এই মুহূর্তে দেশ জুড়ে এক উত্তাপের পারদ ক্রমশ চড়ছে। শেষ পর্যায়ের ভোট হতে এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। কেন্দ্রের ভোটকে কেন্দ্র করে রুলিং আর অপোজিশনের মধ্যে যে টক্কর চলছে, তা নানা ভাবে চিন্তার খোড়াক যোগাচ্ছে রাজনীতি নিয়ে চর্চা করা মানুষদের কাছে। এখন বিষয় হল এই জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ম্যানিফেস্টোতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখন দেখার হল, সেই প্রতিশ্রুতিগুলো সেই সব রাজনৈতিক দল ভোটে জেতার পরে, রক্ষা করবে কি না। আমাদের দেশে এই প্রশ্নটা লাখ টাকার প্রশ্ন।
নানা বিষয় দেশের বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দলগুলো তাদের ম্যানিফেস্টোতে এনেছে। কিন্তু প্রায় প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দল "ক্লাইমেট চেঞ্জ" বা "জলবায়ু পরিবর্তন"-এর মত বিষয়কে নিয়ে একটি কথাও উল্লেখ করেনি তাদের ম্যানিফেস্টোতে। তাহলে বিষয়টি এক কথাতে কি দাঁড়াল? দেশের ভবিষ্যৎ যে রাজনৈতিক দলের হাতে যাবে, তাদের পরিবেশ সম্পর্কে বিন্দু মাত্র কোন সচেতনতা নেই। সারা পৃথিবী জুড়ে আলোচনা হওয়া উষ্ণায়নের মত বিষয় নিয়ে নূন্যতম সচেতনতার অভাব রয়েছে।
এখন বিষয় হল ক্লাইমেট চেঞ্জ কি আদৌ কোন প্রভাব ফেলছে আমাদের দেশে? ভারত সরকারের পরিবেশ দফতরের সদ্য প্রকাশিত রিপোর্ট জানাচ্ছে ভারতীয় উপকূল ও ভারতের বড় শহরের উপর ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রভাব প্রকট। এমন কী ক্লাইমেট চেঞ্চের কারণে আমাদের দেশে ক্রমশ সংকটে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য। দেশের মধ্যে থাকা শারিরীকভাবে অক্ষম মানুষেরা, গরিব মানুষ, বৃদ্ধ মানুষেরা, সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা সব থেকে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে। দেশের মানুষের মধ্যে "ইকো অ্যাংজাইটি", ইকো প্যারালাইসিস, ডিমেনসিয়া, সিজোফ্রেনিয়া,অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, অসটিওপোরেসিসের মত রোগ দ্রুত বাড়ছে। স্বাস্থ্য নিয়ে এই সব কথা উঠে আসছে "জিও হেলথ" জার্নালের গত বছর প্রকাশিত গবেষণা পত্রে।
শুধু শহর নয়,বাংলার গ্রামের পরিবেশ সমান ভাবে বিপন্ন। এই বিপন্ন সময়ের কথা রাজনীতিতে না আসলে বিপদ। পরিবেশ,প্রতিবেশ, প্রাত্যহিক জীবন কোনটাই রাজনীতির উর্ধে নয়। দেশের নীতি প্রভাব ফেলে সামাজিক ব্যবহারিক গঠনের ওপরেও। তবে উষ্ণায়নকে ভারতের প্রেক্ষাপটে সামগ্রিক ভাবে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন রকম। কাজেই এলাকা ভিত্তিতে "ক্লাইমেট মডেল" তৈরির ওপর বিশেষ জোর দেওয়া প্রয়োজন। উপকূল এলাকাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব খুবই গভীর। বাংলার সুন্দরবনের দিকে তাকালেই তা যথেষ্ট স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। সাইক্লোন যে ভাবে প্রায়শই আঘাত হানছে সুন্দরবনে, তাতে বিপন্ন হচ্ছে উপকূলের সুন্দরবন। বাড়ছে পরিবেশগত উদ্বাস্তু। বিপন্ন হচ্ছে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের মত প্রান্তিক মানুষেরা।
বুলবুলের তান্ডবে ট্রলার উল্টে বারো জন মৎস্যজীবী জলে ডুবে যায়। তিন জন প্রাণ বাঁচতে পারলেও বাকিরা নিখোঁজ। ঝড়ের পরে ট্রলারকে উদ্ধার করা গেলে তিনটে মৃত দেহ আটকে ছিল সেখানে। আর বাকি দেহগুলো আজকের দিন পর্যন্ত তাদের পাওয়া যায়নি। কাজেই মৎস্যজীবীদের ঝড়ে বেরোলে প্রাণ হারানোর বিপদ আর ঘরে থাকলে আর্থিক সংকট। জলবায়ু পরিবর্তন এমন ভাবেই মৎস্যজীবীদের পরিযায়ী হতে বাধ্য করে। ভিন রাজ্যে ঝড় ঝঞ্চাতে মাছ ধরতে না গেলেও ট্রলার মালিকরা মৎস্যজীবীদের দৈনিক একটা টাকা দেয়। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ টাকা, মূলত কেরালাতে। কাজেই অর্থিক নিশ্চয়তা ভিন রাজ্যে অনেক বেশি, সুন্দরবনের সাপেক্ষে।
মৎস্যজীবীদের এই পরিযান পৃথিবীর সাপেক্ষে দেখলে ‘পরিবেশগত উদ্বাস্তু’-দের মধ্যে সেই সংখ্যা ক্রমশ মিশে যাচ্ছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়ে ‘পরিবেশগত উদ্বাস্তু’দের সংখ্যা যে ভাবে বাড়ছে তা সত্যি চিন্তার বিষয়। ৬জুন ২০২৩ সালের ‘দ্যা হিন্দু’-র ‘সাউথ এশিয়ান্স ক্লাইমেট মাইগ্রেশন ইজ টিকিং বম্ব’ শীর্ষক রিপোর্টে লেখা হচ্ছে ‘By 2050, globally there could be 1.2 billion climate refugees. In South Asia, there have been over nine million internal displacements in 2020, making it the region having the highest number of new displacements due to climate change.’
কাজেই এমন এক বিপন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের কি ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে, সেই পথ খুঁজতে তাদের সাহায্য করতে হবে। এই কাজে রাষ্ট্রের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তবে স্থানীয় ভাবে মাছ চাষে উৎসাহ দিয়ে, বিভিন্ন রকম লোনের মাধ্যমে তাদের সাহায্য করে, মৎস্য শিকার নীতি তৈরি করে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের কাছে পৌঁছতে হবে। সামাজিক ভাবে সাধারণ মানুষদের আরো বেশি ‘জলবায়ু ধর্মঘট’-এর ডাক দিতে হবে। তবেই কমানো যাবে প্রান্তিক ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের ‘পরিয়ায়ী হওয়ার পরিযান'।