ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার একশো বছর পালন করা শুরু হয়েছে। যে কোনো দেশের কমিউনিস্ট পার্টির একশো বছর পূর্ণ হওয়া অবশ্যই সাধারণ ভাবে এক ঐতিহ্যমণ্ডিত বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই একশো বছর পূরণ হওয়ার মধ্যে কী কোনো গৌরব আছে? কী হয়েছে পার্টি প্রতিষ্ঠার পর এই একশো বছরে? দেখা যাবে, একশো বছর আগে দেশের যে পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, একশো বছর পরেও একটি দেশের কমিউনিস্ট পার্টির যে কাজ, দেশের আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে, শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করে, সমাজতন্ত্রের পথে এগোনো, এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টি তো সে কাজ করে উঠতে পারেই নি, বরং বহুধা বিভক্ত হয়ে গেছে। ফলে দেশের শ্রমজীবী মানুষ লাগামহীন রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে আরও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে, কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার একশো বছর পরে দাঁড়িয়ে একবার ফিরে দেখা যেতে পারে কেন এই অবস্থা, কেন এই ব্যর্থতা, কেন এই পরিণতি? অবশ্য আলোচনাটি বিশাল, এই স্বল্প পরিসরে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা সম্ভব নয়, তাই এখানে অতি সংক্ষিপ্তকারে আলোচনাটি রাখা হচ্ছে।
এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, একেবারে জন্ম লগ্ন থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার মধ্যে বিতর্ক, নেতৃত্বের পরস্পরবিরোধিতা, স্ববিরোধিতা, বিভ্রান্তিকর বক্তব্য যুক্ত হয়ে আছে। প্রথমেই বিতর্ক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার দিনটি নিয়ে। ১৯২০ না ১৯২৫, কোনটি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম সাল? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের-এর উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দের ইন্ডিয়া হাউসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয় সাতজন সদস্যকে নিয়ে। তারা এটাও জানিয়ে দেয়, এই সংগঠন তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নীতি অনুসরণ করেই চলবে। পার্টি কমিটিতে ছিলেন— মানবেন্দ্রনাথ রায়, এভলিন ট্রেন্ট, অবনীনাথ মুখোপাধ্যায়, রোজা ফিটিনগভ, মহম্মদ আলি, মহম্মদ শফিক সিদ্দিকি এবং তিরুমল আচার্য। আন্তর্জাতিকের তুর্কিস্তান ব্যুরোকে এ সংবাদও জানানো হয় যে–
This is to state that the communist party of India has been organized here. It is working in conformity with the principles of the Third International under the Political guidance of the Turkestan Bureau of the Comintern. (source- Documents of the history of the communist party of India, Vol 1, Edited by Gangadhar Adhikari.).
পরবর্তী কালে তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এই কমিউনিস্ট পার্টিকে স্বীকৃতিও দেয়।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণতম নেতৃত্ব মুজফফর আহমেদও তাঁর আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গ্রন্থে সে কথা স্বীকার করেছেন। এ তো গেল ১৯২০ সালে বিদেশের মাটিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের কথা। এর পর দেখা যাচ্ছে, পরবর্তীকালে মানবেন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় জানাচ্ছেন যে তাঁর নাকি এমন দল গড়ে তোলার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। তিনি লিখেছেন— I did not approve of the formation of the emigrant communist party, and I did not believe that it had any right to speak on behalf of the workers of India, not to mention the Indian people as a whole. (Source- M N Roy, Memoirs, Allied Publishers Pvt. Ltd. Calcutta, 1987.)
