যে যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে।
এক অভূতপূর্ব বিচারের রায় এ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষক – শিক্ষিকাদের ভবিষ্যৎকে অবশেষে এই প্রহসনের দিকেই ঠেলে দিল। ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের মামলার রায়ে নিয়োগে অনিয়মের পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করা সম্ভব না হওয়ায় পুরো প্যানেলটাই বাতিল করে দিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। চাকরি গেল ২৫০০০ এর ও বেশি শিক্ষক অশিক্ষক কর্মচারীর । বৃহস্পতিবার সকালে দেশের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ এই রায় জানিয়ে বলে ২০১৬ সালের কলুষিত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আর সংশোধন সম্ভব নয় তাই হাইকোর্টের রায়ে হস্তক্ষেপ না করে পুরো প্যানেলই বাতিল করা হল।
২০১৬ সালের এস এস সি নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে গ্রুপ সি, ডি নবম, দশম, একাদশ, দ্বাদশ এর সমস্ত নিয়োগই এক কলমের খোঁচায় পুরো বাতিল করে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট কারণ বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও মহম্মদ সব্বর রাশিদির ডিভিশন বেঞ্চ যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করতে সক্ষম হয়নি, ফলে মোট ২৬৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল হয়ে যায়। এস এস সি কলকাতা হাইকোর্টকে জানিয়েছিল ৬২৭৬ জনই বেআইনিভাবে চাকরি পেয়েছে কিন্তু তদন্তে আরও অনেক নাম উঠে আসে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে ওএমআর শিট নষ্ট করে ফেলা হয়েছে তাই যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের পৃথকীকরণ সম্ভব নয়, তাই পুরো প্যানেলই বাতিল, এ যেন আঙ্গুল ব্যাথার ওষুধ না মেলায় হাত কেটে ফেলার মত অদ্ভুত (হাল্লা রাজার) বিচার। আর এই নজিরবিহীন রায়কে কাজে লাগিয়ে মানবিক মুখোশের আড়ালে নোংরা রাজনৈতিক খেলায় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে উঠে পড়ে লেগেছে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলগুলি।
তথ্য অনুযায়ী - ২০১৬ সালের এসএসসি-র মোট নিয়োগপত্র ২৫,৮৪৪ র মধ্যে, মোট নিয়োগ ২৫,৭৫৩, এর মধ্যে, ইনসার্ভিসের ৪২৫ (যারা আগের কাজে যোগ দিতে পারবে), বাদ দিলে মোট নিয়োগ = ২৫,৭৫৩ - ৪২৫ = ২৫,৩২৮। একমাত্র ১ জন ক্যানসার রোগী সোমা দাস বাদ দিলে সর্বমোট চাকরি বাতিল হয়েছে ২৫,৩২৭ জনের, যাদের মধ্যে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে যেমন ওএমআর কারচুপি এবং র্যাঙ্কজাম্প করে চাকরি পেয়েছেন ৪,৩২৭, SSC-র সুপারিশ ছাড়াই চাকরি পেয়েছেন ২,৮২৩, প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও চাকরি পেয়েছিলেন ১,১৭৪, অতএব মোট ৮,৩২৪ জন অযোগ্য বিবেচিত হয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, এই অযোগ্য ৮,৩২৪ জন চাকরিপ্রাপ্তদের বেতন ফেরত দিতে হবে বাৎসরিক ১২% সুদ সমেত। এখানেও এই রায়ে এক বিশাল অসঙ্গতি, কারণ যাঁরা দোষী বা কারচুপিতে অভিযুক্ত তাঁরাই টাকা ফেরত দেবেন, তার অর্থ এই যে দোষী- নির্দোষদের আলাদা করা সম্ভব নয় বলা হয়েছে, সেটা ভুল। তাহলে সমস্যা কোথায় ? ২৫,৩২৭ এর মধ্যে ৮,৩২৪ জন অযোগ্য কথাটার মানে এই নয় যে বাকি ১৭,০০৩ জন যোগ্য। এই ১৭,০০৩ জন যোগ্য না অযোগ্য এটা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। তার মানে এরা বলির পাঁঠা। সংবিধানের আর্টিকল ১৪ এবং ১৬ অনুযায়ী এঁদের নিয়োগপ্রক্রিয়া না হওয়ার দরুণ এঁদের চাকরি খোয়াতে হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্কুলে ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে বসেই শিক্ষক – শিক্ষিকারা জানতে পেরেছে এই আমানবিক রায়ের কথা এবং তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের কোন অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সেটা অনুমান করা কোন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের পক্ষে কঠিন নয়। শুধু তাই নয় চাকুরিরত শিক্ষক–শিক্ষিকারা যে স্কুলগুলোতে বর্তমানে কাজ করছেন, ক্লাস নিচ্ছেন তাদের পদপূরণই বা হবে কিভাবে, এই সব স্কুলগুলোতে যে বিশাল সংখ্যায় ছাত্র ছাত্রীদের পড়াশুনা বা ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার দায় কে নেবে, এ নিয়ে কারও মাথা ব্যাথা নেই।
বলাই বাহুল্য যে এই রায়ে একরকম ইচ্ছাপুরণ হল রাজ্য সরকার এবং খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণ মুড়ি মিছরি মিশে যাওয়ায় তিনি প্রবল নিন্দার হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে গেলেন। এই মামলা চলাকালীন বিভিন্ন সময়ে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা ধরা পড়েছে। বহু তাগাদা সত্তেও এস এস সি ওএমআর সীট জমা দিতে পারেনি, এমনকি রাজ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং এস এস সি র মধ্যে অযোগ্যদের তালিকা সংক্রান্ত বিষয়েও বিস্তর ফারাক দেখা গেছে, ওএমআর সীট এর মিরর স্ক্যান অনুপস্থিতি, পিডিএফ ভিন্ন অন্য ফরম্যাটে স্ক্যান কপি পাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যাপারে রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত অপদার্থতাই বারবার সামনে প্রকট হয়েছে, কিন্তু শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত রাজ্য সরকার খুব সুবিধাগতভাবেই দোষারোপ করছেন বিরোধী দলগুলিকে, তোপ দাগছেন উকিল বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের উপর কেননা তিনি এই নিয়োগ মামলার প্যানেল বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। এর আগে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিত গঙ্গোপাধ্যায় ৫৫০০ প্রার্থীর চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কলকাতা হাইকোর্টের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করেছিল। যা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতে রাজ্য স্তরের সিলেকশন টেস্ট-২০১৬ (এস. এল. এস. টি)'র নিয়োগ প্রক্রিয়াটিকে এবং তার মাধ্যমে করা সমস্ত নিয়োগ বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছিল। সেই সময়ে এই রায় মেনে নিয়ে রাজ্য সরকার নিজে দায়িত্ব নিলে হয়ত এতবড় বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেত, কিন্ত এ রাজ্য়ে খাদ্য, স্বাস্থ্যের মত শিক্ষা ক্ষেত্রেও যেখানে পদে পদে দুর্নীতির পাঁকে পঙ্কিত সেখানে এরকম জল ঘোলা করে পুরো বিষয়টি গুলিয়ে দেবার চেষ্টা যে সুপরিকল্পিত একটি রাজনৈতিক চাল সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়না।
সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল যেদিন পার্লামেন্টে ওয়াকফ বিল পাস হল, সেদিনই রাতে সুপ্রিম কোর্ট এই জাজমেন্ট এর নোটিশ পাঠায়, যাতে এ রাজ্যে ওয়াকফ বিল নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য না হয় বা প্রতিক্রিয়া দেওয়ার উপায় না থাকে। এর আগে বাম জমানায় ত্রিপুরাতে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের আমলে ২০১০ এবং ২০১৩ সালে স্কুল শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ১০০০০ জনের দুর্নীতিগ্রস্ত নিয়োগ মামলা নিয়ে ত্রিপুরা হাইকোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিমকোর্টে গিয়েছিল ত্রিপুরা সরকার, কিন্তু সেখানেও সম্পূর্ণ প্যানেলই বাতিল হয়ে যায় এবং তার পরের বছরই ভোটে পড়ে যায় মানিক বাবুর সরকার, কিন্তু ত্রিপুরার ৪০ লক্ষ জনসংখ্যার নিরিখে ১০০০০ সংখ্যাটি বড় হলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর রাজ্যে ১০ কোটির জনসংখ্যার মধ্যে ২৫০০০ চাকরিহারা সেরকম প্রভাব ফেলতে পারবে কি না সেটি প্রশ্নযোগ্য।
তা ছাড়া, বেড়াল তপস্বীর মত মুখ্যমন্ত্রী আগেই ৭ এপ্রিল শিক্ষক–শিক্ষিকাদের নিয়ে বৈঠক ডেকে বিরোধী দলদের প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন রাজ্যের স্কুল ও কলেজেগুলিতে ১ লাখ শূন্য পদের কথা, অতএব এই ফাঁকে আর বড় টোপ দিয়ে আগামী দিনে ভোটে নিজের জায়গা পোক্ত করে রাখার কৌশল। এই ১৭০০০ প্রার্থী দের আবার পরীক্ষা নেবার কথাও তিনি বলেছেন কিন্তু সেটি আরও বড় রকমের সম্মানহানি এই শিক্ষক – শিক্ষিকাদের জন্য কারণ তারা তাদের অভিজ্ঞতা আর সিনিয়রিটি হারাবেন এবং চাকুরিতে ছেদ পড়বে। এই লজ্জাজনক পরিস্থিতির দিকটা কারও মাথায় আসছেনা। এই সম্মানহানির ভয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষক–শিক্ষিকাদের আত্মহত্যার চেষ্টা করার খবর ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে যারা চাকুরিতে বহাল ছিলেন, আগামী দিনে পরিবার চালানো ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার ন্যুনতম উপায়টুকু তাঁদের সামনে নেই।
ঘোলা জলে মাছ ধরার জন্য বিজেপি ও সিপিআইএম ও কম যায়না কারণ এই ইস্যুতে সরকার পরে গিয়ে তো আর নতুন বাম সরকার হবে না, হবে বিজেপির সরকার। আর বিজেপি এলে সরকারি স্কুলগুলো উঠে গিয়ে সেখানে আদানি, আম্বানি দের মত বড় বড় কর্পোরেট দের নামী স্কুল খোলার পথই প্রশস্ত হবে। বাম আমলে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের রমরমার বিষয়টি সবারই অবগত। আবার ঠিক যেমন ভাবে আরজিকর আন্দোলনকে হাতিয়ার করে শুভেন্দু অধিকারির দল নবান্ন অভিযান বা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালিয়েছে গত বছর, সেই ভাবেই তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে গুলিয়ে দিতে চাইছে শিক্ষক – শিক্ষিকাদের আন্দোলনের অভিমুখ। ২০২০ সাল থেকে ধর্মতলায় ধর্নামঞ্চে আন্দোলনকারী কোলাঘাট এর শিক্ষিকা রাসমনি পাত্রের ভাষায় রাজ্য সরকার, বিরোধী দল, এস এস সি সবাই মিলে সেটিং করে এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে, কারণ অযোগ্যাদের বাদ দিয়ে অপেক্ষামান তালিকা থেকে যোগ্যদের চাকরী দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
আজ পর্যন্ত শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতবর্ষে সবচেয়ে বড় জালিয়াতি -দুর্নীতির উদাহরণ মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারি, কিন্তু সেখানেও সরকার দোষীদের সাব্যস্ত ও চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করেছে সি বি আই তদন্তের মাধ্যমে, তাহলে এরাজ্যের ঘটনায় বারবার সি বি আই ব্যর্থ হচ্ছে কেন ? কোনও কোনও শুভানুধ্যায়ী রাজনৈতিক দল শিক্ষক – শিক্ষিকাদের জন্য দরদ প্রকাশ করে বলছেন সংবিধানের মৌলিক অধিকার এর দিক থেকে, সুপ্রিমকোর্টে এ রিভিউ পিটিশনএর জন্য আবেদন করা কিন্তু একদিকে যেমন সেটির ঝামেলা অনেক অন্যদিকে সেই পিটিশন আদৌ গ্রহণ বা বিবেচনা হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
এই মুহূর্তে আন্দোলনকারী শিক্ষক – শিক্ষিকাদের আশু কর্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সরাসরি আলোচনায় বসে স্বচ্ছ তদন্তর মাধ্যমে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সবার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবী জানান। শুধু শিক্ষামন্ত্রী কে জেলে পাঠানো নয়, রাজ্য সরকার ও এস এস সি কে চাপে রেখে নিয়োগের প্রতি স্তরে, নিচুতলার কর্মী থেকে আমলা সবার জন্য কঠোর থেকে কঠোরতম বিচারের মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা যাচাই করা, তাছাড়া দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের ও বিরোধীদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে, কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছাতার তলায় না থেকে যদি সব দল কে চাপে রেখে নিজেরাই গণতান্ত্রিক ভাবে আন্দোলন সংগঠিত করা যায় সেটিই সবচেয়ে কার্যকরী বিকল্প, যাতে কোন বিশেষ দল বা রঙ এই ২৫০০০ ছেলে মেয়ের ভবিষ্যতকে ভোটের আজেন্ডা হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে।
সবশেষে একটাই কথা বলার থাকে, যে যতদিন এই রাজ্যের তথা দেশের উদয়ন পণ্ডিতরা সংগঠিত হয়ে একজোটে বলতে পারবে “দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান।“ ততদিন এই সমস্ত কর্পোরেটের পদলেহনকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর থেকেও মুক্তি নেই এবং বিচারব্যাবস্থার অচলায়তনের থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।