রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডঃ লরেন্স ব্রিট আজ থেকে দু দশক আগে ফ্যাসিবাদ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন 'ফ্রি এনকোয়ারি' পত্রিকার ২০০৩ সালের বসন্ত সংখ্যায়।হিটলার (জার্মানি), মুসোলিনি (ইতালি), ফ্রাঙ্কো(স্পেন), সুহার্তো (ইন্দোনেশিয়া) এবং পিনোচেত (চিলি)-- এদের শাসনব্যবস্থা অধ্যয়ন করে ডঃ ব্রিট এদের মধ্যে চোদ্দটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান।তিনি এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে ফ্যাসিবাদের পরিচয়জ্ঞাপক লক্ষ্মণ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তৃতীয় লক্ষ্মণের শিরোনাম ছিল- "জনগণকে স্বপক্ষে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে সাধারণ শত্রু বা 'বলির পাঁঠা' চিহ্নিতকরণ ব্রিট বলেছেন জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু,মুক্তমনা উদারবাদী, কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী ইত্যাদি সবাইকে সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক বা সাধারণ শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং এদের অপসারণ বা হত্যা করার প্রয়োজনে জনগণকে জাতীয়তাবাদী উন্মত্ততায় ঐক্যবদ্ধ করা হয়। আজকের ভারতবর্ষে মুক্তমনা,গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী সমস্ত মানুষ ব্রিট বর্ণিত তৃতীয় লক্ষণটির অর্থ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। সংখ্যালঘু মুসলমান, আর্বান নকশাল, চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধের নামে সিভিল সোসাইটিকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু সাব্যস্ত করার পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সরসংঘচালক মোহন ভাগবত সংঘের সদর দপ্তর নাগপুর থেকে বিজয়া দশমীর বার্ষিক বক্তৃতায় গণশত্রুর তালিকায় নতুন নাম সংযোজন করেছেন। এই নতুন লক্ষ্যবস্তু হল 'কালচারাল মার্ক্সিস্ট' এবং 'ওক'(Woke)।
কালচারাল মার্ক্সিস্ট ও ওক : অর্থের সন্ধান
মূল আলোচনায় প্রবেশ করার আগে এই শব্দ দুটির অর্থ জেনে নেওয়া প্রয়োজন। কালচারাল মার্কসবাদ শব্দবন্ধটি মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় আলোচিত হতে শুরু করে ২০১৬ সালের পর থেকে যখন মনস্তাত্ত্বিক জর্ডান পিটারসন কানাডার পার্লামেন্টে পেশ করা একটা বিলের বিরোধিতা করতে গিয়ে কালচারাল মার্কসবাদকে দোষারোপ করেন। প্রসঙ্গত বিলটির বিষয়বস্তু ছিল লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যের অবসান। জর্ডানের মতে লিঙ্গ নিরপেক্ষ সর্বনাম ব্যবহার আসলে বাক স্বাধীনতার বিপক্ষে এবং মার্কসবাদীরা আসলে পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন। এর আগে রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও তিনবার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পদপ্রার্থী প্যাট বুচানন মহিলাদের অধিকার, সমকামীদের অধিকার আন্দোলন সহ আমেরিকায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনকে আমেরিকার অসুখ আখ্যা দিয়ে তাদের জন্য সেদেশের কালচারাল মার্ক্সিস্টদের দায়ি করেন। বুচানন সহ অনেকের বক্তব্য কালচারাল মার্কসবাদ তত্ত্বের পুরোধা হলেন আন্তোনিও গ্রামসি এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল (নিও-মার্ক্সিস্ট)। সংক্ষেপে বলতে গেলে ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশে রক্ষনশীল ও প্রগতিবিরোধীরা তাদের বিপক্ষের মানুষদের, বিশেষ করে যারা সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে সতত সরব তাদের দাগিয়ে দিতে 'কালচারাল মার্ক্সিস্ট' শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন
(What is cultural Marxism and is it really taking over University everywhere? Mathew Sharpe/ scroll.in/ sep 18. 2020)
ওক (woke) শব্দটি বিশেষণ হিসাবে ব্যবহৃত হয় যা আফ্রিকান-আমেরিকান ভার্নাকুলার ইংলিশ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ জাতিগত কুসংস্কার ও বৈষম্যের বিষয়ে সচেতন থাকা। ওক শব্দটির রাজনৈতিক অর্থ আজ বহু আলোচিত। মেরিয়াম-ওয়েবস্টার অভিধান মতে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে ওক বলতে বোঝায় সেই মানুষকে যিনি শিক্ষিত, প্রাজ্ঞ এবং সামাজিক অবিচার ও জাতিগত অসাম্য সম্পর্কে সচেতন। ২০১৪ সালে আমেরিকায় শুরু হওয়া 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আন্দোলনের সময় থেকে ওক শব্দটি আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করে ও প্রতিক্রিয়াশীল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। রিপাবলিকান দের মধ্যে চরম অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী অংশ যাদের নেতৃত্বে ছিলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফ্লোরিডা গভর্নর রন ডি স্যাটিস, কারি লেক, মেহমেট ওজ ওক ভাবনার বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তাঁদের মতে কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের সামাজিক ন্যায় ও সাম্যের আন্দোলন দেশটার আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও চরিত্র বদলে দিতে পারে। রন ডি স্যাটিস এর ভাষায়; "what you see now with the rise of this woke ideology is an attempt to really delegitimize our history and to delegitimize our institutions and I view the wokeness as a form of cultural Marxism"
(what does 'woke' mean and why are some conservatives using it? / Kiera Alfonseca/abc news/ jan 21. 2023)
এই অর্থ থেকে পরিষ্কার যে কেন আজ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মতাদর্শগত আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু কালচারাল মার্ক্সিস্ট ও ওকরা।
মোহন ভাগবত কথামৃত
বিজয়া দশমীর ভাষণে মোহন ভাগবত সুচারু ভাবে সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে সরব এবং বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করেছেন। আমরা আলোচনার সুবিধার্থে বক্তব্যটিকে কয়েকটি পয়েন্টে ভাগ করছি।
১। এই পৃথিবীতে এমন কিছু লোক আছে (ভারতেও তারা আছে) যারা চায় না ভারত নিজের পায়ে দাঁড়াক। তাই তারা চেষ্টা করে সমাজে বিভেদ তৈরির, যৌথতাকে নষ্ট করার এবং সংঘর্ষের আবহাওয়া তৈরির।
২। এই ধ্বংসাত্মক, সর্বগ্রাসকারী শক্তি নিজেদের কালচারাল মার্ক্সিস্ট বা ওক বলে। কিন্তু এরা ১৯২০ সাল থেকেই মার্কসকে ভুলে গেছেন। সমাজে বিদ্যমান যাবতীয় নিয়মবদ্ধতা, নৈতিকতা, সংস্কৃতি, সম্মান এবং সংযমের তারা বিরুদ্ধাচারণ করে। গুটিকয়েক মানুষ দ্বারা সমগ্র মানবজাতির উপর প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য তারা সমস্ত নৈরাজ্য ও অবিবেচনাকে তারা উৎসাহ দেয় এবং পুরষ্কৃত করে।
৩। তাদের কর্মপদ্ধতি হল শিক্ষাজগত ও মিডিয়াতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং শিক্ষা,সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সামাজিক জীবনে বিভ্রান্তি, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করা।
৪। এই অবস্থায় ভয়, বিভ্রান্তি ও ঘৃণার এক বিষাক্ত চক্র তৈরি হয়। একটা সমাজ যদি পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখন অবিশ্বাস জনিত কারণে তা দুর্বল হয়ে পরে এবং অজ্ঞাত সারে সেই ধ্বংসাত্মক শক্তির শিকার হয়ে যায় যারা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে আমাদের উপর প্রভুত্ব করতে চায়। ভারতীয় ঐতিহ্যে এই ধরণের কাজ যা সমাজের মধ্যে অবিশ্বাস, সন্দেহ ও বিভ্রান্তির জন্ম দেয়,আমরা বলি 'মন্ত্র বিপ্লব'।
(woke, cultural Marxist... Have forgotten Marx since 1920s : RSS chief Mohan Bhagwat/ The Hawk/ oct 24, 2023)
সংঘের প্রচারযন্ত্র
সংঘ পরিবারের কাজকর্ম সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারা জানেন কোন বিষয় বা ইসুকে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রচারিত করার আগে সংঘের প্রচারযন্ত্রগুলো সেই ইসুগুলোর জন্য জমি প্রস্তুত করতে থাকে ক্রমাগত প্রচারের মাধ্যমে। এ বারেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। কালচারাল মার্ক্সিস্ট ও ওকদের বিরুদ্ধে নানান ধরণের প্রচার বেশ কিছু দিন ধরেই শুরু হয়েছে। বিষয়টার মধ্যে যেহেতু একটা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে তাই প্রথমে তাত্ত্বিক অবস্থানটা বোঝানোর জন্য মার্কসবাদ বিরোধী বিদেশি বুদ্ধিজীবীদের লেখা প্রকাশ করা শুরু হয়। জার্মান অর্থনীতিবিদ অ্যান্থনি পি মুলার এর একটি লেখা (cultural marxism is the new war machine for destruction / Anthony P Muller/ organiser, april 15,2023) এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
এই লেখার সারাৎসার হল—
* মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক নতুন তত্ত্ব জনপ্রিয় হচ্ছে যার নাম কালচারাল মার্ক্সিজম।এই তত্ত্বমতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ভরকেন্দ্র আর সর্বহারারা নেই, সেই জায়গা নিয়েছে বুদ্ধিজীবীরা।এই তত্ত্বের জনক আন্তোনিও গ্রামসি এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল। এই তত্ত্বের প্রবক্তারা মনে করেন যে সর্বহারারা বিপ্লবী হিসাবে তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে ব্যার্থ হয়েছেন, এখন বিপ্লব ঘটানোর দায়িত্ব বর্তেছে সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের নেতাদের উপর যারা ক্রিশ্চান সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে এমন এক পৃথিবী তৈরি করতে চায় যেখানে মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীরা শেষ কথা বলবেন।
* ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব না ছিল রাশিয়ান,না ছিল সর্বহারা।সেসময় রাশিয়ায় শিল্প শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল নগন্য। বলশেভিক বিপ্লব ছিল মূলতঃ কৃষকদের নিয়ে পেশাদার বিপ্লবীদের ঘটানো বিপ্লব।বলশেভিক বিপ্লব ও প্রথম সোভিয়েত রাষ্ট্রের চরিত্র বিচার করলে বোঝা যায় যে এই নতুন অত্যাচারী রাষ্ট্র জারের শাসন থেকে জনগণকে মুক্ত করার জন্য ঘটানো হয় নি,হয়েছিল রাশিয়াকে বিশ্ব বিপ্লবের লঞ্চিং প্যাড হিসাবে ব্যবহারের জন্য।
* সাংস্কৃতিক মার্কসবাদী রা অন্তহীন ভাবে সামাজিক ন্যায়ের দাবি করে যার মধ্যে থাকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বৃদ্ধ বয়সে পেনশন ইত্যাদি। তাদের লক্ষ্য সমাজে একটা বড়ো অংশের লোকদের ' অভাবী ' ও ' বঞ্চিত' দেখানো ( বহুক্ষেত্রে এটা কাল্পনিক)। এই ক্ষেত্রগুলোতে রাষ্ট্রকে ক্রমাগত খরচ করিয়ে দিয়ে তারা এক অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে এবং সমস্ত কিছুর জন্য এই নয়া- মার্কসবাদীরা পুঁজিবাদকে দায়ি করে।
* সাংস্কৃতিক মার্কসবাদীরা সমাজকে এক আত্মপরিচয়ের সংকটে ফেলে দেয়,এক ভন্ড নৈতিকতার মাপকাঠি বানিয়ে।সর্বহারার এক নায়কত্ব এখন অতীত,এখন তাদের লক্ষ্য রাজনৈতিক শুদ্ধতার একনায়কত্ব।
* এই মানুষেরা বুঝে গেছেন শ্রমিক শ্রেণি আজ আর সমাজতন্ত্রের পক্ষে থাকবে না কারণ শ্রমিকরা সমাজতন্ত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।ক্ষমতা ভোগ করে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের পার্টি নেতৃত্ব ও মিলিটারি কর্তারা। আর সেই কর্তৃত্বকে ন্যায্যতা দেয় লেখক ও শিল্পীরা তাদের সৃজন কর্মের মাধ্যমে। এদের কৌশল হল; "The way towards the rule of cultural Marxist is the moral corruption of the people. To accomplish this the mass media and public education must not enlighten but confuse and mislead "
এই আন্তর্জাতিক কুৎসা প্রচারকে পরের ধাপে ভারতের প্রেক্ষিতে স্থাপন করার জন্য দরকার ভারত কেন্দ্রিক আলোচনা।
সেই লক্ষ্যে সংঘের মুখপত্র অর্গানাইজারে আরেকটি লেখা ( How cultural Marxism has emerged as a new age threat to Bharat's internal security / Karan Thakur/ june 10, 2023) প্রকাশিত হয়েছে যাতে বলা হয়েছে --
* মার্কসবাদী তত্ত্ব মনে করে সামাজিক বৈষম্যের কারণ সম্পদ ও সুবিধার বৈষম্য। এই পথের প্রবক্তারা সমাজকে 'হ্যাভ" ও ' হ্যাভ নটস' -- দুটি সংকীর্ণ পরিচিতিতে ভাগ করে। এই বিভাজনের গল্পকে বিশ্বাস করলে প্রত্যেকটা মানুষই কোন না কোন পক্ষে পড়বে।
* পরবর্তীকালে এই অর্থনৈতিক বিভাজনের ভাবনাটিকে সাংস্কৃতিক জীবনে টেনে আনা হয়। সাংস্কৃতিক যে বৈষম্যগুলো যা হয়ত ঐতিহাসিক ভাবেই আছে (আমরা তাকে কেউই সমর্থন করি না) তার জন্য উত্তর পুরুষদের দায়ি করে সামাজিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়।
* সৌভাগ্যক্রমে ভারতে সেই অর্থে জাতি ও বর্ণ বিদ্বেষ নেই। কিন্তু এখানকার সাংস্কৃতিক মার্কসবাদীরা পরিবর্তে নিয়ে এসেছে জাতপাত, লিঙ্গ, ধর্ম, ভাষা প্রভৃতি ইস্যুগুলি। অবশ্যই ভারতে সম্প্রদায়গত বৈষম্য আছে কিন্তু সেক্ষেত্রে একটা পক্ষকে বঞ্চিত ও অন্যপক্ষকে বঞ্চনাকারী -- এইরকম সাদা কালো বিভাজন করা যায় না। বিষয়গুলোর মধ্যে অনেক ধূসর রেখা আছে।
* আজ এই সাংস্কৃতিক মার্কসবাদীদের কারণে হিন্দু পুরুষদের অবস্থা হচ্ছে ক্রিশ্চান পুরুষদের মত। তাদের একতরফা ভাবে খলনায়ক হিসাবে চিত্রিত করা হচ্ছে।
* এই মতের লোকেরা এক সম্প্রদায়ের লোকদের অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয়। এদের লক্ষ্য যত বেশি বিভাজন, তত বেশি দুর্বল সরকার। আজ এই সব নন ইস্যুতে সরকার এতই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছে যে অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের মত ইস্যুগুলো বঞ্চিত হচ্ছে। আজ এই সাংস্কৃতিক মার্কসবাদী ও ওকরা শিক্ষা, মিডিয়া, বিচারব্যবস্থায় সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক ফ্রন্ট খুলে ফেলেছে। সেক্ষেত্রে সরকারকেও বহু মাত্রিক কৌশল নিতে হবে, সেক্ষেত্রে ভাগবত গীতা আমাদের পথ দেখাবে।
সংঘ পরিবারের নীল নকশার স্বরূপ সন্ধান
মোহন ভাগবতের বক্তৃতা এবং অর্গানাইজারে প্রকাশিত লেখাদুটোকে যদি আমরা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে দুটো বিষয় চোখে পড়বে। একদিকে যেমন কিভাবে এদেশে সামাজিক ন্যায়ের জন্য সরব মানুষেরা এবং অবশ্যই কমিউনিস্টদের গণশত্রুতে পরিণত করার চেষ্টা করা হবে তার একটা নীল নকশা দেখতে পাই। কিন্তু অন্যদিকে আবার সংঘ পরিবারের রাজনীতির সীমাবদ্ধতা ও তার দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠবে। একথা অনস্বীকার্য যে মেরুকরণের রাজনীতি, ধর্মীয় বিদ্বেষ ও কর্পোরেটদের প্রতি সীমাহীন আনুগত্য দেখিয়ে ২০১৪ সাল থেকে সংঘের অভিভাবকত্বে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি তাদের প্রকল্পিত হিন্দু রাষ্ট্রের পথে অনেকটাই এগোতে পেরেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হল বিজেপি যে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতি দ্বারা চালিত হয় তারা বর্ণবাদের সোচ্চার সমর্থক। আবার বিজেপি যে হিন্দুত্বের রাজনীতির জয়যাত্রার স্বপ্ন দেখে তা দলিতদের সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সংঘের পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করা হয় আম্বেদকর ছিলেন হিন্দুদের পক্ষে এবং মুসলমান ও কমুনিস্ট বিরোধী, ঘর ওয়াপসির সমর্থক, গেরুয়া পতাকাকে জাতীয় পতাকা গণ্য করার পক্ষে ইত্যাদি। সংঘের প্রচারে দুটো দিক ছিল-- এক দিকে আম্বেদকরের নতুন ইমেজ নির্মাণ যা তাদের প্রধান সমর্থক অর্থাৎ বর্ণ হিন্দুদের খেপিয়ে তুলবে না, অন্য দিকে আম্বেদকরের জাতপাত নিয়ে বক্তব্যকে আলোচনার বাইরে রাখার চেষ্টা। সংঘের সকালের প্রার্থনা সভায় দলিত নায়কদের স্মরণ, বিজেপি কর্তাদের রীতিমতো নিয়ম করে দলিতদের বাড়িতে ভোজন ও রাত্রিবাস, মোহন ভাগবত কর্তৃক হিন্দুদের গো মাংস ভক্ষণের আহ্বান, এমনকি এই বিজয়া দশমীর বক্তৃতায় আম্বেদকর রচনাবলী পড়ার আহ্বান আসলে এক প্রসাধনী পরিবর্তনের মাধ্যমে দলিতদের মন জয়ের চেষ্টা। কিছু নির্বাচনী সাফল্য পেলেও এবং সংঘ পরিবারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্বেও তাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে দলিত ভাবনার যে মূলগত বিরোধ তার সমাধান সংঘের পক্ষে সম্ভব হয় নি। সংঘ বর্ণ ব্যবস্থার পক্ষে আর আম্বেদকরের রাজনীতির মূল অক্ষ হল "অ্যানিহিলেশন অব কাস্ট"।
তাই হিন্দুত্বের রাজনীতির বিরুদ্ধে, আম্বেদকরকে আত্মসাৎ করার বিরুদ্ধে দলিত শিক্ষিত যুবকেরা এক বৌদ্ধিক প্রতিবাদে সামিল হয় যা হিন্দুদের রাজনীতির স্বরূপকে উন্মোচিত করে। তাই মোদি জমানায় দলিতদের উপর উচ্চ বর্ণের সন্ত্রাস তো কমেই না বরং দ্বিগুণ বেড়েই যায়। আবার দলিতরা প্রতিবাদের নতুন ভাষ্য তৈরি করে যা চেন্নাই আই আই টি তে পেরিয়ার স্টাডি সার্কেলের বৌদ্ধিক চেতনায়, হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদে, উনার সত্যাগ্রহে, ভীমা কোঁরেগাও এর ভূমিতে প্রতিভাত হয়। সম্প্রতি বিহারে জাতগণনার পর সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে গেছে এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে এক চ্যালেঞ্জ হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। শুধু বর্ণ ব্যবস্থার অভিশাপ নয়,কলেজ - বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ, স্বাধীন মিডিয়ার অভিনন্দন যোগ্য ভূমিকা, রূপান্তরকামী থেকে শুরু করে পরিবেশ-- বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন সংঘ নির্দেশিত কর্তৃত্ববাদী,এককেন্দ্রিক, ফেডারেল কাঠামো বিরোধী হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের প্রকল্পকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাই ভীমা কোঁরেগাও মামলা, জেএনইউ আগ্রাসন, নিউজক্লিককে রূদ্ধ করার মত ঘটনা ঘটাতে হচ্ছে আজকের গেরুয়া শাসকদের।
শেষের কথা
কর্পোরেট মদতে ও সংঘ পরিবারের অভিভাবকত্বে বিজেপি শাসনাধীন সরকার গণশত্রু চিহ্নিত করার যে কৌশল নিয়েছে তাকে প্রতিরোধ করতে প্রয়োজন সামাজিক ন্যায়, সহনশীল উন্নয়ন ও দেশের জল-জমি- প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করতে যে মানুষ ও সংগঠনগুলো আজ লড়াই করছে তাদের সার্বিক ও বিশ্বাস যোগ্য ঐক্য। পরিস্থিতি দাবি করছে ক্ষুদ্র স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর লড়াইয়ের জোট তৈরি করা। না হলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠনের ভাবনা দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে।