কেন্দ্র সরকারের তিনটি নতুন কৃষি আইনের একটি চুক্তি চাষের লক্ষ্যে প্রণীত। এমন নয় যে, আইন হল বলে সব কৃষক হৈহৈ করে চুক্তি চাষে ঢুকে পড়বে। চাষাবাদে বীজ, সার, কীটনাশক, বিদ্যুতের ব্যবহারে কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্যে কৃষকরা ভুক্তভোগী। এসবের উত্তরোত্তর মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন খরচ সামলাতে কৃষকরা নাজেহাল। ফলে কোম্পানি সম্পর্কে তাদের একটা অসহায়তা আছে।
কিন্তু আইন প্রণেতাদের রাজনীতির জন্য শিকার প্রস্তুত আছে। সমস্যা-সঙ্কুল কৃষিতে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার জেল্লা, তাও আবার ‘রক্ষাকবচ’ ভাবনায় আইন এবং ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ ললিত বচন—রাজনীতির এই পূর্বাপর তাৎপর্যে কোম্পানির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে ছুটবে, এমন কৃষক নেহাত কম নেই। চুক্তি চাষের ভালোমন্দ না বুঝেই এগোবে অনেকে। এতেই মোদি সরকারের কর্পোরেট কৃষির স্বপ্নপূরণ সম্ভব। তবে এটুকুতেই তার নিষ্পত্তি নয়। বরং এটা সূচনা। শুরুটা হয়ে গেলে তা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগোতে থাকবে। নিয়তির মতো।
চুক্তি চাষের শুরুতে একটা মজা আছে। অনেকটা অজানা-অচেনা বিবাহিত দুই নারী-পুরুষের বাসর যাপনের মতো। একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। বছর তেরো-চোদ্দ আগের ঘটনা। আমাদের এলাকায় কিছু কৃষক পেপসিকো’র সঙ্গে ফুড প্রসেসিং কোয়ালিটির আলু চাষে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। কোম্পানি বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ করেছিল। শর্ত ছিল ফসলের দাম থেকে এসবের দাম পরিশোধ হবে। আরও শর্ত ছিল, উৎপাদিত সব আলু কোম্পানি কিনে নেবে। দাম শুরুতেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল-- কুইন্টাল প্রতি আটশো টাকা। খোলা বাজারের দামের তুলনায় গড়পরতা তিনশো থেকে চারশো টাকা বেশি। আলুচাষীরা বেজায় খুশি। কিন্তু তৃতীয় বছরে কোম্পানির এজেন্ট আলুর গ্রেডিং করে, কোয়ালিটির কথা তুলে এমন গোল পাকালো যে, চাষীরা কমবেশি অর্ধেক পরিমাণ আলুর দাম পেল খোলা বাজারের দামের তুলনায় অর্ধেক। ফলে তারা মোটের ওপর লাভ পেল সামান্য। এরপর তারা আর পেপসিকোর ছায়া মাড়ায়নি। এখন আইনের বলে তো কোম্পানির পোয়াবারো। মানেটা দাঁড়াল, অংশুমান রায়ের গাওয়া গানটার মতো— মাথায় টোপর পরার আগে ওজন করে দেখো/শোলার টোপর লোহার হবে/সেটা মনে রেখো।
মোদি সরকার প্রথম ক্ষমতায় এসেই কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির নামে জিএম শস্য বা জিন পরিবর্তিত শস্য (Genetically Modified crop)-এর অবাধ ট্রায়াল ও কিছু নির্বাচিত জিএম শস্য চাষের জন্য সমস্ত বাধা-নিষেধ তুলে দিতে সচেষ্ট হয়েছিল। বহু কৃষক সংগঠন ও সমাজ সংগঠন, কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের বিরোধিতায় সরকার পিছিয়ে যায়। পৃথিবীতে কৃষিতে সবচেয়ে বিতর্কিত এই জৈব-রাসায়নিক প্রযুক্তি। রাসায়নিক উপায়ে কৃত্রিমভাবে শস্যবীজের জিনগত পরিবর্তনের ফলে উদ্ভিদ ও জীব বৈচিত্র্যের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিপদ, মানুষ ছাড়াও বহু জীবের নানা রোগ ও শারীরবৃত্তীয় সমস্যার আশঙ্কা, যার কিছু ইতিমধ্যে প্রমাণিত এবং কৃষিতে কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম— জিএম শস্যের বিরোধিতায় এই হ’ল মূল বিষয়। কৃষি উৎপাদনে এর পরিণাম হ’ল পশ্চিম ভারতে বিটি কটন (জিএম তূলা) চাষীদের বিপর্যয়ের মতোই। কিন্তু কোম্পানিগুলোর কাছে এর চমৎকারিত্ব হ’ল, জিএম বীজ উৎপাদন উচ্চস্তরের প্রযুক্তিতেই সম্ভব, যা তাদের আয়ত্ত্বাধীন এবং প্রাথমিক পর্যায়ে চোখ ধাঁধানো (!) ফলন দিতে সক্ষম। আজ মোদি সরকার কৃষি সংক্রান্ত নতুন আইনগুলো যদি ধরে রাখতে পারে, তা হলে কোম্পানিগুলো চুক্তিচাষে ঢুকবে জিএম বীজ নিয়ে। এই বীজ হবে তাদের কৃষি-মৃগয়ার সেরা হাতিয়ার।
জিএম শস্য হ’ল বন্ধ্যা শস্য (Terminator Crop)। এই বীজ একবারই চাষ করা যায়। এর থেকে কোনো বীজ ধরা যায় না। মুশকিল হ’ল, জিএম শস্যের জমির পার্শ্ববর্তী বা কাছাকাছি জমিতে সাধারণ উচ্চফলনশীল শস্যের চাষ হলে জিএম শস্যের পরাগরেণু সাধারণ শস্যে গিয়ে পড়বে। ফলে সাধারণ শস্যও বন্ধ্যা হয়ে যাবে। তার থেকে বীজ ধরলে ফলন পাওয়া যাবে না। অবধারিতভাবে চুক্তি চাষে অনিচ্ছুক কৃষকরা উচ্চফলনশীল শস্যের চাষ করবে। বারে বারে লোকসানে পড়ে তাদের কোমর ভেঙে যাবে। সেদিন কোনো যুক্তি, কোনো বিকল্প তাদেরকে আশ্বস্ত করতে পারবে না। শুধু টিকে থাকার তাগিদে তারা কোম্পানির দ্বারস্থ হবে।
গত শতকে সত্তরের দশকে খাদ্য-সয়ম্ভরতার অজুহাতে সবুজ বিপ্লব আমদানি করা হয়েছিল। আমদানি, কেন না এর পিছনে ছিল মার্কিন প্রভুর লম্বা হাত আর রকফেলার, ফোর্ড ফাউণ্ডেশন-এর মতো বহুজাতিক কোম্পানি। সবুজ বিপ্লবের উপাদান উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি সবেতেই ছিল মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য। মাটিকে মৃতপ্রায় করে, লক্ষ কৃষককে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়ে, পাঞ্জাবের বহু এলাকাকে ক্যান্সার বেল্ট বানিয়ে, পানীয় জলে আর্সেনিক মিশিয়ে, কৃষি উৎপাদনের চমৎকারিত্ব হারিয়ে উৎপাদন হার গত শতকের পঞ্চাশের দশকের হারের থেকেও নীচে নামিয়ে এনে সবুজ বিপ্লব আজ অবয়বহীন। আজ নতুন ঢক্কানিনাদ— দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব। এর পিছনেও সেই বহুজাতিক— মনস্যান্টো, ওয়ালমার্ট, আর্চার ড্যানিয়েলস মিডল্যাণ্ড। প্রযুক্তির নাম জিএম শস্য।
বারবার বহুজাতিকদের ত্রাতা ঠাওরে ভারতের কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির পাঁচকাহন কেন? আমাদের দেশটার কি এমনই দৈন্যদশা? এর উত্তর পেতে সবুজ বিপ্লবের সূচনাকালে ফিরতে হবে। সেন্ট্রাল রাইস রিসার্চ ইন্স্টিটিউটের ডিরেক্টর ড: আর এইচ রিচারিয়া সেই সময় বলেছিলেন, আমাদের দেশের উচ্চফলনশীল বীজের বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিবর্ধন করে ফলন আরও বাড়ানো সম্ভব। তিনি সবুজ বিপ্লবের হাঁকডাকের সময়েই ১৭০০০ দেশী ধানের জাত সংগ্রহ করেছিলেন, যেগুলির মধ্যে বেশ কিছু জাত ছিল উচ্চফলনশীল। যেমন, গাদুর সেলা’র ফলন ৯৭৪৬ কেজি/হেক্টর, বালকুনি’র ফলন ৫০০০ কেজি/হে:। এরকম আরও কত দেশী ধান। শুধু তাই নয়, অনেক দেশী ধানের সামান্য পরিবর্ধন করে তিনি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছিলেন। যেমন বি ডি-৮১১ (মূল ধানের নাম স্কোয়ালারি)-- ফলন ৭৩৫০ কেজি/হে:, বি ডি-৮১৩ (মূল ধান নুঙ্গী)—ফলন ৭৬২৩ কেজি/হে:, বি ডি-২০৭ (মূল ধান টেডিবাংকো)—ফলন ৬২৫০ কেজি/হে:। সামান্য রাসায়নিক সার প্রয়োগে ও কীটনাশক ছাড়াই কিংবা সামান্য প্রয়োগেই এই ফলন হত। বহুজাতিক কোম্পানি-উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল বীজ বা জিএম সীড এসবের ধারেকাছে পৌঁছবে না। এসব ধান মানুষের বিস্মৃতির অন্ধকারে পড়ে আছে। এই বাংলায় ড: দেবল দেব স্বউদ্যোগে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর ব্লকে দেশী ধানের বহু জাত খুঁজে খঁজে সংরক্ষণ করে চলেছেন। সে খবর ক’জন রাখে?
আজ যখন আমরা কৃষিতে কোম্পানিগুলোর সরাসরি ঢুকে পড়া ও কোম্পানির অধীনে চুক্তি চাষের বিরোধিতা করব, তখন এইটুকুতেই আটকে থাকা যাবে না। আমাদের দেশজ কৃষির কথা, দেশের কৃষকদের কৃষি-নৈতিকতার কথা বলতে হবে। হারিয়ে যাওয়া কৃষি-সম্পদ পুনরুদ্ধারের কথা বলতে হবে। এখানেই আমাদের আত্মবিশ্বাস, এখানেই আত্মনির্ভরতা।
ঋণ স্বীকার: লেখাটিতে ‘কৃ্ষি: ভাবনা ও দুর্ভাবনা’ (অনুপম পাল প্রণীত) গ্রন্থ এবং ডিআরসিএসসি প্রকাশিত ‘কৃষি একটি অব্যর্থ মারণাস্ত্র’’ পুস্তিকার ‘দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব কেন পূর্ব ভারতে’ প্রবন্ধ (কল্যাণ রুদ্র লিখিত) থেকে কিছু তথ্য গৃহীত।