নিজে পার্টি গড়লেন, আবার নিজেই পার্টি গড়ার বিরোধিতা করলেন। কী স্ববিরোধিতা! শুধু তাই নয়, নবগঠিত এই পার্টির মধ্যে কিছুদিনের মধ্যেই পরস্পর ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয়ে যায়। সে ঝগড়াঝাঁটি থামাতে তুর্কিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়, তারা ব্যর্থ হলে পরামর্শ দেয়, মস্কোতে গিয়ে দুপক্ষের বিবাদ মিটিয়ে নিতে। এই বিবাদ মতাদর্শগত ছিল না অবশ্যই, সবটাই নেতৃত্ব নিয়ে, সংগঠনের রূপ নিয়ে এবং এমন আরো নানা বিষয়ে বিবাদ। তবে তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকও প্রবাসে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই কমিউনিস্ট পার্টিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পরে অবশ্য তারা সে স্বীকৃতি ফিরিয়ে নেয়।
মুজফফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন এই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ১৫মে, জার্মানি থেকে, নাম ছিল দি ভ্যানগার্ড অফ দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স। মুজফফর আহমেদ ও তাঁর সহকর্মীরা এই পত্রিকা ভারতে বিলি করতেন। তবে সে পত্রিকায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র হিসাবে লেখা থাকত না। তবে দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল দি ভ্যানগার্ড নামে । সেখানে এই পত্রিকা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র হিসাবেই ঘোষণা করা হয়। মুজফফর আহমেদ আরো জানিয়েছেন যে শ্রীপাদ ডাঙ্গে ও ঘাটে গোষ্ঠি ভুল তথ্য সরবরাহ করে ১৯২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কানপুরে কমিউনিস্ট কনফারেন্সকেই পার্টি প্রতিষ্ঠার সময় বলে গণ্য করেছেন। তবে পাঠকদের মনে রাখতে হবে, মুজফফর আহমেদও সেই কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন এবং ১৯৬৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত সেই ১৯২৫ সালকেই পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে পালন করে এসেছেন। তাঁর ভুল ভাঙ্গল, যখন ডাঙ্গের সঙ্গে আর বনিবনা হল না, পার্টি ভাগ হল, তখন তাঁর ও তাঁর দলের মনে হল ১৯২৫ নয়, ১৯২০ হল প্রকৃত পার্টি প্রতিষ্ঠার বছর। যে পার্টি প্রতিষ্ঠা হয়ে ছিল এম এন রায়ের নেতৃত্বে ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে। বড্ড দেরী হয়ে গেল!
তবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি অবশ্য তৈরী হয়েছিল সেই ১৯২৫ সালে কানপুর কনফারেন্সেই। সেই কনফারেন্স কে ডেকেছিল? গান্ধীর পাঠানো এক অনুচর সত্যভক্ত ১৯২৫ সালে এই সম্মেলন আহ্বান করে। এর সম্পর্কে মুজফফর আহমেদ লিখেছেন—
"কানপুরের মোকদ্দমা চলার সময়ে মাঝে মাঝে দর্শকদের আসনে একজন লোক এসে বসত। তার নাম ছিল সত্যভক্ত। এটা কিন্তু তার বাবা-মায়ের দেওয়া নাম ছিল না। গান্ধীজীর সবরমতী আশ্রমে তিনি এই নাম গ্রহণ করেন। সেখানে সত্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলত কি না।" (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রথম যুগ)। মুজাফফর আহমেদ জানাচ্ছেন, সেই সত্যভক্ত ঘোষিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ডাকা কানপুর কনফারেন্স-এ তিনি যোগ দিলেন। কারণ সত্যভক্তই তাঁকে চিঠি লিখে কনফারেন্স-এ যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই কানপুর কনফারেন্স-এ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হল। সেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে যাঁরা ছিলেন, মুজাফফর আহমেদ তাঁদের