তলানিতে পোঁছাল। ঝাঁ চকচকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নেই যে গ্রামাঞ্চলে তার কথা আলাদা। শহর বা মফস্বলে যারা লোকের বাড়িতে কাজ করে বা রিকশা চালায় বা ভাগচাষী, তাদের ছেলেমেয়েদের আবার কিসের মেধা? কী হবে তাদের লেখাপড়া শিখে? পথে দেখা হতে আমাদের এলাকার নামকরা ছেলেদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক একদিন হতাশ গলায় বললেন “আগে আমাদের স্কুলে পড়ত ডাক্তার, মাস্টার, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসারদের ছেলেরা। এখন কারা পড়ে জানিসই তো। এদের নিয়ে আর কী লেখাপড়া হবে?”
সেই কারণেই সরকারী স্কুল সরকারের নিজেরও দুয়োরানি হয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারী স্কুলের ফি নিয়ে গণ্ডগোল মেটাতে নিজে আসরে নামেন, কিন্তু সরকারী স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়, নামমাত্র মাইনেয় কাজ করে যান প্যারা টিচাররা। অনশন করতে গিয়ে পথের পাশে মারা যান, কাগজের ভিতরের পাতায় খবর হয় আর মহামান্য আদালত নির্দেশ দেন এমন জায়গায় আন্দোলন করতে হবে যেখানে কারোর অসুবিধা হবে না।
এইসব ভাবনাতেই শিলমোহর দিল নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি। ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল। যাদের বাবা-মায়ের সঙ্গতি আছে সেই ভদ্রসন্তানরা দামী স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। যত যাবেন তত গরীব, সংখ্যালঘু, নিম্নবর্গীয়, জাতি উপজাতির মানুষই কেবল পড়ে থাকবেন সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আর তাঁদের লেখাপড়া করা যে তেমন জরুরী নয় সে সিদ্ধান্ত সমাজ এবং সরকার তো নিয়েই রেখেছে। তাছাড়া সরকারী প্রতিষ্ঠানের আর কী দাম থাকবে? সরকারী পক্ষপাত তো রিলায়েন্স ইউনিভার্সিটির মত বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিই। তাছাড়া নতুন শিক্ষানীতি বলেই দিয়েছে “চরে খাও।” রামকৃষ্ণ মিশন বা সেন্ট জেভিয়ার্সের মত হাতে গোনা কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া কে আর চরে খেতে পারবে? মাইনে বাড়বে। মধ্যবিত্ত ঋণ নেবে, নিম্নবিত্ত পড়া ছেড়ে দেবে। এ হেন বেসরকারীকরণে ভদ্রলোকদের খুশি হওয়ার মত আরেকটা ব্যাপার ঘটবে। যাদের তাঁরা “সোনার চাঁদ, সোনার টুকরো” বলেন, তাদের লেখাপড়া করা কমে যাবে। এমনিতেই বহু জায়গায় সংরক্ষিত আসনগুলো পূরণ হয় না (তথাপি জেনারেল ক্যাটেগরি ‘বঞ্চিত’), এরপর যেমন-খুশি-ফি-বাড়াও ব্যবস্থায় আরো কম ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবে। কারণ ভদ্রলোকদের মস্তিষ্কের গভীরে প্রবিষ্ট প্রোপাগান্ডা যা-ই বলুক, ভারতের গরীব মানুষদের মধ্যে বামুন, কায়েতদের চেয়ে তফসিলি জাতি উপজাতিভুক্ত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি।
আপনি ফোনে, ট্যাবে, ল্যাপটপে বা ডেস্কটপে এতদূর পড়ে ভাবছেন বাজে সময় নষ্ট হল। ফালতু লোকেদের জন্য এত অশ্রুপাত কিসের? আমার জন্য, আমার ছেলেমেয়ের জন্য তো নতুন শিক্ষানীতি অনেক দ্বার খুলে দিল। সত্যি কি তাই? নতুন ব্যবস্থায় আপনারাও ফালতু লোকেদের দলে পড়ে যাবেন না তো? মনে রাখবেন, এখন থেকে কিন্তু ডিগ্রির দাম আর আগের মত থাকবে না। ফার্স্ট ইয়ারে পড়া ছেড়ে দিলে সার্টিফিকেট, সেকেন্ড ইয়ারে ছাড়লে ডিপ্লোমা, শেষ অব্দি পড়লে ডিগ্রি। অধ্যবসায়ের বিশেষ দাম থাকল কি? চাকরির বাজারে এমন ডিগ্রির দাম থাকবে তো? ফিজিক্সের সাথে ইতিহাস পড়া যাবে শুনতে রোমহর্ষক। কিন্তু অঙ্ক আর কেমিস্ট্রি না পড়ে ইতিহাস পড়লে ফিজিক্স শেখা যাবে তো? অন্তত চাকরি বাকরি পাওয়ার মত শেখা সম্ভব হবে তো? যে সরকার এই শিক্ষানীতি বানিয়েছেন তাঁরা আবার মেকলের শিক্ষাব্যবস্থার বড় সমালোচক, কারণ ওটা ছিল ইংরেজ সরকারের কেরানি তৈরি করার ব্যবস্থা। তার বদলে এঁরা এনেছেন বহুজাতিকের বাধ্য কর্মী তৈরির ব্যবস্থা, তাই স্কুলস্তর থেকেই স্থানীয় ব্যবসায় ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা। কিন্তু সেটাও সুচারুভাবে সম্পন্ন হবে তো? তাছাড়া শিক্ষক শিক্ষিকাদের মেধাও তো এবার থেকে বাজারের পণ্য হয়ে গেল, তারও দরাদরি হবে। ইতিমধ্যেই উচ্চশিক্ষায় পার্ট টাইমার দিয়ে কাজ চালানো দস্তুর হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে তার যোগ্যতার উপযুক্ত দাম পাবে তো?
পাঠ্যক্রম কী হবে সে আলোচনায় কালক্ষেপ করা উচিৎ হবে না। যে যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এসে গেছে সেখানকার খবর রাখলেই সহজে আন্দাজ করা যায় নজরুল, সুকান্ত বাদ যাবেন। রবীন্দ্রনাথ টিকে গেলেও যেতে পারেন, তবে ‘ভারততীর্থ’, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’ ইত্যাদি কবিতাগুলো ছেলেমেয়েদের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেওয়া হবে না। বাংলার ইতিহাস ব্যাপারটা বাদ দেওয়াই ভাল হবে, কারণ সেই পাল যুগ থেকে শুরু করে পলাশীর যুদ্ধ অব্দি কেবল বিধর্মীদের রমরমা তো। আর উনবিংশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলন ব্যাপারটা একদম পড়ানো যাবে না। ঐ সময়েই তো বাঙালিরা সব অহিন্দু ম্লেচ্ছ হয়ে গেল। রামমোহন বলে একটা লোক গভর্নর জেনারেলকে চিঠি লিখল (ডিসেম্বর ১৮২৩), এ দেশের যুবকদের সংস্কৃত পড়ানোয় অত মন না দিলেও চলবে। ইংরেজি পড়ান, আধুনিক দর্শন পড়ান। মানে লোকটা কেবল পবিত্র সতীদাহ প্রথা তুলে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। ও আপদ বিদেয় হতে না হতেই আবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলে আরেকজন হাজির। সে আরো বড় বিপদ। কেবল বিধবাদের বিয়ে দিয়েছে, মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছে তা নয়; পণ্ডিতদের সাথে, ব্যালান্টাইন সাহেবের সাথে ঝগড়া করে বেদ, বেদান্ত, সংস্কৃতকে পাশে সরিয়ে দিয়ে ইংরেজি আর পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষার পাকা ব্যবস্থা করেছে। ওসব পড়েই তো দেশটা উচ্ছন্নে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র — এসব বুদ্ধি তো ঐ পশ্চিমের জানলা গলেই ঢুকে পড়েছে।
অবশ্য বাংলা ভাষাটাই তো থাকবে না, বাংলার ইতিহাসের কথা আসছে কোথা থেকে? ইংরেজি মাধ্যমে তো পড়াতে দেবেন না বলছেন সরকার। তা আপনারা যারা ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে চেয়েছিলেন, তারা কি আর বাংলা মাধ্যমে পড়াবেন এখন? তা তো হয় না। সরকার জানেন সে কথা। তাই বলবেন হিন্দি মাধ্যমে পড়াতে। বোকা তামিলদের তাতে আপত্তি থাকতে পারে, আপনাদের তো নেই। এমনিতেই তো ছেলেমেয়ের সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দি করে রেখেছেন অনেকে।
নয়া শিক্ষানীতি কি জয়, হিন্দি মিডিয়াম কি জয়।