ক-টিভিতে সন্ধেবেলায় এক মুখরতা শো-এর সূত্রধর খবর দিলেন, আজ পশ্চিম বঙ্গের তিনটি জেলা থেকে বিষধর সাপের কামড়ে সাত জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বকদ্বীপে তিন জন, মেদিনীপুর জেলার ত্রিমাথায় দু জন, পুরুলিয়া এবং নদীয়া জেলায় একজন করে মারা গেছেন। কালাচ, গোখরো এবং চন্দ্রবোড়া সাপের কামরেই এই মৃত্যুগুলি ঘটেছে। তারপর তিনি অশ্বদলের নেতা ভীম শর্মাকে বললেন এই ব্যাপারে তাঁর মতামত জানাতে।
ভীম শর্মা প্রথমেই বললেন, আমরা এমনিতেই এক জঙ্গলের রাজত্বে বাস করছি। সেখানে সাপের উপদ্রব তো হবেই। রাস্তাঘাট ঠিকঠাক নেই, গ্রামের দিকে সমস্ত রাস্তার ধারেই ঝোপঝাড়। আলোর ব্যবস্থা অপ্রতুল। ফলে মানুষ অসাবধানে কখন যে সাপের সামনে পড়ে যায়, তার ঠিক কী? এই রাজ্যে সরকার বলে কিছু আছে নাকি?
গজদলের নেতা নকুল পারিয়া মাঝপথে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, আপনাদের এই একটাই কাজ। সরকারের সমালোচনা করা। বলি, রাজ্যের রাস্তাঘাটগুলো দেখেছেন তাকিয়ে? সমস্তটা ঝকঝক করছে। হ্যাঁ, গ্রামের দিকে সব রাস্তায় এখনও আলোর ব্যবস্থা আমাদের সরকার করে উঠতে পারেনি। তাই বলে সাপ সম্পর্কে বাঙালিরা একেবারে অখেয়াল বা কিছুই জানেন না—এমন তো নয়। সাবধান তো হতেই হবে। বিশেষ করে গরম এবং বর্ষার মাসগুলিতে।
সূত্রধর আবার এনাকে থামিয়ে দিয়ে মাইক্রোফোন এগিয়ে দিলেন ডাক্তার অনন্ত তরফদারের কাছে। বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি তো পশুবিষ বিশেষজ্ঞ। এই সাপের কামড়ে মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
ডাঃ তরফদার বললেন, দেখুন, আমাদের রাজ্যে সপ্তাহে দু একটি স্নেকবাইটের খবর আমাদের কাছে আসে। এক দিনেই সাতটি ঘটনা এবং সব কটিতেই মৃত্যুর পরিসংখ্যান যথেষ্ট উদ্বেগজনক। গ্রামেগঞ্জে পাব্লিক সাধারণত হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেরি করে। ওঝাটোঝার কাছে আগে যায়। তাতে অনেকটা মূল্যবান সময় খরচা হয়ে যায়।
ভীম শর্মা বলে উঠলেন, হাসপাতালে নিয়ে গেলেই বা কাজ হবে কিনা, তার কোনো গ্যারান্টি আছে? কটা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম সিরাম আছে বলতে পারেন? এই তো আমাদের হাওড়া জেলায় দুদিন আগে তিনটি কেস নিয়ে সদরে হাসপাতালে পাঠালাম। ওরা বলে দিল, আমাদের স্টকে এভিএস নেই। মন্ত্রীর কোনো দায়িত্বজ্ঞান আছে নাকি?
চ্যানেল ঘুরিয়ে চলে গেলাম ণ-চ্যানেলে। সেখানে একজন পরিবেশবিদ তখন বোঝাচ্ছেন, মুর্শিদাবাদ জেলায় সাপের উপদ্রব কেন এত বেড়ে গেল, কেন পর পর তিন দিন সাপের কামড়ে মোট পাঁচ জন মারা গেল, এটা শুধু উপর থেকে দেখলে হবে না। আমরা পরিবেশ এমন ভাবে নষ্ট করে ফেলছি যে সমস্ত বন্য প্রাণী তাদের স্বাভাবিক বাসস্থান ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। ঝোপেঝাড়ে সাপ আর ব্যাঙ খুঁজে পাচ্ছে না, ফলে তারা লোকালয়ের আশেপাশে চলে আসছে। আগামী দিনে যদি শোনেন, তারা শহরের রাস্তাঘাটেও দেখা দিচ্ছে তাতেও অবাক হবেন না। এমনিতে আমাদের রাজ্যে বছরে গড়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যান। এবছর সেই সংখ্যা আরও বেড়ে গেলে অবাক হবেন না। সামনের দিন কাল খুব খারাপ।
চ-টিভি, ম-টিভি—যেখানেই ঢুকছি, দেখছি, সাপের লোকালয়ে চলে আসার এবং কামড়ানোর ঘটনাবলিই শোনাচ্ছে এবং দেখাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে টিভি বন্ধ করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। খুব বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, রাস্তায় যাকেই দেখছি, তারই পায়ে হাঁটু অবধি গামবুট। কী ব্যাপার? চেনা লোক নিশিময়বাবুকে দেখে জিগ্যেস করলাম, করেছেন কি নিশিদা? এই বোশেখ মাসের গরমে গাম বুট পরে কেন? ঘামে তো পা গলে যাবে।
তা তো যাচ্ছেই, কী আর করা! নিশিময়বাবু মুখটা বেঁকিয়ে বললেন, টিভিতে যা বলছে, তাতে এছাড়া আর উপায় নেই। সরকারও বলছে গাম বুট পরে ঘুরতে।
সরকারও বলছে? কখন বলল? আপনি কার কাছে শুনলেন?
নিশিময় বিরক্ত হলেন, আপনি টিভি দেখেন না?
দেখি তো। সব কটা চ্যানেলেই আজ কী হয়েছে, খালি সাপের কথা বলছে, সাপের কামড়ে কোথায় কজন মরেছে সেই কথা শোনাচ্ছে! বিরক্ত হয়ে টিভি বন্ধ করে বেরিয়ে এলাম।
বুঝেছি, ওই জন্যই খবরটা পাননি। সাপ এখন একটা মেজর থ্রেট হতে চলেছে। বাড়ির সামনে রাস্তায় ঘাটে যখন তখন বিষধর সাপের সামনে আপনি পড়ে যেতে পারেন। সাপে কাটলে হাসপাতালে যাওয়ার সময় পাবেন কিনা বলা মুশকিল। তার উপর আবার জেব্রা পার্টির একজন নেতা বলেছেন, আমাদের হাসপাতালে সাপের যে ওষুধ রয়েছে, তা নাকি কাজ করছে না। ফলে সাবধানতাই বাঁচার একমাত্র উপায়। আপনিও মশাই গাম বুট কিনে ফেলুন।
শুনে সত্যিই ভয় হল।
বাজারে জুতোর দোকানে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। চারটে দোকানের একটাতেও গাম বুট আর নেই। যা ছিল বিকেলের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে। তাও একজন সদাশয় দোকানি বললেন, আপনি যদি চান, কিছু অ্যাডভান্স দিয়ে যান। কাল খোঁজ নিয়ে যাবেন। বাবুমার্কেটে পেলে কয়েক জোড়া নিয়ে আসব।
বাড়ি ফেরার সময় খালি মনে হচ্ছিল, গাম বুট তো পেলাম না। এবার কী হবে? যত্ন সঙ্ঘের পাশ দিয়ে আসার সময় দেখলাম ক্লাবের টিভির সামনে বেশ উত্তেজনা। কাছে এগিয়ে গেলাম। একজনকে জিগ্যেস করলাম, কী হয়েছে?
তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার চাঁদ বদন দেখে নিয়ে বললেন, আর কী হবে, এসপ্ল্যানেড এলাকার একটা জুতোর দোকানে গাম বুট কেনার জন্য বিশাল লাইন পড়েছিল। কে একজন লাইন ভেঙে এগিয়ে যাওয়ায় মারপিট লেগে যায়। সেই নিয়ে ম-টিভিতে ক্লিপিং দেখাচ্ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, বাসে ট্রামে যারা উঠছেন নামছেন, প্রায় সকলের পায়েই গাম বুট।
বাড়িতে ফেরার পর গিন্নি বললেন, এই শুনেছ, আগামী কাল থেকে রাস্তায় গাম বুট না পরে বেরলে জরিমানা করবে বলেছে। ৪০৩ টাকা করে ফাইন হবে। তোমার তো আবার সব ব্যাপারেই নিজের বুদ্ধি ফলানো চাই। গাম বুট নিশ্চয়ই কিনবে না, পরবেও না। পকেটে অন্তত টাকা নিয়ে বেরিও।
মেয়ে বললে, বাবা, আজকের খবরে বলেছে, সব্বাইকে বাড়িতে থাকতে। খুব জরুরি কাজ না থাকলে বাড়ি থেকে না বেরতে। রাজ্যের মন্ত্রীপয়দা হয়ে গেলে নাকি সেমিকার্ফু জারি হবে দেশে। ট্রেনের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে।
আমি জানতে চাইলুম, তোদের কলেজ কবে খুলবে কিছু বলেছে?
আর কলেজ। মেয়ে বলল, আরও দুবছর টানা বন্ধ থাকবে। সমস্ত সাপ বন দপ্তর এসে সাফ করবে। তার পর হয়ত ---
আমি শুনে খুবই অবাক হলাম। আজকাল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা হয়। সেখানে এত সাপ মেরে ফেলবে?
গিন্নি বললেন, মেরে ফেলবে কে বলল তোমাকে? ওরা জাল দিয়ে ছেঁকে তুলে নিয়ে যাবে আর জঙ্গলে ছেড়ে দেবে। তবে তাতে সময় লাগবে।
টর্চ আর লাঠি নিয়ে বেরতে বলছে না?
না, মেয়ে বলল, খবরে বলেছে, পারলে হাতে মোটা দস্তানা এবং মাথায় হেলমেট পরে বাইরে বেরতে হবে। কোনো কোনো সাপ আবার নাকি উঁচুতে ফণা তুলে কামড়ে দেয়।
গিন্নি বললেন, সাবধানের মার নেই। ঘরের দরজা জানালাও বন্ধ করে রাখতে হবে।
বইয়ের তাক থেকে ড্যানিয়েল ডিফো-র রবিনসন ক্রুসো বইটা নামালাম। গৃহবন্দি থাকার গাইডলাইন হিসাবে বইটা শুনেছি মন্দ নয়।