অন্যতম। বিরোধের কারণে সত্যভক্ত কনফারেন্স-এ না থাকলেও, তার অনুচরেরা থেকে গেল। কমিউনিস্ট পার্টির কনফারেন্স খোলাখুলি ভাবেই হচ্ছিল। কমিটিও প্রকাশ্যেই গঠিত হল। কমিটি সদস্যদের নাম প্রকাশ্যেই ঘোষণা করা হল। সুতরাং, ব্রিটিশ শাসক থেকে তাদের পদলেহী, সকলেই অবগত হল যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি কাদের নিয়ে গঠিত হল। এবং সেখানে তাদের অনুচরেরা আছে কি না। এ প্রসঙ্গে মুজাফফর আহমেদ-এর সাফাই হল-আমরা যদি কানপুর কনফারেন্স-এ যোগ না দিতাম, তবে, ভবিষ্যতে সত্যভক্তর আলাদা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠতই, আর সেই পার্টি পদে পদে আমাদের পথে বাধা সৃষ্টি করত। কী অদ্ভুত অমার্কসীয় যুক্তি! সত্যভক্ত মনে করলে তো পরেও আবার আলাদা পার্টি তৈরী করতে পারত। যেমন মুজাফফর আহমেদরা তৈরী করেছিলেন ১৯৬৪ সালে। আসলে সত্যভক্ত-র আলাদা পার্টি আর তৈরী করার দরকার হয় নি। কারণ সে কনফারেন্স থেকে বিদায় নিলেও তার যে অনুচরেরা থেকে গিয়েছিল, তারাই পরবর্তী কালে সত্যভক্ত-র যে উদ্দেশ্য ছিল, তা পূরণ করে, গান্ধীবাদী পথেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে পরিচালিত করেছে, ভারতের প্রতিটি বিপ্লবী সম্ভাবনা ধ্বংস করে গেছে, গান্ধীর তথাকথিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের পায়ে মাথা নত করে রেখেছে। শোলাপুর, নৌবিদ্রোহ থেকে তেলেঙ্গানা, তেভাগার ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই বহন করে। মুজফফর আহমেদ জানিয়েছেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে সারা ভারত কংগ্রেস কমিটির সভ্যও ছিলেন তিনজন। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এমন কেন্দ্রীয় কমিটির আন্দোলনমুখী চরিত্র কেমন হবে!আর পার্টি সম্মেলন বা পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন যে প্রকাশ্যভাবে করা উচিত হয় নি, সে কথাও স্বীকার করে নিয়ে মুজাফফর আহমেদ বলেছেন-এ জন্য আমাদের সমালোচনা প্রাপ্য। ব্যস ওই টুকুই। এর পরে কোনো দিনই তাঁদের গোপন পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজন হয় নি, কারণ ক্রমশই তাঁরা ভারত রাষ্ট্রের অংশে পরিণত হয়েছেন। গণ আন্দোলনকে ছেড়ে দিয়েছেন স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্যে, যা অচিরেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে বারবার।
সেই চরিত্রের স্বরূপ অচিরেই দেখা গেল। ১৯২৮ সালে ভারতের শ্রমিক-কৃষক তথা ব্যাপক জনগণের মধ্যে যখন আন্দোলনের জোয়ার দেখা দিয়েছিল, সে প্রসঙ্গে মুজাফফর আহমেদ বলছেন, “১৯২৮ সালের এই সংগ্রামের ভিতর দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী পার্টিতে পরিণত করার অপূর্ব সুযোগ এসেছিল। বিপুল সংখ্যক মজুরের পার্টিতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। ধর্মঘটগুলির বক্তৃতার ভিতর দিয়ে রাজনৈতিক পার্টির সম্বন্ধেও মজুরেরা সচেতন হয়ে উঠছিলেন। সাধারণ শ্রমজীবী জনসাধারণের উপরেও আমাদের প্রভাব পড়েছিল। তখনই কাজ শুরু করলে, তাঁদের সকলের মধ্য থেকে অনেকেই আমাদের পার্টিতে আসতেন”। কিন্তু কেন তখনই এ কাজ শুরু করা গেল না? তিনি সে কারণও জানিয়েছেন। “ভারত সরকার আমাদের ওপরে কঠোর আঘাত হানার জন্যে তাদের অস্ত্র শানাচ্ছিল। জন নিরাপত্তা আইনের খসড়া কেন্দ্রীয় আইন সভায় উপস্থিত করা থেকে আমরা তা খানিকটা বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমরা যে আত্মগোপন করে কাজ করব, সে অবস্থাও তখন আমাদের ছিল না”। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের কি করুণ অবস্থা! আক্রমণ নেমে আসার আগে, শাসকের অস্ত্র শানানো দেখেই তাঁরা ভয় পেয়ে গেলেন। আর আত্মগোপন করে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির কাজ চালানো! গান্ধীবাদে তো এমন পার্টির কথা লেখা নেই! সুতরাং গোপন ভাবে কাজ করা যাবে কী করে? সুতরাং দেশব্যাপী এই আন্দোলনের জোয়ার থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে পার্টির অধিকাংশ নেতৃত্ব মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার সূত্রে গ্রেফতার হয়ে ব্রিটিশ শাসকের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেন।১৯২৯ সালের মার্চ মাসে সারা দেশ থেকে প্রায় পঞ্চাশ-জনকে গ্রেফতার করা হল, যাদের মধ্যে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও সদস্য, শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনের নেতৃত্ব।
পার্টি যখন এই ভাবে স্বতঃস্ফূর্ততার স্রোতে ভাসছে, তখনও সে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের স্বীকৃতি পায় নি। কারণ স্বীকৃতির জন্য প্রাথমিক যেটুকু প্রয়োজন, একটি পার্টি কর্মসূচী ও পার্টি সংবিধান, সেটাও তৈরী হয় নি। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পরামর্শ ক্রমে এই কর্মসূচী ও সংবিধান রচনার কাজ শুরু হয়। ১৯৩০ সালের ডিসেম্বরে অর্থাৎ পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হওয়ার পাঁচ বছর পরে পার্টির খসড়া কর্মসূচী ও সংবিধান তৈরী হয়েছিল।আর তৎকালীন নেতৃত্বের যা স্বরূপ, সত্যিই কি এসবের কোনো প্রয়োজন ছিল? যাই হোক, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পরামর্শ উপেক্ষা করতে না পেরে, খসড়া কর্মসূচী তৈরী হলেও, নেতাদের মধ্যেই তা নিয়ে মতপার্থক্য শুরু হয়ে গেল। দল ভাঙাভাঙিও দেখা দিল। ফলে তৃতীয় আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত থাকল।
১৯৩০ সালের খসড়া কর্মসূচীতে ঘোষণাকরা হয়েছিল— “ব্রিটিশ শাসনকে অস্ত্রশক্তির জোরে পরাস্ত করে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে”। আর তার তিন বছর পার হতে না হতেই, ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি দাবি করে বসল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে “সংবিধান সভা” আহ্বান করতে হবে।আর ১৯৪৬ সালে তো প্রাদেশিক বিধান সভার নির্বাচনে সরাসরি অংশ নিয়ে সংসদীয় সংগ্রামের পথ ধরে ফেলে, রাষ্ট্রশক্তির অংশে পরিণত হল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব। সশস্ত্র শক্তি দিয়ে ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাতের লড়াই নির্বাচনী ইস্তাহারের তলায় চাপা পড়ে গেল চিরকালের জন্য। তেলেঙ্গানার সশস্ত্র সংগ্রামকে পার্টি নেতৃত্বের অনুমোদনে ১৯৪৬ ও ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রশক্তি নির্মম ভাবে দমন করল। শহিদদের রক্ত মাড়িয়ে সংশোধনবাদী বিশ্বাসঘাতক কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্ব পুরোপুরি সংসদীয় পার্টির রূপটি তুলে ধরল। আর এই সংসদীয় লড়াইয়ের পথ ধরেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব চলতে লাগল ধারাবাহিকভাবে। পরিণত হল একটি নির্বাচন-সর্বস্ব পার্টিতে।
নেতৃত্বের এই সংশোধনবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে বিপ্লবী কর্মীবাহিনীর লড়াই কিন্তু থেমে ছিল না। সমগ্র এই সময়ের ইতিহাসটিই হল নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস এবং তার বিরুদ্ধে কর্মীবাহিনীর লড়াইয়ের ইতিহাস। সেই পথ ধরেই ১৯৬৪ সালে পার্টি দু টুকরো হয়ে গেল। এই ভাঙনের প্রক্রিয়া আসলে শুরু হয়ে গিয়েছিল বহু আগেই। পার্টির মধ্যকার বিপ্লবী কর্মীবাহিনী বার বার পার্টি নেতৃত্বের আপোষকামী সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, আর এই বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে পার্টি নেতৃত্বের এক অংশ অপর অংশের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করে পার্টি কর্তৃত্ব দখল করতে চেষ্টা করেছে। সংকীর্ণ গোষ্ঠি গঠন করে পরস্পর দ্বন্দ্বে মেতেছে। ১৯৬৪ সালের বিভাজনের পিছনে পার্টি কর্মীদের চাপ থাকলেও, নেতৃত্ব কিন্তু আদর্শগত ভাবে বিভাজন ঘটায় নি। বিভাজন ঘটেছে নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে। কর্মীবাহিনীকে বিভ্রান্ত করতে সামনে রাখা হয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যকার আদর্শগত দ্বন্দ্বে কমিউনিস্ট চীনের পক্ষে দাঁড়ানোর অজুহাত। এটা যে তাদের ভণ্ডামী ছিল সেটা বোঝা যায়, কিছুদিন পরেই যখন তারা রাশিয়া ও চীনের থেকে সমদূরত্ব রাখার অবস্থান ঘোষণা করে। পার্টির বিভাজনের মধ্যে আদর্শগত বিরোধ যে ছিল না, তা আরও স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, বিভাজনের আগে, যখন বিবাদমান দুই গোষ্ঠির বিরোধ মেটাতে শেষ চেষ্টা হিসাবে ভূপেশ গুপ্তের বাড়িতে সভা ডাকা হয় ১৯৬৪ সালের ৪ জুলাই। সেখানে ভূপেশ গুপ্ত ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, সি রাজেশ্বর রাও, গঙ্গাধর অধিকারী, জ্যোতি বসু, হরকিষন সিং ও প্রমোদ দাশগুপ্ত। জ্যোতি-প্রমোদ গোষ্ঠি পার্টিতে ডাঙ্গেকে চেয়ারম্যান হিসাবে মেনে নিতে রাজি হয়, তবে, সে ক্ষেত্রে নাম্বুদ্রিপাদকে পার্টির জেনারেল সেক্রেটারির পদে বসাতে হবে বলে তারা দাবি করে। ডাঙ্গে গোষ্ঠী এই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সমঝোতা প্রচেষ্টা ভেঙ্গে যায়।এ ছাড়াও আরও নানা প্রস্তাব ছিল। কিন্তু কোনোটিই আদর্শ গত নয়। অবশেষে পার্টি দু ভাগ হয়ে গেল।
তা কেমন হল এই নতুন পার্টি গঠন? কেমন ছিল পুরানো পার্টিটি, যেখানে এই সি পি আই (এম) নেতৃত্ব প্রায় চল্লিশ বছর ঘর করে এলেন? অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতৃত্ব এবং সি পি আই (এম)-এর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরাইয়া এই চল্লিশ বছরে তাঁদের ক্রিয়াকলাপ এবং নতুন পার্টির চরিত্রটি কেমন তার একটি সুন্দর মূল্যায়ন করে নিজেদের মুখোশ নিজেই খুলেছেন। "Why this ultra-left deviation" বা কেন এই অতি বাম বিচ্যুতি নামক একটি দলিল তিনি রচনা করেন এবং ১৯৬৮ সালে সি পি আই (এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির অধিবেশনে (অক্টোবর ৫-৯) তা গৃহীত হয়। সেখানে তিনি বলেছেন গত চল্লিশ বছরে কর্মীবাহিনীর বিপুল আত্মত্যাগ সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে শিকড় বিস্তার করতে পারে নি। শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে বুর্জোয়া প্রভাব আধিপত্য করছে।কৃষকদের মধ্যেও কমিউনিস্ট পার্টি উপযুক্ত ভূমিকা রাখতে পারে নি। শুধু তাই নয়, পার্টি তত্ত্ব ও আদর্শগত শিক্ষাদানের কাজটিও অবহেলা করে চলেছে। গত চল্লিশ বছর ধরে ত্রুটিপূর্ণ কর্মসূচী গঠিত হয়, তারপর ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত কোনো সঠিক কর্মসূচী তৈরী করা যায় নি। পার্টির মধ্যে মৌলিকতত্ত্ব ও মতাদর্শগত প্রশ্ন উঠেছে বারবার, বারবার সে সব প্রশ্ন পার্টির মধ্যে আলোচনা না করে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। পি সুন্দরাইয়া, যিনি