পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আরজিকর নিয়ে এক জনৈক নাগরিকের আর্তনাদ

  • 14 September, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 1823 view(s)
  • লিখেছেন : অনামিকা বসু
মিশেল ফুকোর কথা মিলে যাচ্ছে । হাসপাতাল মূলত রোগীর, তারপর, ডাক্তারের, তারপর কর্তৃপক্ষর, তারপর, স্বাস্থ্যকর্মীদের, তারপর গ্রুপ ডি কর্মচারীদের। এখন ঠিক উল্টো। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরীক্ষিত স্থানে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার প্রাঙ্গণে রোগীর স্থান কিন্তু তলানিতে। আমাদের অতি প্রিয় স্থবির দাশগুপ্তও এমন করেই ভাবতেন, আজ অন্যরকমভাবে ভাবার মানুষদের অভাব হচ্ছে। আরজিকরের নির্যাতিতার বিচারের দাবীতে আন্দোলন চলছে, না ভিতরে ভিতরে দ্রুত বেসরকারিকরণের দাবী জোরালো হচ্ছে, সেটাই গুলিয়ে যাচ্ছে।

লাইভ স্ট্রিমিং হয় না বন্ধুগণ। এক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী একেবারে সঠিক কথা বলেছেন। যেহেতু মূল বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নজরে ও সিবিআই আদালতের বিচারাধীন, তাই লাইভ স্ট্রিমিং করার সময়ে তাদের বিরুদ্ধে বা তাদের প্রতি অনাস্থা নিয়ে কেউ যদি কোন কথা বা প্রসঙ্গ হঠাৎ উত্থাপন করেন, করতেই পারেন কমবয়সী ছেলে-মেয়েরা, তাহলে সমস্যা বাড়তো ছাড়া কমতো কি? এন আর এস এর ঘটনায় ছাত্রছাত্রীদের সাথে লাইভ স্ট্রিমিং হয়েছিল, কিন্তু তা বিচারাধীন বিষয় ছিল না। ভিডিওগ্রাফি দু-তরফেই করতে পারা যাবে বলে সরকার মান্যতাও দিয়েছিল। আর, ১৫ জনের বদলে ৩২ জন কি ৩৪ জন? তাও ৪ জন সিনিয়র ডাক্তার? কেন? এতো ভারী নেতৃত্ব? নাকি কোন জোরালো নেতৃত্বই নেই? এ প্রশ্ন আসে।

জুনিয়র ডাক্তারেরা যারা সম্পন্ন ঘরের ছেলে-মেয়ে নয়, এখন নিট আসার পরে তাঁরা সংখ্যায় কিন্তু অনেক কমে গেছে। সম্পূর্ণ বদলে গেছে দুনিয়া। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বিশেষ কৌশলের নীট প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে হয় যা নিম্নবিত্ত বা অসম্পন্ন ঘরের ছেলেমেয়েদের কাছে ভীষণ কঠিন। সরকারি হাসপাতালেও যাঁরা চান্স পায় তাদেরও অধিকাংশেরই বাবা মা দের কিছুটা ভাল অবস্থা থাকে। বেসরকারি কলেজগুলোর কথা আর এখানে আনলামই না। ফলে মন, অভ্যেস, চিন্তা মানসিকতায় তারা কোন শ্রেনীকে প্রতিনিধিত্ব করে? যাই হোক, তার মানে এই নয় যে তাদের কোন‌ প্রতিবাদ থাকতে পারে না। থ্রেট তারা তো পান পরীক্ষায় পাশ করানো না করানো নিয়ে, এসব বিষয়েও তো তারা ভীষণই ভীত হয়ে থাকতেন। জোরালো আঘাত দেবার জন্যেই এক প্রতিবাদের ভাষা - কর্মবিরতি।

West Bengal Junior Doctors' Front (WBJDF) এ প্রচুর তরুণ , তাজা, টকবগে প্রতিবাদী হলেও তাদের সংগঠন চালানোর অভিজ্ঞতা স্বাভাবিক ভাবেই কম, প্যাঁচপয়জার জানা কম। তাদেরকেও সিনিয়র ডাক্তারদের অভিজ্ঞতা নিতে হয়, সিনিয়রদেরও একটা বড় অংশ তাই তাদের পাশেই আন্দোলনেরত।

বেশ কিছু পিজিটি কর্মবিরতি ধর্নায় আসেন না, কেন আসেননা, তাঁদের কী করা উচিত এমন অসন্তোষও জুনিয়র ডাক্তারদের জিবি মিটিং এ নিয়ে মিনিটস এও নথিভুক্ত করা হয়েছে।

পড়ুয়া পিজিটিদের নানান সমস্যা। পিজিটি-দের (১ম, ২য়, ৩য় বর্ষ) তাদের স্টাডি এবং রিসার্চ এর বাধ্যবাধকতা আছে এবং তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই। যে সমস্ত ডাক্তার চাকরি করেন না অথচ সরকারি হাসপাতালে ডিএনবি করেন (যা MD/MS এর সমতুল্য) সেটা মেডিকেল কলেজ না হলেও তা ডিএনবি ইনস্টিটিউশন। তারাও জুনিয়র ডাক্তার। তাদেরও কেস স্টাডি ও পড়াশুনা-রিসার্চের বাধ্যবাধকতা কিন্তু হেলথ ইউনিভার্সিটির হাতে নেই। ন্যাশানাল বোর্ডের হাতে। অচলাবস্থা কেটে গেলে গত একমাসের ক্ষতির দায় কি সরকার নেবেন? মনে হয়না। আর কে নেবে ছাত্রটি বা ছাত্রীটি ছাড়া? চাকরি করেন না এমন জুনিয়র ডাক্তার যারা ডিএনবি করছে তারা সাধারণত কোন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিএনবি করেন না। যেমন এম আর বাঙুরহাসপাতালে বা কোন কোন স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ডিএনবি কোর্স আছে।

বেশ কিছু ক্ষেত্রে জুনিয়র ডাক্তারদের পরামর্শ দেবার জন্য আছেন সিনিয়র ডাক্তারদের সংগঠনগুলোও। তারা মাঝেমাঝেই সামনে আসেন। তারাও সমর্থন জানাচ্ছেন। জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম এ বহু ডাক্তারদের সংগঠন আছে , কোনটা ছোট, কোনটা বেশ‌ বড়। ছোট সংগঠনের সদস্য সংখ্যা কম। বলতে পারা যায় কোন পার্টিতান্ত্রিক নয়, তারা মানসিকতায় অনেকটাই পুরোনো নকশাল, বামপন্থী বা বামপন্থী কংগ্রেস, স্বাধীন নানানরকম মতের।  

দ্বিতীয়ত আহ্বায়ক দুজনেই ডাক্তারদের সকল সংগঠনেই যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য। তবে নিজেদের অনিচ্ছাকেও গুরুতন্ত্রের দাপটে মাউথ স্পীকার হিসেবে জানিনা কখনও তাদেরকে হতে হয় কারণ সবাইকে নিয়েই চলতে হয়।

সিনিয়র ডাক্তারদের বহু সংগঠন আছে। সরকারি দলের সরকারি ডাক্তারদের সংগঠনের নাম PDA (Progressive Doctors' Association)। যে দল যখন সরকারে থাকে, তখন সেই দলের সংগঠন ভারী হয় এটাই তো স্বাভাবিক ঘটনা। আগের জমানাতে সিপিআইএমের সরকারি ডাক্তারদের সংগঠন ছিল যেমন সবচেয়ে ভারী সংগঠন - AHSD (Association of Health Services Doctors)। জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরসদের মূল কয়েকটি পায়া -

AHSD (CPIM এর সরকারি ডাক্তারদের সংগঠন) এখন খুব কমে গিয়ে সদস্য সংখ্যা কয়েকশ মাত্র। এ্যাকটিভ লোক আরো কম। এই সংগঠনের জয়েন্ট সেক্রেটারি একজন খুব  মুখর হয়ে গেছেন এই মুহুর্তে।  

HSA (Health Services Association )-সদস্যসংখ্যা খুবই কম,  মানসিকতায় অনেকেই (সবাই নন) কিছু পুরোনো রিটায়ার্ড নকশালদের ও পুরোনো কংগ্রেসেরও আছেন। চাকরি করেন এমন সরকারি ডাক্তার খাতায় কলমে আছেন কিছু - তবে অন্যদের তুলনায় খুবই কম।  DFD (Doctors for Democracy) - ছোট একটি সংগঠন; শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ - সদস্য সংখ্যা কম; West Bengal Doctors Forum (WBDF)- সবচেয়ে শক্তিশালী এরা। এরা মূলতঃ কর্পোরেট ডাক্তার। প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বেশ নাম আছে এমন একটি শক্তিশালী সংগঠন। এদের সঙ্গে IMA (Indian Medical Association)- এরও যোগাযোগ ভালোই। এদের নেতৃত্বে অনেক প্রথিতযশা চিকিৎসক আছেন। SDS (Service Doctors Forum) এটি SUCI পার্টির সংগঠন - এরা জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস, ওয়েস্ট বেঙ্গল এর মধ্যে নেই। তবে, জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম এ কতিপয় চিকিৎসক আছেন যারা জাতীয়তাবাদী ডাক্তার সংগঠন, বিজেপির সমর্থক, এমনও ছিলেন।

বহু প্রথিতযশা বেসরকারি অসরকারি কর্পোরেট চিকিৎসক কোভিডে কোটি কোটি টাকা মানুষের অসহায়তার মধ্যেও রোজগার করেছেন। টেলিভিশনে এসে আতঙ্ক পরিবেশন করতেন তাঁরা, ভ্যাক্সিনের ঠিক বা বেঠিক কতটা না দেখে সদর্থক ভাবেই প্রচার করতেন ভ্যাক্সিনের পক্ষে। কেউ বিরোধিতা করলে দেগে দিতেন সমাজের শত্রু, বিজ্ঞানের শত্রু হিসেবে। ভাবটা এমনই জনস্বার্থে এনারা কত উপকার করছেন - এমন ভাবেই প্রজেক্টেড হতেন মেইনস্ট্রীম মিডিয়াগুলোর ছায়াতলে। ফলে খুব দ্রুতই বিখ্যাত হয়ে যান এনারা রাতারাতি। Joint Platform of Doctors দের এরাই মূল শক্তি। এদের পাল্লায় সংগঠনে সবাইকে নিয়ে চলার স্বার্থে বাদবাকি অনেক সমাজবন্ধু নেতৃত্বে থাকা ডাক্তাররা অনেকসময় নিজেদের অন্তরালে বোঝেনও না কখন তাদেরও মেটামরফসিস ঘটে।

বহু ডাক্তারই কর্পোরেটপ্রেমী -তাদের ঘরানা অন্য এক আখ্যান। ফার্মালবি কর্পোরেট দের নতুন জমানা শুরু হয়েই গেছে - ভ্যাক্সিন মার্কেট তৈরি করা - তার মান্যতা সমাজ থেকে, মেডিকেল কলেজগুলো থেকে, তাদের রিসার্চ অর্গানাইজেশন থেকে নির্মাণ করতে হবে ধীরে ধীরে। কীভাবে? নানান ব্যবসায়িক তঞ্চকতায় রিসার্চ এর ছলনায়। পিছনে নিভৃতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে Public Health Foundation of India (PHFI) এবং ইউনেস্কো এইরকম সংগঠন ও বড় বড় NGO। কর্পোরেটরা এমন একটা ডীপ স্টেট (Deep State) তৈরি করে রাখে এখানে কোন রাষ্ট্র, কোন সরকাররেরই তেমন কিছু করার নেই। PHFI র পিছনে সবচেয়ে বড় অনুদানকারী সংগঠন হলো বিল এ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। অমানবিকতাবাদী মুখোশের আড়ালে অসাধু, অসামাজিক, শুধুই বাণিজ্যকেন্দ্রিক বেশ কিছু ডাক্তারদের কুঅভ্যাসগুলোর কথার মহাভারত নয় ছেড়েই দিলাম।

একজন নামকরা কর্পোরেট ডাক্তারবাবু সর্ববিষয়ে ভাল কথা বলার ডাক পান টেলিভিশন মিডিয়াতে। Bengal Chamber of Commerce এর স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির সাথে তাদের মতন অনেকেই সরাসরি তো বহু বছর ধরেই যুক্ত ছিলেন বা আছেন। হাসপাতাল সরণী-তে (পড়ুন ইস্টার্ন বাইপাস) একটি হাসপাতাল কিডনি পাচারে জড়িয়ে পড়েছে - কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশ তা তদন্ত করছে। কিডনির আনরিলেটেড ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন এর মৃগয়াক্ষেত্র হচ্ছে কর্পোরেট হাসপাতাল গুলো।

আজ কিন্তু অবশ্যই কোভিড পর্বের পর আরেকটা মুনাফার উলম্ফন পর্ব চলছে কর্পোরেটদের – শীর্ষ সরকারি হাসপাতালগুলোতে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতিতে। এটার গতি এভাবেই চলতে গেলে পুঁজির যা চরিত্র সে নতুন রূপে বাণিজ্য খোঁজে, পাল্টায় তার চরিত্র, তায় আবার লুটপাটের জন্য মুনাফা - এসব তো খেয়াল রাখতেই হবে ! ভবিষ্যতে সরকারী হাসপাতালের গতি কি কর্পোরেট মুখীনতার উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবে না তো! সিঁদুরে মেঘ নয় তো? এই উদাহরণ কর্তৃপক্ষের কাছে না চাইতেও একটা টেস্ট হয়ে যাচ্ছে না তো !

হাসপাতালে বিশেষতঃ জুনিয়ার ডাক্তারদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা কিন্তু নির্ভর করে না ফ্লাডলাইট বাড়িয়ে দিয়ে,  কোলাপসিবল গেট চারগুণ বাড়িয়ে দিয়ে, সিসি ক্যামেরা দশগুণ বাড়িয়ে দিয়ে বা জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলে। ডাক্তারদের নিরাপত্তার চয়ন তখন থেকেই সূচনা হয় যখন পেশেন্ট পার্টি - ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্পর্ক উন্নত হয়। তারজন্য গোটা ব্যবস্থাটাই বদলাতে হয় - এমন ভাবেই মনে হয় দাবী থাকা উচিত। থাকা উচিত এমন দাবী যে শীর্ষ হাসপাতালগুলোতে জেলা থেকে অজস্র রেফারেল বন্ধ হোক। ওখানকার ডাক্তারবাবুরা একটা এ্যাপেনডিক্স কাটারও অপারেশন কেন ঐ হাসপাতালগুলোতে পাঠিয়ে দেয়? ফলে ৭০% রোগিকে পরিষেবা দিতে হয় বাড়তি - যার ৬০% রোগীরই চিকিৎসা শীর্ষ হাসপাতালে দরকার ছিল না। এই বাড়তি চাপ তো ডাক্তারদেরও ঠিকমতন চিকিৎসার অন্তরায় হয়ে যায় - সেই দাবী কোথায়? ভাল গুণমানের ওষুধের এতো অপ্রতুলতা কেন মেডিকেল কলেজে? এই দুর্নীতির তদন্তও তো দরকার। এই বিষয়ের প্রশ্নগুলোকে উহ্য রেখে কি আর নিরাপত্তা আর সুরক্ষা আসে? প্রথমেই তো ডাক্তার বনাম রোগীর বা রোগীর বাড়ির লোকের অবিশ্বাস তৈরি হয়।

WBJDF এর কয়েকজন ডাক্তারের সাথে কথা বললেই বোঝা যাবে তারা ২৪ বা ২৫ - ২৬ বছরের ছেলে বা মেয়ে। বেশ আত্মবিশ্বাসী টগবগে কিন্তু গলার স্বরে যেন বুঝতে পারা যাচ্ছিল ওরা অনেক ডিপেন্ডেন্ট সিনিয়র দের প্রতি "কী করিতে হইবে" এই নিদান এর জন্যে।

যদি এরকম ঘটে, বেশী নয় ১০০ পেশেন্ট কারোর হাতে স্যালাইন, কারোর বা অসুস্থ  রুগ্ন বাচ্চা মায়ের কোলে বা কেউ স্যালাইন হাতে ব্যানার নিয়ে : লেখা যদি থাকে : "আমাদের কর্পোরেট হাসপাতাল নেই"। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো তে ভর্তি হয়েও নিত্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার রুটীন কাজ যে ব্যাহত হচ্ছে - সে দৃশ্যও কি কোন সংবেদনশীল নাগরিকদের কপালে জুটতে পারে?

"রোগিদের সামান্য একটু আধটু অসুবিধা হতে পারে কিন্তু বিশাল কোন ক্ষতি হয়নি। বা, যা ছিল ঠিকঠাকই চিকিৎসা চলছে" এই অতি কাঁচা বয়ানের অর্থ কী? অসুবিধায় ক্ষতিই যদি না হয় ,তাহলে আর কীসের দাবীদাওয়া? এরকম হয় নাকি! কর্তৃপক্ষ কে চাপে না ফেললে দাবী আদায় হয়? তাহলে কথাটা তো নিজেদেরই কাছেই ব্যুমেরাং হয়ে আসে! সরকারকে চাপ না দিলে তো সরকার মানবে না। এসব কাঁচা কথাতে তো সরকারকেই বাহবা দেওয়া হলো। তারমানে, সরকার তো ঠিকঠাকই এদের ছাড়াই কাজ চালাতে পারে - এই অর্থই তো বেরিয়ে আসে। এ কথার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। জুনিয়র ডাক্তারেরা যে কাজগুলো করেন (পিজিটির ১ম,২য়,৩য় বর্ষ এবং ইনটার্নদের আলাদা আলাদা কাজ) সেগুলো এখন তাহলে কে দেখবে? সিনিয়র ডাক্তারেরা। তাহলে কেস দেখা, ডায়াগনোসিস করা, অপারেশন বা কনসাল্টেশন করা - এগুলো কে করবে ? সিনিয়ররাই। আবার সিনয়রদেরও যারা বড় কত্তা তাদের বিকেলে প্রাইভেট চেম্বারও আছে - কী হবে তাহলে ? কোনটাই ভাল ভাবে হবে না। পেশেন্ট ভর্তি হলেও তার নিত্য রুটিন চিকিৎসার টুকিটাকি ব্যাপারগুলো যেগুলো ইন্টার্ন ও পিজিটি-১ সামলাতো ,সেটা কীভাবে সিনিয়ররা করবেন? ফলে অচলাবস্থা হবেই। একটা ভারী সংখ্যা হল ইন্টার্ন। তারা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। তাদের ১ বছর ইন্টার্নশিপ এ প্রায় ১৫/১৬ টা ডিপার্টমেন্ট এ ঘুরেঘুরে কাজ শিখতে হয়। ডাক্তাররাই বলেন, ইন্টার্নশিপের জীবনটাই গোটা জীবনের সবচেয়ে হাল্কা জীবন। সরাসরি দায়িত্ব থাকেনা। সব দাদা-দিদিদের দায়িত্বে। কী বলবো - ছেলেমানুষ তাঁরা - তাদের মাথাতেও নেই তাদের এই কাজের খামতি জীবনে আর একবারও কিন্তু ফিরে আসবে না।

সরকারি হাসপাতালের আসল বেনিফিশিয়ারি কারা? মূলত নিম্নবিত্ত মানুষেরা। তাই, যে যার মতন করে তার মনের আদলে খুঁজুন এসব লেখার অর্থ কী। জুনিয়র ডাক্তারদের ইংরিজিতে চীফ সেক্রেটারিকে মেইলে উত্তর দেবার বয়ান গুলো দেখুন। কিংবা রাষ্ট্রপতিকে পাঠানো চিঠির বয়ান দেখুন। এ ভাষা ওঁদের চয়ন নয়। অতো আইনের কালোয়াতি ভাষা ২৪/২৫/২৬/২৭ বছরের ছেলেমেয়েদের আসে না। তবে সেটা লেখার সুযোগ যারা নিয়েছেন, তারা কি নিজেদের ইচ্ছেগুলোর কথা উহ্য রাখবেন? হয়তো নয়।

সে উত্তরে সব লেখা আছে তাদের দাবীর কথা। একে, ওকে, তাকে পদত্যাগ করতে হবে। হাসপাতাল কমিটিগুলোতে জুনিয়র ডাক্তারদেরকেও রাখতে হবে। এটা ভাল দাবী। তবে আর কোন রোগি স্বার্থের কথা নেই। ১৯৮৩ র জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনে ১১ দফা দাবিতে ১০ দফাই ছিল রোগিদের জন্যে, ১১ তম দাবি ছিল মাইনে বাড়ানোতে। হাসপাতালের ঠিক বাইরে ত্রিপল খাটিয়ে তারা প্যারালাল আউটডোর সামলাতো। কর্পোরেট নয়, রিপ্রেজেন্টেটিভরা তাদের ওষুধ দিতো আর যা চাঁদা উঠতো তাতে বাল্ক ওষুধ কেনা হতো। সরকার তো চাপ খেয়েই ১৯৮৩ সালে লাঠিপেটা করেছিল জুনিয়র ডাক্তারদের। অধিকাংশ জুনিয়র ডাক্তারেরাই তখন ছিল এ রাজ্যেরই অধিবাসী ডাক্তারি ছাত্র। নীট মারফৎ কোটা বা নয়ডা বা পুণায় লক্ষলক্ষ টাকা খরচ করে কোয়েশ্চেন সেটিং একেবারেই প্রায় আন্দাজ করা প্রশ্ন সঠিক মিলে যাওয়া (মেধাবী হলেও তারা অনেকক্ষেত্রেই অনেকেই বিত্তবান) - এ চিত্র এখনকার।  সেসময়ে নিম্নবিত্ত বহু ছাত্রছাত্রীরা ডাক্তারি পড়তে চান্স পেতো - তখন সিস্টেম টা এমনই ছিল। এখনকার ঠিক উল্টো।গরীব রোগির স্বার্থের কথা থাকবে না তাদের চিন্তার চয়নে। তাছাড়া এতো কর্পোরেট বিগ হাউস হাসপাতাল তো তখন এরকম ছিল না। এখন প্রচুর । তাই টাকা কামানোর হাতছানিও প্রচুর।

 

এবার একটু অন্য কথায় আসা যাক। মমতা সরকারের পুলিশ তৃতীয় লিঙ্গের কারুর কাছে জুতোপেটা খেয়েছে - সেই ভিডিওটা ভাইরাল হয়েছে। কেউ সেটা ক্যামেরায় তুলে নীচে ক্যাপশন দিয়েছেন যাকে আ্যাস্টন বলে : "হিজড়ের হাতেও জুতোপেটা খেতে হলো কলকাতা পুলিশের।" বাহ্ ! কী অসম্ভব ভাল বামপন্থী ভাষা! তারা শ্রেনীস্বার্থ, শ্রেনীচেতনার কথা বলেন না এখন। কাজও করেনা তা। তাদের টার্গেট অডিয়েন্স তো মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত। তাই তাদের আন্দোলনের ক্ষেত্র এখন আদালত আর টেলিভিশন। মাঠ-ময়দান নয়। লিঙ্গ বয়ানকেও রাজনীতির আলোচনায় আনেনা। এটাও যে অসাম্যের এক রুচি বায়সংষ্কৃতি - এ বোধ কি কারোর নেই?

মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে দলতন্ত্রের আন্দোলনের ভাষায় নিয়ে যাওয়া হলো আর এদের ইস্যুভিত্তিক ও গোপনে ভোটভিত্তিক দোসর হলো সবচেয়ে কুখ্যাত ডানপন্থী দলটি।

মিশেল ফুকোর কথা মিলে যাচ্ছে । হাসপাতাল মূলত রোগীর, তারপর, ডাক্তারের, তারপর কর্তৃপক্ষর, তারপর, স্বাস্থ্যকর্মীদের, তারপর গ্রুপ ডি কর্মচারীদের। এখন ঠিক উল্টো। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরীক্ষিত স্থানে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার প্রাঙ্গণে রোগীর স্থান কিন্তু তলানিতে। একজন বয়স্ক পুরুষ রোগী হিমোডায়লেসিস এর পর ট্রলিতে করে আসছেন ওয়ার্ডে। ক্লান্ত, অবশ , পরিশ্রান্ত। তার পরনের কাপড়টি অবিন্যস্ত। এই অর্ধনগ্ন অবস্থায় ঝ্যাঙড় ঝ্যাঙড় করে জং ধরা একটি ট্রলিতে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওয়ার্ডে। এই দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেলতে হয় বিবেকবান যে কোন মানুষের। চেঁচিয়ে না বলে পারা যায় না - ওঁনার কাপরটা ঠিক করে দিন, ওঁনাকে একটু যত্নে নিয়ে যান । ওঁনাকে মানুষের মতন সম্মান দিন।

0 Comments

Post Comment