পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আলেয়া

  • 08 January, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 985 view(s)
  • লিখেছেন : শীর্ষেন্দু দত্ত
চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী প্রতিমা বিসর্জনের ছবি তুলতে চলে গিয়েছিলাম দুপুর দুপুর। মূল প্রসেশন শুরু হতে রাত হবে। এখন চলছে তারই প্রস্তুতি। সকালের দিকে বাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জন। তারপর যারা লাইটিং ছাড়া বিসর্জন করছে তারা নিরঞ্জন করবে। আমি দুপুরে গেছি কারণ দুপুর বিকেলের ছবিগুলো অধিকাংশ ফটোগ্রাফার তোলেনা। জানেও না তখন হয়। তারা রাতের বেলা ভিড়ভাড় আর লাইটিং সহ নিরঞ্জনের ছবি টার্গেট করে। কিন্তু গঙ্গা ধারের রাস্তায় দিনের আলোয় লাইন দিয়ে প্রতিমার মিছিলের যে ছবি তার মজাই আলাদা। আসলে আমি ডে লাইটে ছবি তোলা পছন্দ করি। এর কোনো বিকল্প নেই। আর আনুষঙ্গিক অনেক সাবজেক্ট যেগুলো আলো থাকতে থাকতে তুলে না নিলে সমস্যা। যেমন দুপাশের ভিড় করা দর্শনার্থী, ভাসানের নাচ, হকার প্রভৃতি।

                

 

চন্দননগর স্টেশনে নেমে ছবি তুলতে তুলতে চলে গেলাম চন্দননগর স্ট্যান্ডে, যেখানে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। ছবি তুলতে তুলতে সন্ধ্যে নেমে এলো। এখন শীতের আমেজ ঢুকে পড়েছে কলকাতা থেকে দুরের এসব টাউনে। সন্ধ্যাও তাড়াতাড়ি নেমে আসে।

প্রচুর ছবি তুলছিলাম। কয়েকটা জরুরী ভিত্তিতে মোবাইলেই এডিট করে অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। এখন অনলাইন নিউজ আপডেট ঘন্টায় ঘন্টায় হয়। যে যত আগে ছবি, খবর পাঠাতে পারবে তার চ্যানেল তত বেশি মাইলেজ পাবে। ওহো, বলতে ভুলে গেছি আমি একজন ফ্রিল্যান্স ফটো জার্নালিস্ট। বিভিন্ন এজেন্সিতে ছবি দিই। এটাই আমার পেশা। এই কাজটা আমি খুবই উপভোগ করি। কলকাতা থেকে দূরবর্তী গ্রাম শহরগুলোতে নিয়মিত চলে যাই পেশার টানে। কারণ কলকাতার ছবি, নিউজ কভার কাগজগুলো ওদের স্টাফ দিয়ে করে নিলেও এগুলো আমাদের মতো ফ্রিল্যান্সারদের উপরই নির্ভর করে।

আশপাশে জনসমুদ্র। ঠিক করে দাড়িয়ে ছবি তোলাটাই দুষ্কর। এই ভিড় সারারাত চলবে। অনেক দূর দূর থেকে মানুষজন এসেছে এই বিসর্জন দেখতে। রাস্তার ধারে সকালবেলা এসে চাদর বিছিয়ে জায়গা দখল করেছে।সেখানে বসেই চলছে তাদের খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম। অপেক্ষা রাতের প্রসেশনের। জিটি রোদের দুধারে সারি সারি চেয়ার পাতা হয়েছে বিসর্জন দেখার জন্য। চেয়ার পিছু ভালো টাকা ইনকাম করছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা চেয়ার ব্লক করে রেখেছে। রাতে এসে বসবে।

দেখতে দেখতে রাত বারোটা বেজে গেল। অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে। পাতাল বাড়ি বলে স্ট্রান্ডের কাছে একটা পুরনো বাড়ি আছে, প্রায় হেরিটেজ বাড়ি। যার নীচের তলার একটা বড় অংশ গঙ্গার জলের ভিতরে। ওখানটা চুপচাপ, নিরিবিলি। নিরঞ্জনস্থল থেকে জায়গাটা অনেক দূরে হওয়ায় লোকজনের ভিড় নেই। আমি পাতাল বাড়ির পাশ দিয়ে গঙ্গার দিকে চলে গেলাম। দুএকটা কুকুর আমায় দেখে ঘেউ ঘেউ করে চলে গেল। এখানে বসে আমি বাকার্ডির নিবটা বের করলাম। বোতলের জল আধা ফেলে তাতে বাকার্ডিটা ঢেলে দিলাম। এরপর একটা গুছিয়ে লম্বা চুমুক। আহহ! শান্তি! ঠোঙ্গা থেকে মাটন রোলটা বের করে কামড় দিলাম। বিসর্জনের বাজারে রাত বারোটার রোল যেমন হয়। সামনে দিয়ে গঙ্গা বয়ে চলেছে। দূরে বিসর্জনের আলো,আওয়াজ। ঢাক,ডিজে বাজছে। জগদ্ধাত্রীর নামে শ্লোগান চলছে।