এই কথাগুলি বলেছেন, তিনি ও তাঁর সহযোগী নেতৃবৃন্দও কিন্তু এই সময়ে সি পি আই-তেই ছিলেন। অতএব পূর্বতন কমিউনিস্ট পার্টির উপর দোষ চাপাতে গিয়ে তাঁরা নিজেদের মুখোশটাও কি খুলে ফেললেন না? হ্যাঁ, সেই মুখোশ খুলে ফেলেই, ওই দলিলে তিনি আরও বলেছেন-এক সময়ে ঐক্যবদ্ধ পার্টির এবং শোধনবাদীদের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করার পরে আমাদের পার্টির শ্রেণীগত গঠন হল প্রধানত পেতিবুর্জোয়া চরিত্রের। পার্টি সভ্যদের শতকরা নব্বইভাগই মাঝারী ও ধনীকৃষকদের মধ্য থেকে নেওয়া। শ্রমিক ও অর্ধশ্রমিক সংখ্যা নগণ্য। পার্টি গঠনের এই অবস্থাটাই আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম একটি কারণ। পার্টির এই অবস্থার একমাত্র প্রধান কারণ শ্রমিক ও কৃষকদের বৈপ্লবিক গণসংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুতর অবহেলা”। কী স্বীকারোক্তি!কিন্তু কেন এই স্বীকারোক্তি? কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, যদি দেখা যায় এই দলিলটি উপস্থাপনার সময়কালের দিকে। ১৯৬৮ সালের অকটোবর মাস। এর কয়েকমাসের পরেই ঘটবে নকশালবাড়ির বজ্রনির্ঘোষ! পার্টির মধ্যে ধূমায়িত হতে শুরু করেছে সেই বিক্ষোভের আগুন। নেতৃত্বের সংশোধনবাদী চরিত্র ক্রমাগত খুলে যাচ্ছে পার্টি সদস্যদের কাছে। এটা এই ১৯৬৮তেই নয়। ১৯৬৪ সালে সি পি আই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুবিধাবাদের ভিত্তিতে পার্টি গঠনের সময় থেকেই বিপ্লবী কর্মীবাহিনী সোচ্চার হয়ে উঠেছিল খাঁটি আদর্শগত ভিত্তিতে পার্টি গঠন করার জন্য।১৯৬৪ সালে সি পি আই-তে থাকাকালীনই নাম্বুদ্রিপাদের নেতৃত্বে তেনালী কনভেনশন ডাকা হয় ডাঙ্গে গোষ্ঠি বিরোধীদের নিয়ে। সেখানেই নতুন পার্টি সংবিধান গঠন করে একটি পৃথক পার্টি তৈরী করা হয়।এই কনভেনশনেও বিপ্লবী কর্মীবাহিনী উপস্থিত থেকে নবগঠিত পার্টির সংশোধনবাদী চরিত্রের বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে শুরু করে। সেখানে সুনীতি কুমার ঘোষের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে এম বাসবপুন্নায়ার উপস্থিত করা খসড়া পার্টি কর্মসূচীর বিরোধিতা করে। অভিযোগ তোলে যে এই কর্মসূচীতে শ্রেণিসংগ্রামকে গুরুত্ব দেওয়া হয় নি এবং সংশোধনবাদী সোভিয়েত রাশিয়া ও বিপ্লবী চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে স্পষ্ট আদর্শগত বিভাজন দেখিয়ে চীনা পার্টির পক্ষে অবস্থানকে সুস্পষ্টভাবে দেখানো হয় নি। এই বিপ্লবী গোষ্ঠি নিজেরাও একটি পাল্টা খসড়া কর্মসূচী তৈরী করে অধিবেশনে পেশ করেছিল। তাদের সে কর্মসূচী নিয়ে অধিবেশনে সম্ভবত আলোচনাই হয় নি। এই বিপ্লবী গোষ্ঠি কিন্তু তা সত্ত্বেও নতুন পার্টির মধ্যে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাবার চেষ্টা করে গেছে।পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো জেলা কনফারেন্স তো পার্টির মধ্যে সংশোধনবাদী ও বিপ্লবী গোষ্ঠির লড়াইতে প্রায় যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। কলকাতা জেলা কনফারেন্সে বিপ্লবী গোষ্ঠির হয়ে পরিমল দাশগুপ্ত একটি পাল্টা খসড়া কর্মসূচী দাখিল করেন। শুধু তাই নয়, কলকাতা জেলা কনফারেন্স-এ উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে ৪২ জন প্রতিনিধি, বাসবপুন্নায়ার পেশ করা অফিসিয়াল খসড়া কর্মসূচীর বিরুদ্ধে ভোট দেন। শিলিগুড়ি পার্টি জেলা কনফারেন্সেও চারু মজুমদার খসড়া কর্মসূচীর উপরে একাধিক সংশোধনী পেশ করেন। এর পর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলনেও পরিমল দাশগুপ্ত তাঁর খসড়া কর্মসূচীটি পেশ করেন এবং বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়ে, দাবী করেন ১৯৫১ সালের পার্টি কনফারেন্সে ভারত রাষ্ট্রের যে শ্রেণীচরিত্র তুলে ধরা হয়েছিল, সেই ব্যাখ্যাকেই এখনও মেনে নিতে হবে।এখনও তার কোনো বদল ঘটেনি। ১৯৬৪ সালে সি পি আই (এম) পার্টি গঠনের পরে পরেই, এই বিপ্লবী বাহিনী পার্টি নেতৃত্বের শ্রেণিচরিত্র উপলব্ধি করে, পার্টির ভিতরেই নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেন। এমন কি সুশীতল রায়চৌধুরী, অমূল্য সেন এবং সুধীর ভট্টাচার্য (সুপ্রকাশ রায়), এরাও একটি গোষ্ঠি হিসাবে ঐক্যবদ্ধ হন। বিদ্রোহের এই আঁচ সেদিন সংশোধনবাদী পার্টি নেতৃত্বও উপলব্ধি করেছিলেন। আগুন যে ছড়াচ্ছে সারা দেশেই, সে সংবাদও ছিল পার্টি নেতৃত্বের হাতে। আর সেই জন্যই আত্মসমালোচনার নামে এই দলিল আসলে সমগ্র পার্টি নেতৃত্বের কাছে সাবধান বাণী। সে জন্যই পূর্বোক্ত দলিলের ১১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে “১৯৬২ সাল থেকে শিল্পের মন্দা, বেকারী, সংকটের আবির্ভাব, চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা স্থগিত রাখা, প্রকৃত আয়ে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য প্রভৃতির ফলে বিশেষত, মধ্য শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে বর্তমান মোহভঙ্গ হইতেছে। আর এই শ্রেণিটিই পেতিবুর্জোয়া অতি বিপ্লবীয়ানা ও চরম বামপন্থী-ভাবধারা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজেদের মোহমু্ক্তির কথা প্রকাশ করিতেছে। ইহা কি চিন্তা করা যায়, যে এই ঘটনা আমাদের পার্টির মধ্যে অতি বামপন্থার উদ্ভবে সাহায্য করিবে না”? এই হল আসল কথা। আর সেই জন্যই তো দলিলটির নামকরণ করা হয়েছে-কেন এই অতি বাম বিচ্যুতি! ১৯৬৮ সালে দাঁড়িয়ে কাদের বিরুদ্ধে বাম বিচ্যুতির অভিযোগ আনা হচ্ছে, তা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। দলিলের এই সাবধান বাণী, আত্মসমালোচনার ভণ্ডামী ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি নকশালবাড়ির বজ্রনির্ঘোষকে। তখন আর দলিল নয়, সংশোধনবাদী নেতৃত্বও রাষ্ট্রের শাসন-ক্ষমতাকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের সশস্ত্র শক্তিকে নামিয়ে দেয় এই তথাকথিত উগ্রবামদের দমন করতে। শান্তিপূর্ণ পথে সমাজবিপ্লবের পথের পথিকরা নকশালবাড়ি আন্দোলনকে দমন করতে অস্ত্রের সাহায্য নিয়ে নিজেদের মুখোশটা খুলে দেয়।আর তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালে গঠিত হয় আর একটি কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। সে পার্টির নেতৃত্বের মধ্যে, তত্ত্বের মধ্যে অনেক ভুল-বিচ্যুতি থাকলেও, ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম একটি কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র বিপ্লবের পথে রাষ্ট্রশক্তিকে উৎখাত করার যাত্রা শুরু করেছিল। এই প্রথম একটি প্রায় সঠিক কর্মসূচী একটি কমিউনিস্ট পার্টি গ্রহন করেছিল। যদিও অচিরেই রাষ্ট্রশক্তি সংশোধনবাদী নেতৃত্বের সহযোগিতায় সমস্ত শক্তি দিয়ে এই পার্টির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে কনিষ্ঠতম সদস্য, প্রায় সকলকেই হত্যা করা হয়েছিল। টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল পার্টি সংগঠন। পরবর্তীতে পার্টি শক্তি পুনরায় সংগঠিত করার চেষ্টা করলেও, তার মধ্যে ততদিনে শাসকশ্রেণির এজেন্টদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে সংশোধনবাদী, সংকীর্ণতাবাদী ভাবনা। যে সি পি আই (এম)-এর সঙ্গে বিভাজন ঘটিয়ে, তাদের সংশোধনবাদী হিসাবে চিহ্নিত করে নতুন পার্টি গড়ে তোলা হয়েছিল, সেই সি পি আই (এম-এল)-এর নাম নিয়েই পার্টির মূল কর্মসূচীর একেবারে বিরুদ্ধে চলে গিয়ে অনেকেই সংসদীয় পথে যাত্রা শুরু করেছে। কেউ বা কমরেডদের হত্যাকারীদের রক্তাক্ত হাত ধরে একই সাথে পথ হাঁটছে সংসদীয় আসনের লোভে। কোনো গোষ্ঠি মনে করছে, সব ভুল হয়ে গেছে, আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকেই শুরু করতে হবে। নতুন করে বুঝতে হবে ভারত রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্রকে, ভারতীয় বিপ্লবের পথকে নতুন করে খুঁজে বার করতে হবে।
১৯৩০ সালে তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক যে পথ নির্দেশ দিয়েছিল, ১৯৬৯ সালে একবার যে পথে এগিয়ে চলার চেষ্টা করা হয়েছিল, তারপর, তারপর পঞ্চাশ বছর পার করেও আমরা দাঁড়িয়ে আছি প্রায় শুরুর বিন্দুতেই। এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে।অপেক্ষা করে আছি আর এক সূর্যোদয়ের। কিন্তু সেই সূর্যোদয়ের জন্যই আমাদের আবার নতুন করে সত্যিই ভাবতে হয়, শুধুই কি বিশ্বাসঘাতকতা, শুধুই কি নেতৃত্বের নেতৃত্বহীনতা! সামগ্রিকভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনেরও কি কিছু ত্রুটি ছিল না? ত্রুটি ছিল না কর্মীবাহিনীর মধ্যেও? তা তো ছিলই, তা না থাকলে শুধু নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতায় কমিউনিস্ট আন্দোলন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল তা হতে পারে না। আলোচনার পরিসমাপ্তি টানতে চাই সে প্রসঙ্গে বিখ্যাত ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র-এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে।যা হয় তো কিছুটা উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে আমাদের ব্যর্থতার মূল কারণগুলি খুঁজে বার করতে। তিনি বলছেনঃ কমিউনিস্টদের মূল ত্রুটিগুলি হল—(ক) মূল শ্রমজীবী মানুষ যাঁরা, শিল্প শ্রমিক, কৃষিজ শ্রমিক এবং গরীব কৃষক, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক কাজকে অবহেলা করা হয়েছে। (খ) আদর্শগত ও রাজনৈতিক শিক্ষাদান ও সেই মতো প্রচার প্রপাগান্ডার প্রায় অনুপস্থিতি. (গ) মার্কসবাদকে একটি বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী হিসাবে ছড়িয়ে দিতে না পারা। (ঘ) নির্ভীকভাবে এবং বাস্তবের সাথে সঙ্গতি রেখে ভারতের প্রকৃত বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়া এবং (ঙ) মার্কসবাদীদের মধ্যে সরাসরি বিতর্কের পরিবেশ না থাকা।
তথ্যসূত্র-
১.ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসের রূপরেখা-সুপ্রকাশ রায়
২. কুড়ি না পঁচিশ-বাসু আচার্য
৩. আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি-মুজাফফর আহমেদ
৪. ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রথম যুগ-মুজফফর আহমেদ
৫. Insurrection to Agitation- Paramjit S. Judge
৬. The Indian Communist Party Split of 1964- T R Sharma
৭. Observation on the Indian Communist Party split-John Wood
৮. Towards Naxalbari (1953-1967) An Account of Inner-Party Struggle.-Pradip Basu
৯. Marxism in India: Need for total Rectification – Bipan Chandra. (Published in Mainstream. Vol.XLVII, No
এই লেখাটি সম্প্রীতি মনন পত্রিকায় প্রকাশিত। সহমনের সম্পাদকমন্ডলী এই লেখা নিয়ে বিতর্ক চায়, সেই কারণেই এই লেখা আবার প্রকাশ করা হলো। অন্য বিরুদ্ধ মত এলেও সহমন, সেই লেখা প্রকাশ করবে।