এদিকটা অদ্ভুত রকমের ঠাণ্ডা! এখানে ঘন্টাখানেক বসে স্টেশনের দিকে হাঁটা লাগাবো। জিআরপিকে প্রেস কার্ড দেখিয়ে ওয়েটিং রুমে শুয়ে পড়বো। ফার্স্ট ট্রেন এলে সিধা হাওড়া।

ওপারের গাছপালা, কারখানার চিমনির ফাঁক গলে আলোর ঝিকিমিকি চলছে জোনাকীর মতো। ওপারটা জগদ্দল। একসময় ওপারে কত কলকারখানা চলত। এখন আধা বন্ধ বা অনিয়মিত।

সিপ মারতে মারতে গঙ্গার দিকে মুখ করে বসে রইলাম অনেকখন। কতক্ষণ খেয়াল নেই। মালটা শেষ হয়ে গেছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান মারতেই গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলাম! আমার পিছনে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে এক মহিলা ও একটা বাচ্চা! এত রাতে এই ফাঁকা জায়গায় এরা কি করছে! মহিলার গলা আবার শুনলাম,

-একটু শুনবেন?

আমি ব্যাগপত্তর গুটিয়ে উঠে পড়লাম।

-আপনারা এখানে এতো রাত্রে কি করছেন?

ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম।

-আমি আমার ছেলেকে নিয়ে চন্দননগরে ভাসান দেখতে এসেছিলাম। ছেলেটার হঠাৎ পটি পাওয়ায় ঘাটের কাছে এসেছিলাম। এখন ঠিক চিনতে পারছি না।

মহিলার বয়স বেশি না। বড় জোড় ত্রিশ। খুব সেজেছে। মনে হচ্ছে লাল বেনারসি শাড়ি, হাতে গলায় গয়নাও চকচক করছে। বাচ্চা ছেলেটাও সেজেগুজে হাতে একটা ক্যাপ পিস্তল নিয়ে, বছর আট-দশ হবে। এতো রাতে একা মহিলা! আবার সোনার গয়না! চন্দননগরের মতো এলাকা বলে এখনো কিছু হয়নি। গঙ্গার ওপার হলে এতক্ষণে আর খুঁজে পাওয়া যেত না।

-আপনারা যাবেন কোথায়?

-আমরা কালনা থেকে এসেছি। চন্দননগর স্টেশন অবধি চলে গেলে ট্রেন পেয়ে যাব।

-সে তো জানি। আমিও স্টেশনে যাব, চলুন।

ওদের নিয়ে আমি হাঁটতে লাগলাম স্টেশনের দিকে।

রাস্তাঘাট অন্ধকার। বিসর্জনের সময় পাওয়ার কাট থাকে চন্দননগরে। সমস্ত প্রতিমা নিরঞ্জন শেষ হবে তারপর পাওয়ার আসবে।

-আপনারা খাওয়াদাওয়া করেছেন কিছু?

-হ্যাঁ, রাতে চাউমিন খেয়েছি দুজনে।

-ও।

-আপনি কোথায় থাকেন?

মহিলা জানতে চাইল।

-আমি কলকাতায় থাকি।

-ভাসান দেখতে এসেছেন?

-না। আমি জার্নালিস্ট। ছবি তুলতে এসেছি।

- ও আচ্ছা।

আমি বাচ্চাটার দিকে দেখলাম। এতো ছোট বাচ্চা! এত রাতে দিব্যি সটান হেঁটে চলেছে মায়ের হাত ধরে! ওর চোখেমুখে ক্লান্তির কোনো লেশমাত্র নেই মায়ের মতোই!

-তোমার নাম কি?

ছেলেটা হেসে বলল,

-প্রবীর কুমার দে।

-বাহ সুন্দর নাম! কোন ক্লাশে পড়ো?

-ক্লাশ থ্রি।

ওর মা বাচ্চাটার হাত আরেকটু টেনে ধরে হেসে বলল,

-খুব দুষ্টু। ওর জন্যই আসা।

মহিলা চলতে চলতে ব্যাগ খুলে ছেলেকে একটা চকলেট দিল। আরেকটা চকলেট আমার দিকে হাত টানটান করে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-নিন।

-আরে না না, আমি কেন! আপনারা খান।

তিনি চোখ পাকিয়ে বললেন,

-খান বলছি। এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন হবে!

আমি একটু থতমত খেয়ে চকলেটটা নিয়ে নিলাম। মোড়ক খুলে সেটা চুষতে চুষতে বললাম,

-আপনি নিলেন না? 

-হাঁ, নিয়েছি তো। এই দেখুন।  

বলে ঠোটের মধ্যে চকোলেটটা বের করে দেখালো। ওর ঠোট দুটো গাঢ় লিপস্টিকে ঢাকা হলেও সেটা যে পুরুষ্ট তা চোখ এড়ালো না। চকলেট দেবার সময় ওর হাতটাও দেখেছি। নির্লোম সুডৌল যাকে বলে। আঙুলে নেলপালিশ দেওয়া বড় বড় নখ।

দেখতে দেখতে আমরা স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। একটা বেঞ্চে এসে সকলে বসলাম।

-আপনি একা বাচ্চাকে নিয়ে এসেছেন! আপনার হাসব্যান্ড এলোনা কেন?

মহিলা দরজার দিকে চেয়ে বলল,

-আমার হাসব্যান্ড আমার সাথে থাকেনা।

থতমতো খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-আপনাদের সাথে থাকে না! দূরে কোথাও চাকরি করে?

-না, আরেকটা বিয়ে করেছে।

-সে কি! সেতো বেআইনি। আপনি পুলিশে যাননি?

এবার ও আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

-কি লাভ? জোর করে কি কাউকে আটকে রাখা যায়? ছাড়ুন। আপনার কথা বলুন। আপনি বিবাহিত?

একটু চুপ করে থাকি। তারপর বলি,

-না, আমার বিয়ে এখনো করা হয়নি। বাড়িতে মা আছে। আমি আর মা।

-গার্ল ফ্রেন্ড আছে?

আমি হেসে ফেলি।    

-কিছু একটা থাকতেই হবে? বৌ গার্ল ফ্রেন্ড ছাড়াও তো থাকা যায়?

মহিলাটি বলে,

-একা একা কি বাঁচা যায়! সাথী একটা তো লাগেই। তাই না?

-আমার এই কাজকর্ম এসবই আমার সাথী।

-তা ভালো। কোথাও বেড়াতে যান না?

-আমার কাজটাই তো ঘুরে বেড়ানো। আলাদা করে আর কি যাব! যখন ছুটি পাই তখন বাড়িতে বসে মায়ের হাতের রান্না খাই আর ঘুমাই।

-হুমম, বুঝলাম।

-আপনিও তো একা। সাথীহারা।

কথাটা বলে মনে হল না বললেই হত। কি মনে করবে। কষ্ট পেতে পারে। কিন্তু দেখলাম ও হালকা হেসে বলল,

-সাথী খুজতেই তো পথে নামা।

-পেলেন কাউকে?

ও ঠোট টিপে কটাক্ষ হেনে বলল,

-মনে হয়।

সব কথা সবাইকে বলা যায়না। কলেজ লাইফে প্রেম তো করেছি। তারপর সে মেয়ে বেটার অপশনে বিদেশ চলে গেল। আমি নিয়মিত রেড লাইট এরিয়ায় যাওয়া শুরু করলাম। এসব কথা কি বলা যায়? কিন্তু মেয়েরা সব বোঝে। বলতে হয়না।

ট্রেনের ঘোষনা হয়ে গেল। ওদের ট্রেন আগে আসছে। দু’নম্বর প্লাটফর্মে যেতে হবে।

-চলুন, ফুট ব্রীজ দিয়ে দু’নম্বরে।

আমি বলি।

মহিলা অযাচিত ভাবে আমার হাত স্পর্শ করে বলে,

-আপনার তো এক নম্বরেই গাড়ি দেবে। খামোকা আবার ফুটব্রীজ উঠবেন আবার আসবেন!

আমি বলতে পারি না যে ওদের সাথে আমি আরো খানিকটা থাকতে চাই। এতো তাড়াতাড়ি বিচ্ছেদ ভালো লাগছে না। মুখে বলি,

-না না,ও কোনো ব্যাপার না। চলুন না একটু এগিয়ে দিই।

আমরা ফুট ব্রীজে উঠলাম। আমি একটু দুঃসাহসী হয়ে বললাম,

-আপনার ফোন নাম্বরটা দেবেন?

ও হেসে বলে,

-কি করবেন নম্বর দিয়ে?

আমি কাচুমাচু হয়ে বলি,

-ঠিকঠাক বাড়ি ঢুকলেন কিনা জানতাম।

-এতো দূর যখন আসতে পেরেছি ফিরতেও পারব।

আমি একটু আহত সুরে বললাম,

-তাহলে থাক।

সে আমার কাছে ঘেসে এসে বলল,

-রাগ হল? নিন, লিখুন আমার নম্বর।

-না না, রাগ হবে কেন! বলুন।

আমি আমার মোবাইলে নম্বরটা তুলে জিজ্ঞেস করলাম,

-কি নামে সেভ করব?

-আলেয়া দে।

নামটা সেভ করে আলেয়ার দিকে চেয়ে বললাম,

-নামটা বেশ, আনকমন।

আলেয়া হেসে বলল,

-আমার সবটাই আনকমন।

-আর কি কি আনকমন?

-জানবেন ধীরে ধীরে। আর,একটা অনুরোধ আজকে ফোন করবেন না। আমি বাড়ি ঢুকে আপনাকে ফোন করে দেব। ঠিক আছে?

-বেশ।

ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেছে। আলেয়া বাচ্চার হাত ধরে ট্রেনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

-আসছি, ভালো থাকবেন।

কেন জানি আমার খুব মন খারাপ করতে লাগল। ট্রেনটা ছেড়ে দিল। ওরা জানলার ধারে বসে দুজনেই হাত নাড়তে লাগল। যতক্ষণ দেখা গেল ওরা হাত নেড়ে চলল। আমিও নাড়তে থাকলাম।       

 

কলকাতায় ফিরে দিনদুয়েক  কেমন একটা আচ্ছন্নের মতো হয়ে রইলাম! ঘর থেকে বেরলোম না।  চুপচাপ সারাদিন ঘরে। মাঝে মধ্যে বেরিয়ে পাড়ার চায়ের দোকানে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে আবার ফিরে আসা।

নাহ! আলেয়ার  ফোন আসেনি। আমি পরদিন সকালে ফোন করেছিলাম। সুইচ অফ বলছে!

কি হল আমার! কিছুই তো হয়নি তেমন! পথে ঘাটে অমন কতোই তো আলাপ হয়! কিন্তু এটা এমন করে গেথে গেল কেন? জানিনা। ফোন করেছিলাম ওর নম্বরে আবার এবং আবার। কিন্তু প্রতিবারেই সুইচ অফ বলছে!

কি করবো, কোথায় যাবো, কি করা উচিত কিছুই মাথায় আসল না। কিন্তু এটা পরিস্কার এর একটা শেষ পরিণতি দরকার।  এভাবেই আরো কটা দিন ভেসে গেলে। বারবার ফোন করলাম। সেই সুইচ অফ!  আলেয়া দে নাম দিয়ে ফেসবুক, টুইটার, ইন্সট্রাগ্রাম সব খুজলাম ,বারবার করে খুজলাম। কিন্তু পেলাম না কোনোভাবেই। অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে মনে পড়ল সুকল্যানের নাম। আমার পুরনো বন্ধু। একসাথে একসময় একই কাগজে কাজ করেছি। সুকল্যান কালনায় থাকে। এখন নিজেই একটা সাপ্তাহিক কাগজ চালাচ্ছে কালনা থেকেই। মূলত স্থানীয় খবরাখবর ছাপে। পলিটিক্যাল ব্যাকআপে চলে। প্রচুর অ্যাড পায়। অনেকবার যেতে বলেছে, হয়ে ওঠেনি। ও কখনো সখনো আমার থেকে ছবিও নিয়েছে। সুকল্যানকে ফোন করে বললাম আমি একটা খবরের জন্য কালনা আসছি, যেন থাকে।

সুকল্যান কালনা স্টেশনে দাড়িয়েছিল। আমাকে বাইকে চাপিয়ে ওর অফিসে নিয়ে গেল। কালনা কলেজের পাশের গলিতে ওর ছোট্ট অফিস ঘর। এডিটরের আলাদা চেম্বার কাঠের পাররটিশন দিয়ে। একটি মহিলা ডিটিপি অপারেটর টাইপ করছে। আমরা ভিতরে ওর চেম্বারে বসলাম। ছোট টেবিল, রিভলবিং চেয়ার, পিছনে সিএমের বাঁধানো ছবি।

-বল, কি খাবি?

সুকল্যানের মুখে সাফল্যের হাসি। বললাম,

-শুধু চা বল, আমায় ফিরতে হবে আবার।

সুকল্যানের অফিসে একজন বেয়ারাও আছে। তাকে ডেকে সুকল্যান চা বিস্কুট সিগারেট আনতে বলে বলল,

-এবার বল, কি খবর চাস?

আমি ওকে চন্দন্নগরের ঘটনাটা বললাম, শুধু আলেয়ার প্রতি আমার দুর্বলতাটা যতটা সম্ভব এড়িয়ে বললাম। সুকল্যান সবটা মনে দিয়ে শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে ভাবল। তারপর বলল,

-শুধু কালনা  থাকে আর নাম আলেয়া দে এটা দিয়ে চেনা মুশকিল। কালনা তো খুব ছোট জায়গা নয়। আলেয়া নামটা একটু আনকমন, শোনা লাগছে,কিন্তু কানেক্ট করতে পারছি না। আসলে যতই আনকমন হোক কালনা শহরে এই নামে হয়তো পঞ্চাশ জন আছে। ওর ফোনও নম্বরটা একবার বল তো।

 আমি নম্বরটা বললাম। ও ওর ফোন থেকে রিং করে বলল,

-সুইচ অফ। ট্রু কলারে নাম দিচ্ছে কানাই দে। এই নামে এখানে একজন ব্যাবসাদার নেতা আছে।

ট্রু কলারে চেক করাটা আমার মাথাতে আসেনি। বললাম,

-চিনিস?

সুকল্যান ভেবে চলেছে। বলল,

-এই কানাই দে কে চিনি। রাইস মিল আছে আছে। রুলিং পার্টির নেতা। ওর বৌ বাচ্চাসমেত  বছর খানেক আগে সুইসাইড করেছিল।  দাঁড়া, ডিটেলসটা আমাদের কাগজে বেরিয়েছিল। কপিটা বের করাই।

সুকল্যান ওর মহিলা অপারেটর আর বেয়ারা দুজনকেই কাজে লাগালো কানাই দের খবরটা কবে বেরিয়েছিল বের করতে। আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম।

-আরে, কানাই দের বৌ তো এক দেড় বছর আগে মারা গেছে বলছিস! আলেয়া দে আর ওর ছেলেতো কিছুদিন  আগেও দেখেছি। ফালতু সময় নষ্ট করছিস।

সুকল্যান আমায় হাত দিয়ে থামতে বলে,

-দেখতে ক্ষতি কি? আর কোনো ক্লু তো হাতে নেই, দাঁড়া না। তাছাড়া তোর বর্ণনা শুনে আর নামটা শুনে সন্দেহ হচ্ছে, একবার দেখে নিতে ক্ষতি কি আছে!

প্রায় আধ ঘন্টা পর মহিলাটি একটা কাগজ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল,

-পেয়েছি স্যার। সবটা আছে। ইনসেটে ওর বৌয়ের ছবিও ছেপেছিলাম।

“দেখি দেখি” বলে সুকল্যান প্রায় লাফিয়ে উঠে কাগজটা ছিনিয়ে নিল। কাগজটা খুলে ও এক লহমায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল,

-হ্যাঁ ,ঠিক এক বছর আগে কানাই দের বৌ ওদের বাচ্চা চেলেকে নিয়ে বাড়ি থেকে ঝগড়া করে বেরিয়ে যায়। একদিন পর দুজনের বডি গঙ্গায় ভাসতে দেখে মাঝিরা পুলিশে খবর দেয়। বৌয়ের নাম আলেয়া দে আর বাচ্চার নাম প্রবীর দে বয়স ছয় বছর।পুলিশের অনুমান ওরা চন্দননগরের আশপাশ থেকেই ডুবেছিল। এসব পুরো ডিটেলে আমাদের কাগজেই বেরিয়েছিল,তাই চেনা লাগছিল শোনার পর। এই দ্যাখ বৌটার ছবি...

ছবিটা আলেয়ারই ছিল। সুকল্যান রাতে থেকে যেতে বলেছিল। আমি শুনিনি। ও স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে গেল খানিক আগে। বসতে চাইছিল। আমিই জোর করে ওকে পাঠিয়ে দিলাম। হাওড়া যাওয়ার শেষ ট্রেন আসতে এখনো মিনিট দশেক দেরি আছে। গোটা স্টেশন শুণশাণ।আমি একাই সম্ভবত প্লার্টফর্মে। একটা সিগারেট ধরিয়ে দুটো টান মেরেছি সবে,পিছন থেকে এক মহিলার গলা,

_এই যে শুনছেন? হাওড়া যাবার শেষ ট্রেনটা কি চলে গেছে?     